“কী হল বলুন?”
“অপঘাত মশাই, অপঘাত! একপাল শেয়াল ক’দিন ধরে বাগানের ফলপাকুড় খেয়ে বেজায় ক্ষতি করে যাচ্ছিল। তাই সেদিন সন্ধের মুখে বন্দুক নিয়ে খুড়োমশাই শেয়াল মারতে বেরিয়েছিলেন। তখনই ভূত দেখে হার্টফেল হয়। গত জষ্টি মাসে আপনি চেতাবনি দিয়েছিলেন, সাইকেলে চেপে আমার ভাগ্য আসবে। একেবারে চার মাসের মাথায় কাঁটায় কাঁটায় ফলে গেল। তা সব দখলটখল নিয়ে এখন জেঁকে বসেছি আর কী। তাই ভাবলুম আপনাকে আর একবার হাতটা দেখিয়ে যাই। তা দেখুন তো ঠাকুরমশাই, সামনে আর কী কী ভাল জিনিস আসছে?”
নব একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনার খুডোমশাই ভূত দেখে হার্টফেল হয়েছিলেন বুঝি?”
বিদ্যেধর সতর্ক চোখে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “লোকে নানারকম কথা রটাচ্ছে মশাই! কেউ কেউ বলছে সম্পত্তির লোভে আমিই নাকি খুড়োকে মেরেছি! ও কথায় মোটেই কান দেবেন না মশাই। সন্ধেবেলা শেয়াল মারতে বেরিয়ে খুড়োমশাই যে ভূতটাকে ভুষনোর মাঠে জঙ্গলের ধারে দেখেছিলেন, সেটা তালগাছের মতো লম্বা, আর তার গায়ের রং সবুজ। নির্যস সত্যি কথা। আর আপনার কাছে লুকিয়ে তো লাভ নেই। ত্রিকালদশী মানুষ আপনি, আপনার কাছে মিছে কথা বলে কি পার পাওয়ার জো আছে…? ভুষনোর মাঠের সেই ভূতকে রাতবিরেতে অনেকেই দেখেছে। আমার ছেলে বলাইয়ের বয়স এই সাত বছর, সেও নাকি দেখেছে সবুজ রঙের ঢ্যাঙা ভূতটা সন্ধের পর আনাচে-কানাচে ঘুরে কেঁচো আর গুবরেপোকা তুলে নিয়ে খায়। কী নিঘিন্নে জীব বলুন!”
নব আতশ কাঁচটা বের করে বলল, “শেয়াল মারতে যাওয়াটা আপনার খুড়োর উচিত কাজ হয়নি।”
বিদ্যেধর গলা নামিয়ে বলল, “আমরাও তো তাই বলাবলি করি। তা শেয়ালে দুটো ফলপাকুড় খাচ্ছিল তো খেত। কিন্তু খুড়োমশাইয়ের তো ওইটেই মস্ত দোষ ছিল কিনা। পুরনো জুতোজোড়া অবধি প্রাণে ধরে কাউকে দেননি কখনও। কেউ কুটোগাছটি সরালেও খেপে উঠে লাঠিসোটা নিয়ে তাড়া করতেন। আর তাই তো বেঘোরে প্রাণটা দিতে হল।”
“আপনার খুড়োমশাইয়ের খুব ভূতের ভয় ছিল নাকি?”
“খুব, খুব। দিনমানে পর্যন্ত কাছে লোকজন রাখতেন। সন্ধের পর বড় একটা ঘরের বাইরে বের হতেন না। সেদিন যে কোন নিশির ডাক শুনে হুড়োহুড়ি করে বেরোতে গেলেন কে জানে? আর ভূতেরাও কেন ভুষনোর মাঠে ঘুরঘুর করছে কে জানে!”
“আপনাদের গেজেঁপোতায় কি খুব ভূতের উপদ্রব নাকি?”
“আমি অবিশ্যি দেখিনি, তবে শুনি, ইদানীং তেনাদের আনাগোনা বড্ড বেড়েছে। অনেকেই দেখতে পাচ্ছে তাঁদের। ক’দিন হল দেখছি, দু-তিনজন উটকো লোকও এসে ভুষনোর মাঠের ঝোঁপঝাড়ে ওত পেতে বসে থাকে। তারা ওঝা-বদ্যিই হবে কিংবা ফকির-দরবেশ। আমাদের নিয়ামত ফকিরবাবা তো ভূত ধরে শিশিতে মশলা-তেলে ভিজিয়ে রেখে দিতেন। এদেরও মনে হয় সেই মতলব। তা ভূতের বাজারদর এখন কেমন যাচ্ছে ঠাকুরমশাই?”
নব তার জিনিসপত্র গুটিয়ে উঠে পড়ল। বলল, “আমার স্নান খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে মশাই। আমি চললুম।”
.
হালদারপুকুর হল ভারী একটেরে নিরিবিলি জায়গা। ওপারে ফলসার ঘন বন, চারদিকে জমাট বাঁধা ঝোঁপঝাড়। এ পাশটায় জনমনিষ্যির বড় একটা যাতায়াত নেই। চারদিকে গাছে মেলা পাখিপক্ষী আছে, জঙ্গলে কাঠবিড়ালি, গিরগিটি, সাপ, বেজি, তক্ষক, বাঁদর আর মেঠোহঁদুরের অভাব নেই। পুরনো ভাঙা ঘাটলায় বসে সকাল থেকে ছিপের ফাতনার দিকে নজর রাখছেন বিরাজমোহন। ওই একটা কাতলা মাছ এক বছর ধরে তাঁকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। সত্যিকারের ধরা পড়েছিল একবারই। গত বছর। কিন্তু ধূর্ত মাছটা বঁড়শি গিলেও এমন চুপ করে রইল, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। বিরাজমোহন সেদিন লুচি আর মোহনভোগের পেল্লায় জলখাবার খেয়ে এসেছিলেন। সকালের মনোরম আবহাওয়ায় বয়সের দোষে একটু ঘুম এসে গিয়ে থাকবে। সেই ফাঁকে শয়তান মাছটা ছিপ টেনে নিয়ে পালাল। সেই ছিপ পরে উদ্ধার হয় বটে, কিন্তু সুতোটা কাটা ছিল। সেই থেকে এই পর্যন্ত মাছটা বিরাজমোহনের আরও তিনটে দামি হুইল বঁড়শি ছিনতাই করেছে। তার মধ্যে দুটি আর পাওয়া যায়নি। বিরাজমোহন আজকাল স্বপ্ন দেখেন, বিরাট কালো মাছটা বিরাজমোহনের আহাম্মকির কথা ভেবে মাঝরাতে জলের মধ্যে অট্টহাস্য করে।
আজও সকাল থেকে বসে গিয়েছেন বিরাজমোহন। কাতলার সঙ্গে তাঁর লড়াই কবে শেষ হবে কে জানে? কিন্তু ধৈর্য হারানোর পাত্র তিনি নন। একটি ইতর প্রাণীর কাছে এরকম লজ্জাজনকভাবে হেরে যাওয়াকে তিনি খুবই অপমানজনক বলেই মনে করেন। নিত্য নতুন চারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আজও একটি আনকোরা নতুন চার লাগিয়েছেন তিনি। অতি মজবুত সুতো এবং খুবই দামি হুইল ছিপ।
ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর বিরাজমোহন হঠাৎ খুব জোরালো ঝিঝির ডাক শুনতে পেলেন। ঝিঝির শব্দই, তবে একটু যেন অন্যরকম। কেমন যেন তালে-লয়ে ঝিঝি ডাকছে। সেই সঙ্গে দেখতে পেলেন ফাতনা একটু একটু নড়তে লেগেছে। বিরাজমোহন ছিপটা শক্ত করে ধরে রইলেন।
হঠাৎ জলে একটা বিপুল ঘাই মেরে মাছটা একবার ভেসে উঠে বিরাজমোহনকে যেন জিভ ভেঙিয়ে আবার জলে ডুব দিল।
তারপরই ছিপে প্রচণ্ড টান। আচমকা টানে ছিপটা আজও চলে যাচ্ছিল প্রায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে সামাল দিয়ে বিরাজমোহন সুতো ছাড়তে লাগলেন। মাছটা অনেক দূর চলে গেল। আবার বিরাজমোহন সুতো গুটিয়ে টেনে আনলেন মাছটাকে। আবার মাছটা সুতো নিয়ে পালাতে লাগল। খেলাটা ভারী জমে উঠতে লাগল। এতদিনে ব্যাটা ঠিকমতো বঁড়শি গিলেছে বলে টের পাচ্ছেন বিরাজমোহন। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি মাছটাকে খেলাতে লাগলেন।