ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখানেই অপেক্ষা করে বাতি জ্বেলে রাখার চেষ্টা করবেন? নাকি সিঁড়ি বেয়ে নেমে মেয়ের কাছে যাবেন? মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে। ঠিক করলেন দুটোই করবেন। আপাতত পোস্ট ছেড়ে গিয়ে মেয়েটার অবস্থা একবার দেখে আসবেন।
এদিকে কোয়ার্টারে মেয়েটাও বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। তুলনামূলক নিরাপদ জায়গাটিতে অপেক্ষা করবে? নাকি বাবার খোঁজে যাবে? একপর্যায়ে সিদ্ধান্তে পৌছল এখানে বিশ্রাম নেয়ার আগে তাকে নিশ্চিত হতে হবে বাবা ভাল আছেন। মা মারা যাবার পর তিনিই তো তাকে আদর-ভালবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন। অতএব আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার মত মোটামুটি ধরনের পোশাক পরে বেরিয়ে এল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে বাবাকে খুঁজে পেল। বাতিঘরের সিঁড়ির সবচেয়ে নিচের ধাপের কাছেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল কিশোরী মেয়েটা। কী করবে সে? বাবাকে কীভাবে সাহায্য করবে? এদিকে বাতিটা জ্বেলে রাখাও খুব জরুরি, ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজগুলোকে পথ দেখাতে। বিপদ ঘটে যাওয়ার আগেই কি সাহায্য পৌঁছবে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে মেয়েটার মনের শেষ প্রশ্নের উত্তর ছিল না। পরিস্থিতি শান্ত হতে মোটামুটি এক হপ্তা লাগল। কেবল তখনই অনুসন্ধানী দল পাঠানো হলো বাতিঘরের রক্ষক এবং তাঁর মেয়ের অবস্থা জানতে। কংক্রিটের সিঁড়ির শেষ ধাপে পড়ে হার্ট অ্যাটাকের শিকার বাতিঘররক্ষক মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। পরে মারা যায় তাঁর আদরের ধন একমাত্র মেয়েটিও। বাবার মৃতদেহের পাশেই পাওয়া যায় মেয়েটার নিস্পন্দ দেহ। কীভাবে সে মারা গেল এটা এক রহস্যই রয়ে যায়। বাবা-মেয়েকে ব্যক্তিগতভাবে চিনত এমন লোকদের ধারণা বাবার মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না পেরেই মারা গিয়েছে মেয়ে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাবার আত্মাটা শান্তিতেই তার শেষ গন্তব্যে চলে যায়। কিন্তু মেয়েটার আত্মা বছরের পর বছর ধরে এলাকাটাতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। যখন তার মৃতদেহ উদ্ধার করে লোকেরা তখন যে পোশাক পরনে ছিল, পরে ওই পোশাকেই দেখা যায় মেয়েটার আত্মাকে। একটা ঝড় এগিয়ে এলে তবেই দেখা দেয় কিশোরীর প্রেতাত্মা। টাওয়ারের দিকে এগিয়ে আসা লোকেদের দিকে দৌড়ে যায় তার স্বচ্ছ কাঠামোটা। হাত নেড়ে কাছাকাছি আসতে নিষেধ করে। তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়।
এক রাতের ঘটনা। প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস এবং বৃষ্টি হচ্ছে। এসময় বাতিঘরের ধারের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকা এক দম্পতি এক কিশোরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাস্তার পাশে। তাকে গাড়িতে তুলে নেয় ওই দম্পতি। গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়ে মেয়েটা। স্বামী যখন গাড়ি চালাচ্ছে তখন মহিলাটি পেছন ফেরে মেয়েটাকে কোথায় নামিয়ে দেবে জানতে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। অথচ কেবলই বৃষ্টিভেজা ওই মেয়েটাকে গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে জায়গা দিয়েছে তারা। এতটাই ধাক্কা খায় ওই দম্পতি তখনই রাস্তার পাশে দাঁড় করানো হয় গাড়ি। পেছনের আসনে উঠে পড়ে ভদ্রলোক মেয়েটার খোঁজে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। তবে পেছনের সিটের একটা অংশ ভেজা।
হতভাগা মেয়েটা ওই রাতের ঘটনায় এতটাই আঘাত পায় যে তার আত্মা শান্তি পায়নি। তবে তার এই অস্থিরতা অন্যদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে আসছে মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর থেকে।
জাহাজে অশরীরী
সাগরে বিচরণ করা নাবিকেরা নানা ধরনের বিষয়কে অশুভ বা মন্দভাগ্যের সঙ্কেত হিসাবে দেখে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত বিষয়টি হলো, কোন জাহাজে যদি প্রেত বা ভূত দেখা যায় ওই জাহাজটির আর ভাল কোন কিছুই ঘটবে না। যখন কোন একটা জাহাজের গায়ে ভুতুড়ে তকমা লাগে তখন কোন নাবিকরাই এতে কাজ করতে চায় না। এমনকী কখনও কখনও এ ধরনের জাহাজকে বেশ নতুন এবং আরও বহু বছর সাগরে চলাচলের উপযোগী থাকার পরও ধ্বংস করে দিতে হয়েছে মালিককে।
এবার আমরা যে জাহাজটির কাহিনী শোনাতে যাচ্ছি তার নাম পনাটিক। ওটার হোম পোর্ট ছিল ইংল্যাণ্ডের লিভারপুল। ১৮৬৩-র আগ পর্যন্ত এখান থেকে দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত বন্দরগুলোয় নিয়মিতই যাওয়া-আসা করত। বেশ কয়েক বছর এই সাগরযাত্রাগুলো চলে নির্বিঘ্নে। তো একবার ফিরতি যাত্রার সময় ক্যাপ্টেন আবিষ্কার করেন তাঁর জাহাজে লোক সঙ্কট আছে। লিভারপুলের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার আগে কয়েকজন লোক নিয়োগ দেয়া জরুরি। পেরুর ক্যালাওয়ের ডকগুলোতে ঘুরে তিনজন লোক পেয়ে গেলেন যাদের পছন্দ হয়েছে তাঁর, আবার তারাও কিছু আয়- রোজগারের সুযোগ হাতছাড়া করল না। ক্যাপ্টেন নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলেন, ‘যাক, বাবা, এবার আর যাত্রা করতে কোন সমস্যা হবে না। ভ্রমণটাও মনে হয় ভালই হবে।’
কিন্তু পরের দিন আর রাতগুলো প্রমাণ করল ক্যাপ্টেনের অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। এক পরিষ্কার, চন্দ্রালোকিত রাতে ঘটনার শুরু। বেশিরভাগ নাবিক ঘুমিয়ে আছে। কেবল পনাটিকের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দু’জন ক্রু জাহাজকে ঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্বে আছে। তাদের একজন উইলিয়াম, ডেকে রুটিন টহল দিচ্ছে। এসময় হুইলে থাকা এডমণ্ড রক্ত জল করা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে টহল বাদ দিয়ে উইলিয়াম যত দ্রুত সম্ভব তার সঙ্গী যেখানে আছে সেদিকে ছুটল। ঘটনাটা কী জিজ্ঞেস করার আগেই এডমণ্ড চিৎকার করতে লাগল, ‘একটা লোক, জাহাজে একটা লোক!’