শব্দ এখন আরও চড়েছে। তবে কেমন বিকৃত শোনাচ্ছে। হাসির শব্দটা একটা অশুভ আওয়াজে পরিণত হয়েছে। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে নিচের দিকের সিঁড়ি থেকে। আমার খোঁজে আসছে ওরা!
প্রথমবারের মত ভয় পেলাম। ওটা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল কয়েক সেকেণ্ডে। দৌড়লাম। বেড়ার তারে লেগে জামা ছিঁড়ল, একটা হিলের জুতোও হারালাম। তবে কেয়ার করলাম না। বৃষ্টির মধ্যে ছিন্ন কাপড় এবং এক পায়ে জুতো পায়ে ছুটতে লাগলাম।
সৌভাগ্যক্রমে টহল পুলিসের একটা গাড়ি আমাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিল। শুরুতে ওরা ভাবল, কেউ আমাকে তাড়া করেছে। তবে যখন কী ঘটেছে খুলে বললাম, দয়ালু মালয়ী পুলিস কর্পোরালটি সমঝদারের মত মাথা নাড়লেন। অবাক হননি, জানালেন। প্রাচীন এই স্কুলটা যে ভুতুড়ে এটা নাকি এখানকার অনেকেরই জানা। এ কারণে আশপাশের লোকেরা এই জায়গাটি এড়িয়ে চলে। দালানটা এত বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে কেন, বুঝতে পারলাম এবার।
শেষ বাস
এবারের অভিজ্ঞতাটি শেইলা কো নামের এক স্কুল ছাত্রীর।
এক ছুটির দিনে মেরিন প্যারেডের আয়োজিত এক বারবিকিউ পার্টিতে গিয়েছিলাম স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে। আমি ছাড়া সবাই রাতে সেখানেই থেকে গেল। আমার বাবা- মা খুব কড়া ধাঁচের। যেখানে ছেলেরাও আছে সেখানে কোনভাবেই রাত কাটাতে দেবেন না আমাকে।
রাত মোটামুটি পৌনে বারোটার দিকে মন খারাপ করে বাস ডিপোতে দাঁড়িয়ে শেষ বাসের অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্ধকার, জনহীন ডিপোতে একাকী দাঁড়িয়ে আছি। তারপর ঠিক মধ্যরাতে শেষ বাসটি এল। তবে এটাকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে।
পুরানো একটা এসবিএস বাস। এত পুরানো এসবিএস বাস আগে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। শুধু পুরানো যে তা নয়, ময়লাও। দাঁড়িয়ে পড়ল ওটা। আমাকে ভেতরে ঢুকতে বলল গাড়ির চালক। গাড়ির ধোঁয়াটে জানালা দিয়ে দেখলাম ড্রাইভার প্রায় কঙ্কালের মতই শীর্ণকায়। চোখদুটো কোটরে ঢুকে আছে। ভেতরে কোন বাতি নেই গাড়িটার, তাই ঢোকার সাহস পেলাম না।
তখনই কণ্ডাক্টর হাজির হলো। বলল, ‘বোন, তাড়াতাড়ি ওঠো, সময় নেই আর।’
চালকের চেয়ে তার অবস্থা আরও খারাপ। কেবল যে শরীরে রক্ত-মাংসের বালাই নেই তা নয়, চামড়াটাও কেমন ফ্যাকাসে। মাথার জায়গায় জায়গায় চুল নেই। যখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আঁতকে উঠলাম। দাঁতগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, কালো। বিহ্বলের মত মাথা নাড়লাম। চালককে গাড়ি ছাড়ার ইশারা করল সে। গাড়িটা চলে গেল।
তখনই আমার মনে পড়ল, এসবিএস বাসে কোন কণ্ডাক্টর থাকে না এখন আর। বড় ধরনের কোন ঝামেলা আছে ওই বাসটায়।
তারপরই নতুন, চকচকে একটা বাস এসে দাঁড়াল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রান্স আইল্যাণ্ড বাস আমি ঠিক যে স্টেশনে যেতে চাই সেখানেই যাবে। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বাসে উঠে কণ্ডাক্টরের কাছে জানতে চাইলাম আগের বাসটার বিষয়ে।
‘কোন্ শেষ বাস? এটাই তো শেষ বাস।’ অবাক হয়ে বলল সে।
ওই অশুভ বাসটায় সে রাতে উঠলে কী হত ভেবে আজও কেঁপে ওঠে আমার শরীর।
গায়ে কীসের দাগ?
ভিনসেন্ট ননিস নামের এক বুড়োর কাহিনী এটা। এ ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাও বছর বিশেক হয়ে গেল।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে সিঙ্গাপুর টার্ফ ক্লাবে কাজ করতাম। সিঙ্গাপুরের তখন একটা সময়ই গিয়েছে। যুদ্ধের পর পর। যুদ্ধের ফলাফল হিসাবে অনেক সিঙ্গাপুরী আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছে। আমি প্রায়ই ভাবতাম যুদ্ধের কারণে কীভাবে কিছু লোক বড়লোক হয়ে যায়! আমার কাছে একেবারে অসম্ভব মনে হত। তবে ওই লোকদের ধারণা অবশ্যই ভিন্ন ছিল।
যারা লাভবান হয় তাদের মধ্যে আমার পরিচিতদের একজন ছিল ওয়ং কিম সেং। সে পরিণত হয় সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার ধনী লোকদের একজনে।
টার্ফ ক্লাবে বিশাল এক আস্তাবল ছিল কিমের। সেখানে দামি সব রেসের ঘোড়া থাকত। খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিল সে। বিন্দুমাত্র মায়া-দয়ার বালাই ছিল না মনে। কোন ঘোড়ার রেসে দৌড়নোর মেয়াদ ফুরিয়ে এলে কুকুরের খাবার বানানোর জন্য বেচে দিত, অন্য মালিকেরা যেখানে এমন পরিত্যক্ত ঘোড়াগুলোকে চারণভূমিতে ছেড়ে দিত। তাই তাকে ঘৃণা করতাম রীতিমত। যে কারণে তার এত ধন- সম্পত্তি সেই ঘোড়াগুলোর সঙ্গে কীভাবে এটা করে!
যা হোক, ওয়ং কিম সেং তখন রীতিমত উড়ছে। রুপোলী একটা রোলস রয়েসে চেপে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে ক্লাবে আসতে দেখি তাকে। এক কথায় রাজার মতই তার চালচলন।
তবে পঞ্চাশের দশকের শেষ এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ভাগ্যদেবী মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগল তার দিক থেকে। একের পর এক ব্যবসায় মার খেতে লাগল।
ওই সময়ই তার চেহারায় হতাশ, হতবিহ্বল একটা ভাব লক্ষ করি প্রথমবারের মত। তাকে ঘিরে থাকা বিশাল চাটুকারের দল কমতে কমতে এসে ঠেকেছে কয়েকজনে। এরা তার পোষা দুর্বৃত্ত।
এদিকে আরেকটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। দ্রুতই দেনা পরিশোধ করতে না পারলে তার বেশিরভাগ সহায়- সম্পত্তি নিলামে তুলে দেবে ব্যাঙ্ক। বলা চলে পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে সে।
তারপরই আমার চোখের সামনে ঘটল ভয়াবহ সেই ঘটনাটি। সারাদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর সেদিন রাতে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ক্লাব থেকে। এসময়ই দেখলাম কিমের রোলস রয়েস ঢুকছে ভেতরে। এত রাতে গাড়িটাকে দেখে আশঙ্কায় কেঁপে উঠল আমার শরীর। কিম দু’জন সঙ্গীসহ নামল গাড়ি থেকে। চুপিসারে এগিয়ে গেল তারা আস্তাবলের দিকে। পরমুহূর্তেই ঘোড়াগুলোর আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পেলাম। কী হয়েছে দেখতে ঘুরলাম। হায়, খোদা! আগুন লেগেছে আস্তাবলে। দৌড়ে একটা অগ্নি-নির্বাপক তুলে নিলাম। কিন্তু ওটাসহ আস্তাবলের দিকে দৌড়াতেই কিমের লোকেরা পথ আটকে দাঁড়াল।