বিয়ার শেষ করে কাপ বোর্ডের ড্রয়ার খুলে একটা ফ্লাশলাইট বের করলেন আবরার, তারপর কিচেনের বাতি নিভিয়ে দিলেন।
ফ্লাশলাইট জ্বেলে সিঁড়ি বাইতে শুরু করলেন ডক্টর। কাজটা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফ্লাশলাইট নেভাতে সাহস হলো না তাঁর।
হলঘরে বা সিঁড়িতে কেউ নেই। বেডরুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলেন না। এমনকী খাটের নীচেও লুকিয়ে নেই বেড়ালটা। তা হলে কই গেল? বাড়ির ভেতরেই কোথাও আছে নিশ্চয়। ঘুমের মধ্যে ওটা যাতে তাঁর রুমে ঢুকে পড়তে না পারে সে জন্যে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন ডক্টর। বিছানায় শুয়ে মনে হলো ওপরে ওঠার সময় বন্দুক নিয়ে এলে বোধহয় ভাল হত।
পনেরো
ডক্টর আবরার যখন বলছেন ‘ঠিক আছে, বেড়াল,’ কথাটা শুনে রীতিমত আতঙ্ক বোধ করছিল ভিনগ্রহের হন্তারক। ভয় পাবার কারণ আবরার কিছু একটা সন্দেহ করে বসেছেন যা তাঁর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে। তবে আবরারকে তার যথার্থ হোস্ট মনে হয়েছে-একজন টপ ইলেকট্রনিক্স, পয়সাওয়ালা, সর্বত্র অবাধ বিচরণ, বিয়ে থা করেননি। আবরারের সঙ্গে শিলা ডিকটেশন পর্বের কোনও কিছুই তার কান এড়িয়ে যায়নি। আবরারকে তার হোস্ট হিসেবে খুবই নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এই লোকের ওপর ভর করলে অল্প কদিনের মধ্যে সে নিজের গ্রহে ফিরে যেতে পারবে।
তবে সে একটা ভুল করে বসেছে। তার উচিত ছিল সাধারণ বেড়ালের মত আচরণ করা। সে যদি ওদের সামনে ঘুরঘুর করত তা হলে ওরা বরং তাকে আদরই করত। হয়তো দুধ খেতে দিত। তারপর বাড়ির বাইরেও যেতে দিত। তা হলে অনেক আগেই সে মুক্ত হয়ে যেতে পারত। ফিরতে পারত কোহ্লদের খামার বাড়িতে, নিজের নিরাপদ খোলের মধ্যে। তারপর সুযোগ বুঝে, কাউকে হোস্ট বানিয়ে আবরারের বাড়িতে আসত সে, ঘুমন্ত আবরারের ওপর নিয়ন্ত্রণ-আরোপ করা সহজ হত তখন।
তবে ভুল যখন হয়ে গেছে, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। পালাবার রাস্তা নেই। আবরারটা যা চালাক! সমস্ত দরজা- জানালা বন্ধ করে রেখেছে। আর ময়দার ওপর তার পায়ের ছাপ দেখার পর আবরার তো এখন জানেই সে এখানে আছে।
প্রশ্ন হলো আবরার তার সম্পর্কে কতটুকু কী ধারণা করতে পেরেছে? কিন্তু একটা সন্দেহ সে করে বসেছে তা তো বোঝাই যায়। আবরারের ময়দার ফাঁদে পা দেয়াটাও ভুল হয়েছে। তবে নিজের পায়ের ছাপ মোছার উপায় ছিল না তার ক্ষুদ্র শরীর নিয়ে।
তার আতংক হচ্ছে আবরারের সাম্প্রতিক আচার-আচরণ দেখে। বুদ্ধিমান আবরাব কি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে? বুঝে ফেলেছে তার বাড়িতে যে বেড়ালটা আটকা পড়েছে আদৌ সেটা বেড়াল নয়? হয়তো বা। নইলে সে ওভাবে বেড়ালটাকে সম্বোধন করবে কেন? বোঝাই যাচ্ছে আবরার ঘটে অঢেল বুদ্ধি রাখে। কিন্তু কতটা বুদ্ধি রাখে জানতে হলে লোকটার ওপর তাকে ভর করতে হবে। আর সেটা করতে হলে এই বেড়ালের শরীর থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। সে কি আবার আত্মহত্যার রাস্তা ধরবে? কিন্তু এই বেড়ালটাকে দিয়েও আত্মহত্যা করালে আবরারের কাছে সমস্ত রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। সে ঠিক বুঝে নেবে ভিনগ্রহের কোনও প্রাণীই শুরু থেকে একের পর একজনকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছে।
এখন তার এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার আপাতত উপায় একটাই—কাল সকালে লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে নিজের চেহারা দেখানো এবং সাধারণ বেড়ালের মত আচরণ করা। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এ ছাড়া বিকল্পও নেই তবে বিপদ ওটা নয় যে আবরার তাকে দেখা মাত্র গুলি করে মেরে ফেলবে। তা হলে তো সে বেঁচেই যায়। আর আবরার যদি তার হোস্টদের সম্পর্কে জেনে থাকে, খুনখারাবীর দিকে সে যাবে সব শেষে। কারণ সে বুঝতে পারবে হোস্টকে হত্যা করা মানে যে ওটার ওপর ভর করে আছে তাকে মুক্ত করে দেয়া। সমস্যা হলো, আবরার ব্যাপারটা টের পেয়ে গেলে তাকে ধরে হয়তো খাঁচায় পুরে রাখবে। এরচে’ বাজে ব্যাপার আর কী হতে পারে? বেড়ালটার স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে মুক্ত হতেও পারবে না। আর আবরার বিজ্ঞানী। তাকে নিয়ে হয়তো অনেক অসহ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সে চালাবে। তারচেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো সে হয়তো পুষ্টির অভাবে বেড়ালের শরীরের মধ্যেই একসময় মরে যাবে। কোহলদের বাড়িতে পুষ্টিকর যে সলিউশন সে খেয়েছে তাতে এক মাস টিকে থাকা যাবে, একবছর নয়। আর বন্দী অবস্থায় সে যদি যথার্থ পুষ্টি না পায় তা হলে মৃত্যু তার অনিবার্য।
সারারাত সে এসব নিয়ে ভাবল। একবার ভাবল জানালা ভেঙে লাফিয়ে পড়ে নীচে। কিন্তু সেটা সেই আত্মহত্যাই হবে, লাভ হবে না কিছু।
সে এখন এটুকুই আশা করতে পারে, আবরার যা সন্দেহ করেছে তা স্রেফ সন্দেহই মনে হবে তার কাছে এবং কাল সকালে আবরার তাকে বেরুতে দেবে। তাকে এখন প্রমাণ করতে হবে সাধারণ একটা বেড়াল ছাড়া অন্য কিছু নয় সে।
.
আগের রাতে ঘুমুতে ঘুমুতে রাত একটা বেজে গিয়েছিল, সকালে ঘুম ভেঙে ড. আবরার দেখেন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়িয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে বিশ্রী সব স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন বিছানায়। হঠাৎ বেড়ালটার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।
বেড়াল বিষয়ক ভীতি এ মুহূর্তে তেমন কাজ করছে না তাঁর মধ্যে, দিনের আলোয় অনেকটাই দূর হয়ে গেছে ভয়। মনে হচ্ছে গত দশদিনের অদ্ভুত মৃত্যুগুলোর একটার সাথে আরেকটাকে সম্পর্কযুক্ত করে ব্যাপারটাকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেছেন তিনি।