আমার এক সাংবাদিক বন্ধু, যার রাতের অর্ধেকটা লিখতে লিখতে পার হয়ে যেত প্রায়ই, সেখানে একটা কামরা ভাড়া নিল। তো যে রাতে কামরাটায় উঠল, খুব ক্লান্ত ছিল। হাতে জরুরি কোন অ্যাসাইনমেন্টও ছিল না, তাই একটু তাড়াতাড়িই ঘুমাতে গেল। অন্তত তার হিসাবে। এই কামরাটায় গ্যাস নেই, মোমই ভরসা। একটা মোমকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে অপরটা নেভাতে যাবে এমন সময় কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। বিছানার নিচে তাকাল, ওখানে গিজগিজ করছে তেলাপোকা। এটা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। পৃথিবীতে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে সে তা হলো এই তেলাপোকা। এক লাফে টেবিলের ওপর উঠে এক পায়ের ওপর আরেক পা আড়াআড়িভাবে রেখে বসে পড়ল। সকাল পর্যন্ত এভাবেই বসে থাকবে স্থির করল।
বেশ কিছুটা সময় বিছানার দিকে তাকালই না। তবে অজানা কোন একটা আকর্ষণে সেদিকে তাকাতে বাধ্য হলো। তখনই বালিশটার দিকে দৃষ্টি গেল। কেমন যেন লাগছে। ভাবল নিশ্চয়ই চোখের কোন সমস্যার কারণে এমনটা হয়েছে। অতএব ঠিক করল, ওদিকে আর তাকাবেই না। কিন্তু আবারও কী এক আকর্ষণে তাকাল ওদিকে। না, কোন ভুল নেই। বালিশটা আর বালিশ নেই, একটা মুখ হয়ে গিয়েছে। ওই তো নাকটা দেখা যাচ্ছে, পুরু আর একটু বাঁকা। কানদুটো বড়, মাথার পেছনের দিকে লেপ্টে আছে। চোখ, মুখ সবই আছে। আর শেষের ওই অঙ্গটাই আমার বন্ধুকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। ঠোঁটটা পুরু, মুখটা হাঁ হয়ে আছে। মোটের ওপর বেশ সাধারণ একটা চেহারা। তবে ওটা এখানে কেন?
মোমটা জ্বলতে জ্বলতে ছোট হয়ে এসেছে। পুরোপুরি নিভে যাওয়ার আগেই অপর মোমবাতিটা জ্বেলে ফেলল। আবার মুখটার দিকে তাকাল। বাইরের যান চলাচলের শব্দ একেবারেই থেমে গিয়েছে। ঘোড়ার গাড়ির ঝুনঝুন, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, ট্রামের শব্দ—সব কিছু থেমে গিয়ে আশ্চর্য নীরবতা বিরাজ করছে এখন। তবে এসবে আমার বন্ধুর আগ্রহ নেই। তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু যেখানে বালিশটা থাকার কথা এবং এর বদলে ভুতুড়ে মুখটা আছে সেখানটায়।
ধারণা করল, বেশিরভাগ সময়ে বারে কাটানো মদ্যপ এক মোটাসোটা মানুষের মুখ ওটা। ধারণাটা সত্যি করে দিতেই যেন হঠাৎ বিয়ারের গন্ধ নাকে এসে লাগল।
সন্দেহ নেই বাসি বিয়ারের গন্ধ ওটা। আমার বন্ধু যে কিনা এ জিনিস থেকে দূরে রয়েছে সবসময়, তার জন্য গন্ধটা রীতিমত অসহনীয়। এসময়েই কিছু একটা তাকে নিচের দিকে তাকাতে বাধ্য করল। দেখল বিশাল, কালো একটা শুঁড়অলা বস্তু বিছানার চাদর বেয়ে ওপরে উঠছে। ওটার পেছনে আরেকটা, এভাবে একটা একটা করে গোটা চাদরটাই এই বিদঘুটে জীবগুলোয় ভরে গেল। তাদের হাঁটার শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছে সে। ওপরে ওঠা জিনিসগুলো গোটা শয্যায়, এমনকী ওই মুখটায় ছড়িয়ে পড়ল। সবার লক্ষ্য ছিল আসলে ওই মুখটাই। বিছানা থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল আমার বন্ধুটি। তার এবং দরজার মাঝখানের মেঝের দিকে, দৃষ্টি গেল তার। এখানে-সেখানে কিছু নড়াচড়ার আভাস পেল।
টেবিলে এক হপ্তার ভাড়া রেখে এবং একটা কাগজে বাড়ি ছাড়ার কারণ বর্ণনা করে, আসন থেকে সাবধানে নেমে এল। তারপর ছুটল সামনের দরজার দিকে।
কয়েক হপ্তা পর অন্য একজন পরিচিত সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করল, নদীর দক্ষিণ-পুব অংশে একটা কামরার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে কিনা, তবে অবশ্যই ক্যানিংটন পার্ক রোডে নয়।
‘কেন নয় সেখানে?’ আমার বন্ধুটি জানতে চাইল।
‘কারণ ওখানে আমার একটা অভিজ্ঞতা। কখনও ভুলব না ওই স্মৃতি। তুমি কি ভূতে বিশ্বাস করো? আর তেলাপোকা নিয়ে কি তোমার কোন দুর্বলতা আছে?
‘কী!’ আমার বন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করল, ‘তাহলে ওই বাড়িতেই ছিলে তুমিও!’
তারপর তথ্য চালাচালি হতেই জানা গেল ওই সাংবাদিক যে শুধু ওখানে থেকেছে তা-ই নয় তার অভিজ্ঞতাও অবিকল এক।
‘বাড়ির মালকিনও প্রায়শই ওই কামরার বাসিন্দাদের এই অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি জানতেন। সবাই নিশ্চয়ই তোমার মত এতটা উদার ছিল না যে ভাড়াটা পর্যন্ত রেখে আসবে। আর ওই বালিশমুখের ব্যাপারে তুমি কিছু জানো কিনা জানি না। ওই সময় ডাকা এক চিকিৎসকের কাছ থেকে এর বৃত্তান্ত শুনেছি। ওই বাড়ির মালকিন মহিলাটি আসলেই আস্ত এক পিশাচী। কয়েক বছর আগের এক রাতে ওই মহিলার স্বামী এতটাই মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফেরে যে বিছানায় যাওয়ার অবস্থা পর্যন্ত তার ছিল না। বদ মহিলাটি তাকে বিছানায় তুলে শোয়ানোর বদলে রাতভর বিছানার পাশেই ফেলে রাখে। তেলাপোকারা বিয়ার কী পরিমাণ পছন্দ করে তা তো জানো। ওই গন্ধে রীতিমত পাগল হয়ে যায় ওই কামরায় আশ্রয় নেয়া হাজারো তেলাপোকা। সকালে মহিলা এসে দেখে স্বামী দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে।
বলা হয় সহো নানা ধরনের প্রেতাত্মার জন্য বিখ্যাত। ডিন স্ট্রিটের এক বাড়িতে বহু বছর ধরে আস্তানা গাড়া একটি বিশাল ভুতুড়ে কালোপাখির কাহিনী বেশিরভাগেরই জানা। তবে গ্রিক স্ট্রিটের এক দোকানের ওপরের ফ্ল্যাটের ঘটনাটা আশা করি পাঠকদের পরিচিত মনে হবে না।
বিশ্বযুদ্ধের পর এক মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্র আশ্রয় নেয় গ্রিক স্ট্রিটের ওই বাড়িতে। মোটামুটি হপ্তাখানেক কাটানোর পর একদিন গিয়ে বাড়ির মালকিনকে অভিযোগ করল প্রতিদিন রাতে বিছানাটা শোবার সময় ভেজা পায় সে। মহিলা বলল এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। খেপা ছাত্রটি তখন হুমকি দিল আজ রাতেও একই ঘটনা ঘটলে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেবে।