অসুস্থ কুইয়ি খুব একটা বাধা দিতে পারেননি। তাঁর কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারের সদস্যরা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। একটা প্রথাগত ছোটখাট চীনা বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে মেয়েটার প্রতিনিধিত্ব করে তার পরিবারের কালপঞ্জি লেখা একটা ফলক।
আশ্চর্য ব্যাপার! বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষের অল্প সময়ের মধ্যে কুইয়ি ইয়ং সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না এই বর্ণনায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই সামান্য ব্যাপারটা কি ওই প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মাটাকে ঠাণ্ডা করে দিল, যেখানে পরে তোমার পছন্দের পাত্রীকে ঠিকই বিয়ে করে সংসার করতে লাগলে?’
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়ং বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। ব্যাপারটা এতটা সহজ নয়। আমাকে ওঝার কথামত প্রতিজ্ঞা করতে হয় প্রথম বাচ্চাটার নাম আমার প্রাক্তন প্রেমিকার নামে রাখব। তাই ওর নাম সু।’
ওই সময়ই সু নামের ছেলেটা আমার কাছে এসে বলল, ‘হ্যালো, আঙ্কেল!’
যেভাবে সে কথা বলল, হাঁটল, চোখের পলক ফেলল, বুক কেঁপে উঠল আমার। সব কিছু অবিকল একটা মেয়ের মত। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম, আমার আশঙ্কা যেন সত্যি না হয়।
শিস বাজায় কে?
স্টিভেন গোহ নামের এক তরুণের কাছ থেকে এবারের কাহিনীটি সংগ্রহ করা।
আমাকে গুরুজনরা বলেছিল, অন্ধকারে গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শিস বাজানো উচিত নয়। কারণ এটা মৃতদের আকর্ষণ করে। তবে এসব গালগপ্পে মোটেই বিশ্বাস নেই আমার। উল্টো ঠিক করলাম মওকা বুঝে একদিন এটা পরীক্ষা করে দেখব।
জালান বাহার গোরস্থানের কাছেই আমার বাসা। এক নিরানন্দ শনিবার। হাতে কোন কাজ নেই। হঠাৎ দুষ্টবুদ্ধিটা মাথায় চাপল। মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর বাইসাইকেল চালিয়ে রওয়ানা হলাম গোরস্থানের দিকে। কাছাকাছি এসে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। এবার সারি সারি সমাধির মাঝখান দিয়ে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এগুলাম। রাস্তাটা প্রচণ্ড অন্ধকার। তবে একটুও ভয় করছে না আমার।
একসময় শিস বাজাতে শুরু করলাম।
চারপাশ একেবারে সুনসান। আমার পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসছিল না। এখন যোগ হয়েছে আমার শিসের আওয়াজ। তারপরই ওটা শুনলাম। আমার পেছন থেকে চাপা একটা শ্বাস নেয়ার শব্দ। ওটা কিছু না ধরে নিয়ে, শিস দিতে শুরু করলাম আবারও।
তারপরই গা-টা শিরশির করে উঠল, আমার পেছনে মৃদু একটা শিসের শব্দ। বেশ অদ্ভুত, তবে সুখ ছড়ানো একটা সুর। কেমন ভেজা ভেজা। এবার ভয় পেলাম। শিস বাজানো বন্ধ করে দিলাম। তবে এখন আরও কাছাকাছি চলে এসেছে শিসের শব্দ। আর একজন-দু’জন নয় গোটা একটা দল যেন যোগ দিয়েছে এতে। চারপাশের সমাধিগুলো থেকেও আসছে একই সুরে শিসের আওয়াজ। তখনই সাইকেলে চেপে এক টানে বেরিয়ে এলাম গোরস্থান থেকে। ভূতবিষয়ক প্রাচীন লোককিচ্ছাগুলো এরপর থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করি।
জ্যান্ত কবর
হ্যাম্পস্টিডের ওয়াল ওয়াক-এর বেশ কাছেই তিনতলা একটা বাড়ি। চারপাশে বেশ কতকটা জায়গায় আর কোন অট্টালিকা নেই। এটি, ‘দ্য ডিকনস’ নামেও পরিচিত। ভুতুড়ে বলে বাড়িটির বদনাম আছে বহু আগে থেকে। অনেক লোকই এর শিকার হয়েছেন। তবে এদের মধ্যে এক অধ্যাপক এবং এক লেখকের অভিজ্ঞতাটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও লোমহর্ষক। একটা গবেষণার প্রয়োজনে একরাত একসঙ্গে এখানে কাটান দু’জনে। লেখকের বর্ণনাতেই তাঁদের সে রাতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
আমাদের অভিযান শুরু করি একতলার পেছনের এক কামরা থেকে, রাত দশটার দিকে। তবে এখানে অনুসন্ধান চালানোর জন্য বাড়ির মালিকের অনুমতি জোগাড়ে যথেষ্ট কাঠ-খড় পোড়াতে হয় আমাদের। আমার স্ত্রী যদি তাঁর পুরানো বন্ধু না হত তাহলে হয়তোবা এটা সম্ভবই হত না। বাড়িটাকে বাছাই করার একটা কারণ এর পরিবেশটাই অন্য রকম, ভৌতিক ঘটনার জন্য অধিকতর মানানসই। দ্বিতীয়ত এর ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোগুলোর একটা বারান্দামুখী। বেশি বিপদ হলে ওই পথে নিচের নরম মাটিতে লাফিয়ে পড়তে পারব আমরা। এখানে একটা বিষয় স্বীকার করে নেয়া উচিত, মানুষ হিসাবে আমি অসম্ভব ভীতু প্রকৃতির। তবে অধ্যাপকের প্রতি আমার অগাধ আস্থা। আমার মনে তাঁর সাহস নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। ভয়ানক পরিস্থিতিতেও তিনি ঘাবড়ে যাবেন বলে মনে হয় না। যদ্দূর জানি ভূত বা প্রেতাত্মা নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। তিনি নাকি এদের গতিবিধি টের পেয়ে যান আগেই।
মূল কাহিনীতে ফিরে আসা যাক। পেছনের ওই কামরাটায় মোটামুটি আধ ঘণ্টা হলো বসে আছি এমন সময় সিঁড়ির বাইরে একটা পদশব্দ শুনলাম বলে মনে হলো। প্রফেসর বললেন, এটা কেবল কাঠের ক্যাচক্যাচ আওয়াজ। তারপর কাঠ ও ধাতব পদার্থের সম্প্রসারণ বিষয়ে নাতিদীর্ঘ এক বর্ণনা দেয়া শুরু করলেন। একপর্যায়ে তাঁকে বললাম বহু বছর আগে স্কুলরুমেও এ ধরনের আওয়াজ শুনেছি। তারপর চুপচাপ বসে, আইভি লতার ছায়াগুলো চাঁদের আলোয় মেঝেতে খেলা করছে তা দেখতে লাগলাম। একই সঙ্গে যে কোন ধরনের শব্দ আমার দৃষ্টি ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তারপরই হঠাৎ পথ ধরে প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে আসা ঘোড়ার খুরের এবং গাড়ির চাকার আওয়াজ পেলাম। একপর্যায়ে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম ঘোড়ার গাড়ি বা যেটাই হোক সেটা ‘দ্য ডিকনস’-এর দিকেই ঘুরে গিয়েছে। এরপরই বাড়ির সামনের পথের পাথরে শব্দ হলো এবং পরক্ষণেই সদর দরজায় জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ। কিন্তু বাড়িতে যখন ঢুকি তখন দেখেছিলাম সদর দরজায় কোন কড়া নেই। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তবে প্রফেসরের দিকে যখন তাকালাম ওই রাতে সত্যিকার অর্থে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। দরজায় নক করার আগে নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে ছিলেন। চেহারায় ছিল প্রশান্তির একটা ছাপ। এ সব কিছুই এখন বিদায় নিয়েছে। আমূল একটা পরিবর্তন এসেছে। একেবারে সোজা হয়ে বসে আছেন এখন, সাধারণ আকারের দ্বিগুণ হয়ে গেছে চোখজোড়া, খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন ড্যাব ড্যাব করে। হাতজোড়া চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরে আছে।