কিন্তু জ্যাকের কোন দেখা নেই। একই সঙ্গে হতাশ ও ক্রুদ্ধ হলাম। কেন এল না? আমার সঙ্গে কি তবে মজা করল? প্রধান শিক্ষক সি. গ্রের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন অ্যাণ্ডুর একটা বক্তব্যও দেয়ার কথা। আসবে না, এমন কিছুও জানায়নি। নিশ্চিতভাবেই ভোজের আগেই হাজির হয়ে যাবে। এই আশা নিয়ে অন্য অতিথিদের সঙ্গে হলে প্রবেশ করলাম। সেখানে বয়সে বেশ কয়েক বছরের ছোট দু’জন প্রাক্তন ছাত্রের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। খাবারটাও খুব একটা পছন্দ হলো না। খাওয়া শেষে একটার পর একটা মিনিট পেরোতে লাগল এবং আরও বেশি করে অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলাম। জ্যাকের জন্য রীতিমত উদগ্রীব হয়ে উঠেছি। হঠাৎই মনে হলো মাঝখানের বিশটা বছর যেন এক লহমায় নেই হয়ে গেছে। সত্যি আমি যেন এখনও স্কুলে পড়া সেই ছেলেটি, বালক মনের সেই উত্তেজনা, ভয় সব কিছুই অনুভব করতে পারছি। আমার বাম পাশে তিনটা সিট পরে জ্যাকের আসন। কিন্তু জায়গাটি ফাঁকা, জ্যাক আসেনি। সে শেষপর্যন্ত আমাদের বোকা বানিয়েছে। চেয়ারে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে, ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিলাম। হঠাৎ শরীরে শীতল একটা অনুভূতি ঘুরে তাকাতে বাধ্য করল আমাকে। দেখলাম, লাজুক জ্যাক কোন্ ফাঁকে তার আসনে এসে বসে আছে।
এটাকে কল্পনা ভেবে, চোখ বন্ধ করলাম। যখন চোখ খুললাম দেখলাম, জ্যাক এখনও সেখানে আছে।
‘জ্যাক!’ সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম, ‘জ্যাক!’
তবে অ্যান্ড্রু জবাব দিল না। মনে হচ্ছে শুনতে পায়নি। সিটে চুপচাপ বসে আছে। কনুইদুটো টেবিলের ওপর। চোখ নিচের দিকে। ছোটবেলাতেও এভাবেই বসে থাকত, মনে পড়ল। এসময়ই আমার পাশের একজন জানতে চাইল আমি কী চাচ্ছি? মি. অ্যাণ্ডুর কাঁধে টোকা দিতে বললাম। সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। ‘মি. ফ্ল্যামারিক, স্কুলবেলা থেকেই কি এরকম মস্করা করতে পছন্দ করো?’
জবাব দিতে যাব এসময় হাউস-শিক্ষক বক্তব্য শুরু করার ঘোষণা দিলেন। আমার এবং জ্যাক দু’জনেরই কথা বলার কথা। এসময়ই আমাকে চমকে দিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, জে. এল. অ্যান্ড্রু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপস্থিত হতে না পারায় তার বদলে অন্য একজন প্রাক্তন ছাত্র বক্তব্য দেবেন।
‘জ্যাক এখানে নেই!’ নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। ‘হয় হাউস-শিক্ষক পাগল হয়ে গিয়েছেন, নতুবা আমি। তাকে এত পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে তাহলে?’ এসব যখন ভাবছি তখনই আমার বন্ধুর চেহারাটা ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গেল। হাউস-শিক্ষকই ঠিক তাহলে। জ্যাক এখানে নেই।
ওই সময়ই শরীরের শীতল অনুভূতিটার কথা মনে হলো। নিশ্চিত হয়ে গেলাম মোটেই ভুল দেখিনি, কোন ধরনের আত্মার কারসাজি ব্যাপারটা। যা হোক, আমার সময় হলে বক্তব্য দিলাম। তবে জ্যাকের চেহারাটা তাড়া করে বেড়ানোয় মনোযোগ দেয়া কঠিন হচ্ছিল। রাতে যখন বিছানায় গেলাম তখনও ওর কথা ভুলতে পারছিলাম না।
‘এটা খুব অদ্ভুত! অ্যান্ড্রু আমাদের বিষয়টি জানালই না, ‘ পরদিন হাউস-শিক্ষক বললেন, ‘তার কাছ থেকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে একটা চিঠি আশা করেছিলাম। কিন্তু কিছুই আসেনি। হয়তো সে তোমাকে লিখবে। কী হয়েছে জানাতে ভুলো না।’ তাঁকে কথা দিয়ে আর কাউকে বিদায় জানানোর জন্য অপেক্ষা না করে রেলস্টেশনের দিকে রওয়ানা হলাম।
ব্রুক স্ট্রিট, আমার খাস কামরা। অন্য দিনের থেকে তাড়াতাড়িই আজ বিছানায় গেলাম। একপর্যায়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। পাশের গির্জার ঘড়িতে দুটো বাজার ঘণ্টা বাজতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো যেন ভারী একটা কিছু আছে বিছানায়। হাত বাড়াতেই আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করলাম একটা মাথায় পড়েছে হাতটা। চুল থেকে চুইয়ে পানি পড়ছে। এতটাই ভয় পেলাম যে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এভাবে কতক্ষণ কাটিয়েছি বলতে পারব না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম ভারী ওজনটা আর বিছানায় নেই। ওটা বিদায় নিয়েছে। কেন যেন মনে হলো এই ভৌতিক ঘটনার সঙ্গে স্কুলের ওই ঘটনার সম্পর্ক আছে। অ্যাণ্ডুর কি তবে কিছু হয়েছে? বার্সেলোনায় যেতে হবে আমাকে, স্থির করে ফেললাম।
সকালে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা জিনিস নিয়ে ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। কয়েকদিন পরের এক সন্ধ্যায় পৌছলাম বার্সেলোনা। হোটেলে জিনিসপত্তর রেখে জ্যাক যে পত্রিকা অফিসে কাজ করে সেখানে গেলাম। তবে আমাকে মোটেই সাদর অভ্যর্থনা জানাল না তারা। বলল অ্যান্ড্রু আর এখানকার স্টাফ নয়, তার ঠিকানাও জানা নেই তাদের। আর জানা থাকলেও তাতে আমার কোন লাভ হবে না। তাদের চেহারায় অদ্ভুত এক হাসি খেলা করতে দেখলাম।
মনে হলো জ্যাককে ঘিরে একটা রহস্য দানা বাঁধছে। হয়তো পত্রিকার লোকেরা ওর সম্পর্কে কিছু জানে, কিন্তু বলতে চাইছে না। তারপর গেলাম আমাদের দূতাবাসে। ওটা বন্ধ, কাল এগারোটার আগে খুলবে না। হাতে এখনও কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। কী করব বুঝতে না পেরে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। একপর্যায়ে একটা মার্কেটের মাঝখানের চত্বরের সামনে চলে এলাম। কয়েকটা গ্যাস ল্যাম্পের আলোয় আঁধার খুব কমই দূর হচ্ছে। চতুর্ভুজাকৃতির জায়গাটা খোয়া দিয়ে বাঁধানো। ইংল্যাণ্ডে এ ধরনের চত্বর আরও অনেক দেখেছি। বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে ইতোমধ্যে। বিকালের দিকে শহরের ওপর ঝুলে থাকা ভারী কুয়াশা এখন ভারী বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে। দ্রুতই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। আমি হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরব, এসময় মৃদু একটা গোঙানির মত শুনলাম মনে হলো। পাকা চত্বরটির মাঝখান থেকে আসছে শব্দটা। কাউকে কি খুন করা হচ্ছে? নাকি এটা আমার জন্য একটা ফাঁদ! আবারও গোঙানির শব্দ শুনলাম। নিশ্চিতভাবেই কেউ খুব যন্ত্রণায় এমন শব্দ করছে, আমার ভেতরের সমস্ত দ্বিধা চলে গেল।