প্রথম দালানগুলোর কাছে পৌঁছে সাবধানে ভিক্ষুদের বাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। পাথরের খাড়া ধাপ ছাড়া ওখানে ওঠার আর কোন উপায় নেই। সন্ধ্যার শীতল বাতাস তার কানে নিয়ে এল একটা ঘণ্টাধ্বনি। ওপরের মন্দির থেকে আসছে।
হঠাৎ কাছের দেয়াল থেকে আলাদা হলো কালো একটা ছায়া। তাড়াতাড়ি রিভলভার বের করে যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হলো রিচার্ডসন। আলখেল্লা পরিহিত এক লামার ছায়া ওটা। মাথায় উঁচু ব্রিমের একটা কালো টুপি শোভা পাচ্ছে। ওটার চূড়াটা বিশেষ আকৃতির এক স্তম্ভের আদলে গড়া।
সিঁড়ি বেয়ে একটা ভূতের মত নেমে গেল ছায়াটা। তার আলখেল্লা রিচার্ডসনের রিভলভার ছুঁয়ে গেল। ভিক্ষু বেশ দূরে চলে গেছে নিশ্চিত হওয়ার পর আবার প্রাচীন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল রিচার্ডসন। শেষ পর্যন্ত বিশাল আটকোনা দালানটার সদর দরজার সামনে হাজির হলো। এর ভেতরেই তিন মাথার ইয়ামার অবস্থান। প্রধান লামার কামরায় একটা বাতি জ্বলছে। ওটার আলো ছিটকে আসছে উঠনে।
মন্দিরের দরজাটা তালা তো মারা নয়ই, এমনকী বন্ধও না। ছায়ার মত ভেতরে প্রবেশ করল রিচার্ডসন। তারপর বাসি ছাতা পড়া গন্ধের একটা বড় চেম্বারের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ছাদ থেকে ঝুলছে তিব্বতী পর্দা আর নানা ধরনের পেনডেন্ট। বাতাস ভারী। এখানে-সেখানে বাতিদানিতে লাল কয়লা জ্বলছে। পায়ের নিচের মেঝে ঠাণ্ডা, সেঁতসেঁতে। চারপাশে বড় বড় পিলার মাথা উঁচু করে। ওগুলোর গায়ে সময়ের আবর্তে ফিকে হয়ে যাওয়া নানান কারুকাজ। এসব কিছুই ‘রিচার্ডসন দেখছে তার পকেট থেকে বের করা ফ্ল্যাশ লাইটটার আলোয়। একবার এক জায়গায় আরেকবার অন্য জায়গায় আলো ফেলছে। জানে মৃত্যুকে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে সে’। তবে বিপদ ভালই লাগে এই প্রাক্তন সৈনিকের। আজকের সন্ধ্যাটা রোমাঞ্চকর কিছু আবিষ্কারের প্রত্যাশা এনে দিয়েছে তার মনে।
সামনেই আরেকটা দরজা। প্রথমটা থেকে ছোট। ভেতরের একটা কক্ষ বা চেম্বারের দিকে গিয়েছে। ওই দ্বিতীয় দরজাটা আগলে থাকা দেবতা আর শয়তানের নানান প্রতিমূর্তি আঁকা পর্দাটার কাছে পৌঁছনোর জন্য বইয়ের বাক্স এবং আরও বিভিন্ন জিনিসের মধ্য দিয়ে এগুল।
পর্দাটা একপাশে সরিয়ে কামরাটার ভেতরে তাকাল। মাটির মেঝের মাঝখানে বড় একটা বাতিদানে রাখা বিশাল একটা মোমের আলোয় আবছাভাবে আলোকিত কামরাটা। দেয়ালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ছবি আঁকা। মেঝে ঢাকা পুরানো মোটা কাপড় দিয়ে।
বড় একটা পাত্রে ধূপ জ্বলছে সামনে। এর উল্টোপাশে সোনালি গিল্টি করা একটা দরজা পেরোলেই গুপ্তকুঠুরী। দরজা গলে ঝিকমিক করতে থাকা মন্দিরটার দিকে চোখ গেল ‘তার। কাঁপতে থাকা মোমের আলোয় শত শত ছায়া দেখা যাচ্ছে। এদিকে চেম্বারগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বাতাস অদ্ভুত একটা হিস হিস শব্দ তৈরি করছে। চারপাশ ধূপের ধোঁয়ায় কেমন ছায়া ছায়া হয়ে আছে। সব জায়গায় কেমন আলো-আঁধারির খেলা।
কেঁপে উঠল রিচার্ডসন। তারপরও রিভলভারটা আঁকড়ে ধরে গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চারপাশে ছোট ছোট দেবতাদের ঘেরাওয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিকট দর্শন ইয়ামা। তার তিন মুখে বীভৎস ভঙ্গি। বুকে ক্রুশ আঁকল রিচার্ডসন। পরমুহূর্তেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। ধর্মীয় অমূল্য সব কিউরিওতে পরিপূর্ণ গোটা কামরাটা। পান্না, রুবিতে মোড়া খুলির বাটি, মূল্যবান সব পাথরের জপমালা, অসাধারণ কারুকার্যমণ্ডিত ঝুলতে থাকা কাপড়, মূল্যবান পাথর ঝকমক করতে থাকা ছোট মূর্তি, দামি চিত্রকর্ম-এসব কিছু দেখে রিচার্ডসনের তো দিশেহারা অবস্থা। তবে মাথা ঠাণ্ডা রাখল। মূল্যবান আর ছোট জিনিসগুলোই সে হাতিয়ে নেবে।
পান্নার চোখ এবং কপালে হীরে আটকানো জেড পাথরের ছোট্ট এক বুদ্ধমূর্তি তার মনে ধরল। ওটা পকেটে চালান করল। এবার সোনার গিল্টি করা ইয়ামার দিকে তাকাল। দামি সব মুক্তো দিয়ে তৈরি একটা হার ঝুলছে তার গলায়। কীভাবে ওখানে পৌছানো যায় বুঝতে চারপাশে তাকাল। একটা ছোট সিঁড়ি নজর কাড়ল।
ওটা ধরে উঠতেই বহু হাতের ওই দেবতার পেছনে নিজেকে আবিষ্কার করল। আর তখনই বুঝতে পারল ওটা ফাঁপা। মূর্তিটার শূন্য কোটর দিয়ে অনায়াসে তাকাতে পারল রিচার্ডসন।
মুখটা ভেতর থেকে খোদাই করা। তবে তার জানা নেই এখন যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে কখনও এসে দাঁড়ান প্রধান লামা। ছোট্ট ছুরির এক খোঁচায় কাঠের পেরেকদুটো খুলে ফেলতেই মুক্তোগুলো এসে হাতে জমা হলো।
মন্দিরের সামনে ফিরে এসে রত্নখচিত জপমালাটা হস্তগত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছল যথেষ্ট হয়েছে। আরও অনেক কিছুই তার পছন্দ। তবে বুদ্ধিমান রিচার্ডসন জানে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণ নিয়ে ফেরা।
গিল্টি করা দরজা ঠেলে বের হয়ে আবারও সেই শত ছায়ার রুমে প্রবেশ করল। কামরাটার আশ্চর্য নীরবতা তাকে আঁকড়ে ধরল। ভয় পেয়ে গেল কেন যেন। হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগল। ব্রোঞ্জের বাতিদানের মধ্যে বিশাল মোমবাতিটাকে পাশ কাটাল। অশুভ জায়গাটি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করলেও থেমে চারপাশে দৃষ্টি বোলাল। মৃদু, ব্যাখ্যাতীত একটা শব্দ কানে এল তার। আবছা আলো- আঁধারিতে প্রতিটি কোণ এবং কুলুঙ্গিতে খেলা করা ছায়াগুলো দেখে চুলগুলো খাড়া হয়ে গেল।