‘তাহলে বাড়িতে আমরা একা,’ যন্ত্রমানবের মত বললেন লিণ্টন।
একা!’ তার কথার পুনরাবৃত্তি করল নারী। নীল চোখে রহস্যময় হাসি। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘যে কেউ তোমার চেহারার দিকে তাকালেই বুঝবে আমাকে ভয়ানক একটা কিছু ভেবে বসে আছ। কোন ধরনের স্ক্যাণ্ডাল কিংবা ব্ল্যাকমেইলের একটা আশঙ্কাও নিশ্চয়ই মনে দানা বাঁধছে। এখানে এসে একটু অপেক্ষা করো। এই ফাঁকে পোশাকটা বদলে নিচ্ছি। আজকে তার শরীরটা খুব একটা ভাল না। তাকে বিছানায় রেখে এসেছি।’
লিন্টনকে একটা কামরায় ঢুকিয়ে বাতি জ্বেলে ওপরের তলার দিকে দৌড়ে গেল তরুণী। সে চলে যাবার পর বেশ ক্লান্তি অনুভব করলেন লিন্টন। সারা দিনেই আঁকাআঁকি করেছেন। মৃদু আলো ছড়াতে থাকা গ্যাস বাতিটার সামনে একটা চেয়ারে গা ডুবিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। এই ফাঁকে গোটা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। এটা ঠিক তিনি রোমাঞ্চ পছন্দ করেন, যেখানে বিপদ কিংবা রোমান্স আছে তা টানে তাঁকে। কিন্তু এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে তাঁকে। এখন তিনি খুব ক্লান্ত। তারপর আবার গোটা বিষয়টা কেমন খাপছাড়া, রহস্যময়। এই নারী কে? তাঁকে কেনই বা এ বাড়িতে নিয়ে এসেছে? সব কিছু এমন চুপচাপ কেন? তাঁর জন্য কে অপেক্ষা করে আছে? হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ, অদ্ভুত একটা আওয়াজ, অনেকটা অপ্রত্যাশিত কোন ব্যথায় কেউ কেঁদে ওঠার মত, সচকিত করে তুলল তাঁকে। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকালেন। তবে শব্দটা আর শুনতে পেলেন না। আগের মতই নৈঃশব্দ্যের একটা চাদরে ঢাকা পড়ল গোটা বাড়ি। চেয়ারে ঠেস দিলেন আবারও। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা খুলে ওই তরুণী সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রেমিকার প্রতি বিশ্বস্ততায় কোন খাদ নেই লিণ্টনের। কিন্তু এই রহস্যময় নারীর প্রতি অপ্রতিরোধ্য একটা আকর্ষণকে দমন করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে তাঁর জন্য। এই মুহূর্তে মাদাম ভারতেয়োল্লির ডিজাইন করা আধুনিক একটা পোশাক গায়ে চাপিয়েছে সে। তাকে এতটাই সুন্দর লাগছে যে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মত তাকে দেখতে লাগলেন।
‘কী, লিণ্টন,’ হেসে সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে কোঁকড়ানো চুলগুলো একটু ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আমার মধ্যে কি কিছু দেখতে পাচ্ছ? ও, একটা কথা, কয়েক মিনিট আগে কি একটা শব্দ শুনতে পেয়েছ?’
‘আমার মনে হয়েছিল কেউ একজন ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল। পরে মনে হলো, না, তন্দ্রায় বোধহয় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।’ জবাব দিলেন লিণ্টন।
‘না, তুমি সত্যি শুনেছ। ওটা আমি,’ নারীটি জানাল, ‘আমাদের পাজি বিড়ালটা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে, দেখো।’ বলে একটা হাত তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল। ওটার পেছনে লাল, লম্বা একটা দাগ নজরে পড়ল লিণ্টনের। কেন যেন কেঁপে উঠলেন যুবক। যে কোন ধরনের রক্ত দেখলেই গা ছমছম করে ওঠে তাঁর।
‘কী ভয়ঙ্কর!’ বললেন লিণ্টন, ‘আশা করি ওটাকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিতে পেরেছ।
‘আরে, না। ধরতেই পারিনি। তবে একবার না একবার ঠিকই ধরা খাবে। সবসময় কাউকে না কাউকে আক্রমণ করবেই ওটা। কাল না পরশুই তো রাঁধুনিকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। এখন আর এসব কথা নয়। সাপারের সময় হয়েছে, চলো!’
হল পেরিয়ে ডাইনিঙে ঢুকল তারা। দু’জনের জন্য একটা টেবিল সাজানো হয়েছে সেখানে। এই সময়টার কথা কখনও ভুলবেন না লিণ্টন। কোঁকড়া চুলের ওই নীলনয়নার থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই পারছিলেন না। যখন দৃষ্টি সরিয়েছেন তখনও নরম হাত, লম্বা আঙুল-নখ আর হাতেরই সাদা চামড়ার মাঝে সেই লাল আঁচড়টার দিকেই তাকিয়েছেন। মেয়েটার দিকে এতটাই মনোযোগ ছিল কী খেয়েছেন বলতে পারবেন না। নিজেকে অ্যালকোহলবিদ্বেষী বলে পরিচয় করিয়ে দিলেও আজ রাতে তরুণী যা-ই সামনে দিয়েছে গিলেছেন। একসময় শেষ হলো খাওয়া। তাঁর দিকে ঝুঁকে এল মেয়েটা। সুন্দর চোখজোড়ায় দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ লুকানো আছে আমার হাতায়। দেখতে চাও?’
‘অবশ্যই,’ জবাব দিলেন লিণ্টন। 1
‘তাহলে চলো,’ এই বলে চেয়ার থেকে উঠে পথ দেখাল। তবে তার পিছু নিয়ে এগুতে লিন্টনের বেশ বেগ পেতে হলো। মাত্রাতিরিক্ত ওয়াইনের প্রতিক্রিয়া। রীতিমত টলছেন তিনি। হল অতিক্রম করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা সিঁড়ির সামনে থেমে দাঁড়িয়ে মেয়েটা বলল, ‘এখানে কি একটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারবে? আমি গিয়ে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা।’ তারপর অদৃশ্য হলো মেয়েটা। আবার একা লিণ্টন। কৌতূহল নিয়ে চারপাশে তাকালেন। কেমন কু গাইছে মনে। এই মহিলা কি তবে এই বাড়িতে একাই থাকে? চাকর-বাকরদের ব্যাপারে বলা কথাটা কি সত্যি! আর অন্য একজনের কথা বলেছে সে-ই বা কোথায়? দেয়ালের একটা কুলুঙ্গিতে আবলুস কাঠের ফ্রেমে আটকানো বিশাল এক গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক। এক মনে ওটার দিকে তাকিয়ে ওটার টিক টিক শব্দ শুনতে লাগলেন। এসময়ই তরুণীটি এসে তাঁকে নিয়ে একটু দূরের আরেকটা কামরায় ঢুকল। তাঁর কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘আগুনের পাশের চেয়ারটায় তোমার জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছে।’ কথা বলার সময় তার শ্বাসের গন্ধ তাকে রীতিমত আচ্ছন্ন করে ফেলল। মেয়েটা তাঁর আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়লেন যে জড়িয়ে ধরে কোমলভাবে কয়েকটা চুমু দিলেন। কয়েক সেকেণ্ডে লিণ্টনের বাহুবন্ধনে আটকা থাকল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ জোর করে ছাড়িয়ে নিল। তারপর হাসতে হাসতে তাঁর গায়ে টোকা দিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেল, যাবার সময় দরজাটা ধাক্কা দিয়ে গেল।