আজ যে তার ভাগ্য সদয় তা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বুঝতে পারলেন বিরাজমোহন। কারণ, মাছটা যে হেদিয়ে পড়ছে তা তিনি সুতোর টান দেখেই অনুমান করতে পারছেন। আর-একটু খেলিয়ে নিয়েই এবারে তুলে ফেলতে পারবেন।
ঠিক এই সময় মাঝপুকুরে ভুস করে একটা মাথা জলের উপর জেগে উঠল। সেই সঙ্গে তীব্র ঝিঝির শব্দ। বিরাজমোহন অবাক হয়ে দেখলেন, মাথাটা একজন মানুষের, তবে আকারে বড় এবং রং গাঢ় সবুজ। লোকটা তার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল যে, বিরাজমোহনের গা দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে লোকটা মাঝপুকুরে উঠে দাঁড়াল। বিরাজমোহন দেখলেন, হালদার পুকুরের মতো গভীর জলেও লোকটার মাত্র কোমর অবধি ডুবে আছে। আর তার বাঁ হাতে সাপটে ধরা একটা বিশাল কাতলা মাছ লেজ ঝাঁপটাচ্ছে, মুখে বঁড়শিটা গেঁথে আছে এখনও।
সবুজ লোকটা খুব যত্ন করে মাছের মুখ থেকে বঁড়শিটা খুলে নিয়ে মাছটাকে আবার জলে ছেড়ে দিয়ে বিরাজমোহনের দিকে আঙুল তুলে যেন কিছু বলল। ভাষাটা বুঝতে পারলেন না বিরাজমোহন। শুধু ঝিঝির ডাক তো কোনও ভাষা হতে পারে না। কিন্তু বিরাজমোহন ওই ঝিনঝিন শব্দের মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকা বাক্যটা বুঝতে পারলেন।
লোকটা যেন বলল, “এখান থেকে চলে যাও। আর কখনও এ কাজ কোরো না।”
বিরাজমোহন কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা, আর কখনও হবে না।”
ছিপটিপ ফেলে বিরাজমোহন সিঁড়ি বেয়ে উঠে একরকম দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তারপর বুড়ো বয়সে দৌড়ের ধকলে এমন হাঁফিয়ে পড়লেন যে, কিছুক্ষণ কথাই কইতে পারলেন না।
বীরেনবাবু তাকে দেখে শশব্যস্তে উঠে ধরে এনে বসালেন। “কী হয়েছে বিরাজজ্যাঠা?”
“ভূতে বিশ্বাস করিস?”
“ফুঃ! ভূতটুত কেউ বিশ্বাস করে নাকি? আজগুবি ব্যাপার।”
“আমি এইমাত্র হালদারপুকুরে ভূত দেখে এলাম। শুধু দেখাই নয়, কাতলা মাছটাকে এক বছরের চেষ্টায় আজ বাগে এনে প্রায় তুলেও ফেলেছিলাম। ঠিক সেই সময় জলের ভিতর থেকে একটা সুড়ঙ্গে লম্বা মূর্তি বেরিয়ে এসে মাছটা কেড়ে নিয়ে জলে ছেড়ে দিল। তারপর সে কী তড়পানি! সোজা আঙুল তুলে জানিয়ে দিল, হালদারপুকুরে ফের গেলে দেখে নেবে।”
বীরেনবাবু খুবই চটে গিয়ে বললেন, “হালদারপুকুর তো আমরা বছর চারেক আগেই কিনে নিয়েছি। ও আমাদের খাসপুকুর। কার এত সাহস যে, হালদারপুকুর থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেয়? এক্ষুনি লোজন পাঠাচ্ছি। জবর দখল করা বের করছি আজই। দরকার হলে রক্তারক্তি করে ছাড়ব।”
“মাথা গরম করিসনি। সে মনিষ্যি হলেও না হয় কথা ছিল।”
“মানুষ না তো কী?”
বিরাজমোহন মাথা নেড়ে বললেন, “মানুষ কি আট-দশ হাত লম্বা হয় নাকি তার গায়ের রং সবুজ হয়?”
বীরেনবাবু হা হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, “সবুজ মানুষ! মানুষের ন্যাবাট্যাবা হলে রং হলদেটে মেরে যায়। জানি, রোদে পুড়লে কালচেও মেরে যায়। কিন্তু সবুজ হচ্ছে কোন সুবাদে? এই তো সেদিনও ভেচকুড়ি-কাটা লোকটা সবুজ মানুষের কথা বলছিল। এ তো বড় সমস্যা হল দেখছি! পুলিশে একটা খবর দেওয়া দরকার।”
বিজয়বাবু সব শুনে বললেন, “এটা নিয়ে বেশি হইচই করার দরকার নেই। আপাতত বিরাজদাও আর হালদারপুকুরে না গেলেই ভাল। কারণ, সবুজ মানুষেরা মাছটাছ ধরা পছন্দ করে না।”
বীরেনবাবু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কিন্তু এটা তো আমাদের পক্ষে অপমান! আমাদের পুকুরে আমরা মাছ ধরব তাতে অন্যে বাগড়া দিতে আসবে কেন? এত আস্পদ্ধা কার?”
বিজয়বাবু মৃদু স্বরে বললেন, “আস্পদ্ধা কাঁদের হয় জানিস? যারা শক্তিমান। আমার ধারণা তুই লোকজন, লেঠেল পাঠিয়েও তাদের কিছুই করতে পারবি না।”
“ওরা কারা বিজয়জ্যাঠা?”
“সেটা আমিও ভাল জানি না, তবে জানবার চেষ্টা করছি। সবুজ মানুষরা আমাদের কিছু বলতে চাইছে। সেটা হয়তো খুব খারাপ কথাও নয়।”
বীরেনবাবু বললেন, “কথা কইতে চায় তো ভাল কথা, বাড়িতে এসে চা খেতে খেতে বলুক না। অসুবিধে কোথায়?”
বিজয়বাবু বললেন, “অসুবিধে আছে। তুই বুঝবি না।”
৬. বুড়ো বয়সের একটা লক্ষণ
বুড়ো বয়সের একটা লক্ষণ হল, ইন্দ্রিয়াদি একে একে বিকল হতে থাকে। চোখ যায়, কান যায়, নাক যায়, বোধবুদ্ধি গুলিয়ে যেতে থাকে। এখন যেন সেই রকমই হতে লেগেছে নিমচাঁদের। একচন্দ্রদাদার যখন কানের দোষ হল তখন একদিন তাকে বলেছিল, “বুঝলি নিমে, যখন কানে..সব সময়, দিনমানে কি রাতদুপুরে কেবল ঝিঝিপোকার ডাক শুনবি তখনই জানবি যে, তোর কানের দোষ হয়েছে। ওই শব্দের ঠেলায় অন্য সব আওয়াজ আর কানে ঢুকবার পথই পায় না।‘
কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। বুড়ো বয়স এসে অন্য সব ইন্দ্রিয় ছেড়ে তার কানটাকেই যেন আগে পাকড়াও করেছে। সেই রকমই শুনেওছে নিমচাঁদ। বার্ধক্য এসে আগে কানের উপরেই চড়াও হয়। তারপর সেখানে থানা গেড়ে বসে অন্যসব যন্ত্রপাতি বিকল করার কাজে লেগে পড়ে।
জলার ধারের জঙ্গলের পাশ দিয়ে বুড়োমানুষদের মতোই টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কানে ঝিঝির ডাকটা শুরু হল। ভারী জ্বালাতনের ব্যাপার। প্রথমটায় ভেবেছিল, সত্যি ঝিঝিই ডাকছে বুঝি। তা বনে-জঙ্গলে ঝিঝিরা ডেকেও থাকে। কিন্তু নিমাদ খেয়াল করে দেখল, এই ঝিঝি যেন ঠিক সেই ঝিঝি নয়। শব্দটা অনেক বেশি জোরালো, আর তাতে বেশ একটা ওঠা-পড়া আছে। গান বাজনা সে জানে না, সুরজ্ঞানও নেই। কিন্তু তার যেন মনে হল, এই ঝিঝির ডাকের মধ্যে যেন একটু সুরেলা মারপ্যাঁচও আছে। কানের দোষ হলে বোধহয় এরকমই সব হয়।