“তোমাদের প্রযুক্তিকে ফঁকি দেওয়া কঠিন নয়। নামবার সময় আমরা কিছুক্ষণের জন্য তোমাদের সন্ধানী যন্ত্রগুলোকে অন্ধ ও বধির করে দিয়েছিলাম, তবে তা মাত্র এক সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের জন্য। তাই সেটা নিয়ে খুব একটা হইচই হয়নি। আর নেমে পড়ার জন্য আমাদের ওটুকু সময়ই যথেষ্ট।”
“সমুদ্রের তলায় আপনাদের যে যানটি লুকনো আছে সেটা কি আমাদের সাবমেরিনগুলো খুঁজে পাবে না?”
“না। আমাদের যানটি থেকে কোনও বিকীরণ ঘটে না। সেটা অবিকল একটা তিমি মাছের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে।”
“আমি শুনেছি আপনারা জীবজন্তু এবং পোকামাকড় খুবই ভালবাসেন। এমনকী, একজন লোক বন্দুক দিয়ে শেয়াল মারতে গিয়েছিল বলে আপনারা তাকে মেরে ফেলেছেন।”
“কথাটা সত্যি নয়। লোকটা ভয় পেয়ে মারা যায়। তবে আমরা তাকে ফের বাঁচাতে পারতাম। সেটা করিনি। কারণ, পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা সব জীবজন্তুর চেয়ে বেশি। একটা মানুষের চেয়ে একটা শেয়ালের প্রাণের দাম বেশি।”
“আপনারা পশুপ্রেমিক, তার মানে কি আপনারা মাছ-মাংস খান না?”
“মাছ-মাংসকে আমরা খাদ্যবস্তু বলেই মনে করি না।”
“আমাদের বৈজ্ঞানিক এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা যদি আপনাদের প্রস্তাবে রাজি না হন, তা হলে কী করবেন?”
“সেক্ষেত্রে আমরা জোর করেই তোমাদের সমুদ্র চুরি করব এবং কোনও প্রতিদানও পাবে না।”
“আপনারা কি এতটাই নিষ্ঠুর যে, আমাদের গ্রহটিকে বিপাকের মধ্যে ঠেলে দিয়ে চলে যাবেন?”
“তোমরা আমাদের চেয়েও অনেক নিষ্ঠুর, স্বার্থপর এবং বোকা।”
“একথা কেন বলছেন?”
“তোমাদের সৌরলোকে এই একটিই প্রাণবান গ্রহ। ঠিক তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক।”
“প্রাণীদের তিনটি আশ্রয়। জল, মাটি, অন্তরীক্ষ। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“সমানুপাত বোঝো?”
“একটু-আধটু।”
“এই তিনটি আশ্রয়ে যেসব প্রাণীকুল থাকে এবং সবকিছুকে পাহারা দেয় যে উদ্ভিদ, তাদের সমানুপাত না থাকলে গ্রহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়ে। জানো?”
“জানি।”
“তবে মানো না কেন? পৃথিবীকে খনন করে করে জ্বালিয়ে দিলে তেল-কয়লা, সমুদ্রে-নদীতে ঢেলে দিলে বিষ, বাতাসে ছড়ালে তেজস্ক্রিয় কণা, এ তোমাদের গ্রহ নয়? এ কি নয় তোমাদের বাড়িঘর? কত প্রাণীর প্রজাতিকে অবলুপ্ত করে দিলে, মেরে ফেললে কত পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ। মাটি ঢেকে দিয়ে কেবল বাঁধানো শহরে ভরে দিলে পৃথিবী। ভোগের বস্তুর জন্য কত কলকারখানায় কণ্টকিত করে দিলে চারদিক!”
“আমরা আপনাদের তুলনায় নির্বোধ, স্বীকার করছি। এই গ্রহের মানুষ জ্ঞানী হয়ে জন্মায় না। তারা ঠেকে এবং অভিজ্ঞতা থেকে আজ নিজেদের সর্বনাশ বুঝতে পারছে। বিপরীত প্রক্রিয়ায় সেই সর্বনাশ রোখার জন্যও আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা যদি আমাদের সমুদ্র এবং কীটপতঙ্গ সব নিয়ে যান, তা হলে আমাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হবে।”
“আমাদের উপায় নেই।”
“আপনারা আমাদের হিতৈষীর মতো কথা বলছেন। কিন্তু যা করতে চাইছেন তাতে পৃথিবীর মঙ্গল হওয়ার কথা নয়। প্রকৃত শক্তিমানরা দুর্বলের শক্তিহীনতার সুযোগ নেয় না।”
“প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কেউ নয়। দুর্বলের অধিকার প্রকৃতির নিয়মেই সীমাবদ্ধ। বাঘ হরিণকে খাবে, এটাই নিয়ম।”
“বাঘ ও হরিণ ইতর প্রাণী। বুদ্ধিমান নয়। তারা পৃথিবী ও প্রকৃতি বা পরিস্থিতির নিয়ামক হতে পারে না। বাঘ একসময় মানুষকেও খেত। কিন্তু মানুষ যখন অস্ত্র আবিষ্কার করল, তখন বাঘ হয়ে পড়ল বিপন্ন। বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে শক্তিমান করেছিল, সে প্রকৃতির সব নিয়ম মেনে নেয়নি।”
“বাঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে কী লাভ হয়েছে তোমাদের বলো! আর কটা বাঘ অবশিষ্ট আছে পৃথিবীতে? শুধু অস্ত্রধারণ করলেই হয় না। নিয়ন্ত্রণও অধিগত করতে হয়। আত্মভুক কাকে বলে জানো? যে নিজেকে খেয়ে ফেলে। সমষ্টিগতভাবে তোমরাও আত্মভুক। নিজেদের প্রজাতিকে মারো, পশুপাখি মারো, গাছপালা মারো? ওরাও যে তোমাদেরই অস্তিত্বের বিস্তার তা জানো না।”
মাথা নিচু করে বিজয়বাবু বললেন, “মানছি।”
মানুষটা হঠাৎ তার দিকে একটা থান ইটের মতো ভারী জিনিস ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এই নাও।”
নিখুঁত লক্ষ্যে জিনিসটা বিজয়বাবুর কোলের কাছে এসে পড়ল। কিন্তু গায়ে লাগল না। তিনি জিনিসটা তুলতে গিয়ে দেখলেন, সোনার রঙের একখানা অত্যন্ত ভারী ইট। কয়েক কেজি ওজন। সবিস্ময়ে তিনি বললেন, “কী এটা?”
“সোনা! এটা বিক্রি করলে তুমি অনেক টাকা পাবে। তাই দিয়ে তুমি তোমার ল্যাবরেটরির জন্য অনেক আধুনিক সরঞ্জাম এবং রাসায়নিক কিনতে পারবে।”
“এই সোনা আপনি কোথায় পেলেন?”
“সোনা আমরা সঙ্গে করে আনিনি। তোমাদের গ্রহেরই নানা ধাতুর পরমাণুর গঠন বদলে দিয়েছি মাত্র।”
“এটা কি ঘুষ?”
“ঘুষ কাকে বলে জানি না। তবে এটা আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন।”
“আমি শুনেছি আপনারা কাউকে কাউকে অনেক সোনা দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ। আমরা মানুষের বন্ধুত্বই চাই। ইচ্ছে করলে আমরা পৃথিবীর সব মানুষকেই রাশি রাশি সোনা উপহার দিয়ে যেতে পারি।”
“তাতে সোনার দাম শুন্যে নেমে যাবে এবং পৃথিবীর অর্থনীতিতে দেখা দেবে বিরাট বিপর্যয়।
“সেটা হয়তো একটা ভারী মজার ব্যাপারই হবে। লোভী মানুষ বুঝতে পারবে সোনা একটা সাধারণ ধাতু ছাড়া কিছুই নয়।”
“আমি আপনাদের দান প্রত্যাখ্যান করছি। সোনা আমি নেব না।”