রিভলভারটা হাতে নিয়ে পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে শব্দ লক্ষ্য করে এগুতে লাগলাম। বৃষ্টি ও আলোর স্বল্পতা হেতু সামনে কয়েক ফুটের বেশি দৃষ্টি যাচ্ছে না। পথে কোন ধরনের বাধা থাকতে পারে এটা ভাবিনি। হঠাৎ কাঠের একটা মঞ্চের মত জায়গায় হোঁচট খেলাম। এটার ওপরে উঠব নাকি পাশ কাটিয়ে যাব ভাবছি, এসময়ই দেখলাম আমার কাছেই একটা চৌকির ওপর একটা লোক বসে আছে। বয়স খুব বেশি নয়, পরনে কালো একটা স্যুট। মুখটা হাত দিয়ে ঢাকা থাকায় চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। মাথায় টুপি নেই। উন্মুক্ত মাথায় অনবরত বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। তারপর গড়িয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে নিচে।
বাহুতে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এমন বৈরী রাতে এখানে বসে কী করছে। সে কি অসুস্থ? আমি কি তার জন্য কিছু করতে পারি? জবাবে ভয়ানকভাবে গুঙিয়ে উঠল লোকটা। ধীরে ধীরে মুখ তুলল। ওহ্, খোদা, এ তো জ্যাক। এতটাই বিস্মিত যে কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেললাম। কেবল অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলাম।
‘জমে গিয়েছি প্রায়,’ বিড়বিড় করে বলল সে, ‘চার রাত ধরে এখানে বসে আছি।’
‘চার রাত,’ বিস্মিত কণ্ঠে প্রতিধ্বনি তুললাম, ‘হায়, ঈশ্বর! তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ, জ্যাক!’.
মাথা ঝাঁকাল সে। সেখান থেকে পানি টপ টপ করে পড়ল আমার কাপড়ে।
‘না,’ বলল সে, ‘আমি পাগল হইনি। এখানেই আছি।’ তারপর নিজের দিকে একবার তাকিয়ে যোগ করল, ‘তোমাকে বলে কোন লাভ নেই। বুঝবে না।’
‘আমাদের শেষবার দেখা হবার পর নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে,’ মত প্রকাশ করলাম, ‘একটা মোটামুটি মাথা গোঁজার মত জায়গায় পৌঁছার পরে আশা করি গোটা বিষয়টা বুঝিয়ে বলবে। আমার ধারণা কোন ধরনের মানসিক যন্ত্রণা এবং বৃষ্টিতে ভেজা এই দুইয়ে মিলে তোমার মাথাটা গেছে। এখন বাড়ি গিয়ে এক বোতল হুইস্কি সাবাড় করা উচিত তোমার।’
‘না,’ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, ‘ওখানে আর কখনও যেতে চাই না। বরং তোমার আস্তানায় নিয়ে চলো।’
কী করা যায় বুঝতে না পেরে রাজি হলাম। খুব দ্রুতই শর্টকাটে আমাকে হোটেলের কাছে নিয়ে এল সে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল হোটেলের মালকিন মহিলা। আমার বন্ধুটির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা মহিলাটিকে একই সঙ্গে ভীত করেছে এবং চমকে দিয়েছে। অবশ্য আমি খুব একটা বিস্মিত হলাম না এতে। কারণ জ্যাকের গাল অস্বাভাবিক রকম সাদা, চুল ভেজা, চোখ অস্বাভাবিক বড় এবং কেমন যেন রক্তাভ হয়ে আছে। সাপার রুমে আমরা ঢুকতেই অন্য অতিথিরা দূরে সরে গেল। ফলে বড় একটা টেবিল শুধু দু’জনের জন্য দখলে পেতে কোন অসুবিধা হলো না। চমৎকার স্বাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। ঠাণ্ডা রোস্ট চিকেন, সালাদ, মিষ্টান্ন, কমলার জুস এবং ওপরতোর বিখ্যাত ওয়াইন। আমি রীতিমত খাদকের মত খেলাম। তবে জ্যাক একটা কিছু স্পর্শ করল না।
হতাশার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। ও যে পাগল হয়ে গেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। ‘তোমার ব্যাপার- স্যাপার বুঝতে পারছি না মোটেই। কয়েকদিন ধরেই কিছু খাচ্ছ না নাকি?’ জানতে চাইলাম।
‘সোমবার থেকে,’ জবাব দিল জ্যাক, ‘আজ শুক্রবার। সোমবার সকালে পাউরুটি আর কোকো খেয়েছি।’
তারপর স্কুলজীবনের গল্প করতে লাগলাম। তবে তার এখনকার জীবন, এখনকার বাড়ি, আর ওই সুন্দরী নারী যাকে জ্যাকের স্ত্রী ভেবেছি, এগুলো সম্পর্কে কিছুই বলল না।
বেশ খরচ হলেও ওর জন্য একটা কামরার ব্যবস্থা করলাম। সেখানে বেশ রাত পর্যন্ত গল্প করলাম।
‘ঠিক আছে,’ ঘড়ির কাঁটা দুটোয় পৌঁছলে অবশেষে বলল সে, ‘বুড়ো বন্ধু, এবার যাও, আমাকে এখানে রেখে। সকালে হয়তো এখনকার আমার সঙ্গে একটু পার্থক্য চোখে পড়বে। তবে যা-ই ঘটুক, আর তোমাকে লোকেরা যা-ই বলুক, সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা কোরো।
কথা শেষ করে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল। হতবুদ্ধি অবস্থায় কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম। পরের দিন সকালে কী অবস্থায় তাকে পাব এ ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই আমার। তবে যে কোন কিছুর জন্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত আমি। তবে পরে যেটা জানতে পারি সেটা ছিল আমার জন্য বড় এক ধাক্কা।
সকালে জ্যাকের কামরায় গিয়ে দেখলাম রাতে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম সে অবস্থাতেই আছে বিছানায়। মাথাটা একটু দরজার দিকে ঘোরানো। হালকাভাবে স্পর্শ করলাম তাকে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। কপাল ছুঁলাম। বরফের মত ঠাণ্ডা। মাথাটা ধরতেই এক পাশে হেলে পড়ল নিষ্প্রাণভাবে। কোটের কলার সরাতেই গলাটা উন্মুক্ত হলো। ওটা নীল, ফোলা আর…। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে কামরা থেকে ছুট লাগালাম।
একজন চিকিৎসক ডাকা হলো।
ডাকা হলো। তাকেসহ বন্ধুর শয্যাপাশে এলাম। মৃতদেহটা দেখেই ভয় আর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর মৃতদেহের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল, ‘ঈশ্বর! সে এখানে কীভাবে এল? জ্যাক অ্যান্ড্রু, খুনিটা, সোমবার সকালে জনসমক্ষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে! এ কী করে সম্ভব!’
এই ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাটালাম। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে জনের শেষ শব্দ কয়টা, ‘সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা কোরো!’
সুস্থ হয়েই খোঁজ-খবর শুরু করলাম। যাকে হত্যার অভিযোগে জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তার নাম কারলোটা গডিভেজ, যে মহিলার সঙ্গে সে বাস করত। লণ্ডনে জ্যাকের সঙ্গে যে সুন্দরীটি ছিল এ-ই সে বুঝতে সমস্যা হলো না আমার।