সে চোখ বড় বড় করে যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না উইলিয়ামের। একবার ভাবল সে কি তবে কোন মস্করা করল?
‘একটা লোককে তো তুমি দেখতেই পার। জাহাজে একজন নয় অনেকেই আছে। এমনকী নতুন লোকও তোলা হয়েছে। এদের সবাইকে তুমি ভালমত চেন, এডমণ্ড।’ এই বলে হেসে উঠল। ভাবল তার সঙ্গী যদি মজা করে থাকে তবে তারও একটু ঠাট্টা করতে দোষ কোথায়!
‘উইল, আমি যাকে দেখেছি সে আমাদের কোন ক্রু নয়। ভয়াবহ এক জিনিস ওটা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ডেকের এক গজ ওপরে, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখগুলোও স্বাভাবিক ছিল না। মনে হচ্ছিল অশুভ, ভয়ঙ্কর একটা কিছু ছিল ওগুলোতে।’ কাঁপতে কাঁপতে বর্ণনা দিল এডমণ্ড।
এডমণ্ডের বর্ণনা আর কাঁপা কণ্ঠস্বর শুনে উইলিয়াম বুঝতে পারল মোটেই ঠাট্টা করছে না তার সঙ্গী। একটা অতৃপ্ত আত্মা জাহাজে হাজির হয়েছে এটা বুঝে নিতে কষ্ট হলো না তার। অভিজ্ঞ দুই নাবিকের জানা আছে লক্ষণটা মোটেই শুভ নয়। মুখহীন, জ্বলতে থাকা দুই চোখের হুড পরা এক কাঠামো ওটা, যেটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত বহন করছে। নিশ্চিতভাবেই মৃত কোন মানুষের আত্মা। দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে!
তাদের চিৎকার ও উচ্চস্বরে আলাপ জাহাজের বেশিরভাগ ক্রুকে জাগিয়ে দিল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে এই ভুতুড়ে অবয়ব দেখা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা জাহাজে।
হৈ চৈ, চিৎকার ধীরে ধীরে একটু কমে আসতে শুরু করেছে, এসময় জাহাজের সবচেয়ে কমবয়স্ক নাবিকটি পিঠে একটা স্পর্শ টের পেল। ধীরে ধীরে মাথা ঘোরাল সে। যদি ভাবত তার কোন সিনিয়র সহকর্মী আশ্বস্ত করার জন্য হাত দিয়েছে পিঠে তাহলে হতাশ হতে হত তাকে। কারণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হুড পরা লম্বা এক ছায়ামূর্তি। চিৎকার করার চেষ্টা করল তরুণ, আতঙ্কে শব্দ বেরোল না গলা থেকে। ভয়ার্ত চোখে নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল কালো আলখেল্লা গায়ে চাপানো ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে দূরে সরে পড়তে লাগল। ওটার কমলা জ্বলজ্বলে চোখজোড়া এখন কেবল নজরে পড়ছে তরুণের। তার আতঙ্ক যখনই চরম শিখরে পৌঁছল সাগরের শীতল বাতাসে অদৃশ্য হলো ছায়ামূর্তি।
তবে পরের দুই দিন ও রাতে ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা ঘটল না। জাহাজও লিভারপুল বন্দরে ভিড়ল। কোন ক্রুরই মানসিক অবস্থা ভাল নেই। তবে ভয়াবহ ওই অশরীরী চেহারা দেখানোর পরও যে তারা বেঁচে ফিরতে পেরেছে এজন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল তারা।
একমুহূর্ত দেরি না করে জাহাজ ত্যাগ করল ক্রুরা। এদের একজনও আর ফিরল না জাহাজটিতে। এদিকে আশপাশের প্রত্যেকটা নাবিক তাদের মাধ্যমে রাতারাতি জেনে গেল পনাটিকের ডেকে অশরীরীর হানা দেয়ার ঘটনা। বহু অর্থের লোভ দেখিয়েও জাহাজের ক্যাপ্টেন আর একজন ক্রুকেও পেলেন না তাঁর জাহাজে কাজ করার জন্য।
কয়েক মাস ডকে পড়ে রইল জাহাজটি। তারপর মালিক আশা ছেড়ে দিয়ে বেশ নতুন অবস্থাতেই ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিলেন জাহাজটিকে। ওটার কাঠ, তক্তা ও বিভিন্ন ভাঙা টুকরো কিনে নিল পুরানো জিনিস কেনাবেচা করে এমন দোকানগুলো। সৌভাগ্যক্রমে অন্য কোন জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এগুলো কেনেনি। কারণ অশুভ কোন জাহাজের পরিত্যক্ত বস্তুর সঙ্গেও আত্মার নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমানোর ঘটনা শোনা যায়।
কালো আলখেল্লা পরা হুড মাথার ওই অশরীরীর ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির এখানেই শেষ এটা অবশ্য বলতে পারব না আমরা। হয়তো অন্য কোন জাহাজ কিংবা কয়েকটা জাহাজে হানা দিয়ে যাচ্ছে ওটা।
মায়া হায়েনা
মায়ানেকড়ের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় আছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন বাস্তবেও এদের অস্তিত্ব আছে। নাইজেরিয়ায় নেকড়ে নেই। তাই সেখানে মায়ানেকড়ে বা ওয়্যারউলফের কাহিনীও ডালপালা মেলতে পারেনি। তবে হায়েনা আছে বিস্তর। তেমনি আছে মায়া হায়েনা নিয়ে নানা কাহিনী। নাইজেরিয়ার উত্তর অংশ জুড়ে পর্বতের সারি। এ এলাকায় নানান গোত্রের লোকের বাস। এখানকার অধিবাসীরা বিশ্বাস করে, কিছু লোক জাদুমন্ত্রবলে রাত হলেই হায়েনার রূপ ধারণ করে। আর ঘটায় নানান অনিষ্ট। আজ থেকে শ’খানেক বছর আগে সেখানে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয় এক ইংরেজ সরকারি কর্মকর্তার। স্টুয়ার্ট স্মিথ নামের ওই ভদ্রলোক সেখানে চাকরিসূত্রে নিয়োগ পান। ছোট্ট একটা পুলিস বাহিনীর সহায়তায় জায়গাটিতে শান্তি বজায় রাখা ছিল তাঁর দায়িত্ব। আসলে নাইজেরিয়ায় তখন একের পর এক টিনের খনির খোঁজ মিলছে। নানান জায়গা থেকে ভিড় জমাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার, কুলি ও শ্রমিকরা। বানানো হচ্ছে রাস্তাঘাট। কুলি- মজুরদের জন্য গড়ে উঠছে একটার পর একটা বস্তি, ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য কোয়ার্টার।
এই এলাকাটির অবস্থান বাউচি মালভূমিতে। নিচ থেকে হঠাৎ তাকালে মনে হবে এটা বুঝি বা গ্রানেট পাথরের পাহাড়। কোন লোকবসতি নেই। তবে ওপরে উঠলেই বুঝবেন কতটা ভুল করেছিলেন। সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। দিনে প্রচণ্ড গরম, রাতে আবার কনকনে ঠাণ্ডা। বাউচি মালভূমি এলাকায় চিল, বাজ, শকুনসহ ছোট-বড় নানা ধরনের পাখির কোন লেখাজোখা নেই। সে তুলনায় বন্য জানোয়ারের সংখ্যা বেশ কম। খরগোশ, বিশাল সব ধাড়ি ইঁদুর আছে বেশ। বড় প্রাণীর মধ্যে পাহাড় ও পাহাড় পাদদেশের এলাকাগুলোয় চিতা বাঘ। তবে হায়েনা আছে অনেক। সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে পড়ে শিকারে। বাগে পেলে নিঃসঙ্গ পথচারীদেরও ছাড়ে না। এদের রক্ত জল করা চিৎকার অতি দুঃসাহসীদেরও বুক কাঁপিয়ে দেয়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে এই এলাকার আদিবাসীদের একটু বর্ণনা দেয়া উপযুক্ত মনে করছি। এদের শরীরে পোশাকের খুব একটা বালাই নেই। একটা সময় শ্বেতাঙ্গদের এই এলাকায় প্রবেশ ছিল নিষেধ। বিষাক্ত তীর-ধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত অনুপ্রবেশকারীদের উপর। তবে শ্বেতাঙ্গদের আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে বশ মেনেছে ইদানীং।