কয়েকদিনের মধ্যেই আরও বড় চমকটা হাজির হলো অ্যানের জন্য। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নার্সারিতে সময় কাটানো মেয়েটা, কিটি ব্রকেট যার নাম, হাজির হলো কাঁদতে কাঁদতে। আতঙ্কে কাঁপছে সে। এতটাই ভয় পেয়েছে যে প্রথমে কী বলছে বোঝাই গেল না। তবে একটু ধৈর্য ধরে প্রশ্ন করে অ্যান বুঝতে পারলেন সমস্যাটা কোথায়। নার্সারির ময়লাগুলো বাড়ির পেছনের ভাগাড়ে ফেলতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল সে। এসময়ই বাইরের উঠনের দিকের ছোট্ট জানালাটায় একটা মুখ দেখতে পায়। চেহারাটা কেন তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে এটা বোঝানো বেশ কষ্টকর হলো কিটির জন্য। তবে তার এলোমেলো কথা থেকে অ্যান বুঝতে পারলেন বুড়ি এক মহিলার মুখ ওটা। ভয়ানক কুৎসিত। চুল ঢাকা ছিল পুরানো আমলের ক্যাপ দিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা তার দৃষ্টিটা ছিল অশুভ।
মেয়েটার ভয় বাড়িয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছাই অ্যানের নেই। তাই বললেন ওটা নিশ্চয়ই এক বুড়ি জিপসি। কাউন্টির এই অংশে এরা অনেকই আছে। কিটি তখন জিজ্ঞেস করল, তাহলে ওই মহিলা উঠনে ঢুকল কেমন করে? একমাত্র রান্নাঘর ছাড়া আর কোন পথ নেই ওখানে ঢোকার। রাঁধুনি নিশ্চয়ই একজন জিপসি বুড়িকে তার পাশ দিয়ে চলে যেতে দেবে না? অ্যানকে স্বীকার করতে হলো বিষয়টা রহস্যময়। মেয়েটার ভয় দূর করতে দু’জন মিলে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে তাকালেন উঠনের দিকে। জায়গাটা খালি। রাঁধুনির সঙ্গে কথা বলতে জানাল তার কাছে জিপসি মহিলা তো নয়ই, কেউই আসেনি আজ সকালে। অ্যান মেয়েটাকে বললেন, মনে হয় আলোর কারসাজিতে ধোঁকা খেয়েছে সে।
দুই রাত পর নতুন একটা ঘটনা হাজির হলো অ্যানের সামনে। বাড়ির একজন মেইড রাতে চড়া একটা শব্দ শুনতে পায়। যেন উঠনে লোহার ডাণ্ডা দিয়ে কিছু একটা পিটাচ্ছে কেউ। তার খাস কামরার পাশেই জায়গাটি। এদিকে আগের ওই তরুণী মেয়েটা, মানে কিটি নিশ্চিত করল গত রাতে সে-ও ওই একই ধরনের শব্দ শুনেছে। রান্নাঘরে দুধ গরম করতে গিয়েছিল তখন।
পরের কাহিনীটার উদ্ভব হলো নার্সারি থেকে। ছোট্ট মারিয়া, বেশ সাহসী সে, অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণও নয়, বলল ঘুম থেকে জেগে দেখে নার্সারির দরজার কিনারা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্রী, কদাকার চেহারার এক বুড়ি। মা তাকে বুঝিয়ে বললেন, এটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু অ্যান ঠিকই বুঝতে পারলেন মেয়ে সত্যিই অশুভ বুড়িকে দেখেছে!
পুরো হপ্তাটাই জন চ্যাপম্যান লণ্ডনে কাটিয়েছেন। শুক্রবার রাতে বাড়িতে ফিরবেন ভেবে বেশ শান্তি লাগছে অ্যানের। ছেলে-মেয়ে ও কর্মচারীদের সামনে হাসি-খুশি থাকার অভিনয় চালিয়ে যেতে যেতে রীতিমত অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। এই গ্রাম এলাকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়েগুলো একবার গোটা বিষয়টার সঙ্গে ভূত-প্রেতের সম্পর্ক আছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলেই হয়েছে! অ্যান ভয় পাচ্ছেন এই মেয়েদের কে আবার তাঁর সামনে হাজির হয়ে চাকরি ছাড়ার নোটিশ দেয়! তাছাড়া তাঁর নিজের জন্যও এই ঘটনাগুলোর বাস্তবসম্মত একটা ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন। একপর্যায়ে রহস্যটা সমাধান করার শেষ চেষ্টা হিসাবে বাড়ির সব ভৃত্যকে ডেকে বললেন তাঁদের বাড়ির আশপাশে জিপসিদের আসার খবর মিলেছে। চুরি-ডাকাতি করার জন্য কেউ আবার ভেতরে লুকিয়ে আছে কিনা দেখার জন্য তল্লাশি চালাতে হবে। মেয়েরা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই কাজ করল। প্রতিটি আলমারি, প্যানেল, পাতালঘর, চিলেকোঠা থেকে শুরু করে বাড়ির এমনকী বাইরের ঘরগুলোর আনাচে-কানাচে খোঁজা হলো। কিন্তু কোন জিপসির নাম-গন্ধও পাওয়া গেল না। অবশ্য তিনি যে তাতে খুব একটা বিস্মিত হলেন তা না।
জন চ্যাপম্যান আসার সময় সমাগত হতেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন অ্যান। কিন্তু যখন এলেন, দেখা গেল একা আসেননি। সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থার সদস্য মি. হলকে নিয়ে এসেছেন। অ্যান তাঁকে হাসিমুখে স্বাগত জানালেন। যখন দেখলেন ভদ্রলোক স্বামীর সঙ্গে গল্প করছেন, সিঁড়ি ধরে ওক রুমের দিকে রওয়ানা হলেন ওটাকে রাতে অতিথি থাকার জন্য প্রস্তুত করতে।
স্বামী ঘরে ফেরাতে বেশ নির্ভার লাগছে তাঁর। আপাতত এমনকী ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির কথাও বিস্মৃত হয়েছেন। এসময়ই হঠাৎ চওড়া সিঁড়িতে তাঁর পেছনে পদশব্দ শুনলেন। ঘাড় ফেরালেন কে দেখবার জন্য।
কেউ নেই। সিঁড়িটা একেবারে খালি, নিচে ছায়াময় হলওয়েতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচে নেমে, ছেলে-মেয়েদের নার্সারিতে হাজির হলেন। তাদের হৈ চৈ আর কোলাহলে একটু একটু করে স্বাভাবিক হলেন। রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত ওখানেই কাটালেন। ডিনারটা সবাই চমৎকারভাবেই সারলেন। পুরুষরা স্টাডিতে সিগার টানতে টানতে আলাপ করতে লাগলেন, অ্যান বসলেন সুঁই-সুতো নিয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর দরজায় একটা নক হলো। বৈঠকখানার দায়িত্বে আছে মধ্যবয়স্ক মহিলাটি। মিসেস টেওয়িন নামেই সে পরিচিত। এমনিতে শান্ত স্বভাবের ও ধীর-স্থির হলেও কামরায় ঢুকল যখন তাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাল। চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, কাঁপছে থরথর করে। অদৃশ্য কারও পায়ের আওয়াজ শুনেছে সে, জানতে পারলেন অ্যান। সিঁড়ি বেয়ে ওক রুমে যাওয়া পর্যন্ত পায়ের আওয়াজটা তাকে অনুসরণ করেছে, সে যখন ঢুকেছে তখনও শব্দটা ভেতরে ঢুকেছে। যখন ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়েছে মিসেস টেওয়িন, তখন শব্দটাও থেমে যায়। কয়েক রাত আগে এই মহিলা দরজায় নক করার আওয়াজ শুনেছে। এবারের ঘটনায় এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে চাকরি ছাড়তে চাইছে।