ভ্রূ কুঁচকে ব্রজবিহারী বললেন, “এরা সব কারা রে?”
“দুনিয়ার নামজাদা সব দাবাড়ু ব্ৰজখুড়ো!”
“বলিস কী? দাবা খেলেও নাম হয় নাকি? ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি তাস-দাবা-পাশা, এ তিন কর্মনাশা।”
“সেসব দিন আর নেই খুড়ো। এখন দাবা খেলে নাম হয়, লাখো লাখো টাকা হয়।”
“দ্যাখো কাণ্ড! আগে জানলে তো পুরুতগিরি না করে দাবা নিয়েই লড়ে যেতুম রে। বাবা যে কখনও ওসব ছুঁতেও দেননি! না,
জীবনে কত সুযোগ যে ফসকে গেল!”
তারকও বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “যা বলেছেন ঠাকুরমশাই, বসে বসে দাবা-বোড়ে টিপে যদি আয়-পয় হত, তা হলে রাত জেগে মেহনত করতে যেত কে? তা নবদাদা, ভূতবাবাজির সঙ্গে তো তা হলে এখন তোমার খুব ভাবসাব!”
“তা একরকম বলতে পারিস। তবে কথাটথা তো আর হয় না। কেবল ঝিঝিপোকার মতো একটা শব্দ করে যায়। তা থেকে কিছু বুঝবার উপায় নেই কিনা!”
“তা হলে পরেশদাদার বাগানে যা হচ্ছে তা ভূতুড়ে কাণ্ডই বলছ তো?”
“তা ছাড়া আর কী! পরেশ অবশ্য স্বীকার করতে চায় না। কেবল মিচকি মিচকি হাসে আর পাশ কাটিয়ে যায়।”
ব্রজবিহারী একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বললেন, “খবরটা দিয়ে বাঁচালি বাপ৷ পরেশ মন্তরের জোরে অশৈলী কাণ্ড ঘটাচ্ছে শুনে নিজের উপর ঘেন্না এসে গিয়েছিল। পরেশের মন্তরের যদি ওরকম জোর হয়, তবে কোন ঘোড়ার ঘাস কাটলুম?”
“আরে রামো, মন্তরতন্তর নয় খুড়ো, ভূত!”
৫. তা রোজগারপাতি আজও কিছু
তা রোজগারপাতি আজও কিছু কম হল না নবর।
গুনেগেঁথে দেখল, সকাল থেকে মাত্র ঘণ্টা তিনেকের মেহনতে তিনশো বাহান্ন টাকা। এই রেটে চলতে থাকলে বছরটাকের মধ্যে নন্দকিশোরের আট বিঘে ধানিজমি, সতু হাজরার আটা চাক্কি, যদু ঘোষের বসতবাড়ি আর অন্তত একটা দুধেল গাই কিনে ফেলতে পারবে।
নামাবলিখানা ভাঁজ করে, পুঁথিপত্র গুছিয়ে চশমাজোড়া খুলতে যাবে, এমন সময় একজন মোটাসোটা লোক, “বেঁধে ঠাকুরমশাই, বেঁধে! ও কাজ করবেন না, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! প্রলয় ঘটে যাবে!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে, হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির। নব ঘাবড়ে গিয়ে থপ করে বসে পড়ল।
লোকটা সামনে এসে বসে পড়ে বলল, “করছিলেন কী ঠাকুরমশাই! সেই গেড়েপোতা থেকে আপনার শ্রীচরণ দর্শনে কত কষ্ট করে আসছি, আর আপনি পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলছিলেন?”
নব আমতা আমতা করে বলল, “না, এই বেলা হয়েছে তো! মানুষের স্নানাহার বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!”
পকেট থেকে ফস করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে হাতে গুঁজে দিয়ে হেঁঃ হেঁঃ করে বলল, “আজ্ঞে, গ্রহ-তারকা, রাহু কেতু চিবিয়ে ছাতু করে ফেলছেন, আপনার আবার স্নানাহার! ও হবেখন। তা ঠাকুরমশাই, শরীরগতিক সব ভাল তো?”
“যে আজ্ঞে।”
“আজ্ঞে, সেই যে জষ্টি মাসে বলেছিলেন, সাইকেল থেকেই আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করবে! মনে নেই আপনার?”
নব মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, কতজনাকেই তো রোজ কত কিছু বলতে হয়, সব কি আর স্মরণে থাকে?”
“তা তো বটেই, তা তো বটেই! চুনো-পুঁটিদের মনে রাখাটাও কাজের কথা নয় কিনা। আর আপনারা হলেন গিয়ে বাকসিদ্ধাই, মুখের কথাটি খসল কী সেটাই বোমা হয়ে ফাটল। ওঃ, কী কাণ্ড মশাই!”
নব আঁতকে উঠে বলল, “বোমা ফেটেছে নাকি? ও বাবা!”
“আহা, সেই বোমা নয়! এ হল বাক্যের বোমা, একেবারে অব্যর্থ। তা মশাই, একদিন সত্যিই ওই সাইকেলে চেপেই আমার ভবিতব্য ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে এসে হাজির।”
নব ভারী খুশি হয়ে বলল, “তাই নাকি?”
“তবে আর বলছি কী! দুপুরবেলা সবে খেতে বসেছি, পঞ্চদেবতাকে নিবেদন করে সবে উচ্ছেসেদ্ধ দিয়ে এক গরাস মুখে তুলেছি কি তুলিনি, অমনি বাইরে সাইকেলের পিরিং পিরিং ঘণ্টি। ছোট মেয়ে পটলি ছুটে এসে বলল, ও বাবা, তোমার টেলিগ্রাম এসেছে। কী মুশকিল বলুন, ভাত ছেড়ে উঠলে পাত ত্যাগ হয়ে যাবে। সারা দিনমানে আর অন্নজল মুখে ভোলার উপায় নেই। আর আমার বাড়ির লোকগুলোও সব ক অক্ষর গোমাংস। তখন পিয়ন নীলমণি হাঁক দিয়ে বলল, “ও বিদ্যেধর, আজকের মতো ভাত খাওয়া এমনিতেই ঘুচেছে। টেলিগ্রামে খবর এসেছে যে, তোমার খুড়োমশাই গত হয়েছেন।”
“আহা, কিন্তু এ তো বড় দুঃখের খবর মশাই।”
“কে বলল দুঃখের খবর?”
নব অবাক হয়ে বলল, “নয়? কিন্তু আমি যেন শুনেছিলুম খুড়ো জ্যাঠা গত হওয়া দুঃখেরই ব্যাপার!”
“আহা, তা তো বটেই। তবে কিনা কোনও কোনও খুড়ো গত হলে কারও কারও একটু সুবিধেও হয় আর কী। এই আমার স্বর্গত খুড়োমশাইয়ের কথাই ধরুন। বছরটা আগে বড্ড আতান্তরে পড়ে তিনশোটি টাকা ধার চাইতে গিয়েছিলুম। তা খুড়োমশাই ফস করে একটা হিসেবের খাতা বের করে গড়গড় করে খতিয়ান দিয়ে বললেন, “আমি নাকি গত বাইশ বছরে তাঁর কাছ থেকে মোট এগারো হাজার তিনশো বারো টাকা হাওলাত নিয়ে এক পয়সাও শোধ দিইনি। বুঝুন কাণ্ড! যার অত বড় ফলাও অবস্থা, ত্রিশ বিঘে ধানিজমি, আম-নারকোলের বাগান, মাছের পুকুর আর তেজারতির ব্যাবসা, তার কাছে ওটা একটা টাকা হল? তা বুক ঠুকে সেদিন বলেই ফেললুম, “খুড়ো, আপনি পটল তুললে আপনারটা খাবে কে? এই শৰ্মাই তো আপনার একমাত্র ওয়ারিশান। তারপর মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধশান্তি সেসবও আমি ছাড়া করার লোক নেই!’ এ কথায় খাপ্পা হয়ে খুড়ো আমাকে খড়ম-পেটা করে তাড়ালেন। বুড়ো বয়সে কী অপমান বলুন? খুড়িমা বেঁচে থাকতে এত অনাদর ছিল না। বছর দুই আগে তিনি মরে গিয়ে ইস্তক খুড়োমশাই যেন আরও কঞ্জুস, আরও তিরিক্ষি হয়ে উঠেছিলেন। তার ফলটা কী হল দেখুন।”