অবশ্য এসব ঘটনার শুরু কিন্তু কুইন মেরি হোটেলে পরিবর্তিত হওয়ার আগে থেকেই। কুইন মেরির একসময়কার চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন জন স্মিথ। অবসর নেয়ার পর ওই সংঘর্ষে জাহাজের যে অংশটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে কোন কিছু দিয়ে আঘাত করার ও ঢেউ বাড়ি খাওয়ার ছলাত ছলাত শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা বলেন। জাহাজটাকে খুব ভালভাবে চিনতেন স্মিথ। শব্দের উৎস খুঁজে বের করার জন্য চিরুনি অভিযান চালালেন। কিন্তু এসব শব্দের কোন ব্যাখ্যা আবিষ্কারে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত উপসংহারে পৌঁছেন বহু বছর আগের ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পৈশাচিক প্ৰতিধ্বনি শুনতে পেয়েছেন।
যুদ্ধকালীন সময়ের সেই দুর্ঘটনার পাশাপাশি তৈরির সময় এক বিস্ফোরণেও কিছু প্রাণহানি হয় জাহাজটিতে। এগুলোতে নিঃসন্দেহে এর ভেতরে অতিপ্রাকৃত শক্তি জেঁকে বসে। তারপর আবার জাহাজে অন্তত ৪৮টি অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে।
এদেরই একজন জন পেডার। ডেকের নিচে ডোরওয়ে ১৩ এই তরুণ ক্রুর জন্য প্রচণ্ড অশুভ হয়ে দেখা দেয়। ১৯৬৬ সালের ১০ জুলাই ১৮ বছরের এই তরুণ তার রুটিন কাজ করছিল। হঠাৎ ওয়াটার টাইট দরজা বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। এলিজাবেথ বোর্সটিং স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, নীল ওভারঅল পড়া শ্মশ্রুমণ্ডিত এই তরুণের অবয়বকে পুরানো ইঞ্জিন রুমের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে প্রায়ই।
এখনকার কর্মচারীরা ছাড়াও পর্যটকদের অনেকেরও আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। একসময় কুইন মেরি হোটেলের ট্যুর গাইড এবং সিকিউরিটি অফিসার ছিলেন ন্যান্সি ওজনি। বলেন, এক রাতে পর্যটনের এলাকাটা বন্ধ করার সময় পাশে কিছু একটার উপস্থিতি টের পান, ‘ঘুরে দেখলাম একজন লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।’ অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন একজন পর্যটকের পেছনে রয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। তবে লোকটার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে অন্য কিছু মনে হতেই পারে আপনার। ওই রহস্যময় লোকটির পরনে ছিল ময়লা নীল ওভারঅল, মুখে দাড়ি, গায়ের রং অস্বাভাবিক রকম সাদা, চেহারাটা আশ্চর্য ভাবলেশহীন। সব কিছু মিলিয়ে তাকে কোনভাবেই পর্যটক মনে হচ্ছিল না।
জাহাজের ভেতরের সুইমিং পুলটা এখনও আছে। তবে কেবলমাত্র মানুষের দেখার জন্যই এটা। এখন আর রক্তমাংসের কোন সাঁতারু ব্যবহার করে না। তবে দু’জন নারী ভূতকে এর সুবিধা নিতে দেখা যায়। একজন ট্যুর গাইডের অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয়। তার মনে হয় অন্য পৃথিবীর কিছু একটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সাঁতারুর পোশাক পরে ছিল ওই প্রেতাত্মাটা। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে রহস্যময় সেই সাঁতারু যেমন হঠাৎ হাজির হয় তেমনি হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়।
আরেকজন গাইড জানায় এক নারীকে ১৯৩০-এর দশকের একটা সাঁতারের পোশাক পরে একটা প্রায় শুকনো সুইমিং পুলে লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখে। ওই মহিলাকে লাফ না দিতে সতর্ক করে চিৎকার দিয়ে ওঠে গাইড। তারপর সিকিউরিটি গার্ডের খোঁজে তাকায়। যখনই আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মহিলার দিকে ফেরে, দেখে সে সেখানে নেই।
১৯৮৩ সালের ঘটনা। কুইন মেরি হোটেলের কর্মচারী লেস্টার হার্ট সুইমিং পুলের এক পাশে ছিল। এসময় উল্টো পাশে সোনালী চুলের, ফুল হাতা সাদা গাউন পরা এক নারীকে দেখতে পায়। কিন্তু নারীমূর্তিটাকে খুব ঝাপসা মনে হচ্ছিল তার। যেন মাঝখানে একটা স্বচ্ছ পর্দা আছে। তারপর আরও ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যায় ওটা।
এতে বেশ হকচকিয়ে গেলেও এ ধরনের ঘটনার জন্য কিছুটা হলেও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। একদিন সুইমিং পুলের কাছেই পর্যটকদের জন্য বানানো একটা দোকানে কাজ করছিল সে। এসময় পানির ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ শুনতে পায়। যেন কেউ সাঁতার কাটছে। সুইমিং পুলে সামান্য হলেও পানি রাখা হত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। তাই হার্টের মনে হলো কোন অতিথি হয়তো সীমা অতিক্রম করে এতে গোসল করতে নেমে পড়েছে। যে কাজ করছিল তা বাদ দিয়ে সুইমিং পুলের দিকে দৌড়ল সে। ওখানে কেউ নেই। তবে নিচে নামার মইয়ের কাছের পানি তখনও কাঁপছে। ভেজা এক পায়ের ছাপ এগিয়ে গিয়েছে ডেক ধরে এক দরজার দিকে।
ওটা দেখে হার্টের মনে হয় কোন একজন বেপরোয়া অতিথির কাণ্ডই এটা। অতএব পায়ের ছাপ অনুসরণ করা শুরু করে। মনে আশা এটা তাকে সাঁতারুর কাছে নিয়ে যাবে। তারপরই হঠাৎ করে অদৃশ্য হলো পায়ের ছাপ। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা, এখানকার খুব স্পর্শকাতর অ্যালার্ম সিস্টেম সর্বক্ষণ চালু থাকলেও পুলের চৌহদ্দিতে কোন কিছুর উপস্থিতি ওটা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
হার্ট নিশ্চিত হয়ে গেল সুইমিং পুলের কোন একটা প্রেতাত্মার উপস্থিতিই একটু আগে টের পেয়েছে। হয়তো ১৯৩০-এর দশকের সুইমিং স্যুট পরা প্রেতাত্মাটাই এটি। এদিকটাতেই আরেকটা প্রেতাত্মার আনাগোনার কথা বলে অনেকে। ওটার পরনে থাকে ১৯৬০-এর দশকের পোশাক।
আরও কিছু প্রেতাত্মার আড্ডাখানা এই সুইমিং পুল এলাকা। সাধারণত একটা শিশু কণ্ঠের হাসি শোনা যায়। তবে কখনও একটা গোমড়ামুখো ছোট্ট বালকের অবয়বও চোখে পড়ে। হয়তো সে এতটা অসুখী থাকত না যদি জানত তার মত আরও অনেক অতৃপ্ত আত্মার আবাসস্থল এই কুইন মেরি জাহাজ বা হোটেল। কুইন মেরির একটা কামরা আগে শিশুদের খেলার জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন ওটা স্টোর। ওখানে অনেকেই শিশুদের খেলার শব্দ শুনতে পায়, যদিও কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। জন্মের অল্প পরে মৃত্যুবরণ করা একটা বাচ্চার কান্নাও শোনা যায় কখনও কখনও।