অস্বাভাবিক নীরবতা, গাঢ় অন্ধকার এবং ভুতুড়ে এই স্থিরতার সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন ডার্কির মনে হলো চারপাশে একটা পরিবর্তন অনুভব করতে এবং দেখতে পাচ্ছেন। ‘আমার মন কি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ডার্কি সাগর সম্পর্কে খুব অভিজ্ঞ এক মানুষ। নিজেকে শান্ত করলেন। জাহাজ এবং এর নাবিকদের নিরাপত্তা নির্ভর করছে তাঁর ওপর। স্পাইগ্লাসটা চোখে দিয়ে চারপাশের অন্ধকারের রাজ্যে কিছু ঠাহর করা যায় কিনা বোঝার চেষ্টা করছেন।
ওখানে ওটা কী? চমকে উঠলেন। ফুট পঞ্চাশেক দূরে সাগরের পানিতে একটা আলোড়ন দেখা যাচ্ছে।
কয়েক সেকেণ্ড পরেই চারপাশে একটা শীতল ঘূর্ণি বাতাসের উপস্থিতি টের পেলেন। এদিকে সাগরের ওই অংশটার পরিস্থিতিও যেন আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। ধূসর একটা কুয়াশা তৈরি হয়েছে সেখানে। আশ্চর্য একটা বিষয় নজরে পড়ল তাঁর টেলিস্কোপ, গ্লাসটায় চোখ লাগাতেই। কুয়াশা স্বচ্ছ হয়ে গিয়ে ওপাশে আরেকটি জাহাজের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছে। ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে।
ক্যাপ্টেন উন্মত্তের মত চিৎকার করে নাবিকদের একের পর এক নির্দেশ দিতে লাগলেন। নাবিকরা ত্বরিত সাড়া দিল। ডেকের সতর্কতামূলক নীল বাতি জ্বেলে দেয়া হলো। ছোট্ট জাহাজটা এখন এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে, খালিচোখেও দেখা যাচ্ছে। ওখানকার কেউই মনে হয় এখনও অ্যানি এম. রেইডকে দেখতে পায়নি। ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন বা নাবিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলে কপালে খারাপি আছে বুঝতে বাকি রইল না ডার্কির।
এগিয়ে আসা ছোট্ট কার্গো জাহাজের নাবিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রেইডের লোকেরা ডেকের ওপর লাফাতে লাগল, পতাকা নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। কিন্তু ওটা সেই আগের মতই এগিয়ে আসছে।
‘পাল তোলো। একটা দমকা বাতাস আসছে। এটার সাহায্য নিয়ে জাহাজটা পৌছার আগেই হয়তো দূরে সরে পড়তে পারব।’ হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেন ডার্কি।
দ্রুতই বাতাসটা এল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে হিমশীতল ওই বাতাসটার ঝাপটা লাগল জাহাজে। এদিকে কার্গো জাহাজটা গায়ের ওপর উঠে এসেছে। সংঘর্ষ অনিবার্য। রেইডের প্রত্যেকটি নাবিক বুঝে গেল তাদের কেপ অভ গুড হোপের সৌভাগ্যের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটতে যাওয়া প্রচণ্ড সংঘর্ষের জন্য নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করলেন ক্যাপ্টেন এবং নাবিকরা।
ঘন একটা কুয়াশার চাদরে নিজেকে মুড়ে অ্যানি এম. রেইডের পোর্ট বো-র গায়ে প্রায় লেগে এল জাহাজটি। তিন মাস্তুলের জাহাজের সব ক্রু অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের আঘাত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে থাকা জাহাজটির দিকে। ওটা যতই কাছে আসছে বাতাস আরও শীতল হচ্ছে। ডার্কির কিছু ক্রু চেঁচিয়ে উঠল যখন আপাত জনমানবহীন, জরাজীর্ণ জাহাজটি তাদের মাঝখানে কেটে চলে গেল। যেন বা এখানে অ্যানি এম. রেইড কিংবা এর নাবিকদের কোন অস্তিত্বই নেই।
পুরানো এই মালবাহী জাহাজটা আসলে আর কিছু নয়, এক ভুতুড়ে জাহাজ, নিশ্চিতভাবেই অন্য কোন সময়চক্র থেকে এখানে হাজির হয়েছিল। ওই ভুতুড়ে জাহাজ যখন সাগরে সত্যিকার অর্থেই চলত তখন হয়তো অ্যানি এম. রেইড তৈরিই হয়নি।
ভয়াবহ ওই জাহাজটি শরীরের হাড়মজ্জা কাঁপিয়ে দিয়ে তাদের ভেদ করে চলে যাওয়ার পর সময় নষ্ট করল না রেইডের নাবিকরা। আবার যাত্রার প্রস্তুতি নিল। কেপ অভ গুড হোপের এখানটায় যেভাবে বাতাস বওয়া স্বাভাবিক আবার সেভাবে বইতে থাকল। এদিকে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং নাবিকরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে রেকর্ড টাইমে পৌঁছে গেল, বন্দরে।
ক্যাপ্টেন ডার্কি পরে বলেন, ‘ওটার ডেক কিংবা ব্রিজে জীবিত কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। নজরদারির জন্য লুকআউটেও ছিল না কেউ। আমরা সংঘর্ষ এড়াবার জন্য সব কিছুই করেছিলাম। খুব দ্রুতই পালগুলোও টাঙিয়ে ফেলেছিলাম।’
ক্যাপ্টেন যদি আরও বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হতেন তবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো মোটেই কঠিন হত না তাঁর জন্য। ১৯১১ সালে ঘটনাটি ঘটে, হ্যালোইনের সময়।
বাবা ও মেয়ে
সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের সীমানায় পড়লেও ভৌগোলিক দিক থেকে জর্জিয়ার সাভানার কাছে হিলটন হেড দ্বীপের অবস্থান। জায়গাটি বৈরী আবহাওয়ার জন্য বিখ্যাত। জানান দেয়া ছাড়াই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে সাগরের দিক থেকে।
একসময় হিলটন হেড আইল্যাণ্ডের বাতিঘরের রক্ষক ছিলেন এক স্ত্রী হারানো লোক। ষোলো বছরের মেয়েটা বাবার সঙ্গেই থাকত। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন ভদ্রলোক। বাতিঘরের কোন অসঙ্গতিই চোখ এড়াত না। বাতিগুলোতে তেল দেয়া হত ঠিকভাবে, বাতির চারপাশের কাঁচ ঝকঝকে- তকতকে করে রাখতেন। এই দেখভালের জন্য কর্তাব্যক্তিদের খুব পছন্দের পাত্র ছিলেন এই লাইট হাউস কিপার।
সাপার শেষে প্রতি সন্ধ্যায় ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বাতিসহ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা ভালভাবে পরীক্ষা করে আসতেন। আবহাওয়া ভাল থাক কি খারাপ তাঁর এই প্রাত্যহিক রুটিনে কোন নড়চড় হত না। কাজেই এক ঝড়ের রাতে যখন টহল দেয়ার জন্য বেরোলেন কিপার তাঁর মেয়ে বিষয়টা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হলো না।
কয়েক মিনিটের মধ্যে বাতিঘরের চূড়ায় পৌঁছে গেলেন সিঁড়ি ধরে। ঝড়টা হারিকেনে রূপ নিয়েছে। বাতিগুলোর কাচের আচ্ছাদনের ওপর আছড়ে পড়ছে ঝড়ো বাতাস এবং বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। অভিজ্ঞ একজন বাতিঘররক্ষক হওয়ার পরও এ ধরনের ঝড় জীবনে দেখেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। মনে হচ্ছে শয়তান স্বয়ং যেন চড়ে বসেছে সাগর এবং বাতাসের ওপর।