তবে ভদ্রলোকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের রাতটার কথা এখনও ভুলতে পারে না র্যানি। মালকিনের অনুরোধে ওই রাতটা তাঁর বেডরুমের কাছের ড্রেসিং রুমে ছিল র্যানি। মাঝরাতে প্রচণ্ড এক চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় তার। ঘটনাটা কী জানতে সঙ্গে সঙ্গে মিসেসের কামরায় ছুটে যায়। গিয়ে দেখে বিছানার ওপর গলা চেপে বসে আছেন মহিলা। চেহারাতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
ওহ, আমি একটা দাঁত গিলে ফেলেছি। ওটা গলায় আটকে আছে আমার।’ খসখসে কণ্ঠে বললেন তিনি।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় র্যানি বুঝতে পারছিল না কী করবে। সিঁড়ির দিকে দৌড় শুরু করেছিল; এসময় হঠাৎ মিসেস আরবাথনট শান্ত হয়ে যান।
‘এখন সব ঠিক আছে,’ হাত মুখের ভেতর থেকে বের করে বললেন, ‘একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। তবে মনে হচ্ছিল সত্যি। তোমাকে বিরক্ত করলাম, সরি। শুভরাত্রি।’ তারপর র্যানিকে হাত ইশারায় চলে যেতে বললেন।
কিন্তু তারপর থেকে প্রতি রাতে একই স্বপ্ন দেখে চিৎকার করতে লাগলেন। র্যানি এসে দেখে, শেষমেশ বিষয়টা স্বপ্নই। এভাবে প্রতি রাতের এই ঘটনায় রীতিমত বিধ্বস্ত অবস্থা হয়ে যায় ভদ্রমহিলার। একপর্যায়ে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাবার যে সময়টা স্থির করেন এর কয়েক রাত আগে বান্ধবীদের জন্য এক ডিনার পার্টির আয়োজন করেন। সেখানেই ঘটে অদ্ভুত এক ঘটনা। র্যানি সাহায্য করছিল তার মালকিনকে। যখন মিষ্টি খাচ্ছিল সবাই তখন হঠাৎ মিসেস ডি. (যাঁর সঙ্গে মিসেস আরবাথনট শলা করেছিলেন) মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন, তাঁর হাত থেকে খসে পড়ল চামচ। সবার দৃষ্টি চলে গেল তাঁর দিকে।
‘লুসি, কী হয়েছে?’ জানতে চাইলেন মিসেস আরবাথনট, ‘তুমি কি অসুস্থ? একটু ব্র্যাণ্ডি দেব?’
‘না, না!’ জবাব দিলেন মহিলা। মুখে একটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলেন, ‘তেমন কিছু না। হঠাৎ আমার প্লেটে একটা দাঁত চোখে পড়ে। অবাক হয়ে ভাবলাম কোনখান থেকে এল এটা। কিন্তু এখন তো আর দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি আজকাল।’
‘একটা দাঁত!’ অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল কয়েকজন অতিথি, ‘কেন? কী অবাক কাণ্ড।’
‘কী অদ্ভুত! কোন একটা ভুল হয়েছে তোমার। হয়তো পেস্ট্রির একটা টুকরোকে দাঁত ভেবে বসে আছ। ব্র্যাণ্ডিতে কাজ না হলে ওয়াইন নিতে পার।’ মুখে কথাটা বললেও র্যানি খেয়াল করল মালকিনের চেহারাটা সাদা হয়ে গিয়েছে।
তবে রাতে যখন ঘুমাতে যান একেবারে ভোর পর্যন্ত কামরার বাতিটা নেভাননি ভদ্রমহিলা, খেয়াল করে র্যানি। আর যেদিন ফ্ল্যাট ছাড়ার কথা সেদিনই নিজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্তর নিয়ে বাড়ি ছাড়েন।
তবে যাবার আগে র্যানিকে সব ধরনের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বিদায় করেন।
পরে আমি আরও খোঁজ-খবর নিই মহিলার সম্পর্কে। ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে ফোকস্টোনের কাছে এক ফ্ল্যাটে ওঠেন। কিন্তু অল্প কয়দিন সেখানে থেকেই পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য কোথাও চলে যান। আমার ধারণা যেখানেই যান বাকি জীবনটা ভয়াবহ ওই দুঃস্বপ্নের কবল থেকে রেহাই পাবেন না। আর ওই ফ্ল্যাটটা, যেখানে স্বামী-স্ত্রী থাকতেন, সেটারও সমস্যা আছে। কেউই জায়গাটায় এখন থাকতে চায় না। কেয়ারটেকার বলেছে সবাই ওই একই দাঁত গিলে ফেলার স্বপ্ন দেখে।
কুইন মেরির প্রেতাত্মারা
যখন জাহাজ ছিল তখন কুইন মেরিতে নানান ভুতুড়ে কাণ্ড- কীর্তির কথা শোনা যেত। তারপর একে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে বিলাসবহুল এক হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়। আশ্চর্য ঘটনা, এরপর এতে অতিপ্রাকৃত ঘটনা কমে তো নি-ই বরং বেড়েছে। হোটেল মালিকরাও বিষয়টা ভালভাবেই নিয়েছেন। কারণ আখেরে তাঁদের লাভই হয়েছে এতে!
যেদিন প্রথম সাগরে নামে সেদিন থেকেই শুধু জাহাজকুলে নয় গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে কুইন মেরির নাম। যে কোন জাহাজের উদ্বোধন বিশাল এক ব্যাপার। কুইন মেরির বেলায় আরও প্রকটভাবে কথাটা সত্যি। বিশেষ করে এর মালিকদের জন্য। ইংল্যাণ্ডের কানরাড লাইন ছিল এর মালিক। জাহাজটার পেছনে দু’হাতে টাকা খরচ করা হয়। প্রায় ১০২০ ফুট লম্বা জাহাজটির ওজন ৮১২৩৭ টন। এখানে জানিয়ে রাখা ভাল, টাইটানিক ছিল ৮৮২ ফুট লম্বা, আর ওজনে ৪৬৩২৯ টন।
১৯৩৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সাগরে ভাসে কুইন মেরি। তবে এর মালিকদের হতাশ করে লেডি মেবেল ফর্টেস্কু- হ্যারিসন ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘আরএমএস কুইন মেরি জনপ্রিয়তার শিখরে উঠবে তখনই যখন সে আর সাগরে নামবে না এমনকী কোন যাত্রীও বহন করবে না। তার এই সাফল্য দেখে যাওয়ার জন্য এখনকার অনেকেই থাকবে না, এমনকী আমিও।’
সত্যি তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যখন সত্যি হলো তখন তা দেখবার জন্য বেঁচে নেই ফর্টেস্কু-হ্যারিসন। ব্রিটিশ জাহাজ, যেটা কিনা একসময় পরিচিত ছিল ‘আটলান্টিকের রানি’ হিসাবে, সেটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একটি ভাসমান হোটেল হিসাবে। ১৯৯০-এর দশকে কুইন মেরি হোটেলের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসাবে কাজ করা এলিজাবেথ বোর্সটিঙের মতে ফি বছর হাজার হাজার অতিথি ভাসমান হোটেলটিতে আসে শুধু এখানকার অশরীরীদের কাণ্ড-কীর্তি দেখার জন্য।
হোটেলে পরিণত হবার পর যেন ভুতুড়ে হিসাবে এর সুখ্যাতি কিংবা কুখ্যাতি আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। ওখানে অন্তত গোটা বিশেক অতৃপ্ত প্রেতাত্মাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। ধারণা করা হয় এদের সবগুলোই জাহাজ হিসাবে সাগরে ঘুরে বেড়াবার সময় থেকেই এর সঙ্গী। তবে তখন এদের প্রতাপটা আরও কম ছিল।