এক
তার নাম না থাকলেও রয়েছে অসাধারণ ‘উপলব্ধি’ ক্ষমতা। এই ক্ষমতার সাহায্যে সহজেই সে অচেনা এই গ্রহের অজানা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে। তার নির্দিষ্ট কোনও আকার নেই, নেই চোখ বা কান। তবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা এত প্রখর যে সহজেই আশপাশের সবকিছু ‘দেখতে’পায়, তার সীমানার মধ্যে পড়ে, এমন কোনও শব্দ তার অদৃশ্য ‘কান’ এড়িয়ে যেতে পারে না। মোটামুটি বিশ গজের মত জায়গা সে বেশ পরিষ্কার দেখার ক্ষমতা রাখে, আরও বিশ গজ দূরে তার নজর যায় বটে, তবে ঝাপসা দেখে। এই তো পাশের গাছের ছাল বাকল সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে মাটির নীচে পোকাদের নড়াচড়ার শব্দ। ব্যাপারটা তাকে অবাক করে তুলছে। কারণ, নিজের জগৎ ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের স্পন্দন থাকতে পারে তার জানা ছিল না। তবে উপলব্ধি ক্ষমতা বলছে পোকাগুলো তার জন্য বিপজ্জনক নয়। এমনকী মাথার ওপর, গাছের ডালে ছোট ছোট কয়েকটি পাখি বসে আছে, ওরাও কোন বিপদ ডেকে আনবে না।
এ গ্রহের বিশাল সব গাছ দেখে সে অভিভূত। আর অবাক লাগছে চারপেয়ে একটি প্রাণীকে দেখে। ওটা প্রাকৃতিক একটা গুহার গর্তে ঘুমাচ্ছে, তার থেকে দশ গজ দূরে।
প্রাণীটা যেহেতু ঘুমাচ্ছে, তাই সে জানে সহজেই সে ওটার মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারবে। তারপর ওকে দিয়ে যা খুশি করানো তার জন্যে কোনও ব্যাপারই নয়। তবে এসব ছোটখাট প্রাণী দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য কতটা সাধন করা যাবে, সে ব্যাপারে তার সন্দেহও রয়েছে।
সে ‘পারসেপটর সেন্স’ বা উপলব্ধি ক্ষমতার সাহায্যে স্ক্যানিং করে চলছিল চারপাশ। মনোযোগ কেড়ে নিল একটা ছুরি। জং ধরা, ভাঙা ব্লেডের একটা জ্যাকনাইফ। কেউ ফেলে দিয়েছে অনেক আগে। ওটাকে যে ছুরি বলে তাও জানে না সে। তার কাছে ওটা স্রেফ আর্টিফ্যাক্ট বা শিল্পকলা ছাড়া কিছু নয়। আর আর্টিফ্যাক্ট মানেই বুদ্ধিমান জীবন! তবে বুদ্ধিমান জীবন প্রতিকূল এবং বিপজ্জনকও হয়ে উঠতে পারে। কারণ সে ছোট এবং অসহায়। তাই তার উচিত বুদ্ধিমান জীবনের গঠনপ্রণালী সম্পর্কে আগে জেনে নেয়া, সেক্ষেত্রে ঘুমিয়ে থাকা প্রাণীটা হতে পারে পরীক্ষা করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। ঘুমন্ত প্রাণীটার মনের ভেতর প্রবেশ করে বরং সে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানার সুযোগ পাবে, এভাবে স্ক্যানিং করার চেয়ে।
সে একটা মেঠো পথের মাঝখানে পড়ে রয়েছে, কয়েক হাত দূরে লম্বা ঘাসের জঙ্গল, ওখানে লুকালে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। সে চেষ্টা করল এগোতে, পারল না। তবে অবাক হলো না। কারণ তার গ্রহের তুলনায় এ গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক বেশি। তাদের গ্রহে চলাফেরার প্রয়োজন হলে, শূন্যে স্রেফ ভাসিয়ে তোলে নিজেদেরকে। কিন্তু এখানে সে এটা করতে পারছে না। কারণ এখানে কারও ওপর ভর করে তাকে চলতে হবে, কাউকে তার ‘হোস্ট’ বানাতে হবে। আর এমন ‘হোস্ট’ করার মত একজনকেই সে দেখতে পাচ্ছে-ঘুমিয়ে আছে গুহায়। তবে ওটা খুব ছোট, তার অর্ধেক ওজনও হবে না। তবু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?
হঠাৎ তার পারসেপটর সেন্সে কী যেন ধরা পড়ল। সে ওদিকে পুরো মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। বিপদ হলে খামোকা ওই ছোট প্রাণীটাকে নিয়ে মেতে থাকার মানে হয় না। আগে বিপদের মোকাবেলা করতে হবে।
প্রথমে শুধু কম্পন টের পেল সে, মাটি কাঁপছে, হেঁটে আসছে কেউ, বড় কিছু একটা। তারপর বাতাসে আরেকটা কম্পন ভেসে এল। কথা বলছে কেউ। কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী। তবে একজন নয়, দু’জন। একজন বেশ উঁচু গলায় কথা বলছে, অপরজন খানিক নিচু গলায়। কথা বুঝতে পারছে না সে, বোঝার কথাও নয়। সে ওদের চিন্তা-চেতনার মাঝে ঢুকতে পারল না, তার গ্রহের জীবরা শব্দ উচ্চারণ করে না, পরস্পরের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা হয় টেলিপ্যাথির মাধ্যমে।
এক সময় ওরা দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এল। দু’জনই বটে। একজন তার সঙ্গীর চেয়ে সামান্য লম্বা, তবে দু’জনেই পরিণত বয়স্ক। সন্দেহ নেই দু’জনেই বুদ্ধিমান প্রজাতির, ওদের পরনে পোশাক-শুধু বুদ্ধিমান প্রাণীরাই পোশাক পরে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। দু’জোড়া হাত এবং দু’জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। বাহ্, এরা তার চমৎকার ‘হোস্ট’ হতে পারবে। তবে এ মুহূর্তে এ নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। তার এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন নিজেকে বাঁচাতে হবে।
ওরা দু’জন দুই লিঙ্গের। একটি মেয়ে, অপরটি ছেলে। হাত ধরাধরি করে হেঁটে আসছে এদিকেই। সর্বনাশ! এখনই তো দেখে ফেলবে ওকে। তা হলেই কম্ম সারা।
মরিয়া হয়ে সে তার একমাত্র অবলম্বন ঘুমন্ত, চারপেয়ে প্রাণীটার ওপর সওয়ার হলো, তার মনের ভেতর ঢুকে তাকে হোস্ট বানিয়ে ফেলল। তারপর ওটাকে জাগিয়ে তুলে বেরিয়ে এল গর্ত থেকে। আপাতত এটার ওপরেই সে ভর করে থাকবে। সে ছেলে মেয়ে দুটোকে ভাল করে দেখতে চায়। ওদের সম্পর্কে জানতে চায়। অবশ্য তার ভয়ও আছে। সে যে প্রাণীটার শরীরে ঢুকে পড়েছে, ওটা যদি ওদের চোখে পড়ে যায় তা হলে বিপদ হতে পারে। ওরা তার হোস্টকে মেরে ফেলতে পারে। হোস্টকে মেরে ফেললেও তার অসুবিধে নেই। অসুবিধা হবে ঘুমন্ত কোনও প্রাণীর ওপর সওয়ার হবার আগেই সে যদি ধরা পড়ে যায়, তা হলে। অবশ্য সুযোগ বুঝে হোস্টকে নিজেই হত্যা করবে সে বা মরতে বাধ্য করবে। তা হলেই তার পক্ষে সম্ভব হবে অন্য কোনও ঘুমন্ত প্রাণীর শরীরে ঢুকে পড়ে তাকে হোস্ট বানিয়ে ফেলা। বর্তমান হোস্টটি এত ছোট এবং ভঙ্গুর যে, এর ওপর ভর করে থাকলে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না তার পক্ষে।