ফুলানিদের দেখে মনে হলো সাদা মানুষের এই আচরণে খুব মর্মাহত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক বুড়ো বলল, ‘হুজুর, তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওটা মোটেই হায়েনা নয়। তাহলে গরুদুটোকে তাড়িয়ে বেড়ার ওপাশে রেখে আসত না। কুরগ্রামের ক্যাকটাসের বেড়া ঘেরা খোঁয়াড়টায় সেখানে এখন ঘাস খাচ্ছে আমাদের গরুদুটো। ওটা মোটেই হায়েনা ছিল না, ছিল মায়াবী এক মানুষ।
‘যদি কুরগ্রামের লোকেরা গরুদুটি চুরি করে থাকে তবে অবশ্যই ওদের শাস্তি হবে। কিন্তু ছেলেটার মৃত্যুর সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। এটা হায়েনার কাজ। আমি গ্রামে পুলিস পাঠাব গরুর খোঁজে।’
ফুলানিদের মোটেই খুশি মনে হলো না স্মিথের বিচারে। তবে মুখে বেশি একটা প্রতিবাদ করল না। একজন বলে ফেলল, ‘হুজুর, তুমি কি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে? হায়েনাই যদি নাটের গুরু হবে তবে গরু ফেলে মানুষ শিকারে নামল কেন?’
স্মিথ কোন জবাব দিলেন না। সত্যি বলতে বিষয়টা তাঁর মনেও খচখচ করছিল। একসময় হতাশ ফুলানিরা চলে গেল।
তবে কথামত পরদিন কুরগ্রামে একজন কর্পোরালের নেতৃত্বে চার পুলিস পাঠালেন। হঠাৎ তাদের আগমনে হকচকিয়ে গেল কুরগ্রামের বাসিন্দারা। তারা গরুগুলো সরানোরও সময় পেল না। ধরা পড়ার পর বলল ওগুলো এমনি এমনি ক্যাকটাসের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু গরুদুটোকে ওই বেড়া থেকে বের করে আনতে লাগল পাক্কা আধ ঘণ্টা। এতেই পরিষ্কার হয়ে গেল ওগুলো মোটেই একাকী ওখানে যায়নি। এদিকে স্মিথের কড়া নির্দেশ ছিল কর্পোরালের প্রতি চোরকে ধরে আনতে হবে। না পারলে হাতকড়া পড়বে গ্রামের সর্দারের হাতে। পুলিসরা গোটা গ্রাম তল্লাশি চালাল, কিন্তু কে চুরি করেছে বুঝতে পারল না। একপর্যায়ে হন্তদন্ত হয়ে সর্দার হাজির হলো। শুকনো শরীর, পাঁজরের হাড় গোনা যাবে। বয়স অন্তত তিন কুড়ি। সঙ্গে বেশ শক্তপোক্ত, কঠিন কয়েকজন যুবক। সব ঘটনা শুনে সর্দার যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল সে এসব বিষয়ে কিছু জানে না। কর্পোরালের মনে হলো আসলেই সে কিছু জানে না। তলে তলে কলকাঠি নাড়ছে অন্য কেউ। এই বুড়োকে শুধু শো হিসাবে সর্দার করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কী আর করা! কর্পোরাল মুসা গোমবি সর্দারকে হাতকড়া পরিয়ে রওয়ানা হলো। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেল চোরকে হাজির করা না হলে সর্দারকে থাকতে হবে কয়েদখানায়।
স্মিথের আস্তানায় আচ্ছাসে জেরা করা হলো সর্দারকে। একটা শব্দও বের করা গেল না তার মুখ থেকে। স্মিথের মনে হলো গোটা গ্রামে এই ঘটনা সম্পর্কে এই বুড়োই বুঝি বা সবচেয়ে কম জানে। সবচেয়ে অবাক ঘটনা, সর্দারকে ছাড়িয়ে নিতে কুরগ্রামের একজন লোকও এল না।
তবে এতেই দমে গেলেন না স্মিথ। নতুন বুদ্ধি বের করলেন। পুলিসের মারফত গ্রামবাসীদের জানালেন গরু যেহেতু তাদের গ্রামে পাওয়া গেছে তাই দণ্ড তাদের হবেই। শাস্তি হিসাবে দশটা ঘোড়া, একশো ছাগল এবং এবারের শস্যের একটা অংশ দিয়ে দিতে হবে। এবার সত্যি টনক নড়ল কুরগ্রামের লোকদের। সর্দারের জন্য তাদের মন একটুও না পুড়লেও জরিমানার কথা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কয়েকজনকে পাঠাল স্মিথের ক্যাম্পে। তারা এসে বেশ নরমভাবেই বলল এই চুরির পেছনে তাদের কোন ভূমিকা নেই। সাহেব কেন তাদের ওপর জুলুম করছেন! স্মিথ বললেন তাহলে তারা আসল চোরকে ধরিয়ে দিক। এবার তারা একজন আরেজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। স্মিথ বুঝলেন একটা ঘাপলা আছে। চেপে ধরলেন। এবার স্বীকার করল সব কিছুই তারা জানে। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিল না এতদিন। গ্রামের এক পাশে থাকে ‘জু জু’ নামের এক লোক। তাকে সবাই ভয় পায়। সে-ই সব কিছু করছে। দিনে মানুষ থাকলেও রাতে অসম্ভব ক্ষমতাধর এক হায়েনায় নিজেকে পরিণত করতে পারে এই মায়াবী। তার বিরুদ্ধে কিছু বললেই প্রাণ যাবে তাই এতদিন সাহস করেনি তারা। স্মিথ দেখলেন কুরগ্রামের লোক এবং ফুলানিদের কথা মিলে যাচ্ছে। মায়াবীকে ধরে আনার জন্য পুলিস পাঠালেন। তিন দিনের মধ্যে ধরে স্মিথের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো তাকে।
লোকটাকে দেখে রীতিমত থ হয়ে গেলেন স্মিথ। এ কাকে দেখছেন! মনে হচ্ছে প্রাচীন যুগের কোন গুহামানব বুঝি বা এ যুগে হাজির হয়েছে। গায়ের রং কালো। তবে চোখগুলো নীলাভ। দ্যুতিহীন। আলো সহ্য করতে পারছিল না, পিট পিট করছিল। পেশীবহুল শরীর। গা লোমে ভর্তি বারবার চেষ্টা করছিল ছুটে পালাতে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। স্মিথের দেখেই মনে হলো এ হয়তো এসব কিছু করেনি। গ্রামের লোকেরা আধা মানুষ-আধা জন্তুটাকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। তারপরও কয়েকদিন এখানে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এসময় স্মিথের বন্ধু অস্টারস্টকও উপস্থিত ছিলেন ক্যাম্পে। তিনিও অদ্ভুতদর্শন মানব-জন্তুটাকে দেখে চমকে উঠলেন। স্মিথ নানা ধরনের প্রশ্ন করলেন। একটারও উত্তর দিল না লোকটা। মুখ দিয়ে কেবল লালা গড়াচ্ছিল তার। অতএব কিছু খাবার দিয়ে আটকে রাখা হলো তাকে গোলাকার একটা মাটির ঘরে। খড়ের ছাদ, মাঝে শক্ত তালগাছের খুঁটি। দরজাটা তালাবদ্ধ। বাইরে অস্ত্র হাতে এক প্রহরী রাখা হলো। রাতে কয়েদখানায় উঁকি মেরে স্মিথ আর অস্টারস্টক দেখেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে মানব-জন্তুটা। পানি খেলেও খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। তার গা থেকে বের হওয়া বিকট গন্ধে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর হয়ে পড়ল দু’জনের পক্ষে। তাড়াতাড়ি আবার তালা আটকে বের হয়ে এলেন দুই বন্ধু।