‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আচ্ছা, স্যর, আপনার কাছে কি আপনার স্ত্রীর কোন ছবি আছে?’ জানতে চাইলাম।
‘হ্যাঁ, সঙ্গেই আছে। আমার মনে হয়েছিল আপনি দেখতে চাইতে পারেন, লেখকদের কৌতূহল বেশি থাকে জানি আমি,’ এই বলে একটা ছবি এগিয়ে দিলেন।
ওটা পরীক্ষা করতে যাব এমন সময় দরজায় মৃদু একটা টোকার শব্দ। মিসেস স্মিথ নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ, হালকা-পাতলা গড়নের মহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। ডি কোসার্ট যাওয়ার জন্য উঠলেন। এদিকে মহিলাটির ততক্ষণে ছবিটির দিকে চোখ পড়েছে। চেঁচিয়ে উঠলেন উত্তেজনায়, ‘ওহ্, খোদা! এটা কি মিসেস ফার্নিস নয়?’
‘আপনি কি একে চেনেন?’ এই বলে ছবিটা ভদ্রমহিলার সামনে ধরলেন।
‘আপনিই কি সেই লেখক?’ মিসেস স্মিথ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।
‘না, আমি এই মহিলার স্বামী।’
‘কিন্তু ইনি তো মিসেস ফার্নিস। তাই নয় কি?’ আমার টেনে দেয়া আসনটায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা।
এই মুহূর্তে আমার একটু ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করলাম। ডি কোসার্টের উদ্দেশে বললাম, ‘মিসেস স্মিথও আপনার মত ‘দ্য ডিকনস’-এর ব্যাপারে আগ্রহী। তাই তিনি আজ সকালে এখানে এসেছেন। তাঁর কী বলার আছে বরং শোনা যাক।’ তারপর মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ম্যাম, আপনি সব কিছু খুলে বলুন। আমার মত এই ভদ্রলোকেরও ওই বাড়ি নিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আছে।’
‘তবে,’ বলা শুরু করলেন মিসেস স্মিথ, ‘যা বলব এটা নিয়ে আমাকে কোন ঝামেলায় ফেলবেন না তো আবার! অবশ্য তাতেও খুব একটা কিছু আসে-যায় না। কারণ খুব দ্রুতই এ পৃথিবীর মায়া কাটাতে হবে আমাকে। আমার স্তন, গলা ও একটা ধমনীর ঠিক ওপরে—মোট তিন জায়গায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসক বলেছেন ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’ কথাগুলো বলে একটু সময় চুপ করে থাকলেন ভদ্রমহিলা। হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করলেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘আমি বাস করতাম হ্যাম্পস্টিডে। তিন বছর আগে স্বামীকে হারাই। ব্রাইট’স ডিজিজে (কিডনির এক ধরনের রোগ) মারা যান তিনি। এর কিছুদিন আগেই লণ্ডি দিয়েছিলাম একটা। সেই সূত্রে মিসেস ফার্নিসের সঙ্গে যোগাযোগ। ‘দ্য ডিকনস’-এ থাকতেন ভদ্রমহিলা। আমার স্বামীর রোগের ব্যাপারে প্রথম দিন থেকেই তাঁর অদ্ভুত একটা আগ্রহ দেখি। তবে এটায় খুব একটা গুরুত্ব দিইনি প্রথমে। তারপরই একদিন আমার বাসায় হাজির হলেন হঠাৎ। আমার ছোট্ট পার্লারটিতে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় স্বামীর অসুস্থতার পেছনে বড় ধরনের খরচ হয় তোমার।’
‘হ্যাঁ, ম্যাম। কুলাতে পারছি না একেবারেই।’ অ্যাপ্রনের কোনা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম।
‘তার কি সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে?’
‘না, ম্যাম। ডাক্তার বলেছেন আর বড়জোর কয়েকটা দিন।’
‘ডাক্তার কয়দিন পর পর আসেন?’
‘আমি ডাকলে তবেই আসেন।’
‘এবার তাঁর পেলব হাতটা দিয়ে আমার কাঁধ স্পর্শ করে গলা নামিয়ে বললেন, ‘তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। কিছু টাকা-কড়ি পেলে নিশ্চয়ই ভালই হয়। একশো পাউণ্ড হলে চলবে?’
‘স্বীকার করলাম আমার মত এক দরিদ্র নারীর জন্য একশো পাউণ্ড বিশাল ব্যাপার।
‘খুব ভাল।’ মিষ্টি হেসে বলতে শুরু করলেন, ‘এর বিনিময়ে আমি চাইব তোমার স্বামীকে মৃত্যু পর্যন্ত বাকি কয়েকটা দিন আমার বাড়িতে এনে রাখো। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি দ্য ডিকনস-এ তার ভালমতই দেখাশোনা হবে। আর তুমি তো বলেছই বড়জোর কয়েকটা দিন বাঁচবে সে। কোথায় মারা গেল এটা নিশ্চয়ই তোমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মারা যাবার পর তোমার বাড়িতে গোপনে নিয়ে আসা হবে মৃতদেহ। এখান থেকেই গোর দিতে নিয়ে যেতে পারবে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না।’
‘প্রস্তাবটা এতটাই অস্বাভাবিক যে, কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না।‘
‘কিন্তু, ম্যাম, তুমি কেন এটা করছ?’
ওহ! আমি বললেও বুঝবে না।’ রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললেন তিনি, ‘এখন একশো পাউণ্ড কামাতে চাইলে রাজি হয়ে যাও।’
‘আমি জানি মিসেস ফার্নিস কথা দিয়ে না রাখার মানুষ নন। কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। আমার স্বামীকে সব কিছু বলতে আপত্তি করলেন না। আসলে তাঁর হারানোর কিছু নেই। ভাবলেন এতে যদি আমাদের কিছুটা উপকার হয়! আমি আর আমার ছেলে জিম রাতের আঁধারে স্মিথকে ‘দ্য ডিকনস-এ নিয়ে গেলাম। তিন রাত পর তাঁর মৃতদেহ বাড়িতে নিয়ে এলাম। ডাক্তার জানালেন তাঁকে খবর দিয়েও কোন লাভ হত না। কারণ কোন কিছুই আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারত না। একশো পাউণ্ড পেলাম আমরা। মুখ বন্ধ রাখলাম আমি আর আমার ছেলে। তবে একটা বিষয় জেনে আমাদের মনটা বেশ খচখচ করতে লাগল। মি. ফার্নিস নাকি আমার স্বামী যে সময় মারা গিয়েছেন তখনই মারা যান এবং ওই একই রোগে।’
ডি কোসার্টের সঙ্গে চোখাচোখি হলো আমার। ঘৃণায় রি রি করছে আমাদের শরীরটা।
‘আপনি নিশ্চিত মি. ফার্নিস ব্রাইট’স ডিজিজে মারা গিয়েছে?’ জানতে চাইলাম।
‘আমি তাই শুনেছি,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিলেন মহিলা, ‘কয়েকজনই একই কথা বলেছে। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তেমন কেউ ছিল না। কেবল মিসেস আর ভাড়ায় শোক করা কয়েকজন মানুষ। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মনে হয় ভদ্রলোকের বনিবনা ছিল না। আমি আর জিম বিষয়টি ভুলতে পারিনি। অনেক সময়ই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখি। বেশিরভাগ সময় জ্যান্ত গোর হওয়ার দৃশ্য এবং মিসেস ফার্নিসের সাদা, পেলব হাতজোড়া দেখি।’