হঠাৎই বুঝতে পারল ছায়াগুলো জীবন্ত। মনে মনে নিজেকে একটা ধমক দিল। এটা অবশ্যই কল্পনা। আবার তাকাল। এবার আর কোন ভুল নেই। চওড়া কিনারার একটা কালো টুপি নজর কাড়ল তার। ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। যে দরজাটা কেবল পেরিয়ে এসেছে সেদিকে তাকাল। আতঙ্কে পিছু হটল। আরেকটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। ওটার মাথায়ও কালো টুপি। যেদিকেই তাকাল কালো টুপির ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। পালাবার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। দ্রুত ঘুরে ভেতরের মন্দিরের দিকে যাওয়া দরজাটার দিকে এগুল। ওটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। সে নিশ্চিত এই কামরাতে ঢুকবার কিংবা এর থেকে বেরোবার আর কোন পথ নেই। চারপাশের ছায়াগুলো দেখছে।
হঠাৎ একটা আলোর ঝলকানি। এটা কোন দৃষ্টিবিভ্রম নয়। ভুতুড়ে এক কাঠামো, যেটাকে ছায়া ভেবেছিল, ওটার হাতে শোভা পাচ্ছে ধারালো এক ছুরি। শিস দেয়ার মত একটা আওয়াজ। প্রবৃত্তিগতভাবে মাথা নিচু করল রিচার্ডসন। আর এটাই জীবন বাঁচিয়ে দিল তার। যেখানে মুখটা ছিল সে জায়গাটা দিয়ে সজোরে চলে গেল পাতলা একটা ইস্পাতের ছুরি। ব্রোঞ্জের একটা বলে বাড়ি খেয়ে তার পায়ের ওপর পড়ল ওটা।
ছায়াগুলোর মধ্যে একটাকে লক্ষ্য করে পিস্তল তাক করল রিচার্ডসন। তারপর আরেকটাকে নিশানা করল। কিন্তু বুঝতে পারল কোন লাভ হবে না। ওগুলো খুব ঝাপসা। পকেট থেকে টর্চটা বের করে একটা অন্ধকার কোণ লক্ষ্য করে বাতিটা জ্বালল। আঁধার কেটে যাওয়া আলোকরশ্মিতে লম্বা, পাতলা একটা কাঠামো ধরা দিল। গায়ে এক জাতের হরিণের চামড়ার পোশাক, মাথায় কালো টুপি। আলো পড়তেই দেয়ালের গায়ে ঝুলতে থাকা নকশাখচিত কাপড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল কাঠামোটা। তারপরই একটা চিৎকার শোনা গেল। নানা দিক থেকে ছুরি হাতে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসতে লাগল।
রিচার্ডসনের হাতের রিভলভার আগুন ঝরাল। চিৎকারের সঙ্গে যোগ হলো গোঙানি। দুটো কাঠামো মাটিতে আছড়ে পড়ল। পরমুহূর্তে খালি হয়ে গেল কামরাটা।
একটার পর একটা ঘণ্টা পেরিয়ে যেতে লাগল। রিচার্ডসন কড়া পাহারায় আছে। কিছুই এল না। এখান থেকে নড়তে সাহস করল না সে। দরজাটা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করতেই মৃদু একটা আওয়াজ শুনল। সেদিকে টর্চের আলো ফেলল। দেখল দেয়ালের পর্দাগুলো একটু নড়ছে।
ভোর হলো। একই সঙ্গে ক্লান্ত, চিন্তিত রিচার্ডসনের দিশেহারা অবস্থা। একটা সেগুন কাঠের টুলের ওপর বসল। সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকতে পারছে কমই। কেবল আবছা একটা আলোর আভা জানিয়ে দিল ভোরের আগমনী। কামরাটা বিশেষ করে যে ছোট্ট চেম্বারটায় আছে সেটা ভালভাবে পরীক্ষা করতে লাগল।
ঈষৎ দুলতে থাকা পর্দা ভরা এই হল ছাড়া পালানোর আর কোন রাস্তা যে সামনে খোলা নেই এটা ভালই বুঝতে পারছে রিচার্ডসন। এটা করার চেষ্টা করলে অন্তত বিশটা ছুরি তার পিঠে গাঁথবে। মাটিতে ভূপাতিত দুই লামার দেহ অদৃশ্য হয়েছে। কে তাদের নিয়েছে বলতে পারবে না।
দরজার গরাদের ফাঁক দিয়ে যখন দেয়াল এবং ছাদ পর্যবেক্ষণ করছে হঠাৎ বুঝতে পারল, পায়ের নিচে মাটি নড়ছে তার। পাথুরে ভূমি যেন একটু একটু করে ওপরে উঠছে।
লাফিয়ে সরে গিয়ে তাকাল লুকানোর একটা জায়গার খোঁজে। এসময়ই বুদ্ধিটা এল মাথায়। ইয়ামার ফাঁপা শরীরটার ভেতরেই তো লুকাতে পারে সে।
গিল্ড করা দরজার ওপর দ্রুত একটা পর্দা ফেলল, যেন তার গতিবিধি কারও নজরে না পড়ে। ভুতুড়ে দেবতার কাঠামোর দিকে সিঁড়ি ধরে এগিয়ে গেল। তারপর বিশাল মূর্তিটার পেছনে ঢুকে পড়ল অনায়াসে।
ইয়ামার শূন্যগর্ভ চোখ দিয়ে দেখছে সে। মাটি আস্তে আস্তে ওপরে উঠেই চলেছে। মাটির সমতলের কয়েক ইঞ্চি নিচে একটা ট্র্যাপডোর আছে নিশ্চিতভাবেই। সম্ভবত মন্দিরের নিচের মূল্যবান হীরা-জহরতের ভল্টের দিকে গিয়েছে ওটা।
একটু একটু করে ওপরে উঠছে মেঝের ওই অংশ। ট্র্যাপডোরের ওপরের অংশটা ধরে থাকা লম্বা হলুদ একটা হাত নজরে পড়ল। কয়েক সেকেণ্ড পর কালো টুপি পরা একটা কাঠামো খোলা অংশটা দিয়ে চেহারা দেখাল। সিঁড়ি ধরে এসে বিশাল স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়াল লামা।
তারপর একজনের পর একজন আসতেই লাগল। এভাবে জনা বারো লামা হাজির হলো গুপ্ত দরজাটা দিয়ে। রিচার্ডসন টু শব্দটি করছে না। লামারা খোঁজ করতে লাগল তার। দরজা খুলে দেখল। ভেতর থেকে যোগ দিল আরও কয়েকজন। উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে কামরার নানা দিকে নির্দেশ করছে। তবে ইয়ামার স্ট্যাচুর দিকে নজর নেই কারও। তারপরই একজনের নজরে পড়ল দেবতার হার গায়েব। অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ক্রোধে, দুঃখে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।
এসময়ই প্রধান লামা বা মন্দিরের অধ্যক্ষ হাজির হলেন। গলায় পেঁচানো নানা ধরনের মূল্যবান পাথরের অনেকগুলো জপমালা। নিচু স্বরে কী যেন বললেন। সঙ্গে সঙ্গে চারজন লামা সিঁড়ি বেয়ে ইয়ামার ভাস্কর্যের দিকে আসতে লাগল। নেকলেসটা চুরি করায় নিজেকে অভিশাপ দিল রিচার্ডসন তবে এখন আর অতীতের ভুলের কথা ভেবে লাভ নেই। প্রথম লামাটির মাথা নজরে আসতেই ঘুরে গুলি করল। একটা চিৎকার। পরক্ষণেই ভিক্ষুরা সঙ্গীর দেহটা নিয়ে পিছু হটল। সবাই গিল্টি করা দেবতার মূর্তির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে।