“বেশ তো। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান কোরো না। তা হলে তোমাদের ভাল হবে না।”
“বন্ধুত্ব সমানে সমানে হয়। আমরা আপনাদের পণবন্দি মাত্র। তবু আপনারা যে সৌজন্য প্রকাশ করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি এটাও বুঝতে পারছি, আপনারা যা চাইবেন তাই হবে। আমাদের কিছুই করার নেই।”
“এই সত্যটা তাড়াতাড়ি বুঝেছ বলে তোমাকে ধন্যবাদ। এখন তুমি যেতে পারো। তোমাদের রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিজ্ঞানীদের প্রতিনিধিরা উপরে অপেক্ষা করছেন। তোমার পিছন দিকে যে গুহামুখ দেখছ, ওইটেই বেরোনোর পথ। যাও।”
বিজয়বাবু উঠলেন। গুহামুখে পৌঁছে ফিরে একবার চেয়ে দেখলেন, দু’জন সবুজ মানুষের পাহারায় পাঁচজন লোক গুহায় এসে ঢুকল। লতাপাতা দিয়ে তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। বিধ্বস্ত চেহারা। দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের উপর কিছু অত্যাচার হয়েছে। এদের মধ্যে অগ্নিকেও দেখতে পেলেন বিজয়বাবু। বোধহয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। তাই মারধর খেতে হয়েছে। বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে ঢালু বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। মানুষকে হয়তো এভাবেই তার দীর্ঘদিনের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। একটা সমুদ্র লোপাট হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে হয়তো নিয়ে যাওয়া হবে কীটপতঙ্গের বিরাট ঝক। আর কী কী নিয়ে যাবেন ওঁরা, জানেন না তিনি। তবে পৃথিবীর সামনে যে বিরাট দুঃসময় আসছে তাতে সন্দেহ নেই।
গভীর রাত। বিজয়বাবুর ল্যাবরেটরিতে গভীর দুশ্চিন্তা মুখে নিয়ে অঘোরখুড়ো, বীরেনবাবু, বিরাজজ্যাঠা, নীলকান্ত, অয়স্কান্ত, কৃষ্ণকান্ত, কানু, বটু, নব, হরেন সবাই হাজির। বিজয়বাবু বিপদের কথাটা তাঁদের বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলছিলেন। কথা শেষ হয়েছে। এখন সবাই গুম হয়ে বসা। কারও কথাটথা আসছে না।
ঠিক এই সময় উত্তরের বন্ধ জানলায় খুট খুট করে একটা শব্দ হল।
বিজয়বাবু নিচু গলায় বললেন, “কে?”
“আজ্ঞে, জানলাটা খুলুন। কথা আছে।”
বিজয়বাবু উঠে গিয়ে জানলাটা খুলে দেখতে পেলেন, গামছায় মুখ ঢাকা একটা বেঁটেমতো লোক দাঁড়ানো।
“কে হে তুমি?”
“আমি বঙ্কাচোর।”
“চোর! অ্যাঁ! কী সর্বনাশ! চোর আজকাল সাড়া দিয়ে আসা ধরেছে?”
“আহা, অত উঁচু গলায় কথা কইবেন না। বাতাসেরও কান আছে। তারা আবার সবই শুনতে পান কিনা।”
“কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে, গুরুতর কিছু কথা নিবেদন করেই চলে যাব।”
“অ। তা ভিতরে এসো বাপু। ভয় নেই।”
“আজ্ঞে, ভয়ডর থাকলে কি আমাদের চলে? তা হলে বরং দরজাটা খুলে দিন। গুহ্য কথা কিনা, খোলা জায়গায় বলাটা ঠিক হবে না।”
বিজয়বাবু দরজা খুলে দিলেন। বঙ্কা ভারী সংকোচের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই মশাইরা।”
বিজয়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক আছে। এবার কথাটা হোক।”
বঙ্কা মাথাটাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না। পেটের দায়ে আমাকে চুরিটুরি করতে হয়। তা চুরি করি বলেই কিছু সুলুকসন্ধান জানা আছে। ইদানীং দেখছিলাম গাঁয়ের কিছু লোকের বেশ উন্নতি হতে লেগেছে। রামভরোসা নতুন দুটো মোষ কিনল, তার মা গিরিজাবুড়ি রুপোর বদলে সোনার বালা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দু’বেলা পোনা মাছের কালিয়া রান্না হচ্ছে বাড়িতে। তাই দেখেই একদিন সিঁধ দিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ। বুড়ি সারাদিন গোবর কুড়োয়, ঘঁটে দেয়, রাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনোর কথা। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি, বুড়ি উদুখলের ডান্ডাটা নিয়ে বসে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে। ঘা-কতক খেয়ে আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে প্রাণটা হাতে করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলুম, এই যা। ৮৮
তবে তক্কে তক্কে কয়েকদিন নজর রাখার পর লক্ষ করলাম, বুড়ি রোজই দুপুরের দিকে ঝুড়িভরতি খুঁটে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। জঙ্গলে ঘুঁটের খদ্দের থাকার কথা নয়। পিছু পিছু গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!”
বিজয়বাবু ম্লান হেসে বললেন, “সবুজ মানুষ তো!”
“যে আজ্ঞে, যাদের ডেরায় আজ আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।”
“তারপর কী হল?”
“বুঝলুম, সোনাদানা ওই ডেরাতেই আছে। বুড়ি একঝুড়ি খুঁটে বেচে এক মোহর করে পায়। তাও সে ইয়া বড় মোহর, অন্তত ভরি পাঁচেক ছাচা সোনা! মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দিব্যি ডেরা বানিয়েছে। তা আজ মাঝরাতে ঢুকে পড়লাম মা কালীকে একটা প্রণাম ঠুকে।”
বীরেনবাবু বলে উঠলেন, “জব্বর সাহস তো তোমার?”
“আজ্ঞে না, সাহসের বালাই নেই। পেটের দায়ে প্রাণ বাজি রেখে ওসব করতে হয় আর কী। তবে কিনা একেবারে নির্যস প্রাণটাই যাওয়ার কথা। সুড়ঙ্গের অন্ধিসন্ধি তো জানা নেই। পড়বি তো পড় একেবারে দু-দুটো ঢ্যাঙা মানুষের সামনে। কিন্তু কী বলব মশাই, দু’জন যেন আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠে কুঁকড়ে লটকে পড়ে গেল।”
“বলো কী?”
“আজ্ঞে, এক বর্ণ বানিয়ে বলা নয়। মা কালীর দিব্যি।”
“তোমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কী হল?”
“আজ্ঞে, সেই কথাই বলতে আসা।”
“বলে ফেলো বাপু।”
“ইদানীং চোখে একটু কম দেখছি বলে রাতবিরেতে কাজের খুব অসুবিধে হচ্ছে। তাই ভেবেছিলুম, একজোড়া চশমা হলে বড় ভাল হয়। তা দেখলাম, আমাদের কানু রোজ অঘোরখুডোর চশমা চোখে দিয়ে বটতলায় বসে লোকের ভূতভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তা ভাবলুম ওরকম জোরালো চশমা হলে কাজের খুব সুবিধে। তা পরশু রাতে…!”