“তা তো হবেই রে!”
“তা ঠাকুরমশাই, এই চুরিটুরি ছেড়ে কি ঘুঁটের ব্যাবসাতেই নেমে পড়ব নাকি?”
“দুর পাগল! স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরো ধর্ম ভয়াবহ! কুলধর্ম কি ছাড়তে আছে? তোরা হলি তিন পুরুষের চোর, অন্য কাজে তোর আর্ষই নেই। যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে। এই আমাকে দেখছিস না, সকাল থেকে মন্তর পড়ে পড়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, জুটেছে কয়েকটা মজা কলা, একধামা মোটা আতপচাল, কয়েকটা অখাদ্য কাটা ফল, দশটি টাকা। তা কী আর করা যায়? বাপ-দাদা এই কর্মেই জুতে দিয়ে গিয়েছেন, দিনগত পাপক্ষয় করে যাচ্ছি।”
তারক কিছুক্ষণ চুপ করে বসে খুব গভীর চিন্তায় ডুবে রইল। তারপর বলল, “আচ্ছা ঠাকুরমশাই, খোলও কি আজকাল বিলেত আমেরিকায় চালান যাচ্ছে?”
“কেন রে, হঠাৎ খোলের কথা উঠছে কেন?”
“এই মহিন্দির ঘানিওলার কথাই বলছিলাম। আগে তো তার তেল কেনার তেমন খদ্দেরই ছিল না। ইদানীং শুনছি, সে তেলের বদলে খোল বেচে দেদার রোজগার করছে।”
“বলিস কী?”
“একেবারে নির্যস খবর ঠাকুরমশাই। সামনের শনিবার পরানগঞ্জে গোহাটা থেকে গোরু কিনবে বলে মহিন্দির কোমর বেঁধেছে।”
ঠাকুরমশাই চোখ কপালে তুলে বললেন, “মহিন্দির গোর কিনছে! ও বাবা, তা হলে তো তার ভাসাভাসি অবস্থা।”
“আরও একটা খবর আছে ঠাকুরমশাই।”
“বলে ফেল।”
“পরেশ তোপদারের একখানা সবজির খেত আছে, জানেন তো?”
“তা জানব না কেন? মদনপুর জঙ্গলের দক্ষিণে তার সবজির চাষ।”
“হ্যাঁ, ভারী নিরিবিলি জায়গা, কাছেপিঠে লোকালয় নেই। পরেশ সেখানে একখানা কুঁড়ে বেঁধে চৌপর দিন খেত পাহারা দেয়।”
“ফলায়ও ভাল। ভারী বড় সাইজের মিঠে বেগুন হয় তার খেতে।”
“বেগুন, বেগুনের কথা আর কবেন না। আপনার তো সত্তরের উপর বয়স হল, তাই না? এই সত্তর বছরে কত বড় সাইজের বেগুন দেখেছেন?”
“তা দেখেছি বই কী। ছোটখাটো লাউয়ের সাইজের কাশীর বেগুন খেয়েছি, এখনও মুখে লেগে আছে।”
“পরেশের খেতে যে বেগুন ফলেছে তা দেখলে আপনি মূর্ছা। যাবেন। চার-পাঁচ হাত উঁচু গাছে পাঁচ-সাত সের ওজনের শ’য়ে শ’য়ে বেগুন ঝুলছে দেখে আসুন গে!”
“দুর পাগল! ও নিশ্চয়ই বেগুন নয়!”
“আমারও প্রত্যয় হয়নি ঠাকুরমশাই। আর শুধু বেগুনই বা কেন, এই অসময়েও পরেশের বাগানে গেলে দেখতে পাবেন, রাক্ষুসে ফুলকপি আর দৈত্যের মতো বাঁধাকপি ফলে আছে। দুটো কপিতে একটা ভোজবাড়ির রান্না হয়ে যায়। তা ভাবলুম, রাতবিরেতে পরেশদাদা ঘুমোলে এক-আধটা জিনিস তুলে এনে বউ-বাচ্চাদের দেখাতাম। তা বলব কী মশাই, বাগানের ফটকটাই ডিঙোতে পারলাম না।”
“কেন রে? ফটকটা খুব উঁচু নাকি?”
“দুর দুর, চার ফুটও নয়। কিন্তু যতবার ভিতরে ঢুকতে যাই, কীসে যেন বাধক হয়। দেখলে মনে হয় ফাঁকা, কিন্তু ঢুকতে গেলেই যেন একটা শক্ত জিনিসে ঠেকে যেতে হয়। একবার মনে হয়েছিল পরেশদাদা বুঝি কাঁচ দিয়ে বাগান ঘিরেছে। কিন্তু দেখলুম, সেটা কাঁচও নয়। তাতে হাত দিলে হাত চিনচিন করে।”
“হ্যাঁরে, নেশাভাঙ করিসনি তো?”
“মা কালীর দিব্যি ঠাকুরমশাই, চোর হতে পারি, নেশাখোর নই। তবে পরেশদাদাকে গিয়ে পরদিন বেলাবেলি ধরেছিলুম। জিজ্ঞেস করলুম, “দাদা, এরকম সরেস জিনিস ফলালে কেমন করে? তা পরেশদাদা মিচিক মিচিক হেসে কথাটা পাশ কাটিয়ে গেলেন। শুধু বললেন, “যত্নআত্তি করলে সব জিনিসেরই বোলবোলাও হয়। তারপর রাতের ব্যাপারটাও কবুল করে ফেলে জিজ্ঞেস করলুম, “দাদা, বাগানের চারদিকে কাঁচের দেওয়াল তুললেন নাকি?” পরেশদাদা মৃদু হেসে বললেন, “কাঁচটাচ নয় রে, বাগান মন্তর দিয়ে ঘেরা থাকে। চোর তো দূরের কথা, একটা মাছি অবধি ঢুকতে পারে না।”
“বলিস কী! পরেশের মন্তরের এত জোর? আর আমি যে সারাটা জীবন মুখের ফেকো তুলে বিশুদ্ধ দেবভাষায় এত মন্তর পড়লুম, তাতে তো কোনও কাজই হল না! পরেশ কি আমার চেয়ে বেশি মন্তর জানে?”
“কুপিত হবেন না ঠাকুরমশাই। ব্রাহ্মণের রাগ বড় সাংঘাতিক। প্রলয় হয়ে যাবে।”
“দুর দুর! তোর কথা শুনে তো সন্দেহ হচ্ছে, ব্রহ্মতেজ বলে কি কিছু আছে নাকি? মন্তর ঘেঁটে বুড়ো হয়ে গেলুম, আজ অবধি মন্তরে একটা মশা-মাছিও মারতে পারিনি!”
এমন সময় চাতালের পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কে বলে যে আপনার মন্তরের জোর নেই? বললেই হল? আর পরেশের সবজির খেতে যেসব কাণ্ডমাণ্ড হচ্ছে তা মোটেই মন্তরের জোরে নয়। ও হচ্ছে ভুতুড়ে কারবার।”
ব্রজবিহারী নবকুমার দিকপতিকে দেখে ভারী খুশি হয়ে বললেন, “আয় নব, বোস এসে। তা ভুতুড়ে কারবার যে সেটাই বা কী করে বুঝলি?”
“পরেশের চোদ্দো পুরুষের কেউ মন্তর-তন্তরের কারবার করেনি। মন্তরের মহিমা ও কী করে বুঝবে? আর আপনার মন্তরের কথা কী বলব ব্রজখুড়ো, আপনি হয়তো মন্তরের জোর টের পান না, কিন্তু আমরা তো দিব্যি পাই। এই যে সেদিন কেষ্ট হাজরার বাড়িতে শেতলা পুজো করছিলেন, ঘরের ভিতর বসে আপনি মন্তর পাঠ করছেন, আর বাইরে সেই মন্তর যেন চারদিকে ঠং ঠং করে হাতুড়ির ঘা দিয়ে বেড়াচ্ছে! মধুদের বাগানে গাছ থেকে দুটো ডাঁশা পেয়ারা খসে পড়ল, হাবুদের কাবলি বিড়ালটা একটা মেঠো ইঁদুরকে তাড়া করতে গিয়েও করল না। পরে দেখলুম, জটা ওদের দাওয়ায় বসে ফাঁস ফাঁস করে কাঁদছে, আর সুদখোর মহাপাপী খগেন সাঁতরা মন্তরের শব্দ শুনে দু’কানে হাতচাপা দিয়ে বাবা রে, মা রে’ করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। স্বচক্ষে দেখা।”