তাঁর চেহারার এমন পরিবর্তন দেখে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। এদিকে বেশ কিছুটা সময় চলার পর দরজার শব্দটা এখন থেমে গিয়েছে। সদর দরজা খুলে কিছু একটা এগিয়ে আসার মৃদু শব্দ পেলাম।
এই চালমাত অবস্থায় প্রফেসর আবারও আমাকে চমকে দিলেন। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে জানালার দিকে দৌড়লেন, সেখান থেকে বারান্দায়, ওই শেষবারের মত দেখলাম তাঁকে আমি।
স্বীকার করতে দোষ নেই ক্ষমতা থাকলে তাঁকে অনুসরণ করতাম। কিন্তু ভয়ে এতটাই অবশ হয়ে গিয়েছে হাত-পা এমনকী গোটা শরীর, নড়তে পারছি না। কেবল আতঙ্ক নিয়ে অতিপ্রাকৃত একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওটা কী? কী দেখব আমি? জিনিসটা কীভাবে ভেতরে ঢুকল?
ঈশ্বর! যাঁরা এই পরিস্থিতিতে পড়েছেন তাঁরাই কেবল ওই সময়ে একজন মানুষের মনের অবস্থা কী হয় তা বুঝবেন। একটার পর একটা সেকেণ্ড পেরোতে লাগল। কিছুটা সময় তেমন কিছুই ঘটল না। তারপরই ধীরে ধীরে কুয়াশার একটা ঘেরাটোপ গোটা কামরাটাকে ঢেকে দিতে লাগল। মেঝের ছায়াগুলো অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল। সিঁড়িতে খুব মৃদু একটা পদশব্দ শুনলাম। আসছে ওটা। নড়ার চেষ্টা করলাম, দৌড়নোর চেষ্টা করলাম, দৃষ্টিটা দরজা ও ল্যাণ্ডিঙের দিক থেকে সরিয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না।
পদশব্দ ধীরে ধীরে আমার আরও কাছে আসতে লাগল। একপর্যায়ে সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে গেল। আমার বরাবর ল্যাণ্ডিঙে দাঁড়িয়ে আছে এখন, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। একসময় কামরাটায় প্রবেশ করল। তবে এখনও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। যখন এগিয়ে এল, দুটো আলাদা গোলাকার আলো দেখতে পেলাম। ধীরে ধীরে দুটো অনিন্দ্যসুন্দর হাতে রূপ নিল। সরু, লম্বা, সাদা আঙুল, গোলাপী নখগুলো পালিশ করা। অনেকগুলো আংটি আঙুলে। হীরা, রুবি, পান্নার মত দামি রত্নপাথর ঝকঝক করছে তাতে। যখন হাতজোড়া আমার কাছাকাছি হতে লাগল, মিষ্টি, মাতাল করা একটা গন্ধ চাবুকের মত আছড়ে পড়ল আমার নাকে। কেউ একজন আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। দামি পশমী গাউনের ছোঁয়া অনুভব করছি। নরম একটা হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরল। উষ্ণ, সুগন্ধি একটা ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম ঠোঁটে। ওই নরম আঙুলগুলো আমার গাল, কপাল, চোখে আদরের স্পর্শ বুলিয়ে দিতে লাগল। সব ভয় দূর হয়ে গেল মন থেকে।
‘হায়, ঈশ্বর!’ উল্লাসে মনে মনে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘এটা যদি চলতেই থাকত আজীবন, তবে কী ভালই না হত!’
নরম আঙুলগুলো এবার মুখ হাঁ করাল আমার। নরম, শীতল একটা তরল নেমে গেল আমার গলা দিয়ে। চেয়ারে মাথাটা ঠেস দিয়ে রাখলাম। কপালে নরম, আদুরে একটা হাতের স্পর্শ। এই স্পর্শে ধীরে ধীরে ঘুমের অতল রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। যখন জাগলাম, আবারও ওই স্পর্শ, মাতাল করা গন্ধের জন্য পাগল হয়ে গেলাম।
‘ফিরে এসো!’ করুণ কণ্ঠে মিনতি করলাম, ‘এক মুহূর্তের জন্য হলেও তোমার সেই স্বর্গীয় স্পর্শ চাই।’ কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। তারপরই আবিষ্কার করলাম কথা বলতে পারছি না। যেমন নড়াতে পারছি না শরীরটা। একটা বিছানায় শুয়ে আছি। কামরায়ও একা নই আর।
আমি দেখতে না পেলেও একাধিক মানুষ বা প্রেতাত্মা আমার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে আছে। আমার মৃত্যু এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়েই আলোচনা করছে তারা। কর্কশ এক জোড়া হাত নির্মমভাবে আমার শরীর মাপছে কফিনে ঢোকানোর জন্য। একপর্যায়ে সেটায় ঢোকানো হলো। পেরেক ঠুকে কফিনের ডালা আটকানো হচ্ছে এখন। নড়ার এবং চিৎকার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছি। কিন্তু যেখানে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেখানেই পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব হলো না। কফিনের কাঠের কেমন গা গুলানো মিষ্টি একটা গন্ধে রীতিমত বমি পাচ্ছে।
তারপর দুই জোড়া হাত কফিনটা তুলে নিল। সিঁড়ি বেয়ে আমাকেসহ নামতে লাগল তারা। ঘোড়ার গাড়িতে তোলা হলো আমার দেহসহ কফিনটা। বুঝতে পারলাম গাড়ির নড়াচড়া এবং ঘোড়াগুলোর হেষা শুনে। তারপর দুলে উঠল আমার শরীরটা। পাথুরে রাস্তায় চলতে শুরু করেছে গাড়ি। কিছুক্ষণ হুঁশ ছিল না। একপর্যায়ে যখন জ্ঞান ফিরল, ভয়াবহ একটা বাস্তবতার সামনে হাজির হলাম। জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে আমাকে।
আবিষ্কারটা এতটাই ভয়াবহ যে জ্ঞান হারালাম। তবে মাটির শীতল, দম বন্ধ করা পরিবেশের কারণে জ্ঞান ফিরে পেলাম আবার। সব ঘটনা একের পর এক মনে পড়তে লাগল।
প্রচণ্ড একটা হতাশা প্রভাব বিস্তার করল আমার ওপর। যে কোন শব্দ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। কিন্তু চোয়াল নাড়াতে পারলাম না। হাতদুটো ছুঁড়লাম। ওগুলো নাড়াতে পারছি এখন। তবে মুখের একটু ওপরে, আমার কাঠের কারাগারের ছাদে বাড়ি খেল ও-দুটো। মাথা ঝাঁকালাম। পা ছুঁড়তে লাগলাম। একপর্যায়ে পায়ের আঙুল ভাঙল। ফেনা, রক্ত মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। হতাশ, পর্যুদস্ত আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
তারপর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। ওপরের অন্ধকারের সমুদ্রটা যেন বুকে ইটের বোঝার মত চেপে আছে। হাঁসফাঁস করতে করতে হাত দিয়ে ওটা সরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম।
আরও একবার স্থির হয়ে গেলাম। মৃত্যুর পর কি এভাবেই অন্ধকার ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে? তারপরই আগের জীবনের কথা, সেখানে একের পর এক ভুলের কথা স্মরণ করলাম। পাপের কথা ভাবলাম। আহ্! একবার যদি মুক্তি পেতাম জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজাতাম। গোরস্থানের ওপরের বাতাসটাকে অনেক মিষ্টি, তাজা, আর ঘাসগুলোকে সবুজ মনে হচ্ছে। একবার যদি সেখানে, পৌঁছতে পারতাম!