বিজয়বাবু চারদিকটা খুব ভাল করে লক্ষ করলেন। গুনে দেখলেন সবুজ মানুষরা সংখ্যায় এগারোজন। হয়তো আরও আছে। এগারোজনই তাকে স্থির চোখে লক্ষ করছে। তাতে অবশ্য বিজয়বাবুর ভয় হচ্ছে না।
ঝিঝির ডাকের ভিতর একটা পরিবর্তন ঘটল। টানা আওয়াজটা নানা টুকরো টুকরো স্কেলে ভেঙে গেল, চড়া হল আবার খাদে নামল। বিজয়বাবু হঠাৎ সেই শব্দের ভিতর থেকে কথা বা বার্তা টের পেতে শুরু করলেন। তাকে প্রশ্ন করা হল, “তুমি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। আমি আপনাদের সম্পর্কে জানতে চাই।”
“তোমাদের পক্ষে আমাদের অনুধাবন করা অসম্ভব। তোমাদের মস্তিষ্কের অত ক্ষমতা নেই। তোমরা শুধু এটুকু জানলেই চলবে যে, আমরা অনেক দূর গ্রহের লোক।”
“কত দুর?”
“জেনে লাভ নেই। তোমাদের ধারণার বাইরে।”
“আপনারা আমাদের গ্রহে কেন এসেছেন তা কি জানতে পারি?”
“পারো। আমরা তোমাকেই আমাদের মধ্যস্থ হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলাম। তুমি একটু বিজ্ঞান জানো। তুমি একজন সদাশয় এবং ভাল লোক।”
“আমি সদাশয় এবং ভাল লোক সেটা কী করে বুঝলেন? আমাকে তো আপনারা চেনেন না?”
“চিনি। আমরা আমাদের চারদিকে গাছপালা, কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু এবং মানুষেরও সব কিছু জানতে পারি। প্রত্যেকটা মানুষ, গাছপালা, এমনকী, কীটপতঙ্গেরও কিছু ভাষা আছে। তোমরা বুঝতে পারো না, আমরা পারি।”
“আপনারা কি খুব জ্ঞানী মানুষ?”
“তোমাদের তুলনায় হাজার গুণ।”
“আমি কি আপনাদের কোনও ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি?”
“পারো। তোমার সাহায্যের উপরেই আমরা নির্ভর করছি। আমরা দস্যু বা লুটেরা নই। কিন্তু আমাদের একটু স্বার্থ আছে। তোমাদের কাছে আমরা কিছু চাই।”
“কী চান আপনারা?”
“খানিকটা জল, কয়েকটা কীটপতঙ্গ, কিছু গাছপালা আর কিছুটা বর্জ্য পদার্থ।”
“এসব কি আপনাদের নেই?”
“আছে। কিন্তু আমাদের গ্রহ তোমাদের গ্রহের চেয়ে পাঁচ গুণ বড়। আমাদের যথেষ্ট জল নেই, তোমাদের মতো এত প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ নেই। জীববৈচিত্র্য অনেক কম এবং প্রাকৃতিক বর্জ্য পদার্থ যৎসামান্য। আমাদের গ্রহ খুব সুন্দর, আমাদের সভ্যতা অনেক বেশি প্রাগ্রসর, কিন্তু তোমাদের মতো এত প্রাকৃতিক সম্পদ, যার মূল্য তোমরা আজও বুঝে উঠতে পারোনি, তা আমাদের নেই। তাই বন্ধুভাবে আমরা তোমাদের কাছে এসব জিনিস চাইছি। পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের সেটা বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব
আমরা তোমাকে দিতে চাই।”
“কতটা জল আপনাদের চাই?”
“পৃথিবীর সমুদ্রে যত জল আছে তার দশ ভাগের এক ভাগ।”
“সে তো অনেক জল! এত জল পৃথিবী থেকে সরে গেলে যে আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে! ঋতুচক্রের গোলমাল হবে, বৃষ্টিপাত হয়ে পড়বে অনিয়মিত। আর প্রায় গোটা একটা সমুদ্রই যদি লোপাট হয়ে যায়, তা হলে পৃথিবীর ওজন কমে যাবে, হয়তো বা আহ্নিক গতিও বদলে যেতে পারে।”
“তুমি খারাপ দিকটার কথা আগেই ভাবছ কেন? ভাল দিকটার কথাও ভাবো। পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে, ধীরে ধীরে জলস্তর উপরে উঠছে। আগামী চল্লিশ বছরের মধ্যেই নিচু এলাকাগুলো সমুদ্রের গ্রাসে চলে যেতে থাকবে। এই শতাব্দীর শেষে স্থলভূমির অনেকটাই নিমজ্জিত হয়ে যাবে, বহু দেশ মুছে যাবে মানচিত্র থেকে। সমুদ্রের মধ্যে এবং ধারে যেসব আগ্নেয়গিরি আছে, সমুদ্রের জল যদি তার মুখ পর্যন্ত উঠে যায়, তা হলে আগ্নেয়গিরির মধ্যে জল ঢুকে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটবে এবং সুনামির সৃষ্টি হবে তা এতই ভয়ংকর যে, উপকূলের বড় বড় সব শহর শুধু ভেসেই যাবে না, মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। আমরা যদি তোমাদের একটা সমুদ্র নিয়ে যাই তা হলে অন্তত সেই ভয়টা থাকবে না। তার উপর তোমরা পেয়ে যাবে অনেকটা নতুন স্থলভূমি, পেয়ে যাবে একটা আস্ত মহাদেশও।”
“পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা আপনাদের প্রস্তাব মানবেন না।”
“তাদের বুঝিয়ে বলল, আমরা অকৃতজ্ঞ নই। যে জিনিস আমরা নিয়ে যাব তাতে তোমাদের সামান্য ক্ষতি হবে বটে, কিন্তু আমরা প্রতিদানও দিতে জানি। বিনিময়ে আমরা তোমাদের বাতাসের দূষণের মাত্রা কমিয়ে দেব। ওজোন স্তরের ছিদ্র মেরামত করে দেব, আরও সবুজ করে দিয়ে যাব পৃথিবীকে।”
“এক সমুদ্র জল আপনারা কীভাবে নেবেন?”
“খুব সোজা। বঙ্গোপসাগরে নীচে আমাদের মহাকাশ ভেলা অপেক্ষা করছে, আর আকাশে এক লক্ষ মাইল দূরে রয়েছে আমাদের বড় মহাকাশযান। সমুদ্রের জল আমাদের নিজস্ব পাম্পে খানিকটা শূন্যে তুলে নিলেই তা বরফের চাঙড়ে পরিণত হবে। খুব সূক্ষ্ম একটা জ্যাকেটে মুড়ে তা আমাদের মহাকাশযানের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হবে। এরকম অজস্র চাঙড় করে জল নিয়ে যাওয়া কঠিন ব্যাপার কিছু নয়।”
দুশ্চিন্তায় বিজয়বাবুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, উত্তেজনায় ঘাম হচ্ছে, বললেন, “আমি চেষ্টা করে দেখব।”
“কোনও প্রশ্ন আছে?”
“অনেক প্রশ্ন। আপনারা কোন ভাষায় কথা বলছেন? ভাষাটা আমি জানি না, কিন্তু সব বুঝতে পারছি কী করে?”
“আমরা ভাষা দিয়ে কথা বলি না। আমাদের কথা ধ্বনি-সংকেত। তোমার মস্তিষ্ক সেটা অনুবাদ করে নিচ্ছে।”
“পৃথিবীর চারদিকে অনেক উপগ্রহ ঘুরছে, সারাক্ষণ নানা জায়গা থেকে দূরবীক্ষণ আর রাডার দিয়ে আকাশের সর্বত্র নজর রাখা হচ্ছে। কোনও মহাকাশযানের পক্ষে এত সব নজরদারি এড়িয়ে পৃথিবীতে আসা সম্ভব নয়। আপনারা এলেন কী করে?”