অ্যান তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করে বললেন, সকালে বিষয়টা নিয়ে ভাবা যাবে। যা হোক, একটু পানি মিশানো ব্র্যাণ্ডি খেয়ে ঘুমাতে গেল মহিলা।
ওই রাতে স্বামীকে সব কিছু খুলে বললেন অ্যান। অনেক স্বামীই হয়তো বৃত্তান্ত শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। স্ত্রীকে একটু কম কল্পনাপ্রবণ হওয়ার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু থিয়েটারের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকায় এ ধরনের অতিপ্রাকৃত বিষয়ের প্রতি বেশ আগ্রহ জন্মেছে জনের। শুধু তাই না এমনটা যে ঘটতে পারে এটা মনেও করেন। অ্যানকে ‘জড়িয়ে ধরে বললেন, আগামী হপ্তাটা এখানে থেকেই কাজ করবেন তিনি। আর নিজেই রহস্যটা সমাধানের চেষ্টা করবেন।
তাঁকে হতাশ হতে হলো না। পরের কয়েকদিন এই অদৃশ্য পদশব্দ শোনা গেল। কয়েকটা ভৃত্য এবং বড় দুই মেয়ে শব্দটা শুনল। শুধু যে ওক বেডরুম এবং সিঁড়িতেই আওয়াজ শুনেছে তা নয়, বাড়ির আরও নানা প্রান্তেই পায়ের আওয়াজ শোনা গিয়েছে। এক রাতের ঘটনা। বিছানায় শুয়ে আছেন অ্যান। হঠাৎ দরজার দিকে পদশব্দ শুনতে পেলেন। এক ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। কিন্তু ল্যাণ্ডিং একেবারে খাঁ খাঁ করছে। পরের রাতে জন দেখলেন ‘বালিশের নিচে কিছু একটা লুকাচ্ছেন অ্যান। ঘটনাটা কী জানতে চাইলে কিছু বললেন না তাঁর স্ত্রী। নিজে খোঁজ করতেই আবিষ্কার করলেন একটা রিভলভার। এবার মুখ খুললেন অ্যান। অশরীরীটার মোকাবেলা করতে ওটা রেখেছেন। জন বললেন এতে কোন লাভ তো হবেই না, উল্টো বাড়ির লোকজন আহত হতে পারে। বুঝতে পেরে বালিশের নিচ থেকে রিভলভার সরালেন অ্যান, তবে নাগালের মধ্যেই রাখলেন অস্ত্রটা।
এমনকী এখন ভৃত্যদের সামনেও আর অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না এমন ভান করেন না অ্যান। ভয়ানক একটা কিছু বাড়ির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে বুঝতে পেরে চাকর-বাকররা বাড়ির ভেতরেই দল বেঁধে চলাফেরা করে। বিশেষ করে বড় দুই মেয়ে পেটি এবং মারিয়ার মধ্যেও ভয়টা ছড়িয়ে পড়েছে। রাতে নার্সারিতে আবারও ভয়ানক মুখটা দেখা যাবার পর ছোট ছেলে-মেয়েগুলোও কেমন একটা অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। এক রাতের ঘটনা। ভৃত্যরা ডিনারে বসেছে। হঠাৎ কামরার দরজাটার খিলে টান পড়ল। তারপরই আস্তে আস্তে খুলে গেল দরজাটা। কাউকে দেখা গেল না। আবার বন্ধ হয়ে গেল। সবাই ভয়ে পেয়ে গেল। একটা মেয়ে জ্ঞান হারাল। কিটি চিৎকার শুরু করে দিল উন্মত্তের মত।
জন চ্যাপম্যান সব কিছু শুনে পরের দিন চাকরদের ডিনারের সময় ওই কামরাটায় রইলেন, যদি আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সত্যিই তা-ই ঘটল। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়েও এই রহস্যময় দরজা খোলা ও বন্ধ হওয়ার পেছনে কার ভূমিকা তা উদ্ঘাটন করতে পারলেন না। তবে কাজটা যে রক্ত-মাংসের কারও নয় তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।
পরদিন বিকালে জরুরি কাজে লণ্ডনে যেতেই হলো জনকে। স্ত্রীকে বললেন রাতে কামরায় সঙ্গে একজন ভৃত্যকে রাখতে। মিসেস টেওয়িনকে বেছে নিলেন অ্যান। চ্যাপম্যানদের বেডরুমের কোনার ছোট্ট বিছানাটায় ঘুমাবে সে।
রাত আনুমানিক একটার দিকে অপর খাটে বিড়বিড় শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল অ্যানের। ‘আমাকে জাগাও! আমাকে জাগাও!’ বলছে মিসেস টেওয়িন। চোখদুটো বন্ধ, তবে মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। নিজের বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন। মালকিনকে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নের কবল থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দিল মিসেস টেওয়িন। জেগে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করেও সফল হচ্ছিল না সে।
বলল স্বপ্নে সে চলে গিয়েছিল ওক রুমের বিছানায়। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক তরুণী। ফ্যাকাসে মুখ। লম্বা, ঘন কালো চুল তার। গায়ে ছিল পুরানো দিনের সাদা ঢিলে গাউন বা রোব। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কামরার অপর একটা মহিলার দিকে তাকিয়ে ছিল। বিছানার পাশে ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। এই মহিলাটাই ভয় পাইয়ে দেয় মিসেস টেওয়িনকে। অদ্ভুত রকম অপরিচ্ছন্ন মহিলাটি, তবে চেহারাটা এতটাই অশুভ যে ভাবলে এখনও গা শিরশির করে উঠছে। তার পরনেও ছিল পুরানো ফ্যাশনের পোশাক। দুর্গন্ধে ভরা ধূসর চুলের ওপর চাপিয়েছিল একটা টুপি।
‘বাচ্চাটাকে তুমি কী করেছ, এমিলি? কী করেছ বলো!’ ব্যঙ্গ করে সে জিজ্ঞেস করল তরুণীকে।
‘ওহ! আমি ওকে মারিনি। ওকে রক্ষা করেছি। বড় হয়ে নম্বর রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে ভারত গিয়েছে।’
তারপর তরুণী বিছানার কাছে এসে ঘুমন্ত মহিলাকে সরাসরি বলল, ‘আগে কখনও কাউকে বলিনি। তবে তোমাকে বলছি এখন। আমার নাম মিস ব্ল্যাক। আর ওই বুড়ির নাম নার্স ব্ল্যাক। এটা তার নাম নয়, তবে আমাদের পরিবারের সঙ্গে অনেক দিন ধরে থাকায় এই নামেই তাকে ডাকি আমরা।’
এ পরিস্থিতিতে বিছানার সামনে হাজির হয়ে বুড়ি তার কথায় বাধা দেয় এবং ঘুমন্ত মিসেস টেওয়িনের কাঁধে হাত রাখে। কিছু একটা বলে। যেটা মনে করতে পারছে না এখন। তবে যে জায়গাটিতে অশুভ মহিলা হাত বুলিয়েছে সেখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। সে বুঝতে পারছিল তার জেগে ওঠার দরকার। তাই মালকিনকে ডাকছিল।
পরের দিন সকালেই বেরিয়ে পড়েন অ্যান। এই বাড়ি আর এর পুরানো বাসিন্দাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে। কেউ তেমন কিছু বলতে না পারলেও এই এলাকার পুরানো, এক বাসিন্দা কিছু তথ্য দিলেন। সত্তর-আশি বছর আগে, এই ১৭৭৫-এর দিকে, মিসেস রেভেনহল নামের এক ভদ্রমহিলা ওই বাড়িতে থাকতেন। তাঁর এক ভাতিজি, যার নাম মিস ব্ল্যাক, মহিলার সঙ্গে থাকত। এর বাইরে আর কিছু জানেন না ওই ভদ্রলোক।