টইটম্বুর
নয়না সে ছোট্র মেয়ে দাদুভায়ের সাথি,
যখন-তখন জ্বালে ঠোঁটে হাসির হাজার বাতি।
দিনদুপুরে পক্ষিরাজের ডানার হাওয়া খায়,
রাতদুপুরে ভেসে বেড়ায় রাঙা চাঁদের নায়।
পেটমোটা সব বইয়ের ইটে বানায় খেলাঘর,
এক পলকে বিছানা হয় মেঘনা নদীর চর।
বিকেলবেলা ড্রইংরুমে হরিণ ডেকে আনে,
নয়না তো পশুপাখির মজার ভাষা জানে।
হরিণ যখন খিদের তাড়ায় খোঁজে গাছের পাতা,
দেয় সে খেতে দাদুভায়ের পদ্য লেখার খাতা।
নয়না খুব মিষ্টি মেয়ে সূর্যি যে তার মামা,
জ্যোৎস্না দিয়ে তৈরি মেয়ের গায়ের মিহি জামা।
অ আ লেখায় নয়না রোজ দোয়াত করে উপুড়,
ছুটে বেড়ায় হাতে নিয়ে মাসিক ‘টইটম্বর’।
টিকটিকি
টিকটিকিটা দেয়াল জুড়ে
ঘুরে বেড়ায় আনন্দে।
ঠিক ঠিক সে শোনায় গান
ঘড়ির কাঁটার ছন্দে।
দেখতে দেখতে ভোর চলে যায়,
এসে পড়ে সন্ধে।
ঘাপ্টি মেরে ব’সে থাকে
ছোট্র পোকার গন্ধে।
টিকটিকি তুই খাস নে পোকা,
অহিংসাতে মন দে।
টুকরো ছবি
সকালবেলা ফুল, পাখি আর
ঘাসের ডগা জাগে,
গাছের পাতায় রোদের কাঁপন
দেখতে ভালো লাগে।
দুপুরবেলা মনের সুখে
মেঘে ভাসে চিল,
হঠাৎ আমার মনে পড়ে
আপন গাঁয়ের ঝিল।
সন্ধেবেলা পাখির মালা
দূর আকাশে দোলে,
একে একে মেঘের দেশে
তারারা চোখ খোলে।
রাত্রিবেলা অন্ধকারে
চুপটি ক’রে থাকি,
রাত্রি দিনের অনেক কথা
পদ্যে লিখে রাখি।
দুটি মেয়ে
একটি মেয়ে দুষ্টু বটে,
একটি মেয়ে মিষ্টি।
জন্মদিনে কী চাই ওদের
করছে বসে লিস্টি।
একটি মেয়ের চলন সিধে,
একটির খুব ফিস্টি।
একটি তাকায় সোজাসুজি,
একটির বাঁকা দৃষ্টি।
একটি শান্ত, একটি ঘরে
বাধায় অনাসৃষ্টি।
দুপুর-রাতে
জেগে শুনি দুপুর-রাতে
কিসের শব্দ ঘরের ছাতে?
খুরের আওয়াজ যাচ্ছে শোনা,
ছাতে ওড়ে জ্যোৎস্না-কণা।
এইতো দেখি আমার ঘরে
পক্ষিরাজের ডানা নড়ে।
ঘোড়ার পিঠে রাজার, ছেলে,
বলি ওকে, ‘কেন এলে?”
‘শুনতে এলাম তোমার কথা,
কত তোমার মনের ব্যর্থা,
জানতে এলাম আজকে রাতে’-
এই-না ব’লে লাগাম হাতে
ছোটায় ঘোড়া রাজার ছেলে
একা ঘরে আমায় ফেলে।
ছুটল ঘোড়া তেপান্তরে,
আমি থাকি আমার ঘরে।
নজরুল
কবিতার নয়া গুলবাগে ব’সে
গেয়েছিল গান কোন সেই বুলবুল?
নজরুল, নজরুল।
ছিল কার দুটি জ্বলজ্বলে চোখ,
দিলখোলা হাসি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল?
নজরুল, নজরুল।
হাতে ছিল কার আগুন-ঝরানো
সুরময় বীণা, হৃদয়ে ফুটত ফুল?
নজরুল, নজরুল।
কার কবিতার ঝংকারে বলো
গোঁড়ামির কালো দুর্গ হয়েছে ধুল?
নজরুল, নজরুল।
কার গানে-গানে ছিঁড়ত শেকল,
উপড়ে পড়ত সাম্প্রদায়িক মূল?
নজরুল, নজরুল।
জীবনের শেষ পর্যায় তাঁর
যেন বিষাক্ত তীরবেধাঁ দুলদুল।
নজরুল নজরুল।
ছিল না কণ্ঠে কথা আর সুর;
দৃষ্টি প্রখর, উধাও মাথার চুল।
তবু তিনি নজরুল
নয়না তোর নাচন দেখে
নয়না তোর নাচন দেখে
পাখি ছুটে আসে।
নয়না তোর হাসি দেখে
লক্ষ তারা হাসে।
নয়না তুই হাত বাড়ালে
চন্দ্র আসে নেমে।
নয়না তুই ধমক দিলে
হাওয়া যায় থেমে।
নয়না তোর কান্না দেখে
আকাশ ওঠে কেঁডে।
নয়না তোর জন্যে কত
পুতুল আনে বেদে।
নয়না তুই ঘুমাস যদি,
নিঝুম সারা বাড়ি।
নয়না তুই হাসিমুখে
ওঠরে তাড়াতাড়ি।
নয়নার জন্মদিনে
নয়না তার জন্মদিনে
নিয়ে অনেক সাথি
একটি ফুঁয়ে কেকের ওপর
নেভায় মোমের বাতি।
ছোট্র মেয়ে নয়না তার
ঠোঁটে জ্বালে হাসি,
হাসি দেখে দাদুর মনে
বাজে মধুর বাঁশি।
বলেন দিদা, ‘জন্মদিনে
বলো তো কী চাও?’
নয়না কয় ‘আকাশ থেকে
চাঁদটা এনে দাও’।
কাগজের এক চাঁদ বানিয়ে
দাদু বলেন, ‘নাও’।
প্রিয় স্বাধীনতা
মেঘনা নদী দেব পাড়ি
কলঅলা এক নায়ে।
আবার আমি যার আমার
পাড়াতলি গাঁয়ে।
আলুঘাটায় নেমে পায়ে
মাখব রাঙা ধুলো।
আমায় দেখে খিলখিলিয়ে
হাসবে শিমুলগুলো।
গাছ-ঘেরা ঐ পুকুরপাড়ে
বসব বিকেলবেলা।
দুচোখ ভরে দেখব কত
আলোছায়ার খেলা।
বাঁশবাগানে আধখানা চাঁদ
থাকবে ঝুলে একা।
ঝোপেঝাড়ে বাতির মতো
জোনাক যাবে দেখা।
ধানের গন্ধ আনবে ডেকে
আমার ছেলেবেলা-
বসবে আবার দুচোখ জুড়ে
প্রজাপতির মেলা।
পড়বে মনে দিঘির জলে
উথালপাথাল নাওয়া,
বাউড়ি বিলে খেলার ঝোঁকে
সরু ডিঙি বাওয়া।
হঠাৎ আমি চমকে উঠি
হলদে পাখির ডাকে;
ইচ্ছে করে ছুটে বেড়াই,
মেঘনা নদীর বাঁকে।
শত যুগের ঘন আঁধার
গাঁয়ে আজো আছে।
সেই আঁধারে মানুষগুলো
লড়াই করে বাঁচে।
মনে আমার ঝলসে ওঠে
একাত্তরের কথা,
পাখির ডানায় লিখেছিলাম-
‘প্রিয় স্বাধীনতা’।
বাঁচতে দাও
এই তো দ্যাখো ফুলবাগানে গোলাপ ফোটে,
ফুটতে দাও।
রঙিন কাটা ঘুড়ির পিছে বালক ছোটে,
ছুটতে দাও।
নীল আকাশে সোনালি চিল মেলছে পাখা,
মেলতে দাও।
জোনাকপোকা আলোর খেলা লেখছে রোজই,
খেলতে দাও।
মধ্যদিনে নরম ছায়ায় ডাকছে ঘুঘু,
ডাকতে দাও।
বালির ওপর কত্ত কিছু আঁকছে শিশু,
আঁকতে দাও।
কাজল বিলে পানকৌড়ি নাইছে সুখে,
নাইতে দাও।
গহিন গাঙে সুজন মাঝি বাইছে নাও,
বাইতে দাও।
নরম রোদে শ্যামাপাখি নাচ জুড়েছে,
নাচতে দাও।
শিশু, পাখি, ফুলের কুঁড়ি-সবাইকে আজ
বাঁচতে দাও।
ভরদুপুরে
ভরদুপুরে হঠাৎ ক’রে কাকের ডাকে
ন’ড়ে ওঠে নিঝুম পাড়া,
প্রজাপতির ওড়া দেখে নাচতে থাকে
রাকামণির চোখের তারা।
আকাশ-গাঙে ঝপ ঝপা ঝপ পড়ে শুধু
সোনার নায়ের রুপোর দাঁড়,
রাকার গলায় দুলছে দ্যাখো দুপুরবেলার
রঙে-গড়া চিকন হার।
ভরদুপুরে একটি দুটি তিনটি পাখি
গান শুনিয়ে উড়ে যায়,
গানের সুরে ঝুমুর ঝুমুর ঘুঙুর বাজে
রাজামণির রাঙা পায়।
ভরদুপুরে শুয়ে-শুয়ে ভাইয়া পড়ে
ছবি-ভরা গল্প কত-
বইয়ের পাতা থেকে বেরোয় ডানাঅলা
মেয়েরা সব পরীর মতো।
ভরদুপুরে গলির মোড়ে ডেকে ওঠে
ঝাঁকড়া চুলের ফেরিঅলা;
রাকা ভাবে-লোকটা কখন রোদের ভেতর
ঢুকে পড়ে, যায় না বলা।