আসলে শিল্পী হিসাবে কদর থাকলেও এটা দিয়ে টাকা কামিয়ে বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু প্রেমিকার কথা চিন্তা করে এখন অর্থ-কড়ির কথা ভাবতে হচ্ছে তাঁকে। চিরকুমার বড়লোক চাচা যদি একটু এই তরুণ ভাতিজার কথা ভাবেন তবেই রক্ষা। আর চাচার কথা ভাবতে ভাবতে পাইপ টানতে টানতে, কখন চেয়ারে হেলান দেয়া অবস্থায় একটু তন্দ্ৰামত চলে এল বলতেই পারবেন না। এসময় একটা শব্দে তন্দ্রা টুটে গিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। স্টুডিয়োর দরজায় একটা করাঘাতের আওয়াজ। হতভাগাটা কে! বিরক্ত হয়ে ভাবলেন লিণ্টন। বাড়ির ঝি তো চলে গেছে আগেই। এখন তো সামনের বেলটা না বাজিয়ে কারও ভেতরে ঢুকতে পারার কথা নয়।
‘ভেতরে এসো,’ বললেন।
তারপরই বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলেন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে আধুনিক সাজসজ্জার এক তরুণী। জামাটা ঘন নীল, স্কার্ট খুব ছোট, কোটটা জাঁকালো, তাতে চমৎকার সব বোতাম শোভা পাচ্ছে। উঁচু হিলের চামড়ার জুতো পায়ে। মুখে মোহনীয় হাসি। হাসিটা ভালভাবে দেখতে পেলেন কারণ ওই মুহূর্তে হঠাৎ আগুনের শিখাটা বেশি করে জ্বলে উঠে তার মুখে পড়ে আলো। এমন এক চেহারা যেটা একজন এক পলকের জন্য দেখলেও সহজে ভুলবে না। নাকটা একটু বাঁকা, ভরাট স্তনদুটো যেন কাপড়ের শাসন মানতে চাইছে না, চোখের পাপড়ি ঘন। তবে লিন্টনকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল তরুণীর চোখজোড়া। গভীর চোখদুটো নীল, এর মধ্যে এমন একটা প্রাণবন্ত ভাব আছে যা আগে কখনও দেখেননি তিনি। তবে দৃষ্টিতে কেমন একটা অস্থিরতা আছে। সব কিছু মিলিয়ে এই সৌন্দর্য তাঁকে রীতিমত টানতে লাগল। চোখজোড়ার মোহনীয় ক্ষমতায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন যে, মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত কথা শুরু করল মেয়েটাই।
‘যাক, তোমাকে পেয়ে গেলাম। আর তুমি তো কাজও করছ না।’
কিছু বলার আগে আরেকবার তরুণীর দিকে তাকালেন। হাতের আঙুলে বেশ কয়েকটা আংটি শোভা পাচ্ছে। নখগুলো লম্বা, একটু বাঁকা, সেখানে আগুনের শিখা পড়ে ঝকমক করছে।
‘কিন্তু তুমি ঢুকলে কীভাবে?’ বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলেন লিণ্টন।
‘বেল বাজিয়ে,’ হেসে জবাব দিল তরুণী, ‘এটা খুব সহজ। অন্য কোন দিন বলব। এখন চলো আমার সঙ্গে। তোমাকে নিতে এসেছি।’
‘আমাকে নিতে!’ হতবাক লিণ্টন রীতিমত হাঁসফাঁস কণ্ঠে বললেন। ভালভাবে চোখ রগড়ে দেখলেন, না এটা স্বপ্ন নয়।
‘হ্যাঁ, ভুল শোনোনি। তোমাকে নিতে। দ্রুত হ্যাট আর কোট তুলে নাও। দোরগোড়ায় গাড়িটা অপেক্ষা করছে।’
রহস্যময় এই নারীর কথামত কাজ করতে শুরু করায় নিজেই অবাক হয়ে গেলেন লিণ্টন। কে সে? তাঁকেই বা কেন নিতে এসেছে? এটা জিজ্ঞেস করার বদলে তার মোহনীয় চোখের জাদুতে যেন রীতিমত সম্মোহিত হয়ে গিয়েছেন।
‘ঠিক আছে,’ বললেন লিন্টন। তারপর কোটটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি আসছি। যাচ্ছি কোথায়?’
‘কেন, বাসায়,’ হেসে জবাব দিল নারীটি। ‘মনে হয় যেন তুমি কিছু জানো না। একজন মানুষ তোমাকে দেখতে পাগল হয়ে গিয়েছে। আমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিচ্ছিল না। শেষমেশ প্রতিজ্ঞা করলাম গাড়ি নিয়ে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। দুঃখজনক হলেও তোমার বাড়িতে ফোন নেই।’
‘আশা করি শীঘ্রিই আনতে পারব,’ কুণ্ঠার সঙ্গে বললেন লিণ্টন, ‘সত্যি বলতে, যখন ওটার খরচ পোষাতে পারব।’
‘পোষাতে পারবে!’ তার কথার প্রতিধ্বনি তুলল নারীমূর্তি, ‘তোমার চিত্রকর্মগুলোই যথেষ্ট। এগুলো দিয়েই টাকার পাহাড় বানাতে পারো। এখন জলদি চলো, তুমি বড্ড ধীর।’
বাড়ির দরজায় সত্যি একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল। তবে ভাড়া করা। সঙ্গীর সঙ্গে বিনা দ্বিধায় তাতে চেপে বসলেন লিন্টন।
গাড়ি চলতে শুরু করল। একটা রাস্তা ছেড়ে আরেকটা রাস্তায় ঢুকে পড়ছে ওটা। গ্যাসের ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় ভেতরটা আলোকিত। কিলবার্নের ভেতরই আছে তারা। সব কিছুই বাস্তব। একই সঙ্গে আবার কেমন জানি ধোঁয়াটে লাগছে তাঁর কাছে। তাঁর সুন্দরী সঙ্গী একটু পর পরই তার ছোট্ট, নরম হাত লিণ্টনের হাতের ওপর রাখছে। ভঙ্গিটা এমন যেন, বহু দিনের বন্ধুত্ব দু’জনের। আশ্চর্য হলেও লিন্টন উপভোগই করছেন। মনে হচ্ছে মেয়েটির তাঁকে নিতে আসা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও তিনি তার নামও জানেন না, এমনকী তাকে কখনও দেখেছেন এটাও মনে পড়ছে না। একপর্যায়ে বড় একটা স্কয়ারের এক কোনার একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটি। নিঃসন্দেহে সমাজের অভিজাত লোকেরাই বাস করেন এখানে।
গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে তরুণী তাকে অনুসরণ করার ইশারা করল লিন্টনকে। কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠে চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল, তারপর ভেতরে ঢুকল। লিন্টন তার সঙ্গে ভেতরে পা রাখতেই অদ্ভুত একটা নৈঃশব্দ্য চেপে ধরল তাঁকে। সব কিছু অদ্ভুত রকম সুনসান। মেয়েটা প্রতি কদম ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল বাড়িটায় তার হিলের শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছে। তবে বাড়িটা চমৎকারভাবে সাজানো-গোছানো। কোথায় যেন একটা অসামঞ্জস্য আছে বুঝতে পারছেন না।
তাঁর চিন্তা বুঝতে পেরেই যেন সে বলে উঠল, ‘আশা করি তুমি মাফ করবে আমাকে। বাসাটা অতিরিক্ত চুপচাপ লাগছে। রাঁধুনির বোনের বিয়ের পার্টিতে যেতে চাকর- বাকরেরা এতটাই চেপে ধরল মানা করতে পারিনি।’