মিসেস কিনের বোন অ্যান ট্রির সঙ্গে বিয়ে হয় জন ক্যাম্বল চ্যাপম্যানের। একসময়ের এই থিয়েটার ম্যানেজার তখন বিখ্যাত এক প্রকাশক। তাঁদের পরিবারটি ছিল বিশাল। মোটমাট এগারোটি সন্তান ছিল ওই দম্পতির। ছোট বাচ্চাগুলোর জন্য লণ্ডনের আবহাওয়া একটু অস্বাস্থ্যকর মনে হওয়ায় তাঁরা একটু মফস্বল এলাকায় সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
হার্টফোর্ডশায়ারের চেসহান্টে একটা বাড়ি পছন্দ হয় তাঁদের। ওটার মালিক স্যর হেনরি মিউক্স। এই বিশাল পরিবারের সদস্যদের দেখভালের জন্য ছিল জনা আটেক চাকর-কর্মচারী। তবে বাড়িটা এত বড় যে সবারই জায়গা হয়ে গেল হেসে-খেলে। বড় মাঠ, লন এমনকী কিছু উঁচু গাছও আছে। চাই কী এগুলো বেয়ে উঠে দুরন্তপনার পরীক্ষাও দিতে পারে তারা। মিসেস চ্যাপম্যান গোটা বাড়িটা ঘুরে-ফিরে দেখে স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি।
প্রায় দুইশো বছরের পুরানো বাড়িটা সতেরো শতকের শেষভাগের কোন একসময় বানানো হয়েছে। প্রাচীন ওক গাছের খাম্বা খাড়া করে রেখেছে দালানটাকে। ফায়ারপ্লেসগুলো বড় আর নকশা করা। মাঝখানে একটা চওড়া সিঁড়ির পাশাপাশি দুই পাশে ভৃত্যদের ব্যবহারের জন্য সরু দুটো সর্পিলাকার সিঁড়িও আছে। ছোট শিশুদের খেলার জন্য আছে একটি আলাদা ঘর বা নার্সারি। এর পাশাপাশি চিলেকোঠায় কয়েকটা ঘর আবিষ্কার করে বাচ্চারা এবং এতে তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ভৃত্যরা দারুণ খুশি হয়ে উঠল।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মুক্ত বাতাসের লোভে জন চ্যাপম্যানের অনেক বন্ধু-বান্ধবই এখানে হাজির হয়ে যান। এই দম্পতি সবসময়ই দিল-দরিয়া ও অতিথিবৎসল। লণ্ডনের বন্ধুদের তা অজানাও নয়। এদিকে জন চ্যাপম্যানও সপ্তাহে দু-একটা দিন ব্যবসার প্রয়োজনে লণ্ডনে কাটিয়ে দেন। কখনও স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যান। এখানকার বাড়িতে দু- একটা কামরা সবসময়ই অতিথিদের জন্য তৈরি রাখা হয়। হঠাৎ জানান না দিয়ে হাজির হয়ে গেলেও বিন্দুমাত্র বিরক্ত হন না অ্যান চ্যাপম্যান। এক কথায় চমৎকার, আধুনিকা এক নারী তিনি। জন মাঝে মাঝেই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান এমন একজন আদর্শ স্ত্রী পাবার জন্য।
অ্যান কোন হাউসকিপার রাখেননি। নিজেই বাড়ির বিষয় তদারক করেন। কোন অতিথি আসার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই না, অতিথিরা যে কামরাগুলোতে থাকবেন নিজে একবার সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আসেন। এদের মধ্যে সেরাটা বরাদ্দ থাকে গুরুত্বপূর্ণ বা তাঁদের খুব কাছের মানুষদের জন্য। ওই কামরাটা পরিচিত ওক বেডরুম নামে। ভারী ওকের প্যানেল, বিশাল খাট এবং পর্দায় ওক পাতার ছবির কারণেই এমন নামকরণ। কামরাটা একটু অন্ধকার হলেও সবার বেশ পছন্দ হয় এর আভিজাত্যের জন্য। অ্যান এই কামরাটা সবসময় যেন রেডি থাকে এ বিষয়ে চোখ-কান একটু বেশিই খোলা রাখেন।
শরতের এক সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে অন্ধকাররা আলোদের হটিয়ে জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কয়েকটা বালিশ নিয়ে ওক বেডরুমের সামনে হাজির হলেন অ্যান। এক লেখক বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন জন। ফ্লিট স্ট্রিটের অফিসের গোলমালের চেয়ে তাঁর লেখার বিষয়ে বাড়ির শান্ত পরিবেশে আলাপ করাটাই ভাল মনে হয়েছে। বালিশগুলোর তদারকিতে যে মেয়েটা সে একেবারেই নতুন এসেছে। তাই নিজেই বিষয়টা দেখভাল করছেন অ্যান।
ওক বেডরুমের তালাটা পুরানো। ওটা খুলতে একটু ঝক্কি পোহাতে হয়। হাতে বালিশ থাকায় আরও বেশি বেগ পেতে হলো অ্যানকে। যখন কামরায় ঢুকলেন বোঝাটা নামিয়ে রেখে একটা মোমবাতির খোঁজ করলেন আলো জ্বালতে। এই কামরাটায় বিছানাটা ঠিকঠাক করার জন্য এটা দরকার।
মোমবাতির খোঁজে যখন হাত বাড়ালেন তখনই একটা জিনিস আবিষ্কার করে থমকে গেলেন। কামরাটায় তিনি একা নন। দূরের জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। এক পলকেই অ্যান বুঝে গেলেন সে হালকা-পাতলা দেহের এক তরুণী। লম্বা চুল নেমে গেছে অনেকটা পর্যন্ত। পশমী পেটিকোটের ওপর সাদা একটা শাল চাপিয়েছে। জানালা গলে আসা আবছা আলোতেঁ সিল্কের কাপড়টা ঝিকমিক করে উঠতে দেখলেন অ্যান। ব্যগ্রভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে মেয়েটা, জানালা দিয়ে যেন নিচের বাগানে কিছু একটা দেখছে।
খুব একটা চিন্তা না করেও অ্যানের মনে পড়ে গেল, ভৃত্যরা সবাই চা খাচ্ছে, আর ছেলে-মেয়েরা নার্সারিতে। এটা তাদের কেউ নয়। একটা সম্ভাবনাই বাকি আছে, তা হলো অচেনা কেউ কোনভাবে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু অ্যান বুঝতে পারলেন সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে আসা তার পক্ষে অসম্ভব, কেউ না কেউ দেখতই। হঠাৎই অ্যানের মনে হলো স্বাভাবিক কোন কিছু দেখছেন না তিনি। ভয়ে কেঁপে উঠল শরীরটা। কী মনে করে চোখের সামনে একটা হাত নিয়ে এলেন। যখন ওটা সরালেন মেয়েটা অদৃশ্য হয়েছে।
রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তাঁর আতঙ্কে। তবে ভয়ে নিজের কাজ থেকে বিরত থাকবেন এমন মহিলা তিনি নন। কাঁপতে থাকা হাতে বিছানাটা গোছগাছ করলেন।
ঘটনাটা কাউকে বললেন না, এমনকী স্বামীকেও। পরদিন সকালে যখন অতিথি নাস্তা করতে খাবার রুমে এলেন, আশঙ্কা নিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন অ্যান। তিনি কী বলেন এটা ভেবে। নাকি এখনই একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাঁকে লণ্ডন পৌঁছে দিতে বলেন আবার। কিন্তু তাঁকে বেশ হাসি- খুশিই দেখাল। বরং গৃহকর্ত্রীকে আরামদায়ক শয্যা এবং কামরার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। অ্যান মনে মনেই বললেন, তবে কি ভুল দেখেছেন? আলোর খেলা ছিল ওটা? কই, অতিথির তো কোন সমস্যাই হয়নি রাতে!