দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডক্টর। তিনিও ধরে নিয়েছিলেন বেড়ালটা টার্গেটে গিয়ে বসবে না। তিনি পিস্তল আর টার্গেট আগের জায়গায় রেখে কিচেনে ঢুকলেন। ঘুমাবার আগে এক গ্লাস বিয়ার খাওয়া দরকার।
পরদিন শুক্রবার। শহরে গেলেন আবরার আড্ডা দিতে। বেরুবার আগে বেড়ালটার আচরণে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ না করে খুশিই হয়েছেন তিনি। ওকে নাস্তা দিয়েছেন তিনি। বেড়ালটা চেটেপুটে সব খেয়েছে। যেন এ বাড়ির পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সে। নাকি এটা আবরারকে পটানোর জন্য করছে? জানে, আবরার তাকে সোমবার বাইরে যেতে দেবেন। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ চিন্তা করেননি আবরার। শহরে এসে তার সম্পাদক বন্ধুর সাথে আড্ডা দিলেন। তারপর লেকে গেলেন মাছ ধরতে। তিনটে মাছ ধরা পড়ল বড়শিতে। দুটো তিনি রান্না করে খেলেন, বাকিটা বেড়ালকে দিলেন। বেড়াল গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করল ওটা। আবরার বললেন, ‘যদি আমার সাথে থাকো তা হলে তিনদিন অন্তর মাছ খেতে দেব তোমাকে।
বেড়াল কিছু বলল না। চোখ বুজে পরম আয়েশে কাঁটা চিবোচ্ছে।
সোমবার সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো। আজ বেড়ালটাকে বাইরে যেতে দেয়ার দিন। আবরার পরীক্ষা করে দেখতে চান বেড়ালটা তার আগের আস্তানায় ফিরে যায় নাকি তাঁর কাছেই ফিরে আসে।
কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় দরজা খুলে দিলেন আবরার। বেড়ালটা লাফঝাঁপ দিল না, হালকা পায়ে বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে।
বিনকিউলার রেডিই ছিল, আবরার দ্রুত উঠে এলেন দোতলায়। বেড়ালটা কোন দিকে যায় দেখবেন। বেড়ালটা হেলেদুলে হাঁটছে রাস্তা দিয়ে, কোনও তাড়া নেই। আস্তে হেঁটে ওটা পৌঁছল রাস্তার শেষ মাথায়, দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আবরারের বাড়ির দিকে। চট করে জানালার পাশ দিয়ে সরে গেলেন আবরার। ওটা কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে যাবে কি যাবে না? নাকি দেখছে কেউ ওকে লক্ষ করছে কিনা।
রাস্তার শেষ মাথায় কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল বেড়াল! তারপর আবার হাঁটা দিল। এবার আগের চেয়ে দ্রুত। তবে যে রাস্তাটা ক্রামারদের বাড়ির দিকে গেছে সেদিকে নয়, জঙ্গলের দিকে! খানিক পরে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
বিনকিউলার চোখ থেকে নামিয়ে চাঁদি চুলকালেন ডক্টর আবরার। ওটার আচরণ তো এ পর্যন্ত স্বাভাবিকই মনে হলো। তবে-
আবরার সিদ্ধান্ত নিলেন বেড়ালটার খোঁজে জঙ্গলে যাবেন। বৃষ্টি থেমেছে আধা ঘণ্টা আগে। ভেজা মাটিতে বেড়ালের পায়ের ছাপ ফুটে থাকবে। তিনি দেখতে চান বেড়ালটা কোথায় গেল। এই ফাঁকে একটু বেরিয়ে আসাও হবে।
মাথায় হ্যাট চাপিয়ে, বগলে রেইনকোট নিয়ে (হঠাৎ যদি আবার বৃষ্টি নামে) বেরিয়ে পড়লেন আবরার। মাটিতে বেড়ালটার পায়ের ছাপ ফুটে আছে স্পষ্ট। তবে জঙ্গলের মধ্যে ছাপ খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। কারণ এদিকের বেশির ভাগ রাস্তায় ঘাস জন্মেছে। তবে বাঁচোয়া এটাই যে, বেড়ালটা দিক বদল না করে সোজা রাস্তায় এগিয়েছে।
প্রায় দেড় মাইল হাঁটার পর ট্রেইল শেষ হয়ে গেল। সামনে হাত চারেক প্রশস্ত ছোট প্রস্রবণ। বেড়াল কি লাফ মেরে এটার ওপর দিয়ে চলে গেছে? তিনি লাফ দিয়ে অপর পাড়ে চলে এলেন। প্রস্রবণটার দুই তীরের মাটিই ভেজা। কিন্তু এ পাড়ে বেড়ালের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যায় বেড়ালটা এ পাড়ে আসেনি। তা হলে কোথায় গেল? তিনি ঢাল লক্ষ্য করে এগোতে লাগলেন। বিশ গজ যাবার পর যে দৃশ্যটা দেখলেন, ঘাড়ের পেছনের সমস্ত চুল দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে।
পানিতে ভাসছে ধূসর রঙের বেড়ালটা।
এবার আর মনে সন্দেহ রইল না ডক্টর আবরারের আগে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তা আসলে ঘটানো হয়েছে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে সবাইকে। বুঝে গেছেন ডক্টর বেড়ালের ওপর যে জিনিসটা এতদিন ভর করেছিল তাঁর বাড়িতে, এতদিন শুধু সুযোগ খুঁজছিল বেরিয়ে আসার। স্বাভাবিক আচরণ করেছে সে আবরারের সাথে যাতে ডক্টরের মনে কোনও সন্দেহ জাগতে না পারে। সে এতদূর এসে আত্মহত্যা করেছে যাতে তার লাশ খুঁজে না পাওয়া যায়, যাতে ভেসে যায় স্রোতের সাথে। কিন্তু আত্মহত্যাই এটার শেষ উদ্দেশ্য নয়। গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে এর। কী সেটা?
ওটা যে-ই হোক বা যা-ই হোক তার ভিক্টিমদের যে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। একের পর এক খুন করে চলেছে। কিন্তু কেন? ভয়ঙ্কর কোনও উদ্দেশ্য আছে অদৃশ্য আততায়ীর?
গা শিরশির করে উঠল ডক্টর আবরারের। তিনি একটা ডাল দিয়ে বেড়ালটার লাশ তুলে নিলেন পানি থেকে। একটা কাপড়ে মুড়ে গাড়ির পেছনে রাখলেন। লাশটাকে কি তিনি গ্রীনবে-তে পাঠাবেন অটোপসি’র জন্যে? কিন্তু কী পরীক্ষা করতে বলবেন তিনি ডাক্তারদের? তিনি ভাল করেই জানেন ওটার র্যাবিস নেই। এক ঘণ্টা আগেও বেড়ালটাকে একদম সুস্থ এবং স্বাভাবিক দেখেছেন আবরার।
বাড়ি ফিরে পাইপ ধরিয়ে সোফায় বসলেন আবরার। ভাবছেন। অনেকক্ষণ পর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর প্রথম কাজ হবে স্টেটমেন্টের কপি বন্ধুদের পাঠিয়ে দেয়া। তবে বেড়ালের ঘটনাটাও এর সাথে যোগ করতে হবে। তিনি শিলার সাথে দেখা করতে চললেন শহরে।
শিলা বাসায় নেই। দরজায় চিরকুট রেখে গেছে।
‘তিনটার সময় ফিরব।’ এদিকে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আবরার ডাউন টাউনের রেস্টুরেন্টে ঢুকে লাঞ্চ করলেন, গল্প করার লোক ছিল অনেক। কিন্তু গল্প করতে মন চাইল না। বিয়ার খেয়ে সময় পার করতে লাগলেন। তিনটার খানিক আগে উঠে পড়লেন তিনি।