প্রথম ছয় বছরের ভ্রমণে জাঁকালো জাহাজটি রাজকীয় অতিথি, নায়ক-নায়িকাসহ ধনকুবেরদের খুব পছন্দের ছিল। তারপরই ১৯৩৯ সালের ৩০ আগস্ট বদলে যায় সব কিছু। সেবারের বিলাসযাত্রায় জাহাজে ছিলেন ২৫৫০ জন ধনী ও নামী-দামি ব্যক্তি। সেই সঙ্গে প্রায় সাড়ে চার কোটি ডলারের স্বর্ণপিণ্ড বহন করছিল কুইন মেরি। হঠাৎই নির্দেশ এল জাহাজের ২০০০-এর বেশি ঘুলঘুলির সবগুলো ঢেকে দেয়ার জন্য। গোটা জাহাজের সব যাত্রীর জীবন নির্ভর করতে থাকে তখন কারও চোখে ধরা না পড়ার ওপর। কারণ ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্স কেবলই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আটলাণ্টিকের বরফশীতল জল ঢেকে গেছে নাৎসী যুদ্ধ জাহাজ ও সাবমেরিনে।• আকাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে হিটলারের অনুগত বাহিনীর যুদ্ধবিমান।
সৌভাগ্যক্রমে যাত্রার বাকি সময়টা জার্মানদের নজরে পড়ল না কুইন মেরি। এটাই ছিল প্রমোদতরী হিসাবে এর শেষ ভ্রমণ। তারপর একে রূপান্তরিত করা হয় সেনাবাহী এক জাহাজে, যেটার ডাক নাম ছিল, ‘গ্রে গোস্ট’ বা ‘ধূসর প্রেতাত্মা’। বন্দরে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের ভেতর থেকে আরাম-আয়েশের সব উপাদান ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়। জাহাজটির বাইরের অংশ মেটে ধূসর রং করা হয়। শত্রুর চোখের আড়ালে রাখার জন্যই এটা করা হয়।
যুদ্ধকালীন সময়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। জাহাজটির ২৮.৫ নট গতিকে কাজে লাগানোর জন্যই এর এই রূপান্তর। যদিও এর দুরন্ত গতিই যুদ্ধের সময়ের ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার মূল কারণ। বলা হয় কুইন মেরির গায়ে ভুতুড়ে তকমা লাগার প্রধান কারণও এটি। কুইন মেরি ও তার অনেক ছোট পাহারাদার সঙ্গী কারাকোয়া একসঙ্গে ভ্রমণ করছিল। জার্মানদের বোকা বানানোর জন্য এলোমেলো বা আরও পরিষ্কারভাবে বললে আঁকাবাঁকাভাবে চলছিল জাহাজদুটি। কোনভাবে হিসাবে একটা ভুল হয়ে যায়। ‘ধূসর প্রেতাত্মা’ সরাসরি গিয়ে আঘাত করে কারাকোয়াকে। প্রচণ্ড গতির বিশাল দানবাকৃতি জাহাজের ধাক্কায় আক্ষরিক অর্থে দুই টুকরো হয়ে যায় কারাকোয়া।
প্রহরী জাহাজের ৪৩৯ জন নাবিকের ৩৩৮ জনই মারা যায়। এদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয় আটলান্টিকের হিমশীতল জলে ডুবে। তাদের চোখের সামনেই বড় জাহাজটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল, কারণ যুদ্ধকালীন সময়ে থেমে মৃত্যুপথযাত্রী লোকগুলোকে উদ্ধারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। একই সঙ্গে দুর্ঘটনা এবং ডুবন্ত লোকগুলোকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ-এতটাই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ‘ধূসর প্রেতাত্মা’-র নৌসেনাদের যে ওই জাহাজের পরিবেশটাই অন্যরকম হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তখন থেকেই অতিপ্রাকৃত কিছুর আছর হয় এর ওপর।
নিরাপদে বন্দরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৭০ টন সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করা হয় জাহাজটি। কিন্তু এটা মোটেই নাবিকদের মনোজগতে কিংবা এর ওপর যে অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রকাশ ঘটেছে তাতে কোন প্রলেপ দিতে ব্যর্থ হলো। এত কিছুর পরও যুদ্ধে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেল জাহাজটি। এমনকী যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল সবসময় আটলান্টিক পাড়ি দিতে কুইন মেরিকে বেছে নিতেন।
১৯৪৫ সালে শান্তি ফিরে এলেও প্রমোদতরী থেকে নৌসেনা আনা-নেয়ার যানে রূপান্তরিত জাহাজটি সেনা, নাবিক ও বৈমানিকদের সেবাতেই ব্যবহৃত হতে লাগল। বলা চলে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে সে এখন। মোট ১৩০০০ যুদ্ধবিধবা এবং তাদের সন্তানদের আমেরিকা এবং কানাডায় পৌঁছে দিল। এজন্য মোট ছয়বার ভ্রমণ করতে হয় একে। পরের বিশ বছর কুইন মেরি আবারও যাত্রী পরিবহন করল। এর মধ্যে মাঝে মাঝে ছিলেন সমাজের অভিজাত ব্যক্তিরাও।
১৯৬৭-র ডিসেম্বরে কুইন মেরির সাগরযাত্রার অবসান ঘটল। অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো তাকে। এসময় একে কিনে নিল আমেরিকার শহর লং বিচ কর্তৃপক্ষ। সাড়ে ৩৪ লাখ ডলার দিয়ে জাহাজটি কিনল তারা। স্থায়ীভাবে তার জায়গা হলো লং বিচে। এর মাধ্যমে একত্রিশ বছর আগে লেডি মেবেল ফর্টেস্কু-হ্যারিসনের করা ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হবার পথে প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলো। এরপর থেকে জাহাজটি আর কোন যাত্রী বহন করেনি। তেমনি আর একবারের জন্যও সাগরে যাত্রা করেনি। এদিকে ব্রিটিশ জাহাজের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো জাহাজটির নাম। একটি দালান হিসাবে একে নথিভুক্ত করা হলো। এর জনপ্রিয়তাকে পর্যটক টানার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন মালিকেরা। জাহাজটিকে হোটেলে রূপান্তরের কার্যক্রম শুরু হলো।
এসময়ই মালিকরা আবিষ্কার করলেন এর ব্যতিক্রমী অতীতের কারণে এখানে আস্তানা গেড়েছে বহু প্রেতাত্মা। হালের যে অংশটা কারাকোয়াকে আঘাত করে ওই অংশটিতে ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির সংখ্যা যেন বেশি। একজন কর্মচারী ওই জায়গাটিতে রাতে একটা রেকর্ডার রেখে যায়। পরদিন রেকর্ড অন করতেই দুটো জাহাজ ঠোকাঠুকির ভয়ানক আওয়াজ শোনা গেল। কেউ কেউ আবার এই জায়গায় নানা ধরনের অদৃশ্য কণ্ঠ ও রক্ত হিম করা চিৎকার শুনতে পাওয়ার দাবি করে।
অনেকেই অদ্ভুত সব আওয়াজ শোনার কথা বলে। কেউ বলে জাহাজের গায়ে হাত দিয়ে ঠক ঠক করার শব্দ শুনতে পেয়েছে। কেউ আবার প্রমত্ত ঢেউয়ের এবং ধাতব পদার্থ ছেঁড়ার আওয়াজ শোনে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো অশুভ চিৎকার এবং গোঙানি। লোকে বলে ওই প্রহরী জাহাজের ক্রুদের চিৎকার ওগুলো। মৃত ওই নাবিকেরা কোনভাবে কুইন মেরির পরিবেশের সঙ্গে আটকে গিয়েছে।