“তুমি যে ঝিঝির ডাক শুনতে পাচ্ছ সেটা ঝিঝির ডাক নয়। ওটাই আমাদের কথা।”
“ও বাবা, কিন্তু ঝিঝির ডাকের কথা আমি বুঝলুম কী করে?”
“কথা নয়, তুমি ভাবটা বুঝতে পারছ।”
“ও বাবা! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! তা ওরকম একটা গোখরোর বিষ তুমি হজম করলে কী করে?”
“আমাদের শরীরে এমন জিনিস আছে যাতে এসব বিষ কাজ করে না।”
“তুমি লোকটা তা হলে কে বাপু? কোথা থেকে আসছ?”
“আমি অনেক দুরের লোক।”
“তোমার গায়ের রং ওরকম সবুজ কেন?”
“তোমার গায়ের রং কেন বাদামি?”
“আহা, মানুষের গায়ের রং তো এমনধারাই হয়।”
“আমাদের রংও আমাদের মতোই।”
“আমাকে তো বাপু তুমি গায়ের জোরে হারিয়েই দিলে। অবশ্য আমিও বুড়ো হয়েছি।”
“তুমি মোটেই বুড়ো হওনি।”
“হইনি! বলো কী? কানে শুনছি না, চোখে দেখছি না, পায়ে জোর-বল কমে গিয়েছে।”
“তোমার বয়স মাত্র সাঁইত্রিশ। তোমার চোখ, কান, গায়ের জোর সবই ঠিক আছে। তবে আমাদের শরীরে যে শক্তি আছে তার একশো ভাগের এক ভাগও তোমাদের নেই।”
নিমাদ খানিকটা ভরসা পেয়ে বলল, “আমার বয়স তুমি কী করে জানলে?”
“যে-কোনও মানুষ, জীবজন্তু বা গাছপালা দেখে আমরা তাদের নির্ভুল বয়স বলে দিতে পারি। এই ক্ষমতা তোমাদের নেই। তোমরা মানুষের প্রজাতি হিসেবে অনেক ব্যাপারে পেছিয়ে আছ।”
নিমাদের কেমন যেন গা শিরশির করছিল। কথাগুলো ভারী আজগুবি ঠেকছে তার কাছে, কিন্তু অবিশ্বাসও করা যাচ্ছে না। ভুতুড়ে কাণ্ড কি না তাই-বা কে জানে?
কথাটা ভাবামাত্রই জবাব এল, “না, ভুতুড়ে কাণ্ড নয়।”
“কিন্তু আমি যে বড় ঘেবড়ে যাচ্ছি বাপু, তুমি ভাল লোক না খারাপ লোক সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তোমার মতলবখানা
কী?”
“সেটা বললেও তুমি বুঝতে পারবে না। তবে আমরা খারাপ লোক নই। তোমাদের কিছু উপকারও করতে চাই।”
“কীসের উপকার?”
“সেটা খুব জটিল বিষয়। তুমি একজন সরল সাধারণ মানুষ, তো জ্ঞানী নও। তোমার পক্ষে সব কিছু বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তবে আমি তোমার কাছে একটু সাহায্য চাই।”
“কী সাহায্য?”
“আগে এই জিনিসগুলো নাও।”
বলে লোকটা নিমাদের দিকে দু’খানা চ্যাপটা মতো ধাতুর চাকতি ছুঁড়ে দিল।
নিমাদ কুড়িয়ে নিয়ে দেখল, দুটো তেকোনা সোনালি রঙের জিনিস। বেশ ভারী। সোনাদানা সে বিশেষ চেনে না, তাই সোনা কি না বুঝে উঠতে পারল না। বলল, “এ কি সোনাটোনা নাকি রে বাবা?”
“হ্যাঁ, সোনা।”
“এর যে অনেক দাম!”
“হ্যাঁ। আর এটা তোমার পারিশ্রমিক।”
“তা কী করতে হবে বাপু?”
“কিছু লোক আমাদের সম্পর্কে জানতে চায় বলে খোঁজখবর নিতে আসছে। তারা আমাদের ক্ষতিও করতে পারে। তুমি একজন শক্তিশালী এবং সাহসী লোক। তুমি আজ রাতটা এই জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পাহারা দেবে। পারবে না?”
“পারব। তারা এলে কী করতে হবে?”
লোকটা ছোট্ট একটা চার আঙুল লম্বা নলের মতো জিনিস তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এটা একটা বাঁশি। ফুঁ দিলে কোনও শব্দ হবে না। কিন্তু আমরা সংকেত পেয়ে যাব।”
“তা তোমরা কোথায় থাকো বাপু?”
“এই জঙ্গলের মধ্যেই, আরও গভীরে এবং মাটির নীচে।”
“তা শুধু বাঁশি বাজিয়েই খালাস! একটা লাঠিটাঠি হলে আমি একাই দশটা লোকের মহড়া নিতে পারি।”
“তার দরকার নেই। আমরা হিংস্র মানুষ নই, মারপিট পছন্দ করি না।”
“তা বললে হবে কেন বাপু! এই যে একটু আগে আমাকে তুলে রাম আছাড় মারলে?”
“সেটা তোমাকে মারার জন্য নয়। তুমি সত্যিই একজন শক্তপোক্ত লোক কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্যই আছাড় মেরেছিলাম।”
নিমষ্টাদ একটু নাক কুঁচকে বলল, “শুধু পাহারা দেওয়া সার, বাঁশি বাজানোটা তেমন গা-গরম করা কাজ নয়। একটু লড়ালড়ি হলে বড় ভাল হত।”
“না, ওদের কাছে বন্দুক-পিস্তল আছে। হয়তো শিকারি কুকুরও থাকবে।”
“ঠিক আছে বাপু, সন্ধের পর-পরই আমি না হয় খেয়েদেয়ে চলে আসব। তা বাপু, এই সামান্য কাজের জন্য এত সোনাদানার কী দরকার ছিল?”
“সোনাকে তোমরা খুব মূল্যবান মনে করো তা আমরা জানি। কিন্তু তোমাদের এই পৃথিবীর মানুষরা নির্বোধ। তারা কখনও ভেবেই দেখেনি যে, সোদানার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হল কাদামাটি, কেঁচো, পোকামাকড়, গাছপালা এবং অনেক বর্জ্য পদার্থ, আর জল। মানুষ যেদিন সেটা বুঝবে, সেদিনই সে সত্যিকারের সভ্য হবে।”
“তুমি বাপু কেবল গোলমেলে কথা বলো। যেগুলোর কথা বললে সেগুলো কি দামি জিনিস নাকি?”
“ওসব বুঝতে তোমাদের অনেক সময় লাগবে। কোন জিনিসের কী দাম সেটা বুঝতে পারাটাই বিচক্ষণতা।”
লোকটা টক করে উঠে দাঁড়াল। নিমচাঁদ দেখল, ঢ্যাঙা লোকটার মাথা এত উঁচুতে যে, সে পঁড়িয়ে হাত বাড়িয়েও নাগাল পাবে না।
স্তম্ভিত এবং বাক্যহারা নিমচাঁদ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে আর বুড়োদের মতো হাঁটা ধরল না। বরং কমবয়সি চনমনে একটা মানুষের মতো বড় বড় লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার বুড়ো বয়সটা তাড়া খেয়ে পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। আর সহজে এদিকপানে আসবে বলে মনে হয় না।
৭. কোনও বালব জ্বলছে না
কোনও বালব জ্বলছে না, টিউবলাইট জ্বলছে না, আলোর কোনও উৎসই নেই, অথচ ঘরটা স্নিগ্ধ একটা আলোয় ভরে আছে। সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু চোখে আলো লাগছে না। মাটির নীচে এ গুহার মতো বড় ঘরখানা আসলে একটা বেসমেন্ট। কিন্তু যেন প্রাগৈতিহাসিক। নীচে মাটি, দেওয়াল মাটির, কোনও আসবাবপত্র নেই। লম্বা, সবুজ অদ্ভুত চেহারার মানুষরা দেওয়ালের গায়ে পিঠ রেখে আসনসিঁড়ি হয়ে ধ্যান করার ভঙ্গিতে বসে আছে। তাদের মেরুদণ্ড সোজা। তারা এতটাই লম্বা যে, বসা অবস্থাতেও তাদের মাথা পাঁচ-ছ’ ফুট উপরে উঠে আছে। ঝিঝির শব্দে চারদিকে বাতাসে একটা ঢেউ খেলে যাচ্ছে।