এদিকে আস্ক কিন্তু ঠিকই মালিকের নির্দেশনায় যাত্রা চালিয়ে গেল। দ্রুত যোগ্য একজন ক্যাপ্টেন নিয়োগ পেলেন। নতুন সব ক্রু নিয়ে চলল জাহাজটি পুরানো গন্তব্যের উদ্দেশে, যেটা ওই ভুতুড়ে ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে বানচাল হয়। কয়েক হপ্তা বাদে জাহাজের মালিকরা একটা খবর পেলেন। আটলান্টিক মহাসাগরে দেখা গেছে আস্ককে, যেখান থেকে ব্রাউন জাহাজ ঘুরিয়েছেন তার কাছেই। আগুনে গোটা জাহাজটাই পুড়ে ছারখার। ক্রুরা সবাই এখনও জাহাজেই আছে, তবে কেউ বেঁচে নেই।
প্রেতাত্মার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিকই ছিল। জাহাজের মালিক, নতুন ক্রু এবং ব্রাউনের দুর্ভাগ্য-দেরি হয়ে যাওয়ার আগে কেউই বিষয়টি বুঝতে পারেনি।
নাবিকের সমাধি
কখনও কখনও অতিপ্রাকৃত কোন সংবাদও ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। এবারের ঘটনাটি ছাপা হয় ১৯২১ সালের ১২ মে রচেস্টার ডেমোক্রেট অ্যাণ্ড ক্রনিকল পত্রিকায়।
ওই সময় লেক ওন্টারিওর তীরবর্তী এলাকাগুলো ছিল অনেকটাই লোকবসতিহীন। হঠাৎ হঠাৎ আদিবাসীদের একটা-দুটো ছোটখাট বসতি বা বাড়িঘর চোখে পড়ত। ইয়োরোপীয়দের পদধূলি কমই পড়ত সেখানে। তবে সন্দেহ নেই ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন তুলনা হয় না।
আবার প্রকৃতির রুদ্ররূপের কারণে ১৮০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত এখানে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। ১৮৫৭ সালের এক ঝড়ের সময় জলে ডুবে মৃত্যু হয় এক নবিকের। নিউ ইয়র্কের সোডাস বে-র পয়েন্ট চার্লসের তীরে সমাহিত করা হয় তাকে। এদিকে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে চমৎকার সব বিলাসবহুল কটেজ তৈরি হতে থাকে এলাকাটিতে। এরকম কিছু কটেজের মালিক মিলে একটা সংগঠন দাঁড় করান। গ্রীষ্মকালীন এই আবাসস্থলগুলোর আশপাশের এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেখভালের জন্য একজন কেয়ারটেকারও নিয়োগ করেন তাঁরা। ১৯১৭ সালের দিকে এখানকার কেয়ারটেকার ছিল জর্জ কারসন নামের এক ব্যক্তি।
এই এলাকার সঙ্গে বেশ ভালমতই পরিচিত ছিল কারসন। তার জানা ছিল, সোডাস উপসাগরে যখন শক্তিশালী উত্তর-পুব বায়ু বয়ে যায় তখন কটেজগুলোর কাছে গোর দেয়া ওই নাবিকের কান্না শুনতে পাওয়া যায় বলে দাবি করে এখানকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা। এসব বিষয়ে কারসনের চিরকালের অবিশ্বাস। বাতাসের শব্দই এর জন্য দায়ী এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তার মনে। লোকেদের কল্পনাই একে অন্য দিকে নিয়ে গেছে।
একপর্যায়ে মারফি পরিবারের সদস্যরাও কারসনকে জানায় প্রচণ্ড এক উত্তর-পুর ঝড়ের সময় একটা ভূত তাদের দেখা দেয়। এমনিতে মারফিদের পছন্দ করে এবং বিশ্বাসও – করে কারসন। কিন্তু ওই গ্রীষ্মের রাতে তাদের যে অভিজ্ঞতা হয় বলে দাবি করেছে তা হেসেই উড়িয়ে দেয় সে। পরিবারের সদস্যরা জানায় ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে ছিল সবাই। এসময় কটেজের দেয়ালের বাইরে থেকে নক করার শব্দ শুনতে পায়। মি. মারফি প্রতিটি জানালা পরীক্ষা করেও এ ধরনের কোন শব্দের কারণ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন। কাউকে দেখেনওনি।
শব্দটা হতেই থাকলে ছেলে-মেয়েদের চুপচাপ থাকার নির্দেশ দেন ভদ্রলোক। প্রথমে ভাবলেন কোন প্রতিবেশী ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দশ মিনিট ধরে অনবরত আওয়াজটা হতেই থাকলে বিষয়টা কী তদন্ত করে দেখবেন স্থির করেন। ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন মারফি এবং তাঁর সন্তানেরা। অর্ধেক গেল বামে। বাকি অর্ধেক ডানে। একপর্যায়ে আবার সামনের দরজায় একত্রিত হলো সবাই। অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায়নি, যেমন খুঁজে বের করা যায়নি শব্দের কারণ।
ছোট বাচ্চাদুটি ভেতরে চলে গেল। এদিকে মারফি বড় ছেলেটাকে নিয়ে ঘরের চারপাশে তল্লাশি চালিয়ে যেতে লাগলেন। যদি এই ঠক ঠক আওয়াজের ব্যাপারে কোন সূত্র মেলে। শোঁ শোঁ শব্দে ঝড়ো বাতাস বইছে। এরই মধ্যে ধৈর্য নিয়ে খুঁজছে দু’জনেই। হঠাৎই চোখে পড়ল বেশ কিছুটা নিচে লেকের পাড়ে তুমুল বাতাসের মধ্যে বসে আছে ভৌতিক একটি আকৃতি। বাপ-বেটার ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনে কাঠামোটা উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে পুরানো সেই নাম না জানা নাবিকের সমাধিটার সামনে হাজির হলো। হাতদুটো ওপরে তুলল, তারপর অদৃশ্য হলো।
রাতে পরিবারের একজনেরও ভাল ঘুম হলো না। তবে একেবারে সকাল সকাল উঠে পড়ল সবাই। দুপুরের মধ্যে পাথর দিয়ে একটা স্মৃতিফলক তৈরি করে সমাধিতে স্থাপন করল। আশা করল এর ফলে হয়তোবা পরের বার উত্তর-পুব ঝড় বইলেও পরিবারটিকে আর বিরক্ত করবে না প্রেতাত্মাটা।
ওই গ্রীষ্মেই মারফিদের জমিতে টহল দেয়ার সময় অসাবধানতাবশত পা লাগিয়ে এত যত্নে গড়া পাথরের ফলকটা উপড়ে ফেলল জর্জ কারসন। অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে পাথরের টুকরোগুলো কটেজের পেছনের ময়লার স্তূপে ফেলে দিল।
ওই দিন সন্ধ্যায় রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে চাঁদের আলোয় টহল দিচ্ছিল কারসন। মারফিদের বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌছল হঠাৎ একটা নড়াচড়া মনোযোগ আকর্ষণ করল। আরও ভালভাবে তাকাল। খুব বেশি দূরে নয়, যেখানে পাথরের ফলকটা উপড়ে ফেলেছে সেখানে অদ্ভুত এক দৃশ্য অপেক্ষা করছে তার জন্য। পুরানো ধাঁচের নাবিক– পোশাক পরিহিত এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তবে আর যা-ই হোক, মানুষ নয়। কারণ ওটার শরীর ভেদ করে ওপাশের জলের রেখা দেখতে পাচ্ছে কারসন।