ছ’হপ্তা পরের ঘটনা। এক শিকারি ফ্রেঞ্চম্যান’স আইল্যাণ্ডের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ প্রবল তুষার ঝড়ের মধ্যে পড়ে পথ হারায় সে। এসময়ই দেখে সাদা ফারের পোশাক পরা বিশালদেহী এক লোক কুকুরেটানা স্লেজ নিয়ে ছুটছে। তাকে অনুসরণ করে লোকটাও পৌছে যায় নিরাপদ জায়গায়। সরাইখানায় পৌঁছে গা গরম করতে করতে খুলে বলে ঘটনা। কিন্তু সেখানে উপস্থিত সরাইমালিকসহ অন্যরা জানায় আজ আর কেউ ওই দিকে যায়নি। তখনই সবার মনে পড়ে স্মোকারের প্রতিজ্ঞার কথা। তবে তখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিল না। তারপর যখন একের পর এক শিকারি ওই দীর্ঘকায় সাদা পোশাকের রহস্যময় লোকটির কারণে বৈরী আবহাওয়ায় পথের দিশা পেতে লাগল, তখন আর কারও বুঝতে বাকি রইল না স্মোকার তার কথা রেখেছে।
কত মানুষকে সে বাঁচিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। এমনকী জীবিত থাকা অবস্থায় যে পুলিস সদস্যরা ছিল তার দুশমন তাদেরও বাঁচায় স্মোকার। দু’জন পুলিস কর্মকর্তা এমনই এক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। জর্জ বেটসন ও এড রিয়োপল তাঁদের নাম। ১৯৪৯ সাল। এই দুই কর্মকর্তা তুষার ঝড়ে পথ হারান। এসময়ই প্রবল ঝড়ের মধ্যে কুকুরের একটা দলকে স্লেজ টানতে দেখেন। ওটার সঙ্গে আছে সাদা পোশাকের দীর্ঘদেহী এক লোক। দেরি না করে দলটাকে অনুসরণ শুরু করেন তাঁরা। দুই ঘণ্টা ওদের পিছন পিছন যাবার পর দেখেন পুলিসের একটা ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছেন। এদিকে ওই কুকুরের দল, স্লেজ এবং লোকটা অদৃশ্য হয়েছে। মজার ঘটনা যে স্মোকার জীবিত থাকা অবস্থায় ছিল মানুষের আতঙ্ক, এমনকী বাচ্চাদের ভয় দেখাতেও ব্যবহার করা হত তার নাম, মারা গিয়ে সে হয়ে গেল উপকারী এক প্রেতাত্মা। লোকেরা বলে স্মোকারের দেখা পেয়েছ মানে তুমি বেঁচে গেছ। সে তোমাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে না দিয়ে যাবে না।
পিটার অ্যানডোনি ছিলেন বুড়ো এক শিকারি। স্মোকার সম্পর্কে তাঁর বিস্তর জ্ঞান। তাঁর কথা হলো, ‘ঝড়ের সময় খুব বিপদে পড়েছ, এসময় তোমার কুকুরগুলো যদি হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করে বুঝবে স্মোকার ধারেকাছেই আছে। তাকে খুঁজে বের করে অনুসরণ করো, ব্যস, তোমার আর কোন সমস্যা হবে না। এ পর্যন্ত হাজারের বেশি মানুষকে বাঁচিয়েছে এই ভাল প্রেত।
অ্যান্ড্রু এসেছিল
স্কুল ও কলেজগুলোতেও নানা ধরনের ভূতের খবর পাওয়া যায়। এবারের ঘটনাটি ইংল্যাণ্ডের চ্যারিং ক্রস থেকে দুই মাইল দূরের বিখ্যাত বি. স্কুলের। বর্ণনাকারী মার্টিন ফ্ল্যামারিকের মুখ থেকেই বরং এটা শুনি।
১৮৭০-এর আগস্টের এক সন্ধ্যা। স্লোয়েইন রোডে হঠাৎই বি. স্কুলের পুরানো বন্ধু জ্যাক অ্যাণ্ডুর সঙ্গে দেখা। বহু বছর তার সঙ্গে দেখা নেই। সঙ্গে এক মহিলা। দীর্ঘদেহী, চোখা চেহারার এই নারী নিঃসন্দেহে বিদেশী। এতটাই সুন্দরী যে চেহারা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না।
‘আমি দুঃখিত, গল্প করার জন্য দাঁড়াতে পারছি না,’ বলল অ্যান্ড্রু। ‘তাড়া আছে খুব। রাতেই স্পেনের বার্সেলোনার উদ্দেশে ইংল্যাণ্ড ছাড়ছি। এখন ওখানেই থাকি। ‘অ্যাংলো- বার্সেলোনিয়ান’ নামের একটা ইংরেজি পত্রিকায় চাকরি করি। ডিসেম্বরে স্কুলের অনুষ্ঠানে আসছ তো?’
জানালাম, ইতোমধ্যে প্রধান শিক্ষককে আমার উপস্থিত থাকার বিষয়টা নিশ্চিত করেছি।
‘তাহলে ভালই হলো। আমিও থাকব। হাউস সাপারে একটা বক্তব্যও দেয়ার কথা আমার। বড়দিনে স্পেনে থাকার ইচ্ছা নেই আমাদের। ইংল্যাণ্ডেই বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময়টা কাটাব। তখন তোমার সঙ্গে দেখা হবার অপেক্ষায় থাকলাম। অনেক কিছু বলার আছে। এখন কেন দাঁড়াতে পারছি না আশা করি বুঝতে পারছ। গুড লাক, বন্ধু।’ এই বলে চলে গেল তারা। ঘুরে তাকিয়ে ভিক্টোরিয়ার একটা বাসে উঠতে দেখলাম। অ্যাণ্ডুর সঙ্গে দেখা হয়ে সত্যি খুব ভাল লাগছিল। কারণ আমার বি. স্কুলের ঘনিষ্ঠ দোস্তদের একজন ছিল সে। এক ক্লাসে একই সঙ্গে ভর্তি হই। স্কুল ছাড়ার পর মাঝখানের দীর্ঘ সময়ে একবার ছাড়া দু’জনের আর দেখাই হয়নি।
সে মেয়েটার সঙ্গে কেন পরিচয় করিয়ে দিল না এটা ভেবে অবাক লাগল। তবে এটাও ঠিক তাদের খুব তাড়া ছিল। নিঃসন্দেহে নারীটি তার স্ত্রী। সৌভাগ্য আর কাকে বলে! এত সুন্দরী একটা বউ পেয়েছে। চোখা চেহারা, রসালো ঠোঁট, টানা টানা চোখ, লম্বা পা। উঁচু হিল পরে ছিল। মোজার ফুটো দিয়ে গোলাপী পা দেখতে পাচ্ছিলাম। আবার ভাবলাম, হয়তো তার বোন। তাহলে আমার একটা সুযোগ তৈরি হয়। হয়তো আমাকে বার্সেলোনায় তাদের বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াতও দেবে। বার্সেলোনা নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। জ্যাককে লম্বা-চওড়া একটা চিঠিও পাঠালাম। তবে বন্ধুর চিঠি পেয়ে কিছুটা দমে গেলাম। ওই মহিলা কিংবা বাড়িতে দাওয়াতের ব্যাপারে কিছু বলেনি। স্কুলের পুরানো দিনের কথা বারবার লিখেছে। অনুষ্ঠানটার ব্যাপারে তার বেজায় আগ্রহ, কোথায় আমাদের দেখা হবে এসব বিষয়ে লিখেছে। এভাবে কয়েকবার চিঠি চালাচালি হলো। শেষবার তার চিঠি পেলাম নভেম্বরের ২৫ তারিখ। তারপর আর কোন খবর পেলাম না। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ ইংল্যাণ্ডের জাহাজে চেপে বসার কথা।
শেষ পর্যন্ত এল ঘটনাবহুল সেই সন্ধ্যা। একটা বক্তব্য দেয়ার কথা আমারও। বক্তা হিসাবে আমি একেবারেই গড়পড়তা ধরনের। তাছাড়া বড়দের সামনে বলা এক জিনিস আর স্কুলের ছেলেদের সামনে বলা আরেক কথা। শুরুর অনুষ্ঠানে অন্তত হাজারখানেক পুরানো ছাত্র উপস্থিত ছিল নতুনদের পাশাপাশি। স্কুলের সঙ্গীতটা যখন হলো মনে হচ্ছিল যেন শব্দে কানে তালা লেগে যাবে। ছাত্ররা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল হাউস সাপারের জন্য। স্কুল-দালানের প্রবেশ পথে অ্যাণ্ডুর আমার সঙ্গে দেখা করার কথা। ‘গানের সময় সম্ভবত উপস্থিত থাকতে পারব না, তবে স্কুলের পুরনো দালানটার সামনে সাড়ে নয়টার দিকে হাজির হতে ভুল হবে না।’ বলেছিল সে।