ব্রজবিহারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এই গাঁয়েগঞ্জে কে আর ওসবের মর্ম বোঝে রে, দামই বা দেয় কে?”
“কেন ব্রজখুড়ো, এই তো সেদিন কেষ্ট হাজরাই বলছিল, শেতলা পুজোর পর থেকেই নাকি তার নব্বই বছরের শয্যাশায়ী বুড়ি ঠাকুরমা তেড়েফুঁড়ে উঠে চেঁকি কুটতে লেগেছেন। জ্যাঠামশাইয়ে বাঁ হাঁটুতে বাত ছিল, এখন সেই বাত জ্যাঠার হাঁটু তো ছেড়েছেই, এই গঞ্জ ছেড়েও উধাও হয়েছে। কেষ্টর ছেলে সেভেন থেকে এইটে ওঠার জন্য গত তিন বছর ধরে মেহনত করে যাচ্ছিল। এবার দেখুন, মাত্র তিন বিষয়ে ফেল মেরেছে বলে মাস্টারমশাইরা তার কত প্রশংসা করে সেভেনে তুলে দিলেন। কেষ্টর মেয়ে ফুলির হাতে একজিমা ছিল বলে বিয়ে হচ্ছিল না। শেতলা পুজোর পর সেই একজিমা তাড়াতাড়ি পায়ে নেমে গিয়েছে। ফুলির বিয়েও ঠিক হল বলে।”
তারক এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, ভূতের বৃত্তান্তটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে মশাই।”
নব দিকপতি বগল থেকে দাবার বোর্ড আর খুঁটির কৌটো নামিয়ে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে বলল, “ও, সেকথা আর বলিস না। পরেশের চাষবাড়িতে শুধু তরকারির চাষই হয় না রে, রীতিমতো ভূতেরও চাষ হয়, এ কথা তল্লাটের সবাই এখন জেনে গিয়েছে। আর হবে না-ই বা কেন? পরেশের ওই চাষবাড়িতেই তো একসময় খেরেস্তানদের কবরখানা ছিল। তো তারাই এখন কবর ছেড়ে তেড়েফুঁড়ে উঠে আস্তিন গুটিয়ে ওইসব অশৈলী কাণ্ড করছে।”
তারক সন্দিহান হয়ে বলল, “নিজের চোখে দেখেছ নবদাদা?”
“তা আর দেখিনি? জানিস তো, রোজই আমি সকালে বাজারে গিয়ে কালীস্যাকরার সঙ্গে এক পাট্টি দাবা খেলে আসি।”
“তা আর জানি না!”
“তা সেদিন গিয়ে দেখি, কালী ম্যালেরিয়া জ্বরে কোঁ কোঁ করছে। তা মনটা খারাপ হয়ে গেল। দাবার নেশা বড় সব্বোনেশে নেশা। তাই ভাবলুম, এ গাঁয়ে তো আর পাতে দেওয়ার মতো দাবাড়ু নেই। তা যাই, গিয়ে পরেশের সঙ্গেই এক পাট্টি দাবা খেলে আসি। দিনে এক পাট্টি দাবা না খেলতে পারলে আমার খিদে হতে চায় না, পেটে বায়ু হয়, মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু পরেশের ওখানে গিয়ে বাইরে থেকে অনেক ডাকাডাকি করেও তার সাড়া না পেয়ে চলে আসব ভাবছি, ঠিক এমন সময় বেগুনখেতের আড়াল থেকে একটা সবুজ রঙের লম্বা লিকলিকে ভূত বেরিয়ে এসে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে রইল। দেখে তো আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায় আর কী!”
তারক অবাক হয়ে বলল, “দিনেদুপুরে?”
“তবে আর বলছি কী? আজকাল ভূতেদের যা আস্পদ্দা হয়েছে, বলার নয়। আর শুধু কি কটমট করে চাউনি? একটা লম্বা আঙুল তুলে আমার বগলের দাবার বোর্ডটা দেখিয়ে কী যেন বলল।”
“কী বলল গো নবদা?”
“সে ভাষা বুঝবার কি সাধ্যি আছে আমাদের? ভাষাও নয়, অনেকটা ঝিঝিপোকার ডাকের মতো একটা শব্দ। আমি তো অবাক। ভূত কি দাবাও খেলতে চায় নাকি রে বাবা! আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু হাতে-পায়ে এমন খিল ধরে গিয়েছে যে, পালানোরও উপায় নেই।”
ব্রজবিহারী বললেন, “ভূতের গা থেকে বোটকা গন্ধ পাসনি?”
“তা আর পাইনি! খড়বিচালি আর শুকনো ঘাসপাতা থেকে যেমন গন্ধ আসে, অনেকটা তেমনি।”
তারক বলল, “তা কী করলে নবদা?”
একটা বেগুনগাছের ছায়ায় অগত্যা দাবার ছক বিছিয়ে বসতেই হল। নইলে কে জানে বাবা, ভূতের অসাধ্যি তো কিছু নেই! গলাটলা টিপে ধরে যদি? কিন্তু দাবা খেলতে বসলে আমার আবার বাহ্যজ্ঞান থাকে না। ভয়ডরও উধাও হল। আশ্চয্যির ব্যাপার হল কী জানিস? ভূতটা আমাকে গো হারান হারিয়ে দিল।”
“বলো কী?”
ব্রজবিহারী বললেন, “হবে না? ও হল সাহেবভূত। সাহেবদের সঙ্গে কি আমরা এঁটে উঠতে পারি?”
তারক মাথা নেড়ে বলল, “না না, সাহেব হতে যাবে কেন? শুনছেন না গায়ের রং সবুজ। এ নিশ্চয়ই কাফ্রির ভূত।”
নব বলল, “তো হতে পারে। সাহেবদের তো মেলা কাফ্রি কাজের লোক ছিল বলে শুনেছি। তবে যাই বলিস, দাবা যেন গুলে খেয়েছে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে তিন পাট্টি খেলা শেষ। প্রতিবার বারো চোদ্দো চালের পরই বুঝতে পারছিলাম, হারা ছাড়া উপায় নেই।”
“তারপর কী হল?”
“কী আর হবে? তিন পাট্টির পর ভূতটা উঠে বেগুনখেতের মধ্যে ঢুকে গায়েব হয়ে গেল।”
ব্ৰজবিহারী বললেন, “খুব বেঁচে গিয়েছিস। ঘাড় যে মটকে দেয়নি সেই ঢের!”
নবকুমার গম্ভীর হয়ে বলল, “বাঁচলুম আর কোথায় ব্ৰজখুড়ো! সেই থেকে যে নেশা ধরে গেল? ফের পরদিন গেলুম। ফের তিন পাট্টি খেলা। ফের গোহারান হার। তারপর থেকে রোজই যাচ্ছি।”
“বলিস কী?”
“এই তো সেখান থেকেই আসছি, আজ্ঞে! আজও হেরেছি বটে, তবে ক’দিন হল ভূতটার চালগুলো লক্ষ করে খানিক খানিক শিখেও নিয়েছি কিনা! তাই আগের মতো সহজে হারছি না। আজ তো ওর মন্ত্রীও খেয়ে নিয়েছিলুম। তবে এমন চালাক যে, দুটো নৌকো দিয়ে অ্যাইসান চেপে খেলল যে, পথই পেলুম না।”
ব্রজবিহারী গম্ভীর হয়ে বললেন, “ভূতের সঙ্গে দাবা খেলছিস, একটা প্ৰাশ্চিত্তির করে নিস বাবা। সংহিতা দেখে আমি বিধান বলে দেবখন।”
“আহা, সে না হয় পরে হবে। আগে জুত করে কয়েকদিন ভূতটার সঙ্গে একটু খেলে নিই ব্রজখুড়ো। ভূতটা যে মাপের দাবাড়ু তাতে বিশ্বনাথন আনন্দ, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, টোপালভ, ক্রামনিক সবাইকেই বলে বলে হারিয়ে দেবে।”