নিজের বন্ধুদের কথা ভাবলাম। আমি যে বেঁচে আছি তা যদি জানাতে পারতাম তাদের। কী খুশি হত তারা! ভাবত চিকিৎসক ভুল করেছেন। তাদের বন্ধু শ্বাস নিতে পারছে। দ্রুত তারা দৌড়ে আসত আমাকে বাঁচাতে। তারপরই নির্মম সত্যটা উপলব্ধি করতে পারলাম। আমার অবস্থা তাদের জানানোর কোন সুযোগই নেই। এখানেই একাকী মরতে হবে আমাকে। চোখ বন্ধ করেই যেন গোরস্থানের চারপাশের কাদাটে মাটির স্তূপ, দু’পাশের সমাধিগুলো দেখতে পাচ্ছি। আশ্চর্য ব্যাপার ওগুলোর ভিতরটাও দেখতে পাচ্ছি। দাঁতহীন, ধূসর চুলের ওই মহিলা, ওই বাচ্চাটার খুদে আধো বিকশিত কঙ্কাল। একটার পর একটা সারি ধরে প্রত্যেককেই দেখতে পাচ্ছি। তাদের দিকে তাকাতেই দেঁতো হাসি দিচ্ছে। কেঁপে উঠছি। আবার তাকাতেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপরই দেখলাম বীভৎস চেহারার একটি অদ্ভুত ধরনের প্রাণী গড়িয়ে গড়িয়ে শরীর মুচড়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। শরীরটা হলুদ। একসময় পৈশাচিক জিনিসটা আমার পা স্পর্শ করল। ওই পর্যায়ে জ্ঞান হারালাম। মনে হলো যেন বহু সময় পর জ্ঞান ফিরে এল আবার। চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম ‘দ্য ডিকনস’-এর খোলা জানালাগুলোর পাশে বসা অবস্থায়।
ওখানে বসার চেষ্টা করিনি আর কখনও, এক রাতের অভিজ্ঞতাই আমার জন্য যথেষ্ট। এই বাড়ির পুরানো বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হলো আমাকে। শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। এদের দু’জন মি. ডি কোসার্ট এবং মিসেস স্মিথ আমাকে দেখতে এলেন একই সকালে।
প্রথমে এলেন ডি কোসার্ট। লম্বা, হালকা-পাতলা গড়নের এক মানুষ। মাঝবয়সের ভদ্রলোকটি মরিচা-কালো রঙের একটা স্যুট পরে আছেন।
‘আপনার কাছ থেকে কিছু জানার আছে আমার, ডিকনস সম্পর্কে।’ কথাটা বলে একটা চেয়ারে বসার ইশারা করে দরজাটা সাবধানে আটকে দিলাম। পাছে আবার আমার বাক্যবাগীশ ল্যাণ্ডলেডি কিছু শুনে ফেলে।
‘ঠিক বলেছেন। বছর তিনেক আগে দু’বছরের চুক্তিতে ‘দ্য ডিকনস’ লিজ নিই। মাত্র এক রাতই সেখানে কাটাতে পারি। আর কাছেধারেও যেতে চাই না জায়গাটির। কয়েক বছর আগে স্ত্রী গত হয়েছে আমার। বাড়িতে আমার সঙ্গে যান রাশভারী বয়স্ক এক হাউসকিপার, একজন রাঁধুনি ও একজন মেইড। দশটার দিকে সবাই যার যার বিছানায় চলে যাই আমরা। তখন মধ্যরাত। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছি না। এসময় করিডোরে একটা পায়ের আওয়াজ পাই। ওটা আমার দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। এদিকে ওই সময়ই ওপর থেকে একের পর এক ধুপধাপ শব্দ শুনলাম।
‘ভাবলাম হাউসকিপার ওপরের কোন সমস্যার ব্যাপারে বলতে আসছে। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে দরজার দিকে দৌড়লাম। ওটা হাউসকিপার নয় মোটেই, কিন্তু,’ এতটুকুন বলে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন একবার, তারপর আবার শুরু করলেন, ‘বিশালদেহী, আলখেল্লা পরিহিত এক লোক। বুনো, জ্বলজ্বলে চোখ, বসা কপাল, রক্তলাল চোখ। আমার দিকে হাত তুলল সে। বাতাসে নড়ছে আঙুলগুলো। লক্ষ্য করলাম ওগুলোর আগা ভাঙা, রক্ত ঝরছে।
‘ওটা যে একটা প্রেতাত্মা বুঝতে অসুবিধা হলো না, তবে আমাকে আঘাত করতে আসেনি, বরং কোন বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাচ্ছে। তারপরই অদৃশ্য হলো কাঠামোটা। পরমুহূর্তেই এক নারীর দুটো বাহু গলা পেঁচিয়ে ধরল আমার। বিছানায় নিয়ে গিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, কিংবা ভাবলাম জেগে উঠেছি, আবিষ্কার করলাম জ্যান্ত কবর দেয়া হচ্ছে আমাকে। সত্যি জ্ঞান ফিরে পেলাম সকালে, যখন মেইড আমার জন্য গরম পানি নিয়ে এল।
‘বিষয়টা আমাকে এতটাই নাড়া দিল যে আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ-খবর নিলাম লোকটির চেহারার বর্ণনা দিয়ে। দেখলাম মি. রবার্ট ভ্যালেন্টাইন ফার্নিস নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এই বাড়িতেই মারা গিয়েছেন আমি বাড়িতে ওঠার কিছুদিন আগে। তাঁর আত্মীয়- স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের সঙ্গে ভদ্রলোকের খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না অনেক দিন ধরেই। তবে আমার দুঃস্বপ্ন তাদের নাড়া দিল ভীষণ। আবার কবর খুঁড়ে বের করা হলো তাঁর মৃতদেহ। তখনই প্রমাণ পাওয়া গেল জীবন্ত কবরের ঘটনার। তাঁর পাকস্থলীর ভেতরের জিনিস পরীক্ষা করতেই প্রমাণ মিলল ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার মত খুব শক্তিশালী মাদকের। ওই মাদকের কারণেই কোমায় চলে যান। সবাই ধরে নেন ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন। জীবন্ত কবর দেয়া হয় তাঁকে। অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে দেখতে এসেছিলেন যে চিকিৎসক তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়নি। এদিকে তাঁর বিধবা স্ত্রী কোথায় আছে এটাও জানতে পারলাম না।
‘মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে পরে আর দেখা হয়নি। তারপর একসময় ইতালির তুরিনে যাই। সেখানে এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়।
‘তার চেহারার, তবে এর চেয়েও বেশি হাতদুটোর প্রেমে পড়ি আমি।’ কেঁপে উঠলেন ডি কোসার্ট। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দ্য ডিকনস-এ যে হাতদুটো আমায় জড়িয়ে ধরেছিল ঠিক সেগুলোর মতই। কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আমার সব সম্পত্তি তার নামে লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিতে আরম্ভ করল। এখন আর ওই হাতদুটো সোহাগ করে না আমাকে। রাতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি।’