যা হোক, স্টুয়ার্ট স্মিথের অধীনে আছে বারোজন কনস্টেবল এবং একজন কর্পোরাল। স্টুয়ার্টের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে এখানে কাজ করতে আসা মাইনিং কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার অস্টারস্টকের। এক নদীর তীরে টিনের সন্ধানে খনন কাজ চালাচ্ছেন অস্টারস্টক। বিকাল হলেই দেখা যায় অস্টারস্টক হাজির হয়েছেন স্মিথের বাংলোয়। তারপর দু’জনে মেতে উঠতেন গল্প-গুজবে। এরকমই একদিন আলাপের সময় স্মিথ বললেন, ‘এখানে আসার পর একটা অদ্ভুত গুজব শুনলাম স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে। সন্ধ্যা নামলে অন্ধকারে বেরোতে সতর্ক করে দিল তারা। বলল বেরোলেই সমূহ বিপদ। সাধারণ হায়েনার পাশাপাশি শিকারে বের হয় হায়েনা-মানবেরা। গ্রামেরই কয়েকজন লোক জাদুমন্ত্রবলে হায়েনায় রূপান্তরিত হয়। তারপরই একটা ঘটনা ঘটল। একটা কাজে বের হয়েছি। বেলা শেষ হয়ে আসায় গাঁয়ের কাছেই তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিলাম ভৃত্যদের। রাত্রে খাওয়া শেষে শুতে যাওয়ার পরেই দুটো হায়েনা হাজির হলো তাঁবুর কাছে। ওদের চিৎকারে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। আমরা ঘুমালেই হামলা করার ফন্দি-ফিকির করছে মনে হয়। তাই বের হয়ে এসে দুই গুলিতে দুটোকেই মেরে ফেললাম।
‘ভোরে ঘুম ভাঙল এলাকাবাসীর চেঁচামেচিতে। রাতের ঘটনা তারা জানতে পেরেছে। লোকগুলোর ধারণা এই হায়েনাদুটো আসলে হায়েনা-মানব। তারা তাদের গাঁয়েরই লোক। আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম লোকগুলোর কথা। কিন্তু
মানল না। এবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাতেও কাজা হলো না। সকালবেলা যখন সবার ঘুম ভাঙল গাঁয়ের লোকেরা মাথা গুনে আবিষ্কার করল সবাই আছে। এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। তবে গোঁ ধরল হায়েনাদুটো কাছের অপর কোন গ্রামের লোক।’
স্মিথ ভেবেছিলেন তাঁর কথা শুনে অস্টারস্টকের পিলে চমকে উঠবে। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবে নিলেন। ‘আরে, এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? এসব এলাকায় এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা নেই। তুমি কি নেকড়েমানবের কথা শোনোনি? চোখ-কান খোলা রাখো, আরও অনেক কিছুই জানতে পারবে।’ এই বলে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন অস্টারস্টক। তিনি এই এলাকায় আছেন বেশ ক’বছর ধরে। অনেক কিছুই তাঁর নজরে পড়েছে। স্থানীয় আদিবাসীদের কথাও তাই হেসে উড়িয়ে দিতে পারেননি।
এরপর মাস দুয়েক তেমন কোন ঘটনা ঘটল না। তারপরই একদিন স্মিথ তাঁবু ফেললেন কুরগ্রাম নামের একটি গাঁয়ের ধারে। স্মিথের বাংলো থেকে চার মাইলটাক দূরের এই গ্রামটি পাহাড়ের লাগোয়া। আকারেও বেশ বড়। গ্রামের চারধারে ক্যাকটাসসহ নানা জাতের কাঁটাঝোপের বেড়া। এখানকার অনেক গ্রামেই এটা চোখে পড়ে। বাইরের লোককে দূরে সরিয়ে রাখাই লক্ষ্য। মোটামুটি হাজারখানেক লোক বাস করে গ্রামটিতে। অসভ্য অধিবাসীদের শরীরে কাপড়-চোপড়ের বড্ড অভাব।
স্মিথ এখানে এসেছেন ট্যাক্স আদায়ের জন্য। ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে মাথা প্রতি এক শিলিং। এই টাকাটা ব্যয় করা হবে রাস্তা তৈরিতে। শুরুতে চলল লোক গোনার কাজ। এর মধ্যেই একদিন একদল ফুলানি হাজির হলো। এই জাতের লোকেরা শ্বেতাঙ্গদের রীতিমত দেবতাজ্ঞান করে। শ্বেতাঙ্গদের প্রভাব বেশি যেসব এলাকায় সেসব এলাকায় থাকা তাদের পছন্দ। কাঁদতে কাঁদতে স্মিথের পায়ের কাছে ময়লা কম্বলের একটা পুঁটলি রেখে বলল, ‘হুজুর, আমাদের বড় বিপদ। রক্ষা করেন।’
এদিকটায় গরু চুরির ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। আর ফুলানিরা দক্ষ পশু-পালক। বলা চলে গরু-মোষ পেলেই এরা জীবনধারণ করে। শুরুতে স্মিথের তাই মনে হলো গরু চুরির বিচার চাইতে এসেছে এরা। কিন্তু একটু পরেই পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা আরও অনেক ভয়ানক। পুঁটলিটা খুলতেই চোখ আটকে গেল স্মিথের। আরে, এখানে তো পনেরো-ষোলো বছরের এক কিশোরের মৃতদেহ। গলায় গভীর একটা ক্ষত। দেখে মনে হয় কিছু একটা কামড়ে নিয়ে গেছে খানিকটা মাংস। এটা আর যা-ই হোক বর্শা বা অন্য কোন অস্ত্রের আঘাতে হয়নি। স্মিথের মনে হচ্ছে কোন বন্যপ্রাণীর আক্রমণে এই হাল হয়েছে হতভাগ্য ছেলেটার। তাঁর কাছে কাঁদতে কাঁদতে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইল সবাই। গোটা ঘটনাটা খুলে বলতে বললেন তাদের।
তারা যে কাহিনী বলল তা বেশ অদ্ভুত। দুই দিন আগের এক সন্ধ্যা। অন্য গরুগুলো ফিরে এলেও দুটি গরুর কোন হদিস নেই দেখে ওই ছেলেটাকে পাঠানো হলো ওগুলোর খোঁজে। এমনিতে সে বেশ সাহসী। কিন্তু একটু পরই ফিরে এল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। বলল একটা হায়েনা তাকে অনুসরণ করেছিল। শুধু তাই না কোনভাবেই তাড়াতে পারছিল না। ওটার মধ্যে অশুভ একটা কিছু আছে। গ্রামের লোকেরা ছেলেটার কথায় কান না দিয়ে ইচ্ছামত গালমন্দ করল তাকে। বলল, হায়েনা একা একা মানুষের ধারে-কাছে ভিড়তে ভয় পায়। এই ভীতু প্রাণীটার ভয়ে তার মত এক যুবক কিনা পালিয়ে এসেছে। অতএব ছেলেটা কী আর করবে, আবার গেল ওই গরুদুটির সন্ধানে। তবে চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ভয়ে কাঠ হয়ে আছে।
ওই দিন ছিল অমাবস্যা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যে একটু পর পর হায়েনার ডাক শুনতে পেল ফুলানিরা। এদিকে ছেলেটার কোন খবর নেই। রাতে আর ফিরলই না সে। যেমন খোঁয়াড়ে এল না গরুগুলো।
ভোর হতেই কয়েকজন বেরিয়ে পড়ল ছেলেটা এবং গরুদুটির খোঁজে। একটু পরই ছেলেটার পায়ের ছাপ চোখে পড়ল দলটির। একপর্যায়ে পেল গরুর ছাপও। এখান থেকে জন্তুগুলোকে পেয়ে তাঁবুর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে তরুণ। একটা জায়গায় বেশ বিশৃঙ্খলা হয়েছে মাটির চিহ্ন দেখে তা বোঝা গেল। এর একটু দূরে ঝোপের মধ্যে পাওয়া গেল ছেলেটার মৃতদেহ। গলার একটু মাংস খেয়ে নিয়েছে কিছু একটা। আশ্চর্য ঘটনা, সেখানে গরু বাদে আর কোন জন্তু- জানোয়ারের পদচিহ্ন নেই। তবে কয়েকটা জায়গায় গরুর পেছনে হায়েনার ছাপ দেখে বোঝা গেল গরুগুলোকে সে অনুসরণ করেছিল। স্মিথ বেশ চমকে উঠলেন। একাকী কোন হায়েনা একজন মানুষকে আক্রমণ করার কথা নয়। এদিকে গরুগুলোর পায়ের ছাপ দেখেও এমনটা মনে হচ্ছে না এরা ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে। ফুলানিরা তার কাছে কী চায় বুঝতে পারলেন না। কী কারণে এসেছে জানতে চাইলেন।.