প্রধান লামা কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর নিচু কণ্ঠে বেশ কিছুটা সময় ধরে নির্দেশ দিলেন। সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। এক ঘণ্টা পর তিনজন ফিরল। দু’জন ভারী একটা টেবিল বহন করে এনেছে। ওটাকে মেঝেতে পাতা হলো। লম্বা একটা বোর্ডের ভারে রীতিমত নুয়ে পড়েছে আরেকজন। ওটার ওপরে ময়দা দিয়ে বানানো মানুষের একটা কাঠামো শোয়ানো। এখানে নরবলি দেয়া নিষিদ্ধ। এর বদলে ময়দায় তৈরি মানুষের কাঠামো ব্যবহার করা হয়। একজন সাদা মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছে এখানে। এবার ওটাকে টেবিলের ওপর রেখে তিনজন অদৃশ্য হলো।
একটার পর একটা ঘণ্টা পেরোতে লাগল। আবারও সন্ধ্যা এল। একজন লামার নিয়ে আসা মোম আবছা আলো ছড়াচ্ছে ময়দার কাঠামোটার ওপর। কেউ নেই দেখে ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এল রিচার্ডসন, হাত-পায়ের খিল ছাড়ানোর জন্য। আরও একটা রাতের আতঙ্ক চেপে ধরল তাকে। খাবার, পানি ছাড়া এভাবে কয়দিন বাঁচতে পারবে জানে না। তবে পৃথিবীর মায়া এখনই কাটাতে চায় না।
ঘড়িতে যখন দশটা তখন আবার ছায়াময় কিছু কাঠামো একটার পর একটা হাজির হতে লাগল। জমকালো পোশাক পরনে। অনেকের মাথায় সিংহ, পাখি, ড্রাগন নানান কিছুর মুখোশ। কাঁপছে, মন্ত্র পড়ছে ছায়ামূর্তিগুলো। ওগুলো কি মানুষ নাকি অন্য কিছু বলতে পারবে না রিচার্ডসন। হঠাৎ অদ্ভুত জিনিসগুলোর মাঝখানে আবির্ভূত হলেন প্রধান লামা। ঢিলেঢালা জমকালো এক আলখেল্লা পরনে, মাথায় কালো টুপি। এক হাতে একটা মশালের মত, অন্যহাতে লম্বা একটা লাঠির মাথায় সুচালো ইস্পাতের ফলা। ইয়ামার দিকে মুখ উঁচু করে কথা বলতে শুরু করলেন, ‘সাদা মানুষ, তুমি আমাদের পবিত্র মন্দির লুঠ করতে এসেছ। ইয়ামার হার চুরি করেছ। আমরা তোমাকে আঘাত করিনি। কিন্তু তুমি আমাদের ভিক্ষুদের হত্যা করেছ। এখন দুটো পথ খোলা আছে তোমার সামনে। শয়তানি লাঠিটা (রিভলভার) ব্যবহার করে মরো, নতুবা আমরা তোমাকে মারব। তুমি পালাতে পারবে না। আমাদের এক ডজনকে মারলেও বাকিরা তোমাকে হত্যা করবে। আমরা চাইলে অনাহারে রেখেও মারতে পারি তোমাকে। এর চেয়ে নিজে নিজেই মরো।’
নিঃশব্দে হাসল রিচার্ডসন। মূর্তির অশুভ হাঁ করা মুখটার মাঝখান দিয়ে নিশানা করে গুলি করল। বুড়ো লামার শরীরটা কেঁপে উঠল। হাত থেকে মশালের মত জিনিসটা খসে পড়ল। তাঁর কাঁধ ভেদ করে গিয়েছে বুলেট। দু’জন লামা তাঁকে সাহায্য করতে এগুল। কিন্তু হাত নেড়ে নিষেধ করলেন। মন্দিরের ওই অদ্ভুত মানুষ কিংবা জন্তুগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগুলেন তিনি। ময়দার তাল দিয়ে তৈরি কাঠামোটার সামনে দাঁড়ালেন। একজন সহকারী একটা ধারালো ছুরি এনে দিল তাঁকে।
ইয়ামার মুখের দিকে চোখ তুলে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করলেন প্রধান লামা। ক্রমেই বাড়তে লাগল তাঁর কণ্ঠের জোর। সেই সঙ্গে বেজে উঠল মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। চারপাশে ঘিরে থাকা অদ্ভুত ওই ছায়ামূর্তিগুলো পৈশাচিক কণ্ঠে হুল্লোড় করছে।
রিচার্ডসনের কেমন ঘুম ঘুম আসছে। খাবার আর ঘুমের অভাবেই এমনটা হয়েছে, ভাবল সে।
কান ফাটানো একটা অশুভ চিৎকারের মধ্য দিয়ে শেষ হলো প্রধান লামার মন্ত্রপাঠ। যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোন ঈগলের মরণ চিৎকার। তারপর আশ্চর্য নীরবতা। মাথা তুলে লুকিয়ে থাকা সাদা মানুষের উদ্দেশে বললেন, ‘তুমি নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করোনি। এবার লামাদের জাদুর হাতে মরবে। কিছুই করতে পারবে না। কারণ লামাদের গুপ্ত জ্ঞান সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তোমাদের সাদা মানুষদের।’
ঝুঁকে পড়ে ছুরিটা দিয়ে ময়দার মূর্তিটার এক হাত কেটে ফেললেন তিনি। ওটা মাটিতে ছুঁড়ে মারলেন। ওখান থেকে রক্তের মত একটা কিছু বেরোতে লাগল।
ইয়ামার ভেতর থেকে অমানুষিক এক আর্তনাদ শোনা গেল। এবার অপর হাতটা কাটলেন লামা। তারপর দুই পা। ভয়ঙ্কর এক আঘাতে ময়দার তালটাকে রীতিমত ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারলেন।
সবশেষে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করলেন। এটা যখন করলেন ভেতরের গোঙানি থেমে গেল। তারপরই কাঠের কাঠামোটা বেদি থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ওটার ওপর পড়ে বেদিটাকেই খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলল। তারপর পড়ল টেবিলের ওপর। টেবিলটাকে ভেঙে ফাঁপা কাঠামোটা অন্তত এক ডজন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। প্রধান লামার কাঁপতে থাকা শরীরটা, যেটা অন্য লামারা ধরে রেখেছে, রিচার্ডসনের কাঠামোটার দিকে তাকাল। ময়দার তালটা যেভাবে কাটা হয়েছে সেভাবেই কাটা পড়েছে সাদা মানুষের শরীরটা।
অভিশপ্ত অরণ্য হইয়া বাচিয়ু
রোমানিয়ার ক্লাজ-নেপোকার কাছে ছোট্ট এক বন হইয়া বাচিয়ু। আয়তন মোটে ২৫০ হেক্টর। কিন্তু আকারে ছোট হলে কী হবে নানা ধরনের অতিপ্রাকৃত ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনার জন্য এ বনকে চেনে সবাই এক নামে। রোমানিয়ার বারমুডা ট্রায়াঙ্গলও বলেন কেউ কেউ। ভুতুড়ে ছায়ামূর্তি, খালি চোখে দেখা যায়নি এমন সব ছবি ক্যামেরায় আসা, এমনকী ভিনগ্রহের যান বা উড়ন্ত সসার নামার কাহিনীও ডালপালা বিস্তার করেছে এই অরণ্যকে ঘিরে। জঙ্গলটার বয়সও কম নয়, পঞ্চান্ন হাজার বছর। এটা যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই ক্লাজ-নেপোকা আবার ঐতিহাসিকভাবে কাউন্ট ড্রাকুলার বাসস্থান হিসাবে পরিচিত ট্রানসিলভানিয়ার অংশ। তাই হইয়া বাচিয়ু পরিচিতি পেয়েছে আরও বেশি।