Site icon BnBoi.Com

আবার অশুভ সঙ্কেত – অনীশ দাস অপু

আবার অশুভ সঙ্কেত

আবার অশুভ সঙ্কেত

 

সূচনা

পরপর ছ’হপ্তা ওরা, মানে শয়তান-পুত্রের শিষ্যরা, আঠার মত লেগে রইল মেয়েটির পেছনে। মেয়েটি ঘুমুচ্ছে নিজের বাড়িতে, কাজে যাচ্ছে অথবা বেড়াতে গেছে বন্ধুর বাসায়, ছায়া হয়ে সেঁটে থাকল ওরা পেছনে। নেতার অপমৃত্যুর পরে দলের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যায় আশঙ্কাজনক হারে, অনেকেই আত্মহত্যা করে,

কেউ কেউ দারুণ হতাশায় বেছে নেয় নিঃসঙ্গচারীর জীবন। তবে কয়েকজন হাল ছেড়ে দেয়নি। প্রতিহিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল তাদের বুকে। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে তারা, দিন দিন ক্রোধের মাত্রাটা বাড়তেই থাকে। এরাই মেয়েটির গতিবিধির দিকে লক্ষ রেখে চলেছে গত দেড় মাস ধরে।

একদিন মেয়েটি ডাক্তারের চেম্বারে এসেছে, যথারীতি তাকে অনুসরণ করেছে দুই শিষ্য, বসেছে তারই পাশে, ভিজিটিং রুমে। মেয়েটি অসুস্থ, চেহারায় ফুটে আছে ক্লান্তি আর ব্যথার ছাপ। ব্যাপারটা লক্ষ করে ওরা দু’জন সন্তুষ্ট বোধ করল।

 

 

‘মিস রেনল্ডস,’ মেয়েটিকে সম্বোধন করল রিসেপশনিস্ট, হাত তুলে একটা দরজা দেখাল, যেতে বলছে ওদিকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোল, ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। তরুণ, সুদর্শন চেহারার ডাক্তার হাসিমুখে মুখ তুলে চাইল। তাকে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল তরুণীর। এ লোককে আশা করেনি সে।

‘ড. আর্থারস্টোন প্রাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন,’ ব্যাখ্যা করল যুবক। ‘আমি তাঁর জায়গায় এসেছি। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন না!’

দরজা বন্ধ করল মিস রেনল্ডস, ডাক্তারের পাশের খালি চেয়ারে বসল।

‘এখানটায় খুব ব্যথা, তলপেটে হাত রাখল সে। ‘মাঝে মাঝে মনে হয় ফেটে যাবে।’

খকখক কেশে উঠল তরুণী, যন্ত্রণায় বিকৃত দেখাল চেহারা। ডাক্তার ওকে শুইয়ে দিল একটা কাউচে, পরীক্ষা করবে। কাজটা শেষ করতে বেশি সময় নিল না সে, প্রেসক্রিপশনে একটা নাম আর ঠিকানা লিখে কাগজটা দিল মেয়েটিকে।

‘ইনি আমার এক কলিগ, হার্লে স্ট্রীটে চেম্বার। এসব ব্যাপারে স্পেশালিস্ট। ওঁর সঙ্গে দেখা করুন।’ একটু বিরতি দিল সে। ‘শীঘ্রি।’

মেয়েটি কিছু না বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ‘ভয়ের কিছু নেই,’ আশ্বাস দিল ডাক্তার।

উঠে দাঁড়াচ্ছে তরুণী, খচ করে ব্যথাটা ঘাই মারল পেটে, দাঁতে দাঁত চাপল সে। ‘আপনি কোন…’

রোগিণী কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল ডাক্তার। ‘দুঃখিত,’ তীক্ষ্ণ শোনাল কণ্ঠ, ‘এই স্টেজে আপনাকে পেইনকিলার ট্যাবলেট দেয়া যাবে না।’

মেয়েটি বেরিয়ে যাচ্ছে, তাকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করল ডাক্তার, দেখল সেই লোক দুটো উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজা বন্ধ করল সে, ফোন তুলে বলল, ‘শিকাগোতে লাইন দাও।’

সেক্রেটারি কানেকশন দিতে ব্যস্ত, ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ডাক্তারের মুখে। ‘মৃত্যুর মাঝেও আছে জীবন,’ কথাটা যেন নিজেকেই শোনাল সে বিড়বিড় করে।

.

অপারেটিং টেবিলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি, তার দু’হাত শক্ত করে ধরে আছে দু’জন নার্স। পা দুটো ফাঁক করে বেঁধে রাখা হয়েছে। পেটটা ফুলে আছে বেলুনের মত, চামড়া টানটান। শরীর এপাশ-ওপাশ করে চলেছে সে ক্রমাগত, হাঁপাচ্ছে, মিনতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে নার্সদের দিকে। ‘বেশি সময় লাগবে না,’ সান্ত্বনা দিল তাকে একজন।

ভয়ানক ব্যথাটা শরীরে হঠাৎ ইলেকট্রিক শক মারল, মুখ হাঁ হয়ে গেল তরুণীর, দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। সার্জন হাত বাড়িয়ে একটা স্ক্যালপেল তুলে নিলেন।

‘একটু কাটাছেঁড়া না করলেই নয়,’ বললেন তিনি। ‘ব্যথাটার হাত থেকে রক্ষা পাবে।’

তরুণীর দিকে ঝুঁকলেন তিনি, আবার চিৎকার দিল সে, নার্স একটা প্যাড চেপে ধরল মুখের ওপর।

‘ক্লোরোফর্ম লাগবে না,’ ধমকে উঠলেন সার্জন। ‘ওকে অজ্ঞান করা চলবে না।’

মেয়েটির শরীর আবার মোচড় খেতে লাগল। ‘আসছে ওটা,’ বললেন সার্জন। ‘ওকে শক্ত করে ধরে রাখো।’

মেয়েটির পিঠ বাঁকা হয়ে গেল, ঝাঁকি খেল মাথা, গলা চিরে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তনাদ। তারপর হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল। তরুণী টের পেল শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে জিনিসটা, ব্যথা নেই পেটে, ধপ করে টেবিলের ওপর পড়ে গেল সে, ডাঙায় তোলা মাছের মত বার কয়েক কেঁপে উঠল, তারপর স্থির হয়ে গেল। সার্জন নার্সের হাতে কি একটা জিনিস তুলে দিলেন, প্রার্থনার ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক মুহূর্ত, তারপর পা বাড়ালেন দরজার দিকে। হাত না ধুয়েই করিডর ধরে হাঁটা দিলেন তিনি। তাঁর পেছন পেছন এল একজন নার্স। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখল সার্জন এগিয়ে গেছেন বেঞ্চিতে বসা এক বৃদ্ধ দম্পতির দিকে। ওদের প্রতিটি কথা স্পষ্ট শুনতে পেল সে।

‘আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব করেছি,’ বললেন সার্জন। ‘কিন্তু বাঁচাতে পারিনি ওকে।’

ডুকরে কেঁদে উঠল বৃদ্ধা, তাকে জড়িয়ে ধরল বৃদ্ধ। চেহারায় সব হারানোর বেদনা।

‘টিউমারটা অনেক বড় ছিল,’ শান্ত গলায় বললেন সার্জন।

দরজা বন্ধ করল নার্স, ঘুরল, সঙ্গীর হাত থেকে কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা তুলে নিল হাতে। ছেলে। অজান্তেই মাথা নুয়ে এল অভিবাদনের ভঙ্গিতে। এমন সময় মেঝেতে পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। একটা কুকুর। প্রকাণ্ড শরীর, কুচকুচে কালো, বিরাট চোয়াল। হেঁটে এল সে নার্সের পাশে। নার্স বাচ্চাটাকে মেঝের ওপর শুইয়ে দিল, কুকুরটা ঝুঁকে এল তার ওপর, জিভ বের করে চেটে দিচ্ছে গা।

হাত বাড়িয়ে দিল বাচ্চা, খুদে আঙুল দিয়ে খামচে ধরল লোম, হেসে উঠল খিলখিল করে, নার্সের অন্তত তাই মনে হলো। আড়চোখে দেখল সে মৃত তরুণীকে, সঙ্গী নার্সকে ইশারা করল লাশটাকে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে। চেহারায় ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণার ভাব ফুটে উঠল তার, তবে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘আবার জন্ম নিল ঘৃণা,’ গর্বের সাথে বলল সে।

.

বাসা-বাড়ি, অফিস-ফ্যাক্টরিসহ সর্বত্র শয়তান-পুত্রের শিষ্যদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল বাচ্চার জন্মের কথা শুনে। চরম হতাশায় যাদের দিন কাটছিল, যারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছিল ব্যর্থ আক্রোশে, খবরটা তাদের সবার মাঝে নতুন আশার আলো জ্বেলে দিল। আগামীতে নতুন কিছু ঘটার প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল তারা। ওদিকে, মধ্য ইতালীর এক মঠে, ফাদার ডি কার্লো নামের একজন প্রীস্ট গভীর রাতে ধড়মড় করে উঠে বসলেন নিজের বিছানায়। ঘামে ভিজে গেছে গা, ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি, ভয়ঙ্কর এক সত্য উপলব্ধি করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পেরেছেন ব্যর্থ হয়েছেন তিনি, আবার শুরু হতে যাচ্ছে অশুভ সঙ্কেতের দিন। যা হবে অতীতের চেয়েও ভয়াল ভয়ঙ্কর।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১

এক

প্রায় এক ঘণ্টা হলো হিথ্রো এয়ারপোর্টের প্রাইভেট লাউঞ্জে বসে আছে যুবক। রানওয়ে আর বার ছুঁয়ে যাচ্ছে তার অস্থির দৃষ্টি, উত্তেজনা কমাতে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। একটু পরপর ঘড়ি দেখছে সে, হাতে ধরা কাগজের তাড়ায় চোখ বোলাচ্ছে। বুড়োর সাথে এর আগে সাক্ষাৎ হয়নি তার, তবে জানে পল বুহেরের চোখ ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত কঠিন। উল্টোপাল্টা কিছু বললে বা ভুল কোন তথ্য দিলে সে খুবই বিরক্ত হয়।

হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল লাউডস্পীকার। একঘেয়ে একটা কণ্ঠ বলতে শুরু করল:

‘থর্ন কর্পোরেশনের প্রাইভেট চার্টার শিকাগো থেকে এইমাত্র ল্যান্ড করল।’

যুবক সশব্দে দম ফেলল।

‘প্লেনের যাত্রী মি. পল বুহের এক্ষুণি টার্মিনাল লাউঞ্জে এসে পৌঁছুবেন। ধন্যবাদ।’

দ্রুত টাইয়ের নট ঠিক করল যুবক, জামার বোতাম লাগাল। থর্ন কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং বেশিরভাগ শেয়ারের অংশীদার পল বুহের পশ্চিমা বিশ্বের সবচে’ ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন। এই মানুষটির একক প্রচেষ্টায় থর্ন কর্পোরেশন বিশ্বের বৃহত্তম মাল্টিন্যাশনাল কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। বুহের ত্রিশ বছর আগেই বুঝতে পেরেছিল পৃথিবীতে খাদ্য হলো সবচে’ প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক পণ্য। সে তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করে ফেলেছে বহু আগে, বর্তমানে থর্ন কোম্পানিকে বিশ্বের বৃহত্তম ফার্টিলাইজার এবং সয়া ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে সবাই চেনে। পল বুহের প্রায়ই বলে ‘আমাদের লাভজনক ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে দুর্ভিক্ষের মধ্যে।’

বর্তমানে বুহের পরিণত হয়েছে জীবন্ত এক কিংবদন্তীতে।

যুবক তাকিয়ে আছে বাইরে, থর্ন-এর ব্যক্তিগত প্লেন খুঁজছে, এমন সময় লাউঞ্জের দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল পল বুহের। লম্বা, একহারা গড়ন, মাথায় কোঁকড়ানো, সাদা, ঘন চুল।

‘মি. বুহের, দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গেল যুবক। ‘আমার নাম জন। লন্ডনে স্বাগতম,’ অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডদের মত শোনাল কথাগুলো।

‘থ্যাঙ্ক ইউ, জন,’ হাসল বুহের। ‘নাইস অভ ইউ টু মিট মি।’

বুহেরের প্রবল ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতির কাছে নিজেকে নিতান্তই খেলো মনে হলো জনের। বিনীত গলায় বলল, ‘আপনার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে, স্যার।’

‘ঠিক আছে,’ মাথা ঝাঁকাল বুহের। মনে মনে বলল, ব্যাটা বেশি ফাজিল।

.

পুব দিকে ছুটে চলেছে লিমোজিন, জন একটানে খুলে ফেলল ককটেল ক্যাবিনেট। মাথা নেড়ে নিষেধ করল পল বুহের। খাবে না।

‘লিবিয়ানদের কাছ থেকে কোন সাড়া পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘না, স্যার,’ বলল জন।

‘অসুবিধে নেই। ওদের ফ্যাসিলিটি আরও তিন হপ্তা বাড়িয়ে দাও আর সুদের হারও দেড় গুণ বাড়াও।’

চোখ পিটপিট করল জন। ‘ওরা আপত্তি তুলতে পারে, স্যার।’

‘ওদের তো সবকিছুতেই আপত্তি। যাকগে, আমি একটু চোখ বুজলাম। অফিসে পৌছুলে জাগিয়ে দিও।’

সীটে হেলান দিল বুহের। জন শঙ্কিত হয়ে ভাবল ওর কোন কথায় বস্ আবার মাইন্ড করে বসেননি তো।

টেমস নদীর দক্ষিণ তীরে, ইংরেজী ‘টি’ অক্ষরের আদলে গড়ে উঠেছে থর্ন কর্পোরেশনের ব্রিটিশ হেড অফিস। থর্ন লোগোটি শিকাগোর হেডকোয়ার্টারের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে। টপ ফ্লোরে, নিজের স্যুইট থেকে চেয়ারম্যান টেমস নদী এবং ব্যাংক অভ ইংল্যান্ড পরিষ্কার দেখতে পায়। বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়ে হাউজ অভ পার্লামেন্ট। ফোন করার সময় বুহের দালানটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

অফিসে পৌঁছেই বুহের খোঁজ নিল গত দু’দিনে তার নামে কতগুলো টেলেক্স এসেছে। তারপর বলল আগামী একঘণ্টার মধ্যে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। এক ঘণ্টার মধ্যে তাকে কেউ বিরক্ত করল না। নির্ধারিত সময় শেষে তার সেক্রেটারি বসের স্যুইটে নক করল, দরজা খুলে তাকাল ভেতরে।

‘হ্যাপী বার্থডে, স্যার,’ বলল সে।

বুহের মুখ তুলে চাইল, হাসি ফুটল মুখে, সেক্রেটারির পেছনে দেখা যাচ্ছে লন্ডন হেডকোয়ার্টারের বড়-মাঝারি গোছের সকল কর্মকর্তাদের।

‘ধন্যবাদ,’ বলে উঠে দাঁড়াল সে, ইঙ্গিত করল ওদের ভেতরে আসতে।

সারিবদ্ধভাবে শৃঙ্খলার সাথে ভেতরে ঢুকল তারা। প্রথমে তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট জন্মদিনের অভিনন্দন জানাল পলকে, তারপর ডিপার্টমেন্টাল হেডের দল, সবশেষে এল কোম্পানি এক্সিকিউটিভরা। এদের চেহারাটাই শুধু চেনা পলের। নাম জানে না।

প্রত্যেকে সসম্ভ্রমে পল বুহেরের সাথে হাত মেলাল। হ্যান্ডশেক পর্ব শেষ হলে তরুণ এক ভৃত্য বয়ে নিয়ে এল মোমবাতি দিয়ে সাজানো, ইংরেজী ‘টি’ আকারের বিশাল এক কেক। নিঃশব্দে বুহেরের ডেস্কে কেকটা রেখে পিছিয়ে গেল সে। মৃদু হেসে তাকে ধন্যবাদ দিল বুহের। তিন বারের চেষ্টায় ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারল সব ক’টা মোমবাতি। কাজটা শেষ করে রীতিমত হাঁপাতে লাগল সে। সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করল তাকে। দোরগোড়ায় দেখা গেল ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছে এক ওয়েটার। 1

‘শ্যাম্পেন চলবে?’ জিজ্ঞেস করল সেক্রেটারি।

‘মন্দ কি!’ বলল বুহের।

শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে শুরু করল ওয়েটার। একটা গ্লাস নিয়ে স্মিত মুখে তার কর্মচারীদের স্তুতি শুনছে পল বুহের।

‘পল, বোঝাই যায় না আপনার বয়স হয়েছে।’

….আশা করি গত বছরের মত এ বছরটাও আপনি সাফল্যের সাথে পার করে দেবেন, স্যার,’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

কর্মচারীদের সাথে হালকা মেজাজে কথা বলতে বলতে পল ভাবছিল এদের মধ্যে কে হতে পারবে তার যোগ্য উত্তরাধিকারী। কিন্তু কাউকেই তার মনে ধরছে না। শিকাগোর হেডকোয়ার্টারেরও একই দশা। এই বিশাল সাম্রাজ্য চালাতে তার দরকার আরেকজন চল্লিশ বছরের পল বুহের।

‘সত্তর বছর বয়সকে অভিনন্দন।’

ঘুরে দাঁড়াল পল। জন। মদ খেয়ে লাল হয়ে গেছে চেহারা, ওর দিকে গ্লাস তুলে দেখাচ্ছে।

বিরক্ত বোধ করল বুহের।

‘অভিনন্দন তিন কুড়ি দশকেও,’ মুচকে হাসল জন।

হঠাৎ কেন যেন কেঁপে উঠল বুহের, এক পা পিছিয়ে গেল। কোত্থেকে উদয় হলো তার সেক্রেটারি, সব ক’টা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে জনের হাত ধরে টান দিল। ‘আমি কি কিছু বলেছি?’ হতবুদ্ধি দেখাল জনকে।

‘ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও,’ মৃদু গলায় বলল বুহের। সেক্রেটারি টানতে টানতে জনকে নিয়ে চলল দরজার দিকে, সেই সাথে উপস্থিত অভ্যাগতরাও তার পেছন পেছন এগোল।

বুহের নিজের চেয়ারে এসে বসে পড়ল ধপ করে, চোখ বুজল। খানিকপর চোখ খুলে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার সেক্রেটারি।

‘সরি, স্যার…’

মাথা নাড়ল বুহের। ‘না, ঠিক আছে।’

 

 

‘আপনার কিছু লাগবে?’

‘আরও ত্রিশ বছর,’ বলল বুহের।

জবাবে কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু হাসল মেয়েটা। তারপর বেরিয়ে গেল দরজা বন্ধ করে।

.

ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে পল বুহের, এপাশ ওপাশ করছে, কি যেন বলছে বিড়বিড় করে। পাশে শোয়া মেয়েটা কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হলো, তাকাল পলের দিকে। আঙুল দিয়ে বুকে আঁকিবুকি কাটতে লাগল সে, ডানহাতটা ঝাঁকি খেল বুহেরের। হাতটা চেপে ধরল মেয়েটি, তালুতে সুড়সুড়ি দিল। কপালে ভাঁজ পড়ল বুহেরের, অস্পষ্ট গলায় কি বলল বোঝা গেল না।

হেসে উঠল মেয়েটা, কনিষ্ঠা আঙুলটা ধরে নাড়াতে লাগল। জন্মদাগ দেখা যাচ্ছে আঙুলের ডগায়। আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখতে অবিকল সংখ্যার মত: একদিক থেকে মনে হয় ইংরেজী তিনটে নয়, আবার অন্য অ্যাঙ্গেল দিয়ে তাকালে ঠিক তিনটে ছোট ছয়-এর মত লাগে।

মোচড় খেল বুহের, খালি হাতটা শূন্যে উঠে গেল, সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে। ঠোঁট নড়ছে ওর।

‘কি বলছ?’ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল মেয়েটা।

‘তিন কুড়ি এবং দশ,’ বিড়বিড় করছে বুহের।

‘শ্‌শ্‌শ্‌শ্‌শ্…’ শক্ত করে হাতটা চেপে ধরল মেয়েটা, ঘুমের মধ্যে বুহের এত জোরে চাপ দিল, রীতিমত ব্যথা পেল সে। খসখসে জন্মদাগে লাগছে খুব। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল সে, কিন্তু বুহের ধরেই থাকল।

‘পল,’ ককিয়ে উঠল মেয়েটা।

‘তিন কুড়ি এবং দশ,’ কর্কশ গলায় বলল বুহের। ‘আরমাগেড্ডন… কেয়ামতের বছর। সত্তর বছর।’

টান মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা, গড়ান দিয়ে সরে গেল বুহেরের পাশ থেকে। এখনও ঠোঁট নড়ছে ওর, তবে শব্দ হচ্ছে না। নিজের হাতের দিকে চাইল মেয়েটা। আঙুলে বুহেরের জন্মদাগের ছাপ পড়ে গেছে। জ্বলছে খুব। এক মুহূর্ত অসাড় বোধ করল সে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জন্মদাগের দিকে, তারপর মুখে পুরে নিল আঙুলটা, চুষতে লাগল। মুখ থেকে আঙুলটা বের করল সে, জিভের ডগা ছোয়াল খুদে তিনটা ছয়ের ওপরে, তারপর পাশ ফিরে শুলো, বুহেরের গালে চুমু খেল, বিড়বিড় করে কি যেন বলল। একটু পরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে। তৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ২

দুই

নিজের স্যুইটে বসে নাস্তা সারার পর খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে পল বুহের, এমনসময় বেজে উঠল ইন্টারকম।

‘অ্যামব্যাসাডর এসেছেন, স্যার।’

‘ওঁকে আসতে বলো,’ বলল বুহের।

প্রায় সাথে সাথে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ইউএস অ্যামব্যাসাডর ফ্রেডরিক আর্থার। মধ্য পঁয়তাল্লিশ চলছে তার, দীর্ঘদেহী, গায়ের রঙ গাঢ়, ঠোঁটে ফুটে আছে একটুকরো বাঁকা ছেলেমানুষী হাসি। এই হাসি নারী-পুরুষ উভয়কে আকর্ষণ করে, সেইসাথে কূটনৈতিক নানা সমস্যার সমাধানও করে সে বাঁকা হাসি হেসে।

হ্যান্ডশেক করল ওরা, বুহের কফির কাপ ধরিয়ে দিল অ্যামবাসাডরের হাতে। টিভি চলছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে আর্থার বলল, ‘স্টিভেনসনের বক্তৃতা শুনেছেন? নতুন কিছু বলেছেন?’

রবার্ট স্টিভেনসন ফরেন সেক্রেটারি। খানিক আগে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন টিভিতে।

‘সেই গৎ বাঁধা বুলি,’ কাঁধ ঝাঁকাল বুহের।

‘মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাটা গৎ বাঁধাই,’ মন্তব্য করল মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

তারপর দু’জনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠল। মিনিট বিশেক পর আর্থার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল এবার তাকে উঠতে হবে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আবার হাত মেলাল ওরা।

‘লন্ডনে লম্বা সময়ের জন্যে এসেছেন?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।

‘নাহ্। স্রেফ ফ্লাইং ভিজিট। দেখতে এসেছি কর্মচারীরা কেমন কাজকর্ম করছে। শুক্রবার চলে যাব। ভাল কথা, শুনলাম সিনেটে দাঁড়াবার পরিকল্পনা করেছ।’

হাসল আর্থার। ‘এ ব্যাপারটা তো কারও জানার কথা নয়।’

‘ঠাট্টা রাখো। কাজটা ভালই করছ তুমি। হোয়াইট হাউজে যাবার সমস্ত যোগ্যতাই তোমার আছে।’

জবাবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল আর্থার। সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা তার রয়েছে।

‘ক্যাম্পেইনের জন্যে টাকা দরকার,’ বলল বুহের। ‘আর থর্ন কর্পোরেশনের টাকার অভাব নেই।’

‘জেনে খুশি হলাম, পল। তবে ব্যাপারটা স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? আমি ডেমোক্রাট। আর প্রেসিডেন্ট, যাঁকে আপনি সমর্থন দিচ্ছেন, তিনি রিপাবলিকান।’

‘প্রেসিডেন্ট দুর্বল মানুষ, বলল বুহের। ‘আশা করা হয়েছিল তিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবেন।’

‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব হলো না।’

হাসল বুহের। ‘ওটা প্রশ্ন ছিল নাকি?’

দরজা খুলল আর্থার, পা রাখল চৌকাঠে।

‘কফির জন্যে ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।’

আর্থার চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে রইল বুহের। তারপর বন্ধ করল দরজা। আর্থার বেশ অদ্ভুত, অত্যন্ত চতুর একজন ডিপ্লোম্যাট, তার কোন শত্রু নেই, মানুষ হিসেবেও খুব সৎ। তবে তার সততা কখনও কখনও পাগলামির পর্যায়ে পৌছে যায়। এ ধরনের লোকদের নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তবে আর্থারের ব্যাপারে যাবতীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আগে করে রেখেছে পল বুহের। সে আর আর্থারকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না। ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে।

.

সবে সন্ধে নেমেছে। অক্সফোর্ড রোডের দিকে ছুটে চলেছে পল বুহেরের বিলাসবহুল লিমোজিন। সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে বুহের। ঝিমুচ্ছে। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ক্লান্ত লাগছে। কাজের যত চাপই থাক, তিন/চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিলেই সে চাঙা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ইদানীং একটু সমস্যা হচ্ছে মনে হচ্ছে। ডাক্তার দেখানো দরকার। ঝিমুতে ঝিমুতে নিজের জন্মদিনের কথা ভাবছিল পল বুহের। মনে পড়ছে বাবা বলত: ‘১৯৫০ সালের জুন মাসে তুমি কুড়িতে পা দেবে। আশা করব ততদিনে নিজস্ব স্বকীয়তা অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর ১৯৭০ সালের জুনের মধ্যে তোমাকে অর্জন করতে হবে অনেক অনেক কিছু।’

বাবার আশা পূরণ করেছে বুহের। থর্ন কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট যে সে-ই হতে যাচ্ছে এটা সূর্য পুব দিকে ওঠার মতই নিশ্চিত ছিল। সবাই চমৎকার পরিকল্পনা মাফিক চলছিল। মাঝখানে থর্ন রাজ্যের শেষ বংশধর ডেমিয়েন থর্নের আকস্মিক মৃত্যু তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। ডেমিয়েনের মৃত্যুর পরে আঠারো বছর চলে গেছে। এখনও তার মৃত্যুর কথা মনে পড়লে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠে চোখ মেলল বুহের, দেখল রিয়ার ভিউমিরর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার। বুহের পকেট হাতড়ে ভিটামিন বড়ির শিশিটা বের করল, এক সাথে কয়েকটা মুখে পুরল। পেটের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। গুলিয়ে উঠতে চাইছে। এমন হয়। ছেলেটার সাথে দেখা করার সময় হলেই এমন পেট গোলাতে থাকে বুহেরের। আসলে টেনশনে এমনটা হচ্ছে। ছেলেটা সতেরোতে পা দিয়েছে, প্রাপ্ত বয়স্ক হতে চলেছে। শিষ্যরা বলেছে ছেলেটা নাকি লম্বা হয়েছে বেশ, গায়ে গতরে মাংসও লেগেছে।

ঢেকুর তুলল বুহের। পেট ব্যথাটাই তাকে মারবে। আর ছেলেটার সাথে দেখা হবার সময় হলেই পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায় তার। কোন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রতিপক্ষ এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিয়েও এতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয় পল বুহের। শুধু ছেলেটাই তার ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বুহের। পাকা রাস্তা ছেড়ে সরু, মেঠো পথ ধরেছে লিমোজিনের ড্রাইভার। রাস্তাটা পেরিফোর্ডের দিকে গেছে। তীক্ষ্ণ বাঁকগুলোতে সতর্কতার সাথে মোড় নিল ড্রাইভার। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপ, খরগোশ দৌড়ে পালাচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে ঝোপের আড়ালে। উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা খাচ্ছে উড়ন্ত পোকা, দু’একটা মরে আঠালো শরীর নিয়ে সেঁটে থাকল কাঁচে।

‘এসে গেছি, স্যার।’ ইন্টারকমে খড়খড় করে বেজে উঠল ড্রাইভারের গলা। গেটের বাইরে গাড়ি থামাল সে। ডেমিয়েনের মৃত্যুর পরে এখানে সিকিউরিটি সিস্টেম বসানো হয়েছে। জংধরা, বিশাল লোহার গেট বিদ্যুৎশক্তিতে খোলে, বন্ধ হয়। ড্রাইভার ড্যাশ বোর্ডের একটা বোতামে চাপ দিল, ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল গেট। ড্রাইভওয়ের আধা মাইল দূরে বিশাল প্রাসাদটার পশ্চিম উইং দেখা যাচ্ছে। ওখানে বুহেরের জন্যে সবচে’ দামী ব্রান্ডি অপেক্ষা করছে, ড্রইংরুমের ফায়ার প্লেসে জ্বলছে আগুন। বুহের এবার একটু আরাম করতে পারবে।

কাঁকর বিছানো রাস্তা পার হয়ে লিমোজিন থেমে দাঁড়াল প্রাসাদের সামনে। বাটলার অপেক্ষা করছিল দোরগোড়ায়; বুহেরকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে গেল।

বুহের সোজা ঢুকল ড্রইংরুমে, একটা গ্লাসে মদ ঢেলে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল।

ঘরটা অত্যন্ত দামী আসবাবে সাজানো। ওক কাঠের প্যানেলে হাত বোলাল বুহের, মখমলের ভারী পর্দা টেনেটুনে দেখল, তারপর তাকাল পোর্ট্রেটগুলোর দিকে। রবার্ট থর্ন; তার ভাই, রিচার্ড; এবং ছেলে ডেমিয়েনের ছবি। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল বুহের। এগোল ফায়ার প্লেসের দিকে। বেশ গরম পড়েছে আজ, তবু ফায়ার প্লেসে কাঠ দাউ দাউ জ্বলছে। ওদিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুহের। অপেক্ষা করছে।

খানিক পরে আবার এল বাটলার। ‘বিশ মিনিটের মধ্যে ডিনার রেডি হয়ে যাবে, স্যার।’

মাথা ঝাঁকাল বুহের। ‘কেমন আছে সে?’

‘ভাল আছেন, স্যার।’

‘ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে?’

‘চেষ্টা করে দেখতে পারেন, স্যার।’

বুহের আবার মাথা ঝাঁকাল, মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হলঘর পার হয়ে, পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এল, তারপর একটা গ্যালারি ধরে ঢুকল অন্ধকার এক করিডরে। এটা বাড়ির পশ্চিম উইং-এ গিয়ে মিশেছে। বুহেরের বুকে ধুকধুকানি শুরু হয়ে গেছে, পেটটা আবার মোচড় দিয়ে উঠল। ছেলেটার বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় মৃদু টোকা দিল বুহের, কান পাতল। ভেতরে কোন সাড়া নেই। আবার নক্ করল সে, তারপর দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

ঘরে সরু একটা বিছানা ছাড়া কিছু নেই, দেয়াল আর ছাদের রঙ গাঢ় তামাটে। সুইচ টিপে বাতি জ্বালানোর জন্যে হাত বাড়াল বুহের। অবাক হয়ে দেখল ঘরে কোন বাল্ব নেই। বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কোলাজ করা কতগুলো নিউজপেপার ফটোগ্রাফের দিকে। পাশে দুটো বড়, বাঁধানো ছবিও আছে। একটা ডেমিয়েন থর্নের পোর্ট্রেট, তার মাথা আর কাঁধ দেখা যাচ্ছে শুধু। অন্যটা সমাধি স্তম্ভের ছবি। ঝোপঝাড়ে কবরের মাথায় লাগানো পাথরের টুকরোটা প্রায় ঢেকে গেছে। তবু কষ্ট করে পড়া যায়:

ক্যাথেলিন রেনল্ডস
প্রিয়তম কন্যা
১৯৪৯-১৯৮২

সশব্দে দম ফেলল পল বুহের, হাঁটু ভাঁজ করে বসল বিছানার পাশে, কোলাজটা দেখছে। ওয়ারশ ইহুদিদের দেখা যাচ্ছে ছবিতে, বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে, অসউইজ ক্যাম্পে পাঠানো হবে হতভাগ্য লোকগুলোকে। হিটলার, ইদি আমিন, মুসোলিনি, জোসেফ স্ট্যালিনের ছবিও আছে। হ্যারী ট্রুম্যান হাসছেন, হিরোশিমা ধ্বংস হয়েছে, ধোঁয়ার মধ্যে তাঁর মুখ। কোলাজে সিগার মুখে চার্চিল আছেন। আছেন হেনরী কিসিঞ্জার, এমনকি পলপটও। পলপট অসংখ্য খুলি আর হাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।

কোলাজের ওপর লাল কালিতে, বড় বড় অক্ষরে লেখা:

পুনরাবৃত্তি চাই

 

 

হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল বুহেরের, দ্রুত এক ঢোক ব্রান্ডি গিলে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। বাইরে এসে স্বস্তি অনুভব করল।

প্রাসাদের পশ্চিমাংশের আরও ভেতরে ঢুকে গেল বুহের দ্বিতীয় করিডর দিয়ে। ঠিক তখন বোটকা গন্ধটা ঝাপটা মারল নাকে। এক সেকেন্ড পরে ওটাকে দেখতে পেল সে। করিডরের শেষ মাথায় বসে আছে বিশাল আকারের জানোয়ারটা। ওটার হলুদ চোখ যেন আগুনের গোলা, জ্বলছে ধকধক করে। প্রকাণ্ড মাথাটা তুলল সে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, নিঃশব্দে এগিয়ে এল বুহেরের দিকে, প্রকাণ্ড দেহী, বিরাট চোয়াল, ঘাড় আর কাঁধের পেশীতে যেন জমাট বেঁধে আছে সমস্ত শক্তি। ওটার নিশ্বাসে বিকট গন্ধ। থেমে দাঁড়াল প্রাণীটা, তাকাল বুহেরের দিকে, মাথাটা বুহেরের পেটের সমান উচ্চতায় পৌঁছেছে। এক মুহূর্ত মানুষ এবং কুকুর পরস্পরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, নাক উঁচু করে টেনে নিল বাতাস, মাথা দোলাল, যেন গন্ধ চেনার চেষ্টা করছে, তারপর গলা দিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এল ওটার, সরে দাঁড়াল একপাশে, প্রহরী যাবার অনুমতি দিচ্ছে।

করিডরের শেষে, কালো একটা দরজার দিকে নিঃশব্দে পা বাড়াল বুহের, নক করার জন্যে হাত তুলল, তারপর কি ভেবে আস্তে ধাক্কা মেরে খুলে ফেলল দরজা।

ঘরটা গোল, কালো রঙ করা, ছয়টা স্তম্ভের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ। ঘরে কোন জানালা নেই, একটা বেদীর ওপর রাখা একটি কালো মোমবাতি কোনমতে দূর করেছে আঁধার।

মোমবাতির কাঁপা আলো গিয়ে পড়ছে কাঠের তৈরি যীশুর লাইফ-সাইজ প্রতিমূর্তির ওপর। একটা ক্রুশের গায়ে দাঁড় করানো যীশুর সারা গায়ে পেরেক বসানো, নগ্ন। শিরদাঁড়ায় আমূল ঢুকে আছে একটা ড্যাগার। ড্যাগারের বাঁটে যীশুর ছবি খোদাই করা।

ক্রুশ থেকে ছয় ফুট দূরে একটা মমি করা লাশ। এই লাশের গায়েও কাপড়- চোপড়ের বালাই নেই, শুধু একটা ইস্পাতের ফ্রেমের অবলম্বন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার হাত দুটো সামনের দিকে বাড়ানো, তালু ছড়ানো। মোমের আলো নাচছে তার খোলা চোখে, মনে হচ্ছে জ্যান্ত। মুখে ভয়ঙ্কর, বিকৃত এক টুকরো হাসি ফুটে আছে তার, যেন ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণাকাতর চেহারা দেখে মজা পাচ্ছে।

লাশের পায়ের কাছে বসা কালো আলখেল্লা পরা এক তরুণ, লাশের হাত চেপে ধরে আছে এত জোরে যে তার আঙুলের গাঁটগুলো সাদা হয়ে গেছে।

মৃদু, নিচু গলায় সে প্রার্থনা করে চলেছে। বুহের শুনতে পেল তার আর্তি

‘বাবা, আমাকে শক্তি দাও, তোমার সমস্ত বল আমার মধ্যে সঞ্চার করো। আমাকে শক্তি দাও হে মহান পিতা…’

একটানা, একভাবে প্রার্থনা করেই যেতে লাগল সে। সামান্য সময়ের জন্যেও বিরতি দিল না, দম যেন নিচ্ছেই না। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল বুহের, তারপর চাইল ডেমিয়েন থর্নের মরা মুখের দিকে। তারপর, যেন সহজাত প্রবৃত্তিতে ক্রুশের বিপরীত চিহ্ন আঁকল সে বুকে, পিছিয়ে এল, নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল দরজা।

কুকুরটা ঠাণ্ডা চোখে তাকে দেখল, কান পেতে শুনল বুহেরের ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসা পায়ের শব্দ, শেষে আবার গার্ড নিয়ে বসল সে, কান দুটো সেঁটে আছে মাথার পেছনে, গভীর মনোযোগে শুনতে লাগল ছেলেটার প্রার্থনার গুনগুন শব্দ।

.

ছেলেটির জন্যে ডাইনিংরুমে অপেক্ষা করছে বুহের। মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, শূন্য দৃষ্টি টেলিভিশন পর্দায়, দেখছে না কিছুই। হঠাৎ মুখ তুলে দেখল ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। পরনে শার্ট আর জিনস। শিষ্যরা ঠিকই বলেছে অনেক বড় হয়ে গেছে সে। এখনই লম্বায় তার মৃত বাবার মত, চেহারায় মিলও রয়েছে অনেক। ‘আপনাকে ক্লান্ত লাগছে,’ বলল ছেলেটা। গলার স্বর জোরাল, গভীর।

‘ও কিছু না,’ জবাব দিল বুহের। ‘বয়স হয়েছে না।’

‘নারী সঙ্গ বর্জন করা উচিত আপনার।’

হাসল বুহের। ‘আগে ব্যাপারটা উত্তেজিত করে তুলত আমাকে। এখন আর করে না।’

ছেলেটা বসল। প্রায় সাথে সাথে জর্জ হাজির হয়ে গেল ডিনার ট্রলি নিয়ে।

‘রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন?’ বাটলারের দিকে ফিরেও তাকাল না সে।

মাথা ঝাঁকাল বুহের, পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে ছেলেটার হাতে দিল। এক নিঃশ্বাসে রিপোর্টটা পড়ে ফেলল সে। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বুহেরের দিকে।

‘লিবিয়ানরা আশা করে ডি ফল্ট হবে না। হবে কি?’

মাথা নাড়ল বুহের। ‘ওদের সব কটার লেজ বেঁধে দিয়েছি এক সুতো দিয়ে। কোথাও আর যাবার জায়গা নেই।’ ছেলেটা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা দোলাল, কাগজের তাড়াটা ভাঁজ করে ফিরিয়ে দিল বুহেরকে।

‘বেশ। তাহলে সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে?’ প্রশ্ন করল সে।

‘ব্রিটিশরা জেরুজালেমে নিজেদের ক্যাম্প ডেভিডকে সুসংহত করতে চাইছে। কিন্তু কাজ হবে না।’

‘বেশ,’ কোলে ন্যাপকিন বিছাল ছেলেটা, তারপর খাওয়া শুরু করল।

খাওয়ার সময় তেমন কথা হলো না ওদের মধ্যে। ছেলেটা ক্ষুধার্তের মত খাচ্ছে, চুমুক দিয়ে সাবাড় করছে ওয়াইন, দ্রুত চোয়াল নড়ছে তার, মাঝেমধ্যে মুখে খাবার নিয়েই নানা প্রশ্ন করে গেল সে বুহেরকে।

‘শুনলাম ইহুদ বারাক নেসেট নিয়ে সমস্যায় পড়েছে…’

‘ব্রাডলি হোয়াইট হাউজ চালাচ্ছেন কেমন?’

‘জিম্বাবুয়েতে কবে ক্যু হবে?’

বুহের তার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেল ধৈর্যের সাথে। ছেলেটা হয়েছে তার বাপের মতই, তবে ডেমিয়েন থর্নের আকর্ষণ করার শক্তি নেই ওর মধ্যে। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই মোহিনী জাদুও এসে যাবে।

ডিনার শেষে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে দু’জনে, বাটলার এসে এক টুকরো কাগজ দিল বুহেরকে, ছেলেটার দিকে ফিরে বলল:

‘সেই বুড়ি আবার এসেছে, স্যার।’

হাই তুলল ছেলেটা, বুহের তাকাল চিরকুটের দিকে। ‘মহিলা বলছে সে নাকি তোমার দাইমা ছিল,’ বলল বুহের।

কাঁধ ঝাঁকাল বাটলার। ‘গত এক হপ্তা ধরে মহিলা এখানে ঘুর ঘুর করছে, স্যার।’

বুহের ছেলেটার দিকে চাইল। ‘তোমার কাছ থেকে শেষ আশীর্বাদটুকু পেতে চায় সে।’

আবার হাই তুলল ছেলেটা।

বুহের কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল ফায়ার প্লেসে। ‘ওকে আসতে বলো,’ বলল সে। ‘তবে নিশ্চিত হয়ে নিও এই মহিলা সে-ই মহিলাই কিনা।’

‘জ্বী, স্যার।’

‘ব্রাডলির ব্যাপারে আপনি শিওর তো?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুহের। ছেলেটা বড্ড একগুঁয়ে আর ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। বাইরের কোন ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই। বিশেষ করে এ বয়সের ছেলেরা যেসব কাজ করে আনন্দ পায়। তবে এটাও অস্বীকার করার জো নেই সে অন্য দশটা ছেলের মত সাধারণ নয়।

দরজাটা আবার খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল লোলচর্ম এক বৃদ্ধা। হুইল চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসা, পা ঢাকা কম্বলে, কাঁধে শাল। হাত দুটো কোঁচকানো, আঙুলগুলো যেন আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পরস্পরের সাথে। বুড়ির ওজন টেনেটুনে আশি পাউন্ড হবে। চেয়ারের একটা বোতাম টিপল সে, হিসিয়ে উঠল মোটর, টায়ারের শব্দ তুলে হুইল চেয়ার এগিয়ে আসতে লাগল বুহেরদের দিকে। টেবিলের ধারে এসে থেমে গেল বৃদ্ধা, স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। হাত বাড়িয়ে ক্রাচ তুলে নিল সে, আস্তে আস্তে সিধে হলো। বুড়িকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে যাচ্ছিল বুহের, মানা করল সে।

‘পারব আমি,’ ভাঙা, ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল বৃদ্ধা। ওঠার সময় তার গায়ের হাড় ফুটল মটমট করে, সোজা হয়ে দাঁড়াবার পরে দেখা গেল প্রায় ছেলেটার মতই লম্বা সে।

‘আমার নাম সিনথিয়া অ্যাবট,’ বলল সে। ‘আমি একজন নার্স। তোমাকে জন্মাতে দেখেছি আমি।’

ছেলেটা চুপ করে রইল। ‘তোমার যেদিন জন্ম হলো, সেদিন সন্ধ্যায় বাত রোগে আক্রান্ত হলো আমার হাত। তারপর থেকে সারা শরীরে যন্ত্রণা আমার। প্রচুর ওষুধ খেয়েছি। কাজ হয়নি কোন। বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার ধারণা, ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।

‘দিতেই পারেন,’ বলল ছেলেটা।

‘তীব্র এই যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না। আত্মহত্যা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখার বড় শখ ছিল আমার। দেখতে চেয়েছিলাম কাকে আমি পৃথিবীতে আনতে সাহায্য করেছি।’

ছেলেটা দু’হাত বাড়িয়ে দিল, উঁচু করল চিবুক।

‘আশা করি এখন খুশি হয়েছ।’ বলল সে।

‘আমাকে তোমার আশীর্বাদ দেবে না?’

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, উঠে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে তাকাল অত্যন্ত রোগা শরীরটার দিকে। হাত বাড়িয়ে বুড়ির কপাল ছুঁলো সে, চোখ বুজল বুড়ি। হঠাৎ কেঁপে উঠে চোখ মেলে চাইল।

‘আমি সবসময় দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তোমার জন্মের সময় আমি হাজির ছিলাম আর তোমার বাবার জন্যে একটা শিশুকে হত্যা করেছি আমি।’

ছেলেটা চেপে ধরল বুড়ির মাথা, চেহারা কঠোর হয়ে উঠল, দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা। ‘ঈশ্বর পুত্রের পুনর্জন্মের দিন তোমার বাবা আমাদের বলেছিল ওই দিন যে সব শিশু জন্ম নেবে তাদের সবাইকে হত্যা করতে। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি এ আশায়-’

‘কি আশায়?’ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তরুণ বুড়ির দিকে।

‘আশা করেছিলাম যীশু-পুত্রকে ধ্বংস করতে পারব।’

‘কিন্তু পারোনি,’ গর্জে উঠল ছেলেটা, পিছিয়ে এল এক পা, হাত মুছল শার্টে যেন ময়লা লেগেছে।

‘তোমরা ওকে মারতে পারোনি। তোমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছ। ঈশ্বরের পুত্র বেঁচে আছে এখনও। তার উপস্থিতি প্রতিদিন টের পাই আমি। প্রতি ঘণ্টায় তার শক্তি বেড়ে চলেছে। সে আছে সর্বত্র, অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।’ আরেক পা পিছিয়ে গেল সে, কথা বলার সময় থুথু ছিটল, বুড়ির মুখে লাগল। ‘তোমরা আমার বাবাকে বাঁচাতে পারোনি, আমাকেও পারবে না।’

নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল মহিলা, গাল বেয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে মুখে। হাতের চেটো দিয়ে পানি মুছছে, ছেলেটা এগিয়ে এল সামনে, রাগে চোখে আগুন জ্বলছে।

‘তুমি ভেবেছ তোমাকে ঈশ্বর ব্যথা দিচ্ছেন,’ বলল সে, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। ‘ভুল। তিনি মানবতাকে শাস্তি দেন, যেটাকে তিনি পাপ বলে মনে করেন। আমার বাবা কাউকে শাস্তি দেন না। ব্যর্থতা ছাড়া কাউকে তিনি শাস্তি দেননি। ব্যর্থতা ক্ষমা করতে পারেন না তিনি।’

হাহাকার করে উঠল বৃদ্ধা। ‘কিন্তু আমাকে যা যা করতে বলা হয়েছিল সবই আমি করেছি। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমি আর কি…?’

ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটা। ‘চলে যাও তুমি। আর যেন কখনও না দেখি তোমাকে।’ পিছিয়ে গেল বুড়ি, বসে পড়ল হুইল চেয়ারে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দয়া করে ক্ষমা করো।’

কিন্তু ছেলেটা বুড়ির দিকে ফিরেও চাইল না। বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। নীরবতা নেমে এল ঘরে। বুহের ছেলেটার দিকে তাকাল।

‘তোমার কি মনে হয় না…?’

বুহেরকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল ছেলেটা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল, গনগনে মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেল ইনহন করে।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৩

তিন

ট্যাক্সিটা গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল বুড়ির জন্যে। বুড়ি অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে, চেষ্টাকৃত হাসি দিল ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে। তারপর উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। বাড়ি যাবে। চলার পথে কোন কথা বলল না সে। বাড়ি পৌঁছে সোজা ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে, লিভিংরুম থেকে হুইল চেয়ার চালিয়ে বেডরুমে এল। এ ঘরে কারও প্রবেশাধিকার নেই।

পুরো ঘর কালো রঙ করা। দেয়ালে দুটো ছবি ঝুলছে। একটা ডেমিয়েন থর্নের, অন্যটা তরুণী এক মেয়ের। ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা খাট, লেখার টেবিল এবং চেয়ার। দুটো বুকশেলফও আছে, একটাতে বাইবেল সম্পর্কিত নানা বই, অন্যটাতে পর্নোগ্রাফি। শেলফের সামনে গিয়ে বইগুলো ছুঁয়ে দেখল বৃদ্ধা, তারপর টেবিল থেকে একটা পেপার ওয়েট তুলে ছুঁড়ে মারল ডেমিয়েনের ছবি লক্ষ্য করে। গায়ে শক্তি একেবারেই কম। দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছল না ওটা, পড়ে গেল মেঝেতে। সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপাতে লাগল বুড়ি। ধীরে ধীরে শরীরটাকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে, হাত বাড়িয়ে দেয়াল থেকে ছুটিয়ে আনল দ্বিতীয় ছবিটা, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিছানার কাছে গেল, রীতিমত কাঁপছে, ওটা রেখে দিল বিছানার ওপর। নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। ছবিটা তার বাবা তুলেছিল সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার মাস কয়েক আগে। ওই সময় সে ছিল সাংঘাতিক একা, ভীতু আর সরল।— তারপর একদিন বেলিয়াল নামে সেই পাগলা ছোঁড়ার সাথে পরিচয় হলো…তারপর কি হতে কি হয়ে গেল ঠাহর করতে পারেনি সে।

শুরুতে লোভ দমন করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু হেরে গেছে। নার্স ছিল বলে ওরা তাকে নিজেদের দলে টেনে নিতে কসুর করেনি। সবকিছু কেমন বিশৃঙ্খল মনে হত নিজের কাছে। রাত আর দিনের মাঝে যেন কোন ফারাক ছিল না। তাকে অত্যন্ত শক্তিশালী ড্রাগস খাওয়ানো হয়েছিল। একদিন সকালে তার ঘুম ভাঙে, মনে হয় এতদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু ওটাই ছিল চরম বাস্তবতা। একটা কুকুরের সাথে মিলিত হতে বাধ্য করেছিল ওরা, অবচেতন অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঘাড়ে শুকিয়ে থাকা লালা দেখতে পায় সে। শুকনো জিনিসটা ঘষে ওঠাতেই চোখে পড়ে একটা দাগ-লবঙ্গপাতার আকারে আঁকা তিনটে ছোট ছয়-আর তার বিছানার পাশের দেয়ালে লেখা ছিল বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি:

যাহার বোঝার ক্ষমতা আছে
সে পশুর সংখ্যা দেখিলেই চিনিতে পারিবে:
ইহা একটি মানুষের সংখ্যা
সংখ্যাটি হইল ছয়শো ছেষট্টি।

ওই ঘটনা তাকে ভীষণ আতঙ্কিত করে তোলে, সে ছুটে যায় বাবা-মা’র কাছে, হাতজোড় করে ক্ষমা চায়। যদিও নিজের জীবনের অনেক ঘটনাই সে গোপন করেছিল তাদের কাছে। কিন্তু নীতিবান বাবা-মা ঘর পালানো মেয়ের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন। মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাননি তাঁরা। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। তবে যাবার আগে পুরো গল্প বলে যায় সে। রেলিয়াল এবং তার দলের কাছে ফিরে গিয়েছিল সে। ওরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে, সেই সাথে বলেছে সে এখন তাদেরই লোক।

 

 

চোখ বুজল বৃদ্ধা, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে পড়ছে ডেমিয়েন থর্নের নির্দেশের কথা, কিভাবে নবজাতক শিশুকে ইনকিউবেটরের মধ্যে হত্যা করেছিল তার কথা। কাজটা করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি তাকে। অল্প সময়ের জন্যে অক্সিজেনের লাইনটা খুলে রেখেছে। বাচ্চাটার নামও মনে আছে তার: মাইকেল থমাস, খুদে একটা শিশু।

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে…

চোখের সামনে ভেসে উঠল নানা দৃশ্য…

বেঁটে একটা লোক, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ। তাকে ভীষণ বিশ্বাস করত সে। তার কাছেই প্রথম সতীত্ব খুইয়েছিল সে। লোকটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে ঠেসে ধরেছিল তার হাতে, যন্ত্রণায় সে চিৎকার করছে, ওদিকে লোকটা তার কানে কানে বলছিল: ‘পাপ ক’রলে কি হবে তার একটু স্বাদ নাও…’

প্রীস্টকে দেখতে পেল সে এবার। কামাতুর একটা মুখ। তার গালে ঠোঁট ঘষছে, একটা হাত পিষছে বুক। ‘যন্ত্রণা অবিনশ্বর। যে ত্বক জ্বলে কিন্তু শেষ হয়ে যায় না…’

টের পাচ্ছে কর্কশ একজোড়া হাত তাকে নির্মমভাবে নিষ্পেষণ করে চলেছে। চিৎকার করে উঠল সে। চোখ মেলে চাইল। দেখল এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, সুদর্শন ছেলেটির নাম মাইকেল থমাস। হাসছে সে, তার হাসিতে করুণা আর দয়া যেন ঝরে পড়ছে। তার পাশে একটা মুখ দেখা গেল, অস্পষ্ট, চেহারা চেনা যাচ্ছে না, এগিয়ে এল সে তার দিকে, অগ্নিদগ্ধ হাতটা ধরল পরম মমতায়, কথা বলল সে। তাকে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলছে, বলছে পিতার রাজ্যে তার জন্যে এখনও খালি আছে জায়গা…

ঘুম থেকে জেগে উঠল সে, ঘৃণার দৃষ্টিতে চাইল ডেমিয়েন থর্নের ছবির দিকে। কিন্তু ওখানে থর্নের বদলে সেই অস্পষ্ট মুখটিকে দেখা যাচ্ছে, মনে হলো এখনও স্বপ্ন দেখছে সে আর যেন ঘুমের মধ্যে থেকে তার কণ্ঠ ভেসে আসছে: ‘অনুতাপ করো। অনুতাপের দ্বার সবসময়ই খোলা।’

বিছানায় উঠে বসল বৃদ্ধা, খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোল টেবিলের দিকে। কলম আর কাগজ টেনে নিল। তারপর লেখা শুরু করল। ধীরে ধীরে লিখল সে, কলমটা ধরে আছে শক্ত হাতে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠল মুখ।

‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’

কোন বিরতি ছাড়াই টানা দু’ঘণ্টা লিখে গেল সে, কাগজের ওপর ধীর গতিতে অক্ষর সৃষ্টি করে চলল কলম, যেন ওটা জীবন ফিরে পেয়েছে। লেখা শেষ করে কাগজের তাড়াটা ভাঁজ করে একটা খামে ঢোকাল সে, তারপর ঠিকানা লিখল:

‘ফাদার ডি কার্লো, মনাস্টেরি অভ সান বেনেদেতো, সুবিয়াকো, ইটালি।’

ফাদার ডি কার্লো ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করে না সিনথিয়া। আর কারও কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ার কথা ভাবতেও পারেনি সে। ফাদারই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন, ওকে বুঝতে পারবেন। বাইরে তাকাল বৃদ্ধা। ভোর হয়ে গেছে। ফোন টেনে নিল সে, ট্যাক্সি ডাকবে।

পুব দিকে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি, ভেতরে বসে বৃদ্ধা ভাবছে ফাদার ডি কার্লো সত্যি তাকে ক্ষমা করবেন কিনা। এমনও হতে পারে তিনি তার অনুতাপের বিষয়টিকে শেষ মুহূর্তের হতাশা ভেবে পাত্তা দেবেন না। শালের নিচে চিঠিটি খামচে ধরল সে জোরে, আবার চোখ বেয়ে গড়াতে শুরু করেছে পানি। এবার নিজের কথা ভেবে কাঁদছে সিনথিয়া, কাঁদছে নষ্ট, অন্ধকার জীবনটার কথা ভেবে, যে বাচ্চাটাকে সে নিজের হাতে হত্যা করেছে তার কথা ভেবে।

‘এসে পড়েছি,’ ড্রাইভারের উঁচু গলা শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছল বুড়ি। দেখল যেখানে কনভেন্টটা ছিল সেখানে এখন অফিস উঠেছে। বুক কাঁপিয়ে নিশ্বাস ফেলল সে। যাক, এখানে অন্তত একটা মেইল বক্স আছে।

‘বুড়ি মা, চিঠিটা দিন। আমি ডাকে ফেলে আসি,’ বলল ড্রাইভার। কিন্তু বুড়ি রীতিমত সংগ্রাম করে ক্রাচে ভর দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। কাউকে দিয়ে চিঠি পোস্ট করতে দিতে রাজি নয় সে। নিজেই ডাকে ফেলে এল চিঠি।

‘কাজ শেষ,’ বলল বৃদ্ধা। ‘এবার একটু বায়ে ঘোরাও, বাবা।’

চার্চটা আছে। তবে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ওটা। ছাদ-টাদহীন স্রেফ একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, ভাঙাচোরা সাইন বোর্ড পড়ে বোঝা যায় এটা সেন্ট লিউকাস চার্চ। এখানে তাকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেয়া হয়েছিল, তার বাবা এবং দাদুকেও।

আবার ক্যাব থেকে শরীরটাকে টেনে নামাল বৃদ্ধা, দাঁড়াল পেভমেন্টে। ফুটপাথ কাঁপছে হাতুড়ির বাড়িতে। চার্চ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কাছের একটা সাইন বোর্ডে তা. লেখাও আছে।

চার্চের দরজার দিকে পা বাড়াল বুড়ি। রশিতে পা বেধে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল। শরীরের হাড়গুলো ফুটল মটমট করে। পেছন ফিরে তাকাল বৃদ্ধা। ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজের সীটে বসে ঝিমুচ্ছে।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল বৃদ্ধা। বিশাল ওক কাঠের দরজাটা ‘নেই’ হয়ে গেছে। ভেতরে পা রাখল সে, মুখ তুলে চাইল। ভাঙা ছাদ। ওপরে ভাঙচুর চলছে। হাতুড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোটা জায়গা কাঁপছে থরথর করে, জুতো ভেদ করে কাঁপুনিটা ঢুকে যাচ্ছে গায়ে। চার্চের ভেতরে একটাও বেঞ্চি নেই, শুধু বেদীটা আছে। বেদীর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল বুড়ি। ওপরে তাকাতেই ফুটো ছাদ থেকে ঝুরঝুর করে বালি পড়ল চোখে-মুখে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ হয়ে গেল সে। চোখ ডলে খানিক পরে ধাতস্থ হলো। তাকাল যীশুর মুখের দিকে। ছেলেবেলায় এখানে কত এসেছে সে। এখানে দাঁড়িয়ে যীশুর দিকে তাকিয়ে থাকত।

যীশুর দাড়িঅলা মুখখানা অদ্ভুত শান্ত, সোজা তাকিয়ে আছেন চার্চের বারান্দার দিকে। আজ ওখানে কোন দর্শক বা উপাসনাকারী নেই। যীশু প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। বুড়ি তাঁর সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসল, শুরু করল প্রার্থনা। প্রার্থনা সঙ্গীত সম্পূর্ণ মনে আসছে না, কিন্তু সে নীরবে প্রার্থনা করে যেতে লাগল। হঠাৎ একটা প্রার্থনা সঙ্গীত মনে পড়ে গেল তার, মাথা তুলে গানটা গাইতে শুরু করল বৃদ্ধা।

হাতুড়িগুলোও যেন প্রার্থনা সঙ্গীতে যোগ দিল, একই ছন্দে বাড়ি পড়তে লাগল; নড়ে উঠল যীশুর মূর্তি, ধুলোর ঘন একটা মেঘ তার মুখটাকে ঢেকে দিল।

বুড়ি অনেক কসরত করে উঠে দাঁড়াল, হাত ছোঁয়াল ঘাড়ে। দাগটা নেই। ও জায়গার চামড়া আশ্চর্য মসৃণ। ফুঁপিয়ে উঠল সে, তবে এ তার আনন্দের কান্না।

‘আমি মুক্তি পেয়েছি, ফিসফিস করল সে।

ঠিক তখন হাতুড়ির আঘাতে তার পেছনের দেয়ালে চিড় ধরল, বেদীর ওপর দুলতে শুরু করল মূর্তি। প্রাণপণ চেষ্টায় সটান দাঁড়িয়ে গেল বৃদ্ধা, দু’হাত ছড়িয়ে দিল যীশুর দিকে।

‘এসো, প্রভু, তোমার রাজ্যে আমাকে ঠাঁই দাও।’

শেষ দৃশ্যটা সে দেখল যীশু তার ওপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছেন। ছুঁচাল দাড়ি তার খুলি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল, পাথরের আঙুলের চাপে হাড্ডিসার বুকের সবগুলো পাঁজর ভেঙে গেল মটমট করে। শেষ মুহূর্তে উল্লাসের চিৎকার দিল বৃদ্ধা।

তার লাশ আবিষ্কার করল এক রাজ মিস্ত্রী। সিনথিয়ার মরণ চিৎকার শুনতে পেয়েছিল সে। ব্যাপারটা কি জানার জন্যে ভাঙা দেয়াল টপকাল সে, দেখল যীশুর মূর্তির নিচে চাপা পড়ে আছে এক বুড়ি। মূর্তির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা একটা পা তখনও প্রবল আক্ষেপে মোচড় খাচ্ছে। বুড়ির মুখ রক্তে মাখামাখি, যীশুর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখে জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে রাজ মিস্ত্রীর মনে হলো বুড়ি যেন হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৪

চার

রোমে, নিজের হোটেল রুমে, ঘুম ভেঙে গেল ফ্রেডরিক আর্থারের টেলিফোনের আওয়াজে। বুকের ওপর থেকে আস্তে ধাক্কা মেরে স্ত্রীকে সরিয়ে দিল সে, হাত বাড়াল রিসিভারের দিকে। ফ্রেডরিকের সেক্রেটারি। হাই তুলতে তুলতে জানতে চাইল রাষ্ট্রদূত তার আলোচ্য বিষয়সূচিতে হঠাৎ কোন পরিবর্তন ঘটেছে কিনা। ঘটেনি শুনে বলল, ‘তাহলে কফির সাথে কাগজপত্রগুলো পাঠিয়ে দাও। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।’

রিসিভার রেখে, গড়ান দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল ফ্রেডরিক আর্থার। শীলা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাতে বুনো হয়ে উঠেছিল মেয়েটা। ব্যাপারটা আর্থারের কাছে উপভোগ্য মনে হলেও মিলন পর্বটা আরও আনন্দদায়ক হয়ে উঠত যদি শীলার আবেগ প্রকাশের ভঙ্গীটা আরেকটু সংযত এবং অনুরাগপূর্ণ হত। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠল আর্থার। ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়ায় নয়, কাল রাতে ভালবাসাবাসির ফলে পিঠ আর বুকে জন্ম নেয়া আঁচড় আর কামড়গুলো সাবান লেগে জ্বালা করে ওঠার কারণে। রোম রোমান্টিক শহর, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রোমান্টিকতা শীলাকে যেন আরও যৌনবুভুক্ষু করে তুলেছে।

গোসল সেরে কাপড় পরল আর্থার। তারপর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখ বোলাতে লাগল তেল আবিব থেকে আসা লেটেস্ট ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে। পশ্চিম তীর আর গাজায় সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট সম্পর্কে সেই গৎ বাঁধা খবর যা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে আর্থার। ওদিকে পরিবর্তন খুব কমই হয়েছে। সেই একই বুলি বারবার, জায়গাটাও এক। এমনকি বোমা বর্ষণের ঘটনাতেও কোন বৈচিত্র নেই। সাম্প্রতিক পরিবর্তন বলতে হেবরনে হামলার ঘটনার পরে বিশ্ব-রাজনীতিতে টেনশনটা একটু বেড়েছে। আর লিবিয়ানদের হাতে বোমা আসার খবরে আশঙ্কা এবং ভয়টাও একটু বেশি কাজ করছে, এটুকুই যা।

ফ্রেডরিক আর্থার মনে মনে খুশি। কারণ এবারের রোম সফরে তাকে শুধু দর্শকের ভূমিকাই পালন করতে হবে। দুটো দিন শুধু দেখো, কথা শোনো এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলো-ব্যস, ফুরিয়ে গেল কাজ। প্রেস তাকে নিয়ে বেশি মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানার জন্যে মুখিয়ে আছে স্বাই। স্রেফ ‘নো কমেন্ট’ বলে তাদেরকে পাশ কাটিয়েছে আর্থার। তাকে নিয়ে কার কি পরিকল্পনা রয়েছে জানে না আর্থার, তবে নিজের জন্যে পরিকল্পনা করে রেখেছে সে আগেই।

কফি শেষ করে স্ত্রীকে চুমু খেল আর্থার, তারপর বেরিয়ে পড়ল। নিজেকে খুব তাজা লাগছে, নতুন একটি দিন শুরু করার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

.

মীটিংটা হলো পিএলও আর নেসেটের মধ্যে। বরাবর যা হয়ে আসছে, এবারও তাই হলো। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। পিএলও-র তরুণ সদস্যদের কাছে ‘সমঝোতা’ শব্দটাই নাকি অশ্লীল মনে হয়। আর বোমা বর্ষণের পর থেকে নেসেটের আচরণও বদলে গেছে অনেক। বহিরাগত কোন পক্ষের পরামর্শ বা চাপকে তারা থোড়াই কেয়ার করছে।

ডিবেট রুমে দু’পক্ষের বক্তব্য শুনল আর্থার ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে। যে যাই বলছে, তাতে শেষতক কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ একটা পরামর্শ দিলে ওটা নিয়ে আলোচনা শুরু হবার আগেই আরেকজন এমনভাবে আপত্তি তুলছে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার কোন অবকাশই থাকছে না।

মীটিং শেষ হলো ওভাবেই-অগোছাল এবং কোন সমাধান ছাড়াই। চিন্তিত মুখে মীটিং থেকে বেরুল আর্থার, তাই শুনতে পেল না একজন তার নাম ধরে ডাকছে। হঠাৎ আস্তিনে টান পড়তে ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল সে। বেঁটেখাটো, মোটাসোটা এক লোক, হাতে মখমলের পাউচ।

‘সিনর আর্থার, আমার নাম পাভোত্তি, হোটেল সিকিউরিটি।’

মাথা ঝাঁকাল আর্থার।

‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, স্যার। এক লোক বসে আছে আমাদের অফিসে। আপনার সাথে দেখা না করে নাকি যাবেই না।’

‘ওকে আমার—’

‘লোকটা বলছে সে নাকি সন্ন্যাসী,’ বলল পাভোত্তি। পাউচটা আর্থারের হাতে তুলে দিল সে। ‘এ জিনিসটি আপনাকে দিতে বলেছে সন্ন্যাসী।’

বটুয়াটার মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধা। খুলতেই বেরিয়ে এল ক্ষুরধার এক ড্যাগার। দম বন্ধ করে ভয়ঙ্কর অস্ত্রটির দিকে তাকিয়ে রইল আর্থার। ফলাটা তিনকোনা, হাতলটা ক্রুশ আকারের, যীশুর মূর্তি খোদাই করা।

‘সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সে হোটেল সিকিউরিটির খোঁজ করছিল,’ ব্যাখ্যা দিল পাভোত্তি। ‘আমার এক লোককে দেখে বলল আপনার সাথে দেখা করতে চায়। তারপর আমার লোকের হাতে ড্যাগারটা তুলে দেয় সে। ড্যাগার সম্পর্কে কি যেন বলতে চাইছে সে আপনাকে। আপনাকে আমরা বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু-’

ফলাটায় আঙুল ছুঁইয়ে ধার পরীক্ষা করতে গেল আর্থার। গুঙিয়ে উঠল। কেটে গেছে আঙুল, এক ফোটা রক্ত বেরুল। ‘ওকে ওপরে পাঠিয়ে দাও, কেমন? আর ড্যাগারটা তোমার কাছেই থাকুক।’ বলল সে ধারাল ছুরিটা পাভোত্তির হাতে দিয়ে। তারপর রওনা হয়ে গেল লিফটের দিকে।

নিজের স্যুইটে ফেরার পথে বারবার হাত ঘষল আর্থার। রক্ত লেগে চটচটে হয়ে গেছে। শিউরে উঠল সে। ছেলেবেলা থেকে ছুরি-কাঁচিতে দারুণ ভয় আর্থারের। ইস্পাতের ছুরি চামড়া ভেদ করে মাংসের গভীরে ঢুকে গেছে, এমন দৃশ্য কল্পনা করলেও ওর বমি এসে যায়। এমন যন্ত্রণা নিশ্চয়ই সহ্যের অতীত। যীশুকে যেভাবে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছে…আবার শিউরে উঠল আর্থার। যীশু বা ধর্ম-কর্ম পালনের প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই আর্থারের। তার কাছে ধর্ম মানে স্রেফ একটা সাপ্তাহিক প্রার্থনা সভা। এ নিয়ে কখনও গভীরভাবে চিন্তাও করেনি। আর দু’হাজার সালে ধর্ম নিয়ে মাতামাতিটাকে তার কাছে মনে হয় নিতান্তই অযৌক্তিক।

ঘরে নেই __ চিরকুট রেখে গেছে। ডিনারের সময় ফিরবে। টেবিলে কিছু টেলেক্স মেসেজও আছে। ওগুলো মাত্র পড়া শুরু করেছে আর্থার, নক্ হলো দরজায়। দরজা খুলল সে। বাদামী আলখেল্লা আর স্যান্ডেল পায়ে এক তরুণ সন্ন্যাসীকে নিয়ে এসেছে পাভোত্তি। লোকটির চেহারায় শিশুসুলভ সারল্য, বেশ সুদর্শন। তবে তাকে খুব আড়ষ্ট এবং উদ্বিগ্ন লাগল। বুড়ো মানুষের হতাশা আর ক্লান্তি ফুটে আছে চোখে।

এক পাশে সরে লোকটিকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিল আর্থার, হাত তুলল পাভোত্তির দিকে তাকিয়ে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকটা অস্বস্তিভরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেল।

‘ভয় নেই,’ তাকে আশ্বস্ত করল আর্থার। ‘কোন সমস্যা হবে না।’

হাসার চেষ্টা করল সন্ন্যাসী। ‘আমি ব্রাদার ডেভিড,’ স্পষ্ট উচ্চারণে ইংরেজীতে বলল সে। ‘সুবিয়াকো থেকে এসেছি।’

‘আমার হাতে সময় কিন্তু খুব কম,’ একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল আর্থার।

‘আমি বেশি সময় নেবও না,’ বলল সন্ন্যাসী। ‘আমি যা বলতে এসেছি তা আপনার বিশ্বাস হবে কিনা জানি না। তবে আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করতেও বলছি না।’ একটু বিরতি দিল সে। ‘কতদিনের জন্যে রোমে এসেছেন মি. আর্থার?’

‘কাল চলে যাচ্ছি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সন্ন্যাসী। ‘কালকের যাত্রাটা বাতিল করুন। আমার সাথে এক জায়গায় চলুন। আমাকে ফাদার ডি কার্লো নামে এক সন্ন্যাসী পাঠিয়েছেন। ওঁর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?’ শেষ প্রশ্নে রীতিমত আবেদন ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।

‘না। আমি মানে ঠিক-

‘বাইরে যাবার মত অবস্থা নেই ডি কার্লোর। বুড়োমানুষ তার ওপর ভগ্নস্বাস্থ্য। ওঁকে আপনার সাহায্য করতেই হবে। কারণ গোটা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর ওপরে। কথাটা কি খুব বেশি ইয়ে হয়ে গেল—মানে, কি যেন শব্দটা?’

‘নাটকীয়?’

‘জ্বী। জ্বী। তবে সব কথা খুলে বললে হয়তো আমাকে পাগল ঠাউরে বসবেন। আপনার কাছে অনুরোধ একটাই-একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। ওটা পড়ন। পড়ার সময় মনে হতে পারে পাগলী এক বুড়ির আবোল-তাবোল লেখা পড়ছি, আসলে তা নয়।’ একটু থেমে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি ধর্ম-কর্ম করেন, মি. আর্থার?’

‘শুধু রোববারে গির্জায় যাই,’ জবাব দিল আর্থার। অবাক হয়ে ভাবল কথাটা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে কেন বলল সে। ‘আপনি প্রটেস্টান্ট?’

‘জ্বী।’

‘একটা কোট করছি শুনুন,’ প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত তুলল সন্ন্যাসী। ‘যখন দেখিবে সৈন্যবাহিনী পরিবেষ্টিত করিয়া ফেলিয়াছে জেরুজালেমকে, নিশ্চিত জানিবে ঊষর সময় সমাগত… ইহা হইবে প্রতিশোধ গ্রহণ করিবার দিন, যাহা লিখিত আছে তাহা পূরণ হইতে পারে।’ সেইন্ট লিউক থেকে বললাম।’

ঘড়ি দেখল আর্থার। ‘দুঃখিত, আমাকে একটু…’ অনেক হয়েছে। এসব সন্ন্যাসী হলো বসতে পেলে শুতে চাইবার মত। একে প্রশ্রয় দেয়াই ঠিক হয়নি।

উঠে দাঁড়াল আর্থার, তার সাথে ব্রাদার ডেভিডও। আমার কথাগুলো হয়তো আপনার কাছে পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে,’ বলল সে। ‘ফাদার ডি কার্লো আঠারো বছর আগে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। যীশুর দ্বিতীয় আগমনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। শয়তান পুত্রের শারীরিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছিলেন।’

ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল আর্থার, সন্ন্যাসী হাত ধরে পা বাড়াল দরজার দিকে।

‘কিন্তু যীশুর শত্রুর শক্তি এখনও বেঁচে আছে, মি. আর্থার। শুধু ড্যাগারগুলো দিয়ে তাকে ধ্বংস করা যাবে।’

দরজা খুলল আর্থার।

‘অনুগ্রহ করে চিঠিটি একবার পড়বেন। আমি কাল আপনাকে ফোন করব।’

‘পাভোত্তি,’ হাঁক ছাড়ল রাষ্ট্রদূত। দৌড়ে এল সিকিউরিটি, খপ করে চেপে ধরল সন্ন্যাসীর আলখেল্লা, হিড়হিড় করে টেনে বের করল ঘর থেকে।

‘বিদায়, ব্রাদার ডেভিড,’ বলল আর্থার।

‘শয়তানের বংশধর এখনও বেঁচে আছে, মি. আর্থার। তাকে হত্যা করতেই হবে।’

গম্ভীর চেহারা নিয়ে দরজা বন্ধ করল আর্থার। দূর থেকে ভেসে এল সন্ন্যাসীর গলা।

‘ঈশ্বরের নামে আপনার অবিশ্বাস বিসর্জন দিন…’

ঘণ্টাখানেক পর, কয়েকটা ফোন সেরে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল রাষ্ট্রদূত। হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। হাই তুলতে তুলতে ভেতর থেকে বের করল ছ’টা ফটোকপি। কাগজগুলোর সাথে একটা চিরকুটও আছে। তাতে লেখা:

‘এই মহিলা যা বলেছে সব সত্যি। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। অনুগ্রহ করে চলে আসুন।’

নিচে দস্তখত: ফাদার ডি কার্লো, সুবিয়াকো।

প্রথম পাতার লেখাটা শুরু হয়েছে এভাবে:

‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’ প্রথম পাতাটা পড়ে ফেলল আর্থার, অবিশ্বাসে ডানে-বামে মাথা নাড়ছে। হাত বাড়াল স্কচের বোতলের দিকে।

‘জেসাস ক্রাইস্ট অলমাইটি,’ বিড়বিড় করল সে, তারপর হাসতে শুরু করল।

.

ফ্রেডরিক আর্থারকে সস্ত্রীক দাওয়াত দিয়েছেন বাঙালী সাংবাদিক জামশেদুর রহমান। ফ্লিট স্ট্রীটের সবচে’ খ্যাতনামা ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টদের একজন তিনি। পত্রিকাটির প্রায় জন্ম লগ্ন থেকে এর সাথে আছেন। অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষ। রাজনৈতিক অঙ্গনের রথী-মহারথীরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অফ দা রেকর্ডে অনেক কথাই হয় তাঁদের সাথে জামশেদুর রহমানের। রাজনীতিবিদদের সম্মান বাঁচিয়ে এমন দক্ষতার সাথে তিনি গোপন কথাগুলো বলে দেন যে রথী-মহারথীরা তাঁর ওপর কখনোই রাগ বা অভিমান করার সুযোগ পান না। এ ব্যাপারটা তাঁর কলিগদের ঈর্ষান্বিত করে তোলে। এ গুণটি আছে বলে জামশেদুর রহমান চোখ কপালে ওঠার মত একটি অঙ্কের বেতন পেয়ে থাকেন। শৌখিন স্বভাবের এই বৃদ্ধ মানুষটিকে আজ পর্যন্ত কেউ বাটনহোলে তাজা গোলাপ ছাড়া দেখেনি।

হোটেলের রেস্টুরেন্টে আর্থার ডিনার সারল জামশেদুর রহমানের সাথে। খাবারটা সুস্বাদু। সাথে কালো পোশাকে তার মোহনীয় স্ত্রী। সময়টা ভালই কাটছে ফ্রেডরিক আর্থারের। তবে কথা বলার চেয়ে শ্রোতার ভূমিকা পালন করতেই বেশি পছন্দ শীলার। বাঙালী সাংবাদিক আর স্বামীর খেলাধুলা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক উপভোগ করছে সে।

শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন জামশেদুর রহমান। এতক্ষণে সময় হয়েছে প্রশ্নটা করার। ‘শুনলাম এক পাদ্রি নাকি আজ আপনার সাথে দেখা করেছে,’ হালকা গলায় বললেন তিনি।

মাথা দোলাল আর্থার। জামশেদ ব্যাপারটা জানেন বলে অবাক হলো না সে। এই লোকটি কিভাবে যেন সব খবর আগেভাগে পেয়ে যান।

‘কোন্ এক মনাস্টেরি থেকে এসেছে,’ বলল সে। ‘জ্বালিয়ে মেরেছে।’

ড্যাগারের কথা খুলে বলল আর্থার। টের পেল বগলের নিচ দিয়ে ঠাণ্ডা ধারায় ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।

‘এই পাগলা সন্ন্যাসীটা চায় কি?’ জিজ্ঞেস করলেন জামশেদুর রহমান।

কাঁধ ঝাঁকাল আর্থার। ‘বিস্তারিত বর্ণনা করে আড্ডার মেজাজটা নষ্ট করতে চাই না। বলছে শয়তানের বংশধর বেঁচে আছে, ইংল্যান্ডে নাকি বাস করছে।’

‘মাই গড়’ হা হা করে হেসে উঠলেন জামশেদ।

‘এক বুড়ি মনাস্টেরিতে চিঠি লিখেছে…থাক্, বাদ দিন তো এসব।’

‘আরে, বলুন না,’ বললেন জামশেদ। ‘গল্পটা হয়তো ন্যাশনাল এনকুইরারে চালিয়ে দিতে পারব।’

‘আমার এসব শুনতে ভাল লাগছে না,’ এতক্ষণে মুখ খুলল শীলা। ‘আর কোন প্রসঙ্গ নেই?’

এরপর ওরা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

ঘণ্টাখানেক পর, বিছানায় উঠে শীলা আর্থার জানতে চাইল স্বামীর কাছে, ‘ডিনারে কোন্ বুড়ির গল্প বলছিলে তুমি?’

‘ও কিছু না, অশ্লীল ব্যাপার।’ হাই তুলল আর্থার। ঘুম পাচ্ছে। ‘তবু আমি শুনতে চাই,’ জেদ ধরল শীলা। ‘বলো আমাকে।

 

 

শীলার সাথে তর্ক করতে ইচ্ছে করল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বলল, ‘বুড়ি লিখেছে আমার এক পূর্বসুরি, ডেমিয়েন থর্নের সাথে বিবিসি’র এক মেয়ের দৈহিক সম্পর্ক হয়েছিল।’

‘তারপর?’

‘কয়েক মাস পর হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় থর্ন। সম্ভবত অতিরিক্ত খাটাখাটনির কারণে। মেয়েটা সন্তানের জন্ম দেয়-’ হাসল আর্থার। ‘-তবে জরায়ু থেকে বাচ্চা বের হয়নি।’

আর্থার ভেবেছিল কথাটা শুনে শীলা হয় হাসবে না হলে মুখ কোঁচকাবে। কিন্তু কিছুই করল না সে। চুপ করে থাকল। একটু পর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ডেমিয়েন থর্নের মত সুদর্শন পুরুষ জীবনে দেখিনি আমি।

চোখ ট্যারা করে আর্থার চাইল স্ত্রীর দিকে, ‘তার সাথে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে? জানতাম না তো!’

‘আমি ওকে ছবিতে দেখেছি। স্কুলে পড়ার সময় ডেমিয়েন থর্নকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম।’

আবার নীরব হয়ে গেল দু’জনে। আর্থারের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুলো শীলা।

‘মেয়েটার নাম কি?’

‘কেট,’ বলল আর্থার। ‘কেট কি যেন।’

‘কেট,’ ফিসফিস করল শীলা। ‘ক্যাথলিন, ক্যাথি, ক্যাটেরিন। আমাকে কেট বলে ডাকবে।’ স্বামীর দিকে ফিরল সে, জড়িয়ে ধরল তাকে। ‘আমার নাম কি বলো?’

‘কেট।’ বলল আর্থার।

এরপর প্রেম করল ওরা। উদ্দাম ঝড় শুরু হয়ে গেল বিছানায়। এক পর্যায়ে উন্মাদিনী শীলা অসম্ভব সব কাণ্ড করতে বলল ওকে নিয়ে, ফ্যাসফেঁসে গলায় আর্থারকে বারবার ডাকল ‘ডেমিয়েন’ বলে; আর্থার ওর কাঁধের ওপর দিয়ে জানালার দিকে তাকাল। শীলা স্বামীর চোখে চোখ রাখল। আর্থারের মনে হলো এটা আসলে আলোর কারসাজি: তারার আলো পড়েছে শীলার চোখে, হলুদ, ম্লান দুটি বিন্দুর মত লাগল চোখ জোড়া।

পরদিন সকালে হোটেলে এল আলখেল্লা পরা এক তরুণ। চেহারায় উদ্বেগ। তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হোটেল-ক্লার্ক।

‘আমার নাম ব্রাদার ডেভিড… শুরু করল সে।

‘ও, আচ্ছা,’ বলল ক্লার্ক। আপনার জন্যে একটা প্যাকেজ আছে।’ কাউন্টারের নিচে হাত বাড়িয়ে একটা কাউচ আর একটা খাম বের করল সে। খামের মুখ টেপ দিয়ে আটকানো। ওটা খুলল সন্ন্যাসী, একবার চোখ বোলাল, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘আমি কি একবার মি. আর্থারের সাথে কথা বলতে পারি, প্লীজ। স্যুইট নং চৌত্রিশ…’

‘উনি চলে গেছেন, স্যার।’

‘কোন মেসেজ রেখে গেছেন আমার জন্যে?’

‘জ্বী, না, স্যার। শুধু আপনার হাতের জিনিস দুটো দিয়ে গেছেন।’

চোখ বুজল সন্ন্যাসী, কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কি করে প্রীস্টকে বলবে সে ব্যর্থ হয়েছে।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৫

পাঁচ

ফ্রেডরিক আর্থারের সাথে ডিনার করার দিন তিনেক পর, এক অলস সন্ধ্যায় অফিসের এক এক্সিকিউটিভের সাথে বারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন জামশেদুর রহমান, কথায় কথায় রাষ্ট্রদূতের প্রসঙ্গ চলে এল। তিনি সন্ন্যাসীর গল্পটা বললেন এক্সিকিউটিভকে, ড্যাগার প্রসঙ্গে হা হা করে হাসলেন, মন্তব্য করলেন ব্যাপারটা নির্ঘাত কারও উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।

পরদিন অফিসে ঢুকেই এক্সিকিউটিভ এক তরুণী রিপোর্টারকে ইঙ্গিত করলেন তাঁর ঘরে আসতে। তরুণীর নাম শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। বয়স তেইশ। মাস দুই হলো ফ্লিট স্ট্রীটে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে সংবাদিক হিসেবে বেশ নাম করে ফেলেছে। তেমন লম্বা নয় সে, তবে শরীরটা সুগঠিত, মুখখানা লাবণ্যে ঢলঢল। দু’মাসের মধ্যেই প্ৰমাণ করে দিয়েছে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ধারাল মস্তিষ্কের অধিকারিণী। কর্তৃপক্ষ তার ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

‘বলুন, স্যার,’ দরজা বন্ধ করে হাসি মুখে জানতে চাইল শ্যারন।

‘এখন তো সামার চলছে,’ বললেন এক্সিকিউটিভ।

‘জী।’

‘সামনের ঢিলে দিনগুলোর জন্যে কিছু গরমাগরম খবর মজুত রাখা দরকার।’

হাসিটা ধরে রেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল শ্যারন।

‘কাল জামশেদুর রহমানের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম,’ বললেন এক্সিকিউটিভ। ‘উনি একটা গল্প বলেছেন। গল্পটার সাথে লাশ, ছোরা ইত্যাদি ব্যাপার জড়িত। তুমি পুরানো খবরের কাগজ ঘাঁটলে হয়তো এ বিষয়ে তথ্য পাবে। সম্ভবত হত্যাকাণ্ডগুলোকে ‘ক্রুশিফিক্সন কিলিং’ বা এ ধরনের কিছু একটা নাম দেয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হলে গল্পটা আমাদের ‘আনসলভড্ ক্রাইম স্পট’ বিভাগে ছাপতে পারব। করবে কাজটা?’

মাথা দোলাল শ্যারন। করবে।

খুশি হলেন এক্সিকিউটিভ। বললেন, ‘তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’

তাড়াহুড়োর কিছু না থাকলেও শ্যারনের মাথায় কোন আইডিয়া একবার ঢুকলে ওটার শেষ না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। সে কাজে লেগে গেল।

কিছু ক্লিপিং জোগাড় করে ফেলল শ্যারন। কয়েকটা ক্লিপিং খুবই পুরানো, চাপ দিলে মুঠোর ভেতর গুঁড়ো হয়ে যেতে চায় কাগজ। কাগজপত্র নিয়ে নিজের ডেস্কে বসল সে। একটা সুবিধে হয়েছে শ্যারনের। লাইব্রেরীতে ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় দুই পৃষ্ঠার একটা রেডিমেড গল্প পেয়ে গেছে। ওটাতেই প্রথম চোখ বোলাল সে:

এক করুণ বংশের কাহিনী:
অভিশপ্ত থর্ন পরিবার

হেডিং-এর নিচে একটা ড্যাগারের ছবি। ড্যাগারের হাতলে যীশুর প্রতিমূর্তি। ছবিটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল শ্যারন। তারপর কলমটা টেনে নিল।

লেখাটার বেশির ভাগ জিনিস কাজে আসবে না শ্যারনের, লেখক থর্ন পরিবারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তবে কৌতূহল নিয়ে রচনাটি পড়ল শ্যারন।

গতকাল মৃত্যুবরণ করেছেন বৃটেনে নিযুক্ত তরুণ রাষ্ট্রদূত ডেমিয়েন থর্ন। বত্রিশ বছর বয়স্ক এই যুবকের মৃত্যুর মাধ্যমে যেন থর্ন পরিবারের শেষ অধ্যায় রচিত হলো। এই বিখ্যাত পরিবারটির সবই ছিল, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সকলেই বরণ করেছেন অকাল এবং অদ্ভুত মৃত্যু।

ডেমিয়েন থর্ন মারা গেছেন নিজের বিছানায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। ব্যাপারটা এক অর্থে অস্বাভাবিক।

শ্যারন ডেমিয়েন থর্নের ছবি দেখল। পাশে ছোট ছোট আরও কয়েকটি ছবি। সবগুলোর নিচেই ক্যাপশন আছে: রবার্ট থর্ন, ডেমিয়েনের বাবা, লন্ডন চার্চের সিঁড়িতে গুলি খেয়ে মারা গেছেন, রহস্যময় খুনেকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ক্যাথরিন, ডেমিয়েনের মা, হাসপাতালের জানালা দিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর আগে, পেরিফোর্ডে, তাদের পারিবারিক নিবাসে মিসক্যারেজের শিকার হন ক্যাথরিন। ডেমিয়েনের চাচা-চাচী, রিচার্ড এবং অ্যান থর্ন, থর্ন মিউজিয়ামে আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যান। ডেমিয়েনের সৎ ভাই, মার্ক, তেরো বছর বয়সে ব্রেন হেমারেজে মারা যায়।

আর্টিকেলটাকে সাব-হেড দিয়ে আবার ভাগ করা হয়েছে। একটা হেডিং এরকম:

পেরিফোর্ড, অভিজাত ভৌতিক বাড়ি

হেডিং-এর নিচে একটা জমিদার বাড়ির ছবি। তারপর ডেমিয়েনের তরুণী ন্যানির গল্প, সে জানালায় দড়ি বেঁধে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। ন্যানির পরে যে ডেমিয়েনের দেখাশোনা করত তার কথাও আছে। সে নির্মমভাবে খুন হয়েছে রবার্ট থর্ন যে রাতে মারা গেলেন সেই সময়। আর এই সেই পেরিফোর্ড, লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের, যা ক্যাথেরিন থর্নের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যেও দায়ী

গল্পের আরেক অংশে পরিবারের বাইরের লোকজনের মৃত্যুর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আথারটন নামে এক লোক, থর্ন ইন্ডাস্ট্রির চীফ এক্সিকিউটিভ, শিকাগোতে, থর্ন ম্যানসনে আইস হকি ম্যাচে অংশ নেয়ার সময় পানিতে ডুবে মরেছে। ডেমিয়েনের তেরোতম জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি দেয়া হয়েছিল। আথারটন বরফের মধ্যে পড়ে সলিল সমাধি লাভ করে।

আরেক থর্ন এক্সিকিউটিভ, পাসারিয়ান, ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় মারা যায়। তখন ডেমিয়েন আর তার বন্ধুরা গাইড নিয়ে প্ল্যান্ট দেখতে বেরিয়েছিল। রিচার্ড থর্নের সাক্ষাৎকার নেয়ার পরপরই অদ্ভুত এক ঘটনায় মারা যায় এক মহিলা সাংবাদিক। এ জায়গাটা পড়ার সময় কেন যেন শিউরে উঠল শ্যারন, দ্রুত ক্রুশ আঁকল বুকে। তারপর আবার মনোযোগ দিল পড়ায়।

থর্ন মিউজিয়ামের কিউরেটর দুর্ঘটনায় রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে মারা গেছে। ওই একই সন্ধ্যায় শিকাগোর থর্ন মিউজিয়াম আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ মৃত্যু তালিকার যেন শেষ নেই। চোখ ঘষল শ্যারন, আবার পড়া শুরু করল…

অ্যান্ড্রু ডয়েল, লন্ডনের ইউএস এমব্যাসির রাষ্ট্রদূত, নিজের অফিসে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি…

একটি টেলিভিশন স্টুডিওতে ডেমিয়েনের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় অজ্ঞাত পরিচয় এক লোক আগুনে পুড়ে মারা যায়…

দুই লোক, এদেরও পরিচয় অজানা, কর্নওয়ালের মৃগয়াভূমিতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় শিকারে বেরিয়েছিল ডেমিয়েন। একজনের হাতে ছিল একটা ড্যাগার, আরেকটা ড্যাগার ছিল অপর লাশটির পাশে…

নোট নিল শ্যারন। মৃত্যুর ঘটনাগুলোই শুধু তার গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। লেখক কোন দুর্ঘটনা সম্পর্কেই উপসংহার টানেননি, শুধু দেখাতে চেয়েছেন করুণ মৃত্যু ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছিল থর্ন পরিবারে। ক্লিপিংগুলোর ফটোকপি করল শ্যারন, তারপর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রেস অফিসে ফোন করল। গলা শুকিয়ে গেছে ওর। ফেদারসে ঢুকে ঠাণ্ডা কোকে গলা ভেজাল। তারপর গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।

প্রেস অফিসারের বয়স কম। সুন্দরী শ্যারনকে সাহায্য করার জন্যে সাগ্রহে এগিয়ে এল। শ্যারনের মত মেয়েদের সাথে বিয়ার পান করার সুযোগ তার কদাচিৎ ঘটে বলেই হয়তো।

শ্যারনের দেয়া ড্যাগারের ছবিগুলোয় চোখ বোলাল অফিসার, কুঁচকে উঠল ভুরু, ‘আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি অস্ত্র মনে হচ্ছে।’

‘এগুলো আপনাদের মিউজিয়ামে আছে?’

‘হ্যাঁ। পাঁচটা আছে। আচ্ছা, আমি ফাইল দেখছি।’

কয়েক মিনিট পর কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা ঘরে শ্যারনকে নিয়ে এল প্রেস অফিসার। এটার নাম ব্ল্যাক মিউজিয়াম। ড্যাগারগুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। পাঁচটাই। প্রতিটি ড্যাগারের বাঁটে খোদাই করা যীশুর মূর্তি। কাঁচের ভেতর থেকে যেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

‘তিনটে ড্যাগারের খোঁজ পাওয়া গেছে,’ তরুণ অফিসার ফাইলে চোখ বোলাল। ‘কর্নওয়ালের এক চ্যাপেলে। ওই পাঁচটা আমাদের হাতে এসেছে তদন্ত করতে গিয়ে একটা ড্যাগার ছিল লোকটার পকেটে, আর দুটো ছিল পিঠে বেঁধা।’

‘ফাইলটা একবার দেখতে পারি?’

অফিসার শ্যারনকে ফাইল দিল। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘লাঞ্চ করেছেন? চলুন, একসাথে লাঞ্চ করি?’

‘নো, থ্যাঙ্কস, মিষ্টি করে হাসল শ্যারন। ‘আমাকে এখুনি অফিসে ফিরতে হবে।’ জামশেদুর রহমানকে অফিসে নয়, এল ভিনো রেস্টুরেন্টে পাওয়া গেল। লাঞ্চ করছেন। নিজের পরিচয় দিল শ্যারন, বলল, ‘আপনার বন্ধু, আমার বস্, মি. স্টিফেন গনজালেস বলেছেন প্রয়োজনে আপনার সাথে দেখা করতে। আমি একটা ফিচার করছি। মি. স্টিফেন বললেন রোমে ফ্রেডরিক আর্থারের সাথে আপনি ডিনার করেছেন-’

 

 

‘ওটা আমাদের ব্যক্তিগত আড্ডা ছিল,’ বললেন জামশেদ।

লেখাটার একটা কপি তাঁকে দিল শ্যারন। ‘এই ড্যাগারের কথাই কি তিনি বলছিলেন?’

কাগজে চোখ বোলালেন জামশেদুর রহমান। হতে পারে। এরকম হাতলঅলা ড্যাগারের কথাই বোধহয় শুনেছিলাম। কিন্তু রাষ্ট্রদূতকে এ ব্যাপারটা নিয়ে যেন বিরক্ত করতে যেয়ো না। আমি চাই না-’

শ্যারন ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঘাড় ফিরিয়ে ‘থ্যাঙ্কস’ বলল, তারপর পা বাড়াল দরজার দিকে।

.

পাঁচ ড্যাগারের ওপর দ্রুত ফিচার লিখে ফেলল শ্যারন। তারপর ফোন করল আমেরিকান এমব্যাসিতে। প্রেস অ্যাটাশে জানাল অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করতে চাইলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে হবে শ্যারনকে। লিখিত অনুরোধ সহ প্রশ্ন পাঠাতে হবে।

‘পাঠাব,’ খুশি খুশি গলায় বলল শ্যারন। কোম্পানি নোট পেপারে প্রশ্ন লিখেও ফেলল ঝটপট। এক লোককে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিল গ্রসভেনর স্কোয়ারে, আমেরিকান দূতাবাসে। তারপর হেসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল শ্যারন। প্রটোকল ভাঙছে সে, তো কি হয়েছে? বস্ যদি অনুযোগ করেন তাঁকে না জানিয়ে কেন কাজটা করতে গেল শ্যারন কিংবা জামশেদুর রহমান রেগে যান, জবাবে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসবে শ্যারন। বলবে অনভিজ্ঞতা এবং যৌবনের উচ্ছ্বাস থেকে কাজটা করে ফেলেছে সে। তাঁরা যেন ব্যাপারটাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। আর যদি রোমের ড্যাগারের সাথে অমীমাংসিত মৃত্যুগুলোর মাঝে কোন সূত্র যোগ করতে পারে শ্যারন, তাহলে কেল্লা ফতে। দারুণ একটা গল্প হবে ওটা। ঝুঁকি নেয়াটা সার্থক হয়ে উঠবে।

.

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল শ্যারন। আজ ওর অফ ডে। আজ পেরিফোর্ডে যাবে ঠিক করেছে। থর্ন পরিবারের প্রাসাদ-বাড়ির ছবিতে আবার চোখ বোলাল শ্যারন। লেখক বলছেন চারশো একর জমি নিয়ে এ বাড়ি, তেষট্টিটা ঘর, দুটো উইং। ১৯৩০ সালে বাড়ির একাংশে আরেকটা বিল্ডিং তৈরি করা হয়। ওখানে মাছ ধরার পুকুর আছে, আছে টেনিস কোর্ট, সব্জি বাগান…’

ঘণ্টাখানেক লাগল জায়গাটা খুঁজে বের করতে। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখে ড্রাকুলা আর তার ট্রানসিলভেনিয়ার ভৌতিক দুর্গের কথা মনে পড়ে গেল শ্যারনের। ঝলমলে সূর্যালোকিত দিন। ভরত পাখিরা মনের আনন্দে গাইছে। গাড়ি চালাতে চালাতে মুচকি হাসল শ্যারন ড্রাকুলার কথা ভেবে। এমন নির্জন জায়গায়, বিরাট প্রাসাদে, সত্যি ড্রাকুলা নেই তো?

রাস্তার ধারে গাড়ি থামাল শ্যারন। নেমে পড়ল। একটা মাঠ পেরোল। মাঠের পর প্রকাণ্ড বাড়িটা। চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কমপক্ষে দশ ফুট উঁচু। কয়েক জায়গায় ইট খসে পড়ে মুখ হাঁ করে আছে গর্ত। শ্যারন ভাবল, বাইরে একটা চক্কর দিয়ে ফিরে যাবে কিনা। তারপর রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করবে। কিন্তু দেয়ালের ওপাশে কি আছে দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। দেখলে ক্ষতি কি? ধরা পড়লে মিষ্টি হেসে বলবে সে ভেবেছিল এটা একটা পার্ক।

দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এক ফুট একটা ফাটলের মধ্যে শরীর গলিয়ে দিল শ্যারন।

.

অ্যালার্ম সিস্টেম বেজে উঠতে অবাক হলো ছেলেটা। ক্লোজ-সার্কিট টিভির বোতামে চাপ দিল। পর্দায় ফুটে উঠল শ্যারনের ছবি। দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে দেয়ালের ফাঁকে, কি যেন ভাবছে। তারপর পিছলে নেমে এল জমিনে, ঘাসের ওপর। ছেলেটার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেল, কুকুরটাও নড়েচড়ে উঠল। জানালার বাইরে কটমট করে তাকাল, দাঁড়িয়ে গেছে লোম, গলার ভেতর থেকে গরগর আওয়াজ বেরিয়ে এল, নাক কোঁচকাল, বেরিয়ে পড়েছে ঝকঝকে সাদা দাঁত।

হাত বাড়িয়ে জানোয়ারটার কাঁধ ছুঁলো সে। কুকুরটা তাকাল তার দিকে, হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করছে। ছেলেটা কুকুরটার লোমের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিল, ধরে রাখল ওকে। কুঁচকে যাবার ভঙ্গিতে ভাঁজ পড়ল কুকুরটার কপালে, ঘুরল, তাকাল টিভি পর্দার দিকে। হাঁপাচ্ছে। জিভ বেয়ে লালা পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কার্পেট।

ক্লোজ-আপে টিভি অ্যাডজাস্ট করল ছেলেটা, আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে শ্যারনের দিকে। শ্যারন লন ধরে হাঁটছে।

মেয়েটাকে দেখে অস্থির হয়ে উঠল কুকুর, কিন্তু ছেলেটা ছাড়ল না ওকে। শ্যারন একটা ঝোপের ধারে চলে এসেছে। হঠাৎ বাড়ি খেল লম্বা একটা ডালে। দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যারন। ছেলেটা ওর চোখে পানি দেখতে পেল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো তার। ইচ্ছে করল মেয়েটার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে দু’একটা সান্ত্বনাবাক্য শুনিয়ে আসে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে শ্যারনের দিকে। চিবুক ডলতে ডলতে আবার রওনা হয়েছে মেয়েটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে আসবে। লাফ মেরে সিধে হলো ছেলেটা, এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, করিডর পেরিয়ে, দ্রুত নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। কুকুরটা তার পায়ের সাথে সেঁটে রইল। সাইড ডোর খুলে পা বাড়াল সে লনের দিকে। কুকুরটা দাঁড়িয়ে থাকল দোরগোড়ায়।

.

ঝোপের পরে সুন্দর ভাবে ছাঁটা ঘাসের লন। লনের শেষ মাথায় প্রকাণ্ড বাড়িটা। বাড়িটা খুব সুন্দর তবে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। চাঁদনি রাতে রোমান্টিক পার্টির জন্যে দারুণ জায়গা, ভাবল শ্যারন। বাড়িতে কেউ থাকে না? মুখ তুলে চাইতেই ছেলেটাকে দেখতে পেল সে। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে এল শ্যারনের, স্কুল ছাত্রীদের মত মুখে হাত চাপা দিল। যেন ছেলেটাকে দেখে খুব লজ্জা পেয়েছে।

এত সুদর্শন তরুণ জীবনে দেখেনি শ্যারন।

‘হ্যালো,’ কথা বলার সময় ভাঙা বাঁশির সুরের মত শোনাল গলা।

জবাবে নড় করল তরুণ; নীরবে দেখছে শ্যারনকে। ভুবন ভোলানো হাসিটি উপহার দিল শ্যারন ওকে, পা বাড়াল। ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর পথ আটকে দাঁড়াল।

‘আপনি কে?’ জিজ্ঞেস করল সে।

উচ্চারণটা কোন্ এলাকার ধরতে পারল না শ্যারন, তবে গলার স্বর ভারী আর গভীর।

‘আমি শ্যারন। তুমি কে?’

‘এখানে কি চাই?’ থমথমে গলায় প্রশ্ন করল তরুণ।

‘কিছু না। এমনি পার্কটা ঘুরে দেখছিলাম।’ আবার হাসল শ্যারন। তবে অপরজন হাসল না। শ্যারনের বিখ্যাত হাসি দেখে এই প্রথম কোন পুরুষ মানুষের চেহারায় ভাব ফুটল না। স্রেফ পাথর চোখে ছেলেটা তাকিয়ে রইল তার দিকে

‘এটা পার্ক নয়।’

‘ওহ্, আমি ভেবেছিলাম-’

‘এটা প্রাইভেট এস্টেট।’

‘তাই?’

অনধিকার প্রবেশের অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত শ্যারন। তুমি যতই রূপবান আর শক্তিশালী হও না কেন আমাকে এড়িয়ে যাওয়া তোমার কম্মো নয়, ভাবছে ও।

‘আপনি বাড়িটা দেখতে চান?’

‘ধন্যবাদ। হ্যাঁ…’ হুট করে আমন্ত্রণটা আসবে চিন্তাই করেনি শ্যারন, কি বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা ঘুরে দাঁড়াল, তারপর হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু পিছু এগোল ও। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল, বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ কুকুরটাকে দেখে। বুক হিম করা ডাক ছাড়ল ওটা, গায়ের লোম খাড়া। ছেলেটা মাত্র একবার তাকাল জানোয়ারটার দিকে, সাথে সাথে থেমে গেল গর্জন।

শিউরে উঠল শ্যারন। ‘আমি এতবড় কুকুর জীবনেও—’

‘ওটা রটউইলার, ব্যাখ্যা দিল ছেলেটা। ‘একসময় মাল টানার কাজে ব্যবহার করা হত ওদের। শিকারেও পটু। কাউকে একবার বাগে পেলে…’ হাসল সে।

‘শিকার আমি ঘেন্না করি,’ বলল শ্যারন।

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল তরুণ। আপনার করারই কথা।’

ভেতরে ঢুকল ছেলেটা শ্যারনকে নিয়ে, পেছনে নিঃশব্দে ছায়ার মত অনুসরণ করে চলল কুকুর। বোটকা গন্ধ আসছে ওটার গা থেকে। নাক কোঁচকাল শ্যারন।

হলঘরের মাঝখানে চলে এসেছে শ্যারন, চারপাশে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কি প্রকাণ্ড গ্যালারি, ঝুড়ি থেকে লতা ঝুলছে। ওখান থেকে ক্যাথেরিন থর্ন পড়ে গিয়েছিল, ভাবল শ্যারন।

‘আপনি ঘুরে-ফিরে দেখুন,’ বলল ছেলেটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। কুকুরটা থাকল শ্যারনের সাথে।

‘অনেক ধন্যবাদ,’ বলল শ্যারন। দেখল কুকুরটা আগের মত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

এখানেই তাহলে সব ঘটনা ঘটেছে, ভাবছে শ্যারন। এটাকে এখন আর ভূতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে না। হলঘর পার হয়ে ড্রইংরুমে চলে এল, ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সিঁড়ির দিকে তাকাল। ছেলেটা কোথায় গেল? ছেলেটার সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করবে সে এখানে থাকে কিনা আর এ বাড়ির ইতিহাস সে কতটা জানে। একবার যখন ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছে, সব খুঁটিয়ে দেখবে শ্যারন।

হঠাৎ শ্যারন খেয়াল করল ও একা। চলে গেছে কুকুরটা।

চ্যাপেলে, তার বাবার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, দৃষ্টি লাশের চোখের দিকে। ঠোঁট নড়ছে তার। নীরবে প্রার্থনা করে চলেছে। হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরল সে।

‘ক্ষমা করো, পিতা, আমার অযোগ্যতাকে ক্ষমা করে দাও,’ মৃদু গলায় বলল তরুণ।

এক পা পিছিয়ে এল সে, ঘুরল, জ্বলন্ত চোখে তাকাল যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে।

‘তুমি,’ ঘৃণাভরে বলল সে, ‘ভেবেছ তোমার নোংরা কৌশল দিয়ে আমার মন ভোলাবে। এজন্যে ওই সুন্দরী ছলনাময়ীকে আমার কাছে পাঠিয়েছ, তাই না? ঠিক যেভাবে আমার মাকে পাঠিয়েছিলে আমার বাবার কাছে। বাবার মত আমাকেও মিথ্যে আবেগের ফাঁদে ফেলতে চেয়েছ। আমার শক্তিকে দুর্বল করতে চেয়েছ কামনার ফাঁদ পেতে।’

ক্রুশের পেছন দিকে চলে এল সে, ড্যাগারের হাতল চেপে ধরল, চাড় দিয়ে কাঠের ভেতর ঢুকিয়ে দিল ফলা।

‘তার ফল হলো এই,’ হিসিয়ে উঠল সে, একটানে বের করে আনল ড্যাগার। এক মুহূর্ত কটমট করে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে, তারপর চলে এল লাশের কাছে, বৃত্ত করে ঘুরল চারপাশে, শিরদাঁড়ায় হাত বোলাল। পঞ্চম ভার্টেব্রার নিচে গভীর একটা ক্ষত। আঙুল কেঁপে উঠল ওখানে ছোঁয়া লাগতে। আবার ড্যাগারের দিকে তাকাল সে।

‘ছলনাময়ীরা সবাই খুনী,’ ফিসফিস করল সে। ‘আমার বাবাকেও খুন করেছে এক ছলনাময়ী।’ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে এক মুহূর্ত, তারপর এক লাফে চলে এল যীশুর মূর্তির সামনে, দড়াম করে ঘুষি মারল মুখে, আবার ড্যাগার ঢুকিয়ে দিল মেরুদণ্ডে।

‘ভেবেছ তুমি প্রলোভন সম্পর্কে সব জানো,’ আবার মূর্তির সামনে চলে এল ছেলেটা। ‘ভেবেছ তুমি প্রলোভন জয় করতে পেরেছ। কিন্তু তোমার চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত তোমাকে কিছুই শেখায়নি। তুমি এই মেয়েটাকে পাঠিয়েছ আমার নিয়তি, আমার কর্ম থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে, তোমার রাস্তায় আমাকে নিয়ে যেতে। এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল সে। কিন্তু তুমি ব্যর্থ হয়েছ, এবং সবসময় তাই হবে।’

হাত বাড়িয়ে মুখ ছুঁলো সে তারপর ঘুরে দাঁড়াল।

.

অনেক ঘোরাঘুরি করেছে শ্যারন। সাঁঝ নামছে। বাড়ি ফেরা দরকার। নাক কুঁচকে রেখেছে ও। এ বাড়ির সব জায়গায় কুকুরটার গায়ের বমি আসা গন্ধ। তবে ছেলেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শীত শীত লাগছে শ্যারনের। পাতলা ব্লাউজ আর সামার স্কার্ট ঠাণ্ডা বাতাস ঠেকাতে পারছে না।

হঠাৎ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পড়ার তীব্র ইচ্ছে জাগল মনে। কেন জানি ভয় লাগছে ওর।

দরজা খুলে ড্রাইভওয়েতে পা রেখেছে শ্যারন, কিসের সাথে যেন হোঁচট খেল। বড়, নুড়ি পাথর একটা। জুতো খুলে ফেলল ও। পায়ে নুড়ির খোঁচা লাগছে। গ্রাহ্য করল না শ্যারন। বাতাসের বেগ বাড়ছে। লনের কাছে এসেছে, হঠাৎ মনে হলো কেউ আড়াল থেকে ওকে দেখছে। পেছন ফিরে তাকাল শ্যারন। ভেবেছিল কুকুরটাকে দেখবে। নেই ওটা। কেউ নেই। লন পার হয়ে ঝোপের দিকে এগোল ও, অজান্তে বেড়ে গেছে চলার গতি। কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না তবে বোটকা গন্ধটা যেন গলার ভেতর ঢুকে আছে। বমি আসছে। বাড়িটা থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে শ্যারন, গন্ধটা তত প্রবল হয়ে উঠছে

ঝোপগুলোর মাঝখানে একটা রাস্তা। ওই পথ ধরে হোঁচট খেতে খেতে ছুটল শ্যারন। দুইবার প্রায় আছাড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল গাছের শেকড়ের সাথে পা বেঁধে। ডালগুলো বাড়ি মারছে মুখে। এক হাতে মুখ ঢেকে দৌড়াচ্ছে শ্যারন। বারবার দেখা দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়ছে। স্বপ্নের মধ্যে কে যেন ওকে তাড়া করে। কাঁপতে কাঁপতে বহুবার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে শ্যারন। স্বপ্নটা এমনভাবে গেঁথে আছে মনে, সিনেমায় কাউকে তাড়া করার দৃশ্য দেখলেও আঁতকে ওঠে ও।

দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যারন। ঝোপগুলো এদিকে অনেকটা হালকা। এরপরে ঘাসের জমিন, তারপর দেয়াল, সবশেষে দেয়ালের ওপাশে শ্যারনের গাড়ি। আবার দৌড় শুরু করল শ্যারন। একটু পর থেমে গেল। আবারও ঝোপের রাজ্য! ব্যাপারটা কি? হতভম্ব হয়ে গেল শ্যারন। ও কি তাহলে একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরে মরছে? নিজেকে বকা দিল শ্যারন। দিক ঠিক করে কখনও চলতে পারে না ও।

আবার শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে এল, হাত দুটো বুকে চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে শ্যারন। ঝোপ ঠেলে অন্ধের মত খুঁজছে খালি মাঠটা। মাঠের পরেই দেয়াল। মাঠে পৌঁছুতে পারলেই হলো। কিন্তু এ পথ যে শেষ হয় না। কত বড় এস্টেট এটা? চারশো একর না? এখন হোক আর খানিক পরে হোক, দেয়াল চোখে পড়বেই শ্যারনের। তারপর সে পেরিফোর্ড ছেড়ে চলে যেতে পারবে।

.

নিঃশব্দে মেয়েটার পিছু নিয়েছে কুকুরটা। পঞ্চাশ গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করে চলেছে ওকে। মেয়েটা থামলে সেও দাঁড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা যখন মাঠে চলে এল দু’জনের মাঝে দূরত্ব রইল ত্রিশ গজ। দাঁড়িয়ে পড়ল কুকুর, নাক উঁচু করে শ্বাস টানল, দেখল মেয়েটা ঘাস জমিনের ওপর দিয়ে দৌড় শুরু করেছে। সেও দৌড়াল। এবার আগের চেয়ে জোরে। চওড়া বুকটা উঠছে-নামছে, লাফ মেরে প্রতি সেকেন্ডে দূরত্ব কমিয়ে আনছে সে…

কোন শব্দ শুনতে পেল না শ্যারন, টের পেল বোটকা গন্ধটা বেড়েই চলেছে। ওটার উপস্থিতি অনুভব করল যখন জানোয়ারটা প্রায় ওর গায়ের ওপর উঠে পড়েছে, সেই সময়। ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল শ্যারন, কোমরে লোহার মত শক্ত মাথার প্রচণ্ড গোত্তা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। চিৎকার দেয়ার সময়ও পেল না, উঠতে যাচ্ছে, কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কামড় বসাল পায়ের গোছে। ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাচ্ছে ওটা, চোয়ালজোড়া বন্ধ হলো সশব্দে, হাড় আর মজ্জা ভেদ করে ঢুকে গেল তীক্ষ্ণ দাঁত; এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল শ্যারন। মুখ তুলল কুকুর, কটমট করে চাইল শ্যারনের দিকে, তারপর ছেড়ে দিল ওকে। মিশে গেল অন্ধকারে।

.

তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে গেছে শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। ফোঁপাচ্ছে। আহত পা-টায় আগুন ধরে গেছে, একটুও নড়াতে পারছে না। কুকুরটা ওর পায়ের শিরা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। জানে হাঁটতে পারবে না। তাই হামাগুড়ি দিয়ে এগোল।

ব্যথা সহ্য করতে পারছে না শ্যারন। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলল। দেয়াল পর্যন্ত যেতে পারলে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করবে শ্যারন। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই শুনবে ওর আকুতি।

দশ গজ এগোতে এক ঘণ্টা লাগল শ্যারনের। নিচতলার জানালার ধারে বসে ছেলেটা আর তার কুকুর দেখছে ওকে। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে বৃথাই ঘণ্টাখানেক কান্নাকাটি করল শ্যারন। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল ঘাসের ওপর। ফোঁপাচ্ছে।

একটু পর ফোঁপানি থেমে গেল শ্যারনের। ছেলেটা চার হাত-পায়ে কুকুরের মত এগিয়ে গেল ওর দিকে। নড়ে উঠল শ্যারন, মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল কে আসছে। কিন্তু বেশিক্ষণ মাথা তুলে রাখতে পারল না, ধপ্ করে পড়ে গেল। কাউকে দেখতে পায়নি সে। ওকে নড়তে দেখে ছেলেটা ঝোপের আড়ালে চলে গেছে। ওখানেই উবু হয়ে বসে থাকল সে সকাল পর্যন্ত। ভোরের দিকে নড়াচড়া সম্পূর্ণ থেমে গেল শ্যারনের, এবার ছেলেটা এগোল তার দিকে।

.

দুঃস্বপ্ন দেখছে শ্যারন। তার স্বপ্নে ভিড় করে এল শেয়াল, হায়েনা, শকুন আর হরর ছবির বিকট জিন্দালাশের দল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ওর। উপুড় হয়ে পড়ে আছে শ্যারন। লালা শুকিয়ে আছে মাটিতে। যন্ত্রণায় মাটি খামছে ধরায় উঠে গেছে হাতের চামড়া। জ্বালা করছে। তবে পায়ে কোন সাড়া পাচ্ছে না। মাথা তুলতেই পা-টা নাড়া খেল, আগুন ধরে গেল শরীরে। এবার ছেলেটাকে দেখতে পেল শ্যারন। ন্যাংটো। চার হাত-পায়ে ভর করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। হাসার চেষ্টা করল শ্যারন, কথা বলতে চাইল, আওয়াজ বেরুল না গলা থেকে। এটাকেও দুঃস্বপ্নের একটা অংশ মনে হলো। ছেলেটা তাকিয়ে আছে ওর চোখে চোখ রেখে। হলুদ চোখ। ওর নিশ্বাসে দুর্গন্ধ, কুকুরটার মত। শ্যারনের ওপর শুয়ে পড়ল ছেলেটা। গুঙিয়ে উঠল শ্যারন। বুঝতে পারছে না ছেলেটার মতলব। হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে তীক্ষ্ণ ছুঁচ ফুটল, কামড় দিয়েছে ছেলেটা। মুখ হাঁ করল শ্যারন, চিৎকার দেবে, শেষ মুহূর্তে পরিতৃপ্তিসূচক ঘোঁৎ ঘোঁৎ একটা শব্দ শুনতে পেল। তারপর একটানে শ্যারনের সার্ভিকাল নার্ভ ছিঁড়ে ফেলল ছেলেটা দাঁত দিয়ে। ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল শ্যারনের চোখে।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৬

ছয়

শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের ড্যাগার বিষয়ক লেখাটি ছাপা হলো পত্রিকায়। এর দিন কয়েক পরে, শিকাগোর এক বাড়িতে, লেখাটা পড়ার সময় কফির কাপ হাত থেকে পড়ে গেল এক বুড়োর।

দ্রুত পড়া শেষ করল সে, তারপর তার প্রীস্টকে ফোন করল। নিজের স্টাডিরুমে ঢুকল বুড়ো, বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ পর উত্তেজিত বৃদ্ধ লন্ডনে, ফ্লিট স্ট্রীটের নাম্বারে ফোন করল।

‘আমার নাম নিকোলাস ওয়াল্টার,’ বলল সে। শিকাগো থেকে বলছি। আপনাদের এক সাংবাদিক, শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’

‘দুঃখিত,’ ভেসে এল একটি পুরুষ কণ্ঠ। ‘মিস ফেয়ারচাইল্ড এক হপ্তা ধরে নিখোঁজ। তাকে খুঁজছেন কেন জানতে পারি?’

নিকোলাস ওয়াল্টার কথা বলছে, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। উঁকি দিলেন ছোটখাট, রোগা একজন মানুষ। পরনে ধূসর কোট। ওয়াল্টার লোকটিকে ইশারা করলেন ভেতরে আসতে। ফোনের আলাপ সেরে ঘুরল সে, হাত মেলাল প্রীস্টের সাথে। পত্রিকাটি দিয়ে ইঙ্গিত করল শ্যারনের লেখাটি পড়তে।

প্রীস্ট ধীরে ধীরে পড়লেন। ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত, না?’ মন্তব্য করলেন তিনি পড়া শেষে।

‘খুব,’ বলল ওয়াল্টার।

এরপর দু’জনে মিলে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ চলল। ওয়াল্টার বলল কিভাবে এক নিলামে সে ড্যাগারগুলো পেয়েছিল আর প্রীস্ট সেগুলো নিয়ে ইটালিতে, সুবিয়াকোর এক মনাস্টেরিতে গিয়েছিলেন।

‘ব্যাপারটা যদি আগে জানতাম,’ বললেন প্রীস্ট। ‘তাহলে যেখানের জিনিস সেখানে ফেলে রাখলেই ভাল হত।’

‘ভেবে দেখুন,’ বলল ওয়াল্টার। ‘ইটালিয়ান লোকটা কিন্তু একবারও বলেনি সে ওগুলো দিয়ে কি করতে যাচ্ছে।’

‘কেউ বলেনি।’ এদিক-ওদিক

মাথা নাড়ছে নিকোলাস ওয়াল্টার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে। পত্রিকায় কয়েকজন লোকের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ওদের মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে ওয়াল্টারের।

‘ডি কার্লো বেঁচে আছে কিনা জানেন?’

কাঁধ ঝাঁকালেন প্রীস্ট। ‘জানি না। তবে মনাস্টেরিতে ফোন করে দেখতে পারেন।’

‘যদি বেঁচে থাকে, যাবেন আমার সাথে ওকে দেখতে?’

‘কেন? তাতে লাভ কি?

‘আমার কৌতূহলের নিরসন হবে।’

মাথা নাড়লেন প্রীস্ট। ‘আমার অত কৌতূহল নেই। তাছাড়া, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।’

‘তবে আমি যাব,’ বলল ওয়াল্টার। ‘আমার হাতে অঢেল সময়। আর রোমের মত জায়গায় ছুটি কাটানোর জন্যে এটা হলো সবচে’ উপযুক্ত সময়।’

নিকোলাস ওয়াল্টার তার ষাট বছরের জীবনে নিজের শহর ছেড়ে খুব কমই বাইরে গেছে। সারাটা জীবন সে কাটিয়ে দিয়েছে বইপত্রের মাঝে, প্রাচীন ইতিহাস আর বাইবেল পড়ে। বাইবেলের বিষয়ে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যায়। সে পণ্ডিত মানুষ, সন্দেহ নেই। তবে আধুনিক জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা সামান্যই।

প্লেন ভ্রমণটা উপভোগ করল নিকোলাস ওয়াল্টার। নিজেকে বেশ সজীব আর তরুণ লাগছে। মদ পান না করার বহুদিনের অভ্যাস সে ভেঙে ফেলল স্টুয়ার্ডেসের কাছ থেকে ককটেলের গ্লাস নিয়ে।

রোমে পৌঁছে সময় নষ্ট করল না ওয়াল্টার। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা পুবে, সুবিয়াকোর উদ্দেশে ছুটল। শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার অনেক সময় পাবে সে। আগে ফাদার ডি কার্লোর সাথে দেখা করা দরকার। ম্যাপে রাস্তা দেখে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডি কার্লোর মঠে পৌঁছে গেল ওয়াল্টার।

ওটাকে মঠ না বলে মঠের ধ্বংসাবশেষ বললেই মানায়। পাহাড়ের ওপর, কালো পাথরে তৈরি জরাজীর্ণ একটা দালান। সন্ধ্যা নেমেছে। অথচ দালানের কোথাও আলো জ্বলছে না। জানালা-টানালাও চোখে পড়ল না। গা-টা হঠাৎ শিরশির করে উঠল ওয়াল্টারের।

গাড়ি থামাল সে, বন্ধ করল ইঞ্জিন। চারপাশ আশ্চর্য নীরব। খোয়া ওঠা রাস্তা ধরে ভারী ওক কাঠের দরজাটার দিকে এগোল ওয়াল্টার, নীরব প্রার্থনার ভঙ্গিতে ঠোঁট নড়ছে। যে লোক তার জীবন কাটিয়েছে লাইব্রেরীর চৌহদ্দিতে, সে আজ শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসকে দেখছে চোখের সামনে। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন মনে হতে লাগল ওয়াল্টারের।

পাথরের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল সে, কানে ভেসে এল নীচু গলার প্রার্থনা সঙ্গীত। লোহার ভারী কড়া ধরে নাড়া দিল। শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলল দালানে, তবে প্রার্থনাকারীদের মনোযোগ নষ্ট হলো না তাতে। এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর খুলে গেল দরজা। এক সন্ন্যাসী, আলখেল্লায় মুখটা প্রায় ঢাকা, নীরবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নিজের পরিচয় দিল ওয়াল্টার, সন্ন্যাসী সরে দাঁড়াল ওকে ভেতরে আসতে দেয়ার জন্যে।

‘আপনি এসেছেন, আমরা খুশি হয়েছি,’ পরিষ্কার ইংরেজীতে বলল সন্ন্যাসী। ‘আশা করি আপনাদের বিরক্ত করছি না।’

‘ফাদার ডি কার্লো আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আজকাল কেউ আসে না তাঁকে দেখতে।’

‘কেমন আছেন উনি?’

‘তাঁর অন্তর বড়ই বিক্ষিপ্ত।’

ওয়াল্টার সন্ন্যাসীর পিছু পিছু একটা প্যাসেজ ধরে এগোল, তারপর ঢুকল একটা সরু করিডরে। জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, বাতাসে নোনা গন্ধ। আবার শিউরে উঠল ওয়াল্টার।

একটা দরজার সামনে দাঁড়াল সন্ন্যাসী, টোকা দিল, তারপর ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল। ছোট একটা ঘরে ঢুকল ওয়াল্টার, দেখল সরু একটি চৌকিতে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। ফাদার ডুলান বলেছিলেন ডি কার্লো লম্বা-চওড়া মানুষ, প্রকাণ্ড মুখ, চওড়া চোয়াল, ঈগলের মত নাক। বয়সের কারণে ডি কার্লোর চেহারায় পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এ কি দশা হয়েছে মানুষটার? খুলির চারপাশে কুঁচকে আছে চামড়া, নড়া-চড়া অত্যন্ত ধীর। বিছানা থেকে উঠে বসার সময় যন্ত্রণার ছাপ ফুটল চেহারায়।

‘আমি জানতাম না আপনি অসুস্থ-’ ইতস্তত করে বলল ওয়াল্টার।

‘আমি ভালই আছি,’ জবাব দিলেন ডি কার্লো। ‘পৃথিবীটাই বরং অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’

 

 

‘তা ঠিক,’ সায় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল ওয়াল্টার, তরুণ-সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সে একটা চেয়ার নিয়ে এসেছে। চেয়ারের এক কোনায় বসল ওয়াল্টার, পকেটে হাত ঢোকাল শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের লেখাটা বের করার জন্যে।

‘আমার চিঠি পেয়েছেন?’

মাথা দোলালেন প্রীস্ট। ‘ড্যাগারগুলো যখন পেলেন, জানতেন ওগুলোর গুরুত্বের কথা?’

‘শুধু জানতাম ওগুলো প্রাচীন নগরী মেগিড্ডোতে পাওয়া ছুরির মত দেখতে। মেগিড্ডোর ড্যাগারের ছবি দেখেছি।’

‘ওগুলো মেগিড্ডোর ছুরিই। জেরুজালেমের কাছে, মাটির নিচের একটা শহর ছিল ওটা। এক সময় বলা হত আরমাগেড্ডন।’

‘শয়তানের আত্মা তাড়ানোর কাজে ছুরিগুলো ব্যবহার করা হত বলে শুনেছি, ‘ বলল ওয়াল্টার।

হাসলেন ডি কার্লো। না। ওগুলোর কার্যকারিতা আরও বেশি।’

ওয়াল্টার পত্রিকাটি বাড়িয়ে দিল ফাদারের দিকে। ‘আমি ছুরিগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এ লেখাটা পড়ার পর আবার মনে পড়ে গেল।

ডি কার্লো ভুরু কুঁচকে তাকালেন লেখাটার দিকে, তারপর পড়তে লাগলেন। তাঁর চোখ ভরে গেল পানিতে। জামার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছে তাকালেন ওয়াল্টারের দিকে।

‘আমি এখন যে কথাগুলো বলব আপনি চুপচাপ শুনে যাবেন। আর কথার মধ্যে কোন প্রশ্ন করবেন না।’

রাজি হলো ওয়াল্টার। নড়েচড়ে বসল। প্রীস্ট ধীরে ধীরে তাঁর গল্প বলে গেলেন।

বললেন সেই ঘরের কথা, যেখানে শিক্ষানবিস হিসেবে স্পিলেট্টো নামের এক প্রীস্টের মৃত্যুর সময় স্বীকারোক্তিতে তিনি হাজির ছিলেন। ওই প্রীস্ট ছিলেন শয়তানের শিষ্য, এক পৈশাচিক জন্মগ্রহণে তিনি সাহায্য করেছিলেন। শয়তানের সাথে শেয়ালের মিলনে জন্ম নিয়েছিল এক প্রাণী।

ওয়াল্টার চোখ পিটপিট করল তবে কোন মন্তব্য করল না।

প্রাণীটাকে মানব শিশুর মত চেহারা দেয়া হয়। মার্কিন সিনেটর রবার্ট থর্ন এবং তার স্ত্রী ক্যাথেরিনের সদ্যেজাত সন্তানকে মেরে তার জায়গায় ওই প্রাণীটাকে বিকল্প হিসেবে হাজির করা হয়। স্পিলেট্টো রবার্টকে বুঝিয়েছিলেন তাঁর বাচ্চা মরে গেছে, আর ঈশ্বরের ইচ্ছায় এতিম একটি শিশুকে তিনি পেতে যাচ্ছেন নিজের সন্তানের মত। ক্যাথেরিন থর্নের এর আগে কয়েকবার গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে। মা হবার ওটাই ছিল তার শেষ সুযোগ। রবার্ট থর্ন রাজি হয়। বিকল্প শিশুটিকে নিজেদের সন্তান বলে স্ত্রীকে জানায় রবার্ট। শিশুটির নাম রাখে ডেমিয়েন।

‘শিশুটি ছিল ধ্বংসের প্রতীক,’ বললেন ডি কার্লো।

‘রবার্ট থর্ন শেষ মুহূর্তে সত্য উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি মেগিড্ডো চলে যান। তাঁকে সাতটি ড্যাগার দেয়া হয়। কিন্তু শয়তান পুত্রকে হত্যা করার আগে নিজেই খুন হয়ে যান।

চোখ ঘষল ওয়াল্টার, ডি কার্লো সন্ন্যাসীকে ইঙ্গিত করলেন ওকে এক গ্লাস পানি দিতে। তারপর আবার গল্প শুরু হলো। বললেন ডেমিয়েন থর্ন কিভাবে থর্ন কর্পোরেশনের প্রধান ব্যক্তিতে পরিণত হলো। থর্ন কর্পোরেশন এমন এক কোম্পানি যারা বিশ্বের বেশিরভাগ জনগণকে খাদ্য যুগিয়ে চলছে। বললেন কিভাবে ডেমিয়েনের শিষ্য তৈরি হতে লাগল, সেই সাথে বেড়ে চলল তার শক্তি এবং প্রভাব…

‘তারপর, আমার প্রার্থনার জবাব পেলাম,’ বলে চললেন ডি কার্লো। ‘আপনি ড্যাগারগুলোর খোঁজ পেলেন। আপনার প্রীস্ট ওগুলো আমার কাছে নিয়ে এলেন। এ ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছে। ঈশ্বরের অনুষঙ্গ হিসেবে আপনি কাজ করেছেন।

পানি পান করছিল ওয়াল্টার, বিষম খেল। তবে কিছু বলল না।

‘আমার ছয় ভাইকে নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলাম ডেমিয়েন থর্নকে ধ্বংস করতে।’ কটের নিচ দিয়ে একটা ড্যাগার বের করলেন তিনি। নিজের অজান্তে চেয়ারের সাথে সেঁটে গেল ওয়াল্টার। ঝলমল করছে ইস্পাত, ড্যাগারের বাঁটে অসম্ভব সুন্দর শিল্পকর্ম। এটা সেই ড্যাগার। এই পাগল সন্ন্যাসী যা বলছে তাহলে কি তা সব সত্যি? ভাবল সে।

‘আপনি একজন প্রীস্ট হয়ে মানুষ খুন করতে যাচ্ছিলেন?’ অবিশ্বাস ওয়াল্টারের কণ্ঠে।

‘সে মানুষ, ছিল না,’ স্বাভাবিক গলায় বললেন ডি কার্লো। সে ছিল অ্যান্টিক্রাইস্ট-যীশুর শত্রু।’

মুচকি হাসল ওয়াল্টার। ডি কার্লো ওর মুখের সামনে ড্যাগারটা তুলে ধরলেন। ‘জানি, ব্যাপারটা মেনে নিতে আপনার মন সায় দিচ্ছে না,’ বললেন তিনি। ‘যদিও আপনি একজন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। রবার্ট থর্নও মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। কেট রেনল্ডস নামে একটি মেয়েও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চায়নি। পরে সে-ই এই ড্যাগার ডেমিয়েন থর্নের পিঠে ঢুকিয়ে দেয়।’ ড্যাগারটা ফেলে দিলেন ওয়াল্টারের কোলে। সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল যীশুর মুখের দিকে।

‘ভেবেছিলাম আমরা সফল হয়েছি, তাকে ধ্বংস করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল ভুল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডি কার্লো, শুয়ে পড়লেন কটে।

ওয়াল্টার ফলায় আঙুল ছোঁয়াল। ইচ্ছে করছে চলে যায়। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছে না।

‘বুক অভ রেভেলেশনের কথা তো জানেনই,’ বললেন প্রীস্ট।

মাথা ঝাঁকাল ওয়াল্টার।

‘ওখানে এক জায়গায় আছে,’ বললেন ডি কার্লো। ‘ “এবং ওটা তাহাকে দেয়া হইল সন্ন্যাসীদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্যে, জেতার জন্যে। এবং শক্তি দেয়া হইল তাকে, তাহার সকল আত্মীয়স্বজন, এবং জিভ এবং জাতিকে।” বিরতি দিলেন প্রীস্ট। “শক্তি দেওয়া হইল তাকে।’” পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। ‘আর পৃথিবীতে থর্ন কর্পোরেশনের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই।’

ওয়াল্টার বলল, ‘বাইবেলকে আপনি যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করতে পারেন।’

‘অ্যান্টিক্রাইস্টের শিষ্যরাও নিজেদের মত ব্যাখ্যা দিয়েছে,’ বললেন ডি কার্লো। ‘ট্যাসোন নামে এক লোক ছিল। পৈশাচিক জন্মে সে সাহায্য করেছিল। পরে অনুতপ্ত হয়ে সে রবার্ট থর্নের কাছে যায়। বলে শয়তানকে ধ্বংস করার সময় উপস্থিত।’ বিরতি দিলেন তিনি। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘বাইবেলের ব্যাখ্যা সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত আছেন আপনি। জানেন, শেষের সেদিনে যীশু আবার জন্ম নেবেন এবং মুখোমুখি হবেন অ্যান্টিক্রাইস্টের। আর আরমাগেড্ডনের লড়াই হবে ইসরাইলে।’

জবাবে মাথা দোলাল ওয়াল্টার।

‘তিনি আবার জেগে উঠেছেন। আমি তাঁকে দেখেছি।’

ওয়াল্টার কপাল চেপে ধরল হাত দিয়ে। উঠে পড়বে কিনা ভাবছে, কিন্তু বসে রইল মন্ত্রমুগ্ধের মত। ‘থর্ন তার শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিল যীশুর পুনর্জন্মের দিন যে সব পুরুষ শিশু জন্মগ্রহণ করবে তাদের সবাইকে মেরে ফেলতে। শতশত শিশু হত্যা করা হয়। কিন্তু শিশু যীশুর কোন ক্ষতি হয়নি।’

চোখ ঘষছে ওয়াল্টার, প্রীস্ট ওর গায়ে হাত রাখলেন। ‘বুঝতে পারছি,’ বললেন তিনি। ‘এ ব্যাপারগুলো হজম করা কঠিন, বিশেষ করে আপনার মত মানুষের জন্যে যাঁর সারাদিন কেটে যায় লাইব্রেরীতে। তবু অনুরোধ, আমার কথা শুনে যান।’

বিছানার পাশে একটা শেলফ, ওখান থেকে দুটো খাম বের করলেন ডি কার্লো, একটা দিলেন ওয়াল্টারের হাতে।

‘এই চিঠিখানা আগে পড়ন। অসুস্থ অবস্থায় এক সাহসী মহিলা লিখেছে ওটা। পড়ন এবং কথাগুলো বিশ্বাস করুন।’

প্রেরকের ঠিকানা উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের। ওয়াল্টার চিঠির শেষ পাতা উল্টে সই দেখল। নামটা অচেনা।

‘পড়ুন,’ নির্দেশের মত শোনাল ডি কার্লোর কণ্ঠ।

পড়তে শুরু করল নিকোলাস ওয়াল্টার:

আগামী হপ্তায়, ফাদার, আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে পেটের একটা অপারেশনের জন্যে। আমাকে বলা হয়েছে সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং যন্ত্রণাদায়ক হবে। তবে কথাটা বিশ্বাস করিনি আমি। মনে হয় না আমি আর বাঁচব। আমাকে তো আপনি চেনেনই, ফাদার। ভয়ঙ্কর ঘটনাটাও একমাত্র আপনিই জানেন। তাই আপনাকে বিশ্বাস করে লিখছি।

আপনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করার কয়েক হপ্তা পর যন্ত্রণাটা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে ব্যাপারটাকে পাত্তা দিইনি। তারপর লক্ষ করলাম পেটটা ফুলতে শুরু করেছে। আমার ডাক্তার আমাকে এক স্পেশালিস্টের কাছে পাঠালেন। তিনি ফোলাটা বাড়ার সাথে নিয়মিত নানা পরীক্ষা করে যেতে লাগলেন। ‘ক্যান্সার’ শব্দটা তিনি উচ্চারণ করেননি T এখনও শব্দটা আমাদের কাছে অচ্ছুৎ কিনা। তিনি শুধু মাঝে মাঝে ‘ফোলা’ নিয়ে কথা বলতেন আর এক্স-রে রিপোর্ট দেখাতেন।

তবে ‘ফোলা’টা যে টিউমার নয় সে আমি জানি। আর এক্স-রেগুলো যে অন্য লোকের তাতেও আমার সন্দেহ নেই। ফাদার, কি বলব, হারামজাদা ফোলাটা আমাকে লাথি মারে। এটা যদি দুঃস্বপ্ন হয় তাহলে বলব আমি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছি।

আমি জানি না ক্লিনিক থেকে বেরুতে পারব কিনা। যদি না পারি তাই আগেভাগে চিঠিটা লিখে রাখলাম। ধরে নিন এটা আমার স্বীকারোক্তির বিকল্প। তবে আমার মৃত্যুর আগে এ লেখা পড়তে পারবেন না।

আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই, তাই ডেমিয়েন সম্পর্কে আপনার তথাকথিত প্রমাণ আমাকে বিচলিত করতে পারেনি। ব্যাপারটা এখনও মেনে নিতে পারিনি আমি। ডেমিয়েন আমার কাছে আমার সন্তানের হত্যাকারী ছাড়া কিছু নয়। ও আমার ছেলে পিটারকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাই ওকেও আমি খুন করেছি। পিটারের পিঠে বেঁধা ছুরিটা হ্যাঁচকা টানে বের করার সেই অশ্লীল শব্দটা এখনও আমার কানে বাজে। দেখতে পাই ডেমিয়েনের শিরদাঁড়ায় ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার সেই দৃশ্যও।

ডেমিয়েন আপনার কাছে অ্যান্টিক্রাইস্ট। আমার কাছে আকর্ষণীয় একজন পুরুষ, যার শরীরে ছিল এক অদ্ভুত জন্মদাগ-এর বেশি কিছু নয়।

যাহোক, মাঝে মাঝে রাতের বেলা যখন ওসব কথা মনে পড়ে যায় সেই সময় আমার শরীরের ভেতরে এই শয়তানটা আমাকে…থাক, এ নিয়ে আর কথা বাড়াব না। আমাকে আর ক’দিনের মধ্যে ক্লিনিকে যেতে হবে। আমার জন্যে প্রার্থনা করবেন, ফাদার। আপনার প্রার্থনায় আমার কোন ক্ষতি হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।’

পড়া শেষ করল ওয়াল্টার। মাথা নেড়ে বলল, ‘বেচারী। ক্যান্সারের প্রতিষেধক কি কোনদিন তৈরি হবে না?’

‘ওটা ক্যান্সার ছিল না।’

ওয়াল্টার বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল প্রীস্টের দিকে।

‘মেয়েটা ছিল ডেমিয়েন থর্নের শেষ শিকার। আমার ধারণা, সে ডেমিয়েনের সন্তানের জন্ম দিয়েছে।’ দ্বিতীয় চিঠিটা ওয়াল্টারকে দিলেন ডি কার্লো।

কোন কথা না বলে চিঠি পড়তে লাগল ওয়াল্টার: ‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’

পড়া শেষ হলে ডি কার্লোর দিকে আবার তাকাল সে। চেহারা থেকে সমস্ত রং মুছে গেছে।

‘এ অবিশ্বাস্য,’ বলল ওয়াল্টার।

‘মহিলা মিথ্যা বলবে কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ডি কার্লো।

‘এ পাগলের প্রলাপ।

‘ভুল। মহিলা এক বর্ণ মিথ্যা কথা লেখেনি।’

ওয়াল্টার কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন ডি কার্লো। ‘সেই ভয়ঙ্কর রাতে আমি আর কেট রেনল্ডস তার সন্তানকে কবর দিই। ডেমিয়েনের লাশ ফেলে চলে আসি। ড্যাগারটা নিয়ে এসেছিলাম সাথে। স্বপ্ন দেখেছিলাম নতুন প্রভাতের। কিন্তু ভুল স্বপ্ন দেখেছিলাম। শয়তানের শিষ্যরা ডেমিয়েনের লাশ খুঁজে বের করে। রটিয়ে দেয় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে। ওদের নিজেদের ডাক্তারের এ ব্যাপারে সায় ছিল। শিকাগোতে, ওদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় লাশ।’

‘জানি,’ বলল ওয়াল্টার। ‘টিভিতে দেখেছি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন ডি কার্লো। ‘আমরা শুধু অ্যান্টিক্রাইস্টের শরীরটাই ধ্বংস করতে পেরেছি। তার আত্মা বা শক্তির কোন ক্ষতি হয়নি, তার ছেলে হয়ে উঠেছে আরেক ডেমিয়েন।’ চোখ বুজলেন তিনি, ফিসফিসে শোনাল কণ্ঠ। ‘আমি ব্যর্থ হয়েছি, আমার ভাইদের মৃত্যু বিফলে গেছে। গত মাসে এই চিঠি পাবার পর নতুন করে ব্যাপারটা উপলব্ধি করে ভীষণ হতাশ হয়ে উঠি। বুঝতে পারি আমাদের গলদ কোথায় ছিল। অজ্ঞতাই আমাদের ডুবিয়েছে।’

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ওয়াল্টার, হাঁটু কাঁপছে, মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে হঠাৎই যেন খুব বুড়িয়ে গেছে সে।

চোখ মেললেন ডি কার্লো। ‘আপনাকে যা বললাম সব লিখে রেখেছি। আমার নোট আর চিঠিগুলো নিয়ে যান। লন্ডনে গিয়ে আমেরিকান অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করুন। উনি আপনাকে সাহায্য করবেন।’

‘কেন?’ জিজ্ঞেস করল ওয়াল্টার। ‘তিনি সাহায্য করবেন কেন?’

‘তিনি সৎ মানুষ। তাঁর ক্ষমতা এবং প্রভাব আছে। উনি যা করতে পারবেন আপনার পক্ষে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাছাড়া রাষ্ট্রদূতের বয়স কম। আমরা তো বুড়িয়ে গেছি। ইচ্ছে থাকলেও আর…’ হাসলেন ডি কার্লো, হঠাৎ উঠে বসলেন, টেনে নিলেন বাইবেল।

‘আমাকে কথা দিন,’ বললেন তিনি।

ওয়াল্টার কথা বলার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু কোন শব্দ বেরুল না। ডি কার্লো ওয় হাতটা ধরে বাইবেলের ওপর রাখলেন।

‘ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে কথা দিন।’

মাথা দোলাল ওয়াল্টার। ‘কথা দিলাম।‘

‘তাহলে আসুন প্রার্থনা করি।’

দু’জনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করলেন। ল্যাটিন ভাষায় প্রার্থনা করলেন ডি কার্লো। তারপর সিধে হলেন। ওয়াল্টারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘অ্যামবাসাডরের পিছু ছাড়বেন না। উনি প্রস্তুত হলে ড্যাগারটা পাঠিয়ে দেব।’ হাসি ফুটল তাঁর মুখে। ‘পুনর্জন্ম নেয়া যীশু আপনাকে পথ দেখাবেন। তাঁকে বিশ্বাস করুন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন। পৃথিবীতে আবার আগমন ঘটেছে তাঁর। আমি জানি। আমি তাঁকে দেখেছি।’

ওয়াল্টার নোট আর চিঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর শরীর কাঁপছে। মঠ থেকে দূরে সরে আসার পর কাঁপুনিটা থেমে গেল আর সেই সাথে মনের ভেতর জেগে উঠল রাজ্যের সন্দেহ।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৭

সাত

রোম থেকে আসা একটা ফোনের অনুরোধে কাজটা করতে রাজি হয়েছেন ফাদার টমাস ডুলান। তবে খচখচ করছে মন। এ এক ধরনের অপবিত্র কর্ম, আইন-বিরোধী। কিন্তু ওয়াল্টার তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুই শুধু নয়, চার্চের প্রতি নিবেদিত প্রাণও বটে।

ওয়াল্টার একটা নাম্বার দিয়েছে। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলেন ডুলান। ফাদারের কণ্ঠ শুনে অপর পক্ষ সানন্দে তাঁকে সাহায্য করার কথা বলল। ঘণ্টাখানেক লাগল তাঁর ঠিকানা খুঁজে, মেশিন জোগাড় করে নর্থ সাইডের কবরখানায় ফিরে আসতে। ট্যাক্সিঅলা ভাড়া নিয়ে বিদায় হলো, ডুলান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াল্টারের বন্ধুর দেয়া মেশিনটার প্রতি মনোযোগ দিলেন। বড় একটা চামচের মত যন্ত্রটা, তিন ফুট লম্বা একটা শ্যাফট, হাতলে ডায়াল সহ রঙিন টিভি পর্দাও আছে। ওয়াল্টারের বন্ধু গর্ব করে বলেছে এরচে’ কার্যকরী এবং সর্বাধুনিক টেকনোলজির জিনিস আর নেই। জুলজিস্ট এবং অ্যামেচার প্রসপেক্টরদের জন্যে অপরিহার্য যন্ত্র এটা।

ছয় ফুটে ডায়াল অ্যাডজাস্ট করে সুইচ অন করলেন ফাদার। মৃদু গুঞ্জন তুলল মেশিন। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। তারাজ্বলা নির্মেঘ আকাশ।

সুইচ অফ করে দিলেন ফাদার। গোরস্থানের গেট ঠেলে ঢুকলেন ভেতরে। যন্ত্রটাকে সামনে ধরে রেখেছেন ঘাস কাটা নিড়ানির মত। গোরস্থানটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ধনী মানুষদের এখানে কবর দেয়া হয়।

থর্ন সমাধিটি লেকের পাশে। গ্রানিট পাথরের তৈরি গোল একটা বিল্ডিং, চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। ডাবল ওকের ভেজানো দরজা, ডুলান ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

ঘরটা গোলাকার, কতগুলো পাথরের ফলক বা ট্যাবলেট দাঁড় করানো, দেয়ালের গায়ের চোর-কুঠুরিতে একটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে।

ঘরের চারপাশ ঘুরে দেখলেন ফাদার, পাথুরে ফলকে লেখা থর্ন পরিবারের চার জেনারেশনের বংশ লতিকা পড়লেন। সবচে’ বড় ট্যাবলেটটি স্মারক-ফলক।

‘রবার্ট এবং ক্যাথেরিন থর্নের স্মৃতির উদ্দেশে,’ পড়লেন তিনি। ‘এক সাথে তাঁরা শুয়ে আছেন নিউ ইয়র্ক নগরীতে। এবং রিচার্ড ও অ্যান থর্নের স্মৃতির প্রতিও। তাঁদের আত্মা শান্তিতে ঘুমাক।’

কয়েক পা পিছিয়ে এলেন ডুলান, ঘুরলেন, তাকালেন বড় একটা মার্বেল স্ল্যাবের দিকে। ঘরের মাঝখানে ওটা। স্ল্যাবের মাথায় লেখা:

ডেমিয়েন থর্ন
১৯৫০-১৯৮২

কোন এপিটাফ লেখা নেই, শুধুই নাম। মৃত্যুর পরেও যেন জায়গাটাতে ডেমিয়েনের কর্তৃত্বের ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা মনে পড়ে গেল ডুলানের। টিভিতে দেখেছেন অনুষ্ঠানটি। এখনও চোখে ভাসে। কফিন বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সমাধির দিকে, তারপর বন্ধ হয়ে যায় দরজা। তখনও সংবাদ ভাষ্যকার বলে চলছিল ডেমিয়েনের করুণ মৃত্যুর কথা।

ডুলান মেশিনের সুইচ অন করলেন, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঢেউ নিচে নেমে গেল শিরশিরে অনুভূতি তুলে। এই জীবনে বহু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজির থেকেছেন তিনি, বহু লোককে নিজের হাতে কবর দিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁর মনে হচ্ছে কবরটা ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল, লাশটা শান্তিতে থাকুক। অথচ মনের অজান্তেই হাতল চেপে ধরে রেখেছেন তিনি, কাজ শুরু করে দিয়েছে মেশিন। কাজটা করতে বেশি সময় লাগবে না, তারপর চলে যাবেন, বললেন তিনি মনে মনে।

পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন ফাদার। বাদামী মাটি দেখা যাচ্ছে। ডায়াল পাঁচ ফুটে অ্যাডজাস্ট করতে দৃশ্যটা পরিষ্কার হয়ে ফুটল। কাদা মাটির এক্স-রে বলা যায় ওটাকে। চকোলেট বারের মত দেখতে।

স্ল্যাবের দিকে এগোলেন ডুলান, কবরের পাশে দাঁড়ালেন। লাশের প্রস্তরখচিত নামের ওপর পা রেখে। আবার চোখ ফেরালেন পর্দায়। মাটির চেহারা বদলে গেছে। মাটির সাথে এবার নুড়ি উঠছে। যন্ত্রটা দুই হাঁটুর মাঝখানে রেখে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলেন। শর্ট রেঞ্জের ফোকাস করছেন। তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল পর্দায় কফিনের মেহগনি কাঠের ঢাকনা দেখে। অজান্তে হাত উঠে এল বুকে, ক্রুশ আঁকলেন। ডুলান শুনেছেন মৃত্যুর পরেও লাশের চুল আর নখ বাড়তে থাকে। যদি দেখেন মুখ ভর্তি দাড়ি আর হাতে মস্ত বাঁকানো নখ নিয়ে লাশটা তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে! তখন?

চোখ বুজে ফেললেন ডুলান, ভয়ে ভয়ে ডায়ালের দিকে হাত বাড়ালেন। জোর করে আবার চোখ মেললেন। পর্দায় পাথরের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর। ডায়াল নিয়ে নড়াচড়া শুরু করলেন: দু’ইঞ্চি ওপরে, আরও পাথর; চার ইঞ্চি নিচে, কফিনের মেঝে দেখা গেল; আট ইঞ্চি ওপরে, পর্দা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল, তারপর দুটো শব্দ ঝলসে উঠল ওখানে: AIR VENT.

দ্রুত নড়ে উঠলেন ডুলান, স্ল্যাবের চারপাশে বারবার স্ক্যানার ঘুরিয়ে দেখলেন। কিন্তু পাথর ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। ডেমিয়েন থর্নের কবর সম্পূর্ণ খালি। মেশিন বন্ধ করে দিলেন ঝট্ করে, হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলেন পাথরে খোদাই করা নামের দিকে। ডানে-বামে মাথা নাড়তে নাড়তে সরে এলেন স্ল্যাবের সামনে থেকে।

‘আমার এখন দরকার, জোরে জোরে বললেন তিনি, ‘বড়সড় একটা ড্রিঙ্ক।’

 

 

.

সমাধি থেকে অনেক দূরে, পুবে, ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে চ্যাপেলে, বাবার হাত মুঠো করে ধরে রেখেছে, নীরবে ঠোঁট নড়ছে তার; কপাল থেকে ঘাম বেয়ে নামছে, ঢুকে যাচ্ছে চোখে, ঘাম পড়ছে হাতে, ডেমিয়েন থর্নের হাত ভিজে গেল। ছেলেটার চেহারা কুঁচকে আছে মনোসংযোগের ভঙ্গিতে, কপালে শিরা ফুটে উঠেছে টানটান তারের মত, ওদিকে পেরিফোর্ডের জঙ্গলে প্রকাণ্ডদেহী কুকুরটা মুখ তুলে চাইল পশ্চিম আকাশের দিকে, তারপর ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল…

.

নর্থ শিকাগো সেমিট্রি’র কাছের একটা বার, লিন্ডসে’তে ঢুকলেন ফাদার টমাস ডুলান। ঢকঢক করে মদ গিললেন। বারটেন্ডার তাঁকে দেখল বার দুই ফোন বুদে ঢুকতে। দুইবারই হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন। রোমে খবরটা পৌঁছুনো খুব জরুরী। কিন্তু লাইন পাচ্ছে না অপারেটর। তিন বারের বার লাইন পাওয়া গেল। কিন্তু অপারেটর জানাল অপর পক্ষ ফোন ধরছে না। টেনশনে ফাদারের হার্টবিট বেড়ে গেল। অবশেষে ফোন ধরল ওয়াল্টার। ডুলান তাকে ঘটনাটা বললেন। ধন্যবাদ দিল ওয়াল্টার। কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল ঘটনা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।

ফাদারের দায়িত্ব শেষ। এবার তিনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরতে পারবেন।

রাস্তায় নামার সাথে সাথে বাতাসের ঝাপটা খেলেন ডুলান। আবহাওয়া বদলে গেছে। লেকের পানিতে ঢেউ উঠছে, পুবের আকাশে জমতে শুরু করেছে মেঘ। ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে যাচ্ছে চাঁদের দিকে। গোরস্থানের গেট খুললেন ডুলান। বারটেন্ডার বলেছে কাছের ক্যাব স্ট্যান্ডে যাবার এদিক দিয়ে শর্টকাট রাস্তা আছে। ইন্ডিয়ানদের রাইফেল ধরার মত মেশিনটা বুকের সাথে চেপে হোঁচট খেতে খেতে এগোলেন ফাদার। বেশি মদ খাওয়া হয়ে গেছে, ভাবছেন তিনি। মাথা ঝিমঝিম করছে। থুথু আসছে। মদ পানে অভ্যস্ত নন ডুলান।

থর্ন সমাধির দিকে এক নজর তাকালেন ফাদার। মনে হলো কিছু একটা নড়াচড়া করছে ওখানে, হলুদ দুটো বিন্দুও যেন দেখতে পেলেন এক মুহূর্তের জন্যে। গা শিরশির করে উঠল তাঁর, দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। বাতাসের বেগ বেড়েছে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু ঠিকমত হাঁটতে পারছেন না। টলছেন। হঠাৎ একটা পাথুরে ফলকের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। মৃদু গুঞ্জন শুনে তাকালেন মেশিনের দিকে। হাঁ করে দেখলেন চালু হয়ে গেছে ডিটেকটর। অন্ধের মত হাতড়ে বেড়ালেন সুইচ, বন্ধ করবেন যন্ত্র। কিন্তু খুঁজে পেলেন না সুইচ। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন পর্দার দিকে। কবর খুঁড়ছে ডিটেকটর, একটা খুলি দাঁত বের করে হাসল ফাদারের দিকে চেয়ে। চোখ মিটমিট করলেন ডুলান, ঢোক গিললেন, তারপর সিধে হয়েই দৌড় দিলেন মেশিনটাকে পেছনে টানতে টানতে।

এক দৌড়ে গেটে পৌঁছে যাবেন ভেবেছিলেন ডুলান। কিন্তু শক্তি পাচ্ছেন না শরীরে। খকখক কেশে উঠলেন, দেবদূতের একটা মূর্তির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। বমি আসছে তাঁর। তেতো ঢেকুর উঠছে। থুক্ করে তেতো থুথু ফেললেন মাটিতে। গুঙিয়ে উঠলেন ডুলান, জামার আস্তিনে মুখ মুছলেন। ডিটেকটরের অবিরাম গুঞ্জনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকালেন পর্দার দিকে।

এবারেরটা প্রাণীর কঙ্কাল। কুকুর, বা হায়েনা হতে পারে, শেয়াল হওয়াও বিচিত্র নয়। সিধে হয়েছেন তিনি, মনে হলো কঙ্কালটার হাড়গুলো নড়ে উঠল, পেছনের পা জোড়া লাথি ছুঁড়ছে। ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না তাঁর, তারপরও সম্মোহিতের মত চেয়ে রইলেন। বাতাসে বোটকা একটা গন্ধ। ডুলান রুমাল বের করে নাক চাপা দিলেন।

দেবমূর্তির কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগলেন ডুলান, এগোচ্ছেন গেটের দিকে। এদিকে শুধু কবর আর কবর। প্রার্থনার শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে কবরগুলোর মাঝ দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে ছুটছেন তিনি। যন্ত্রটা ধরে আছেন দু’হাতে। দুটো সমাধি ফলকের গায়ে আটকে গেল ওটা। ডিটেকটরের ওপর হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগলেন ফাদার। সমাধি ফলকে লেখা:

জোনাথন এবং মারিয়া ফোরসাইথ;
এঁরা এক সাথে, শান্তিতে আছেন অনন্তকালের জন্যে।

পর্দায় লাশ দুটোকে দেখা গেল। পাঁজরের হাড়ের ভেতর কিলবিল করছে পোকা, মাছি উড়ছে মুখের ওপর। পাশাপাশি শুয়ে আছে দু’জনে। ডুলান বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন মারিয়া ফোরসাইথের ফাঁক হয়ে যাওয়া খুলি তার স্বামীর কাঁধের ওপর থেকে বিকট ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মারিয়ার মুখের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে জিভ, লকলক করছে। গলা চিরে তীক্ষ্ণ, ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল ফাদারের, পড়িমরি করে দৌড় দিলেন। এখনও মেশিনটা ধরে আছেন মুঠিতে। অন্ধের মত ছুটছেন। বার কয়েক পড়ে গেলেন আছাড় খেয়ে। তবে ভয়ের চোটে ব্যথা টের পেলেন না।

দৌড়াচ্ছেন, হোঁচট খাচ্ছেন আর চিৎকার করে একটা শব্দ বারবার আউড়ে চলেছেন: ‘অপবিত্রকরণ!’ শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলছে যেন গাছের ফাঁকে। মাথাটা বারবার দু’পাশে নাড়াচ্ছেন ফাদার, ভুলে থাকতে চাইছেন ফাঁক হয়ে যাওয়া খুলির কথা। কিন্তু মগজের সাথে আঠা দিয়ে যেন সেঁটে দেয়া হয়েছে দৃশ্যটা, ভুলতে পারছেন না। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন বলে খোলা কবরটা খেয়াল করেননি ডুলান। ডিগবাজি খেয়ে দড়াম করে ওটার মধ্যে পড়ে গেলেন তিনি।

প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখলেন ডুলান। মাথা তোলার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। থুথু ফেললেন। মুখ দিয়ে কাদা বেরিয়ে এল। পা-ও নড়াতে পারছেন না। গোটা শরীর অসাড়। প্রচণ্ড ভয় গ্রাস করল তাঁকে। প্রাণপণে চেষ্টা করলেন ভয় তাড়াতে। হাতে সবচে’ ব্যথা পেয়েছেন ফাদার। মনে হচ্ছে প্যারালাইজ্‌ড় হয়ে গেছে হাত। তবে অসাড় ভাবটা বেশিক্ষণ থাকবে না, নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি। একটু পরে পায়েও সাড়া ফিরে পাবেন। হাতটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বেঁকে আছে। এর আগে কোনদিন শরীরের হাড়-টাড় ভাঙেনি ডুলানের। আবার ব্যথার ঢেউ উঠল, চোখ বুজে ফেললেন তিনি। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে লাগলেন। চোখ মেলে তাকাতেই কবরের ওপর একটা কাঠামো দেখতে পেলেন তিনি। চোখ কুঁচকে আরও ভালভাবে দেখার চেষ্টা করলেন ওটাকে। একটা কুকুর, প্রকাণ্ড মাথা, হলুদ চোখে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। শিউরে উঠলেন তিনি। থর্ন সমাধিতে নাইট গার্ড নেই কেন ভাবছিলেন ফাদার। এবার জবাবটা পেয়ে গেছেন। এরকম বিশালদেহী কুকুররাই হয়তো নাইট গার্ডের কাজ করে।

কুকুরটার চোখে চোখ রেখে মৃগী রোগীর মত হেসে উঠলেন ডুলান। নিজেকে তাঁর হিমবাহের কবলে পড়া পর্বতারোহীর মত লাগছে। আবার চোয়া ঢেকুর উঠল। থুথু ফেলার চেষ্টা করলেন, ঠোঁটের কোনা গড়িয়ে পড়ল কষ। বিশ্রী গন্ধ। মাথা হেলিয়ে গন্ধটার হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করলেন খামোকাই। মস্তিষ্ক তাঁর নির্দেশ শুনছে না। মাথা হেলানো গেল না।

ডুলান দেখলেন কুকুরটা মাথা নিচু করছে, নাক দিয়ে কবরের পাশে উঁচু হয়ে থাকা মাটির স্তূপে ধাক্কা মারল। একরাশ মাটি ঝুরঝুর করে পড়ল ডুলানের নাকে- মুখে। একটা নুড়ি ঠকাশ করে বাড়ি মারল ভুরুতে। ‘হেই,’ গুঙিয়ে উঠলেন তিনি।

কুকুরটা আবার মাটির স্তূপে নাক দিয়ে ধাক্কা মারল। ‘না…’ চেঁচিয়ে উঠলেন ফাদার, হাঁ করা গলার মধ্যে ঢুকে গেল এক দলা কাদা। আর কথা বলতে পারলেন না। শুনতে পেলেন একটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ, তারপর দ্বিতীয় কুকুরটাকে দেখা গেল কবরের পাশে। এরপর আরও একটা। কবরের মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে সবাই। ওদের বিশাল শরীরের পেছনে তারাজ্বলা আকাশটাকে দেখা গেল এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল আকাশ তার ওপর মাটি-বৃষ্টি শুরু হতে। কুকুরগুলো নখ দিয়ে খামচে মাটি তুলছে, ছুঁড়ে ফেলছে কবরে।

একটা পাথরের টুকরো ঢুকে গেল ডুলানের নাকে, রক্ত বেরিয়ে এল। মুখ হাঁ করে চিৎকার দিলেন, গাঁক গাঁক আওয়াজের সাথে মাটি বেরুল শুধু। শক্ত করে চোখ বুজে থাকলেন তিনি, পাপড়ির ওপর মাটি পড়ছে। নীরবে প্রার্থনা করে চলেছেন ডুলান, মুখের ওপর মাটির স্তূপ বেড়েই চলেছে, একসময় বুজে গেল নাকের ফুটো।

.

পরদিন সকালে, কবর খননকারী লোকটা দৃশ্যটা দেখে প্রথমে ভাবল নতুন কবরটার ভেতরে বুঝি গোলাপী রঙের ঝোপ গজিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল ওদিকে, হাত বাড়াল-ছোঁবে। সাথে সাথে ঝাঁকি খেয়ে পিছিয়ে গেল, গুঙিয়ে উঠল। ডিগবাজি খেয়ে আরেকটু হলে পড়ে যাচ্ছিল সে ঘাস নিড়ানির মত যন্ত্রটার গায়ে। কবরের পাশে পড়ে আছে যন্ত্রটা, মোটর ঘুরছে, পর্দায় ফুটে আছে চোখ বোজা টমাস ডুলানের কাদা মাখা মুখ।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৮

আট

রোম টু লন্ডনের প্লেনে, জানালার ধারে বসেছে নিকোলাস ওয়াল্টার। প্রীস্টের সাথে আলাপের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ব্রীফকেসটা টেনে নিল সে, ডি কার্লোর নোটগুলোতে আবার চোখ বোলাল। ওর অবচেতন মন চাইছে ব্রীফকেসটা ফেলে দিয়ে সব ভুলে গিয়ে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু সন্ন্যাসীর কাছে বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করেছে ওয়াল্টার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল চিঠি দুটোর দিকে। সিনথিয়া অ্যাবট নামের বুড়িটা নির্ঘাত পাগল, আর অপরজন তো ভয়ানক অসুস্থ ছিল। মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষ উল্টোপাল্টা কত কথাই তো বলে। ডি কার্লোর তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। ডেমিয়েন থর্নের লাশ কবরে পাওয়া যায়নি। তো এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালালেই হয়।

বাইবেল আর নোটবুক নিয়ে বসল ওয়াল্টার। গোটা ব্যাপারটাকে ফালতু বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও মন পুরোপুরি সায় দিচ্ছে না। সারাজীবন বাইবেল নিয়ে গবেষণা করেছে সে। বাইবেলের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। সে বাইবেলের পাতা ওল্টাতে শুরু করল। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। পাশের সীটের মহিলা উদ্বেগ নিয়ে তাকাল তার দিকে। ওয়াল্টারকে অসুস্থ মনে হচ্ছে তাঁর। ওয়াল্টার আপন মনে নিউ টেস্টামেন্টের পৃষ্ঠা উল্টে চলেছে, মাঝে মাঝে নোটবুকে কি যেন লিখছে।

‘জাতি যুদ্ধ ঘোষণা করিবে জাতির বিরুদ্ধে, রাজ্য রাজ্যের বিরুদ্ধে…শেষ দিনে,’ কথাটা নিজেকেই যেন শোনাল ওয়াল্টার। আবার ঝুঁকে পড়ল বই’র ওপর। ‘ওই ঘটনাগুলো না ঘটা পর্যন্ত এই জেনারেশনের কেউ রক্ষা পাইব না।’

পেন্সিল রেখে দিল ওয়াল্টার, চোখ বুজল। যৌবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যৌবনকাল তার কেটেছে ঐতিহাসিক গবেষণায়। বিজ্ঞানীর কৌতূহলসহ ধর্মীয় বিশ্বাস প্রবল তার, দুটো উপাদানের মধ্যে কখনও বিভেদ খুঁজতে যায়নি। আজ ঘুমিয়ে পড়ার পর সেই ভয়টা আবার তাকে তাড়া করে ফিরতে লাগল। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন দুঃস্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। আজও দেখল।

অ্যান্টিক্রাইস্ট বেঁচে আছে। বুড়ো সন্ন্যাসী যীশুকে আবার জন্মাতে দেখেছেন। ডি কার্লোর উক্তি যদি পাগলের প্রলাপ না হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আরমাগেড্ডন বা কেয়ামতের আর দেরি নেই।

.

কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পার হবার সময় ওয়াল্টার ভাবছিল সে ট্যাক্সি নেবে নাকি মাটিরতলার রেলে চড়বে। কোন্ হোটেলে উঠবে? কাকে প্রথম ফোন করবে? ব্যাগ নিয়ে কংকর্স হল ধরে হাঁটছে, একটা নিউজপেপার স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। পকেটে হাত ঢোকাল ইংলিশ কয়েনের জন্যে।

ডিসপ্লেতে ঝোলানো ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড-ট্রিবিউনের পাতায় চোখ আটকে গেল ওয়াল্টারের। ঝুঁকল, পত্রিকাটি নেবে, হঠাৎ জমে গেল পাথরের মত, তারপর ধীর গতিতে শেলফ থেকে পত্রিকাটি নামিয়ে সিধে হলো। বিড়বিড় করছে ওয়াল্টার, লোকজনের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই।

পত্রিকার প্রথম পাতায় খবরটা ছাপা হয়েছে। এক পুলিশ লেফটেন্যান্ট বলছে এমন ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সে জীবনে দেখেনি। তার নাকি মাথাতেই ঢুকছে না একজন মানুষ কিভাবে আরেকজনকে এভাবে জ্যান্ত কবর দিতে পারে। তবে প্যাথলজিস্ট বলেছে, গর্তে পড়ে গিয়ে লোকটার ঘাড় ভেঙে যায় এবং সম্ভবত সে প্যারালাইজ্ড্ হয়ে পড়েছিল।

‘ওহ্, মাই গড,’ ফিসফিস করল ওয়াল্টার, পড়ে গেল হাঁটু ভেঙে। লোকজন ঘিরে ধরল তাকে। সবাই জিজ্ঞেস করছে সে ঠিক আছে কিনা কিংবা ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন আছে কিনা।

পিকাডিলিতে, ছোট একটা হোটেলে উঠল ওয়াল্টার। বাড়িতে, স্ত্রীকে ফোন করে জানাল সে ভাল আছে।

ঘরকুনো ওয়াল্টার নতুন কোন শহরে এলে সাধারণত ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। সে বিকেলে হাঁটতে বেরুল। লক্ষ করল লন্ডনের কোন কিছুই তাকে আকর্ষণ করতে পারছে না। বারবার টমাস ডুলানের চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখে। কণ্ঠ বাজছে কানে। কাল রাতে যখন ফোন করল সে, উত্তেজিত শোনাচ্ছিল কণ্ঠ।

গাল বেয়ে পানি পড়ছে ওয়াল্টারের, হাতের চেটো দিয়ে অশ্রু মুছল। ডুলানের মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে তার। ড়ি কার্লোর অনুরোধে থর্নের কবর খুঁড়ে দেখতে ডুলানকে অনুরোধ করেছিল ওয়াল্টার। কিন্তু তার এমন নির্মম পরিণতি ঘটবে কে জানত?

হাঁটতে হাঁটতে একটা চার্চের সামনে চলে এসেছে ওয়াল্টার। চার্চের দরজা খোলা। কিছু না ভেবে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।

চার্চে অনেকক্ষণ বসে রইল ওয়াল্টার। মনে পড়ল ডি কার্লোর কথা: ‘জাগ্ৰত যীশু আপনাকে সাহায্য করবেন।’

নিখোঁজ সাংবাদিক মেয়েটির জন্যে প্রার্থনা করল ওয়াল্টার, টমাস ডুলানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করল, সবশেষে প্রার্থনা করল নিজের জন্যেও। যখন বেরিয়ে এল চার্চ ছেড়ে, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আগামী করণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে।

‘মি. অ্যামব্যাসাডর।’

সেক্রেটারির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আর্থারের। লজ্জা পেল। এ হপ্তায় এ নিয়ে অন্তত তিনবার ডেস্কে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। অবশ্য রাত জাগলে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ইদানীং শীলার যৌন ক্ষুধা খুব বেড়ে গেছে। সারা রাত জাগিয়ে রাখে। এ ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। মুচকি হেসে ভাবল সে।

ইন্টারকমের বোতামে চাপ দিল আর্থার। জানতে চাইল সেক্রেটারি কেন ডাকছে।

‘ব্রিফিং পেপার, স্যার।’

‘ধন্যবাদ,’ ঘুম জড়ানো গলায় বলল সিনেটর। ‘ওগুলো পাঠিয়ে দাও, কেমন?’

হাই তুলল আর্থার, তারপর রওনা হয়ে গেল বাথরুমের দিকে।

ব্রিফিং পেপারগুলো স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৈরি। সেই একই গৎ বাঁধা বুলি। পড়তে বিরক্তি লাগে। তবু সাবধানে পেপারগুলোতে চোখ বুলাল আর্থার। ক্লান্ত লাগছে খুব। ক’টা দিন ছুটি নেয়া দরকার। কিন্তু যাবেটা কোথায়? পৃথিবীর কোথাও শান্তি আছে নাকি?

আরব দেশগুলোর কোন উন্নতি নেই। হয় মৌলবাদী সংস্কৃতি চর্চা করছে নয়তো মধ্যযুগের অন্ধকারে পড়ে আছে। ইরাকে না খেতে পেয়ে হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। সাদ্দাম হোসেন তবু সুযোগ পেলেই কুয়েতকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। আফগানিস্তানের অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ভয়াবহ। তালেবানেরা বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে দেশটার। আফ্রিকান দেশগুলোতে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে। ক্যারিবিয়ান এবং ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে চলছে একনায়কতন্ত্র অথবা শাসন করছে গুণ্ডা সর্দাররা। এশিয়ার দেশগুলোতেও শান্তি নেই। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা সবখানেই বিশৃঙ্খল অবস্থা। শান্ত ইউরোপে এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রক্তপিপাসু তরুণরা। এরা নির্বিচারে ছিনতাই, রাহাজানি, খুন-খারাবী করে চলেছে। একজন আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট হয়েও দিন-রাত প্রহরীবেষ্টিত হয়ে চলতে হচ্ছে তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর্থার। যেখানে মানুষ আছে সে জায়গাটাই যেন দূষিত হয়ে উঠছে।

কোথাও ভাল খবর নেই, শুধুই দুঃসংবাদ। অসংখ্য সমস্যা চারদিকে, কোন সমাধান নেই। গ্রসভেনর স্কোয়ারে তাকাল আর্থার। একদল বিক্ষোভকারী হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বৃত্তাকারে মিছিল করছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ বিক্ষোভ করে চলেছে। স্কোয়ারটাকে কখনও ফাঁকা দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না আর্থার।

এবারের বিক্ষোভকারীদের পরনে কালো আলখেল্লা, তাতে নরকঙ্কালের ছবি আঁকা। ওদের দিকে চোখ ফেরাতে একজন ঘুরে দাঁড়াল। কঙ্কালটা যেন সরাসরি তাকাল আর্থারের দিকে। শ’খানেক গজ দূরে এক লোক ঘুষি পাকিয়ে দেখাল আর্থারকে।

ফোঁস করে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর্থার, সরে এল জানালার সামনে থেকে। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে শুনে সে অসুস্থ বোধ করছে। ভাল কিছু শুনতে চায় সে। কিন্তু সে আশা বৃথা।

ডায়েরী দেখল আর্থার: হিলটনে অ্যাংলো-আমেরিকান ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাথে ককটেল পার্টি আছে। পার্টি তাড়াতাড়ি শেষ হলে সে রাত ন’টার মধ্যে বাড়ি ফিরে ডিনার করতে পারবে।

বাথরুমে ঢুকল আর্থার, শাওয়ার কার্টেন টেনে দিল, হতাশ ভাবটা দূর করে দিতে চাইছে জোর করে। চিন্তা করছে ব্যবসায়ীদের কি ভাষণ দেবে। তবে প্রথাগত বক্তৃতা দিতে হবে না। কিভাবে বিশেষ সম্পর্কের খাতিরে শান্তির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো যায় তা নিয়ে দু’একটা কথা বললেই চলবে।

.

কনফারেন্স রুম সাজানো হয়েছে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ পতাকা দিয়ে। আধঘণ্টা গেল সবার সাথে পরিচয় হবার সুবাদে হ্যান্ডশেক করে। তারপর একটা সময় কৌশলে ভিড় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল ফ্রেডরিক আর্থার। একা মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, টের পেল কেউ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘুরল আর্থার, দেখল বেঁটেখাট এক লোক, নার্ভাস ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে।

‘মি. অ্যামব্যাসাডর, আমি নিকোলাস ওয়াল্টার। এক মিনিট কথা বলতে পারি আপনার সাথে?’ লোকটার উচ্চারণ ইলিনয়ের মানুষদের মত, ধরে ফেলল আর্থার। লক্ষ করল এর বুকে ব্যবসায়ীদের মত ল্যাপেল ব্যাজ নেই।

আর্থারের মনের কথা যেন বুঝে ফেলল ওয়াল্টার। ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলল, ‘আমি এ প্রতিষ্ঠানের সদস্য নই। আমি এখানে আসতে পারতাম না। আমার এক বন্ধুর বন্ধু আমাকে নিয়ে এসেছে।’ আর্থারের কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘আপনার সিকিউরিটি আমাকে চেক করেছে,’ বলে চলল ওয়াল্টার। ‘আমি একজন ইতিহাসবিদ, সেই সাথে অ্যান্টিকস ডিলারও। শিকাগোতে থাকি।’

‘আচ্ছা,’ বলল আর্থার।

‘আপনার সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ খুঁজছিলাম। কিন্তু আপনার অফিস আমাকে সে অনুমতি দেয়নি।’

‘আমি দুঃখিত, মি. ওয়াল্টার। কিন্তু সবার সাথে যদি আমাকে দেখা করতে—’

‘তা সম্ভব নয় আমি জানি। কিন্তু আমি আপনার সময় নষ্ট করব না,’ রাষ্ট্রদূতের হাত ধরে দেয়ালের এক কোণে নিয়ে গেল ওয়াল্টার। ‘আমাকে একটা প্যাকেজ দেয়া হয়েছে আপনার জন্যে। আমি ওটা আপনার বাসায় রেখে এসেছি। আমার অনুরোধ, আপনি ওটা খুলে পড়ন।

‘আচ্ছা, হাই উঠছিল আর্থারের, মুখে হাত চাপা দিয়ে ঠেকাল। ‘দয়া করে সবগুলো লেখাই পড়বেন। ফালতু বলে ফেলে দেবেন না প্লীজ।’

ভুরু কুঁচকে উঠল আর্থারের। ঠিক এরকম সুরে কে যেন ওর সাথে কথা বলছিল এর আগে?

‘যা পড়বেন বেশিরভাগই হয়তো পাগলামি বলে মনে হবে। তবে আমি এটুকুই বলব এর সাথে যে দু’জন জড়িত ছিল-বিরতি দিল ওয়াল্টার, তারপর শান্ত গলায় শেষ করল-’এদের একজন, আমার প্রীস্ট মারা গেছেন।’

‘আচ্ছা, বুঝলাম…’ আর্থার চলে যেতে চাইল, ওয়াল্টার ছাড়ল না হাত।

‘আমার প্রীস্ট আবিষ্কার করেছে, মি. আর্থার, আপনার এক পূর্বসুরির লাশ তার কবরে নেই।’

হাসল আর্থার, আবার ছাড়িয়ে নিতে চাইল হাত। আর সেই পূর্বসুরি হলো ডেমিয়েন থর্ন,’ ফিসফিস করল ওয়াল্টার।

আর্থার টান মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল।

 

 

‘নিজেকে প্রশ্ন করুন, ডেমিয়েন থর্নের কফিনে লাশের বদলে পাথর পোরা কেন।’

ঘুরে দাঁড়াল আর্থার, তার পেছন পেছন চলল ওয়াল্টার। ‘আমি পাগল বা উন্মাদ নই, মি. আর্থার। এসব বলে আমি লাভবানও হব না। আমি ভীতু একজন মানুষ, ধর্মপ্রাণ এক কাপুরুষ।’

ওয়াল্টার রাষ্ট্রদূতকে বিরক্ত করছে দেখে এক এইড এগিয়ে গেল ওদিকে।

‘আমি যা বললাম তা করবেন তো, মি. আর্থার? শুধু লেখাগুলো পুরোটা পড়ে ফেলবেন।’

আর্থার উদ্বেগে আকুল, মিনতিভরা মুখখানার দিকে তাকাল। ‘আচ্ছা, পড়ব,’ বলল সে। লোকটার হাত থেকে রেহাই পেলে বাঁচে সে।

হাসল ওয়াল্টার। ‘ধন্যবাদ, মি. অ্যামব্যাসাডর।’

এইড কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পাশ কাটাল। হাসছে সে, যেন দায়িত্বের বিরাট একটা বোঝা কাঁধ থেকে নেমে যাওয়াতে দারুণ খুশি।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ৯

নয়

প্রকাণ্ড বোয়িং ৭৭৭ জাম্বো হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে লম্বা দৌড় শেষ করে উঠে পড়ল শূন্যে, উড়াল দিল পশ্চিমে। নিকোলাস ওয়াল্টার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেঁধিয়ে গেল নরম সীটের ভেতরে। প্রীস্টকে দেয়া কথা সে রেখেছে। দেখা করেছে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে। তবে ওয়াল্টারের সন্দেহ হচ্ছে অ্যামব্যাসাডর আদৌ তার পাঠানো প্যাকেজটাকে গুরুত্ব দেবেন কিনা। অবশ্য সে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের সাথেও কথা বলতে পারে। দু’একজন সাংবাদিকের সাথে তার পরিচয় আছে। এরা কিভাবে গপপো বানায় ভালই জানে ওয়াল্টার। থর্ন সাম্রাজ্য নিয়ে সাংবাদিকদের যথেষ্ট কৌতূহল আছে শুনেছে সে। আর এ ব্যাপারটা নিয়ে যদি সাড়া পড়ে যায় তাহলে বেচারা টমাস ডুলানের অপঘাত মৃত্যু অন্তত বৃথা যায়নি ভেবে সান্ত্বনা পাবে ওয়াল্টার।

লালচুলো স্টুয়াড্রেসকে ডেকে মার্টিনি দিতে বলল সে। মেয়েটার নাম ক্লেয়ার। হাসিটা চমত্কার, মেকি মনে হয় না। ট্রেটা দেয়ার সময় ওয়াল্টারের কাঁধে ক্লেয়ারের নরম স্তন ঘষা খেল। ওয়াল্টারের মনে হলো ইচ্ছে করে কাজটা করেছে মেয়েটা। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে চোখ রাঙাল-বুড়ো বয়সে ভিমরতিতে ধরেছে, না?

ফিল্ম চলার সময় ওয়াল্টারের পাশের খালি সীটে বসে পড়ল ক্লেয়ার। দ্বিতীয়বার জানতে চাইল ওয়াল্টার ভ্রমণটা উপভোগ করছে কিনা এবং সে তার জন্যে আর কি করতে পারে?

‘কিছুই করতে হবে না,’ ফিসফিস করে জবাব দিল ওয়াল্টার। ‘সব ঠিক আছে।’ এক সাথে ছবিটা দেখল দু’জনে। ওয়েস্টার্ন ছবি। তবে পর্দায় মন দিতে পারল না ওয়াল্টার। তার আবার সন্দেহ হতে শুরু করেছে মেয়েটা ইচ্ছে করে তার সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি করছে। এই তো একটু আগে উরু ছুঁইয়ে দিল। মনে মনে নিজেকে আবার ধমক দিল ওয়াল্টার। আসলে অমন কিছুই ঘটছে না, সবই তার কল্পনা। আর মেয়েটা তার মত বুড়োর সাথে রংঢং করতে যাবে কেন? প্লেনে তো তরুণ যাত্রীর অভাব নেই। তামাশা করতে মন চাইলে তাদের সাথে করবে।

পর্দায় ধুমধাম মারপিট চলছে, ক্লেয়ার সরে এল ওয়াল্টারের কাছে, ফিসফিসিয়ে বলল তাকে এখন কফি দিতে যেতে হবে। ওয়াল্টার গ্যালিতে চলে আসুক না। তাহলে ক্লেয়ার তাকে ককটেল বানিয়ে খাওয়াতে পারবে। অর্থপূর্ণ হাসি হেসে চলে গেল স্টুয়ার্ডেস। ফাঁকা দৃষ্টিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল নিকোলাস ওয়াল্টার। গ্যালিতে গেলে ক্ষতি কিসের? কিসের ক্ষতি?

.

ক্লেয়ার জ্যাকেট আর মাথার ক্যাপ খুলে ফেলেছে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে কেবিনের দেয়ালে। ভদকার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, ওয়াল্টারকে বলছে ডিউটি চলাকালীন পান করার অনুমতি তাদের নেই। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখছে কেউ এল কিনা। আরেক স্টুয়ার্ডেস, সিন্ডি ক্লেয়ারের হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে। ক্লেয়ার জানাল তার বাড়ি ডেনভারে। ওয়াল্টারের বাড়ি কোথায়? সে কি করে? ইউরোপ এসেছে ব্যবসার কাজে নাকি স্ফূর্তি করতে?

যতদূর সম্ভব ক্লেয়ারের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করছে ওয়াল্টার। মেয়েটার দিকে প্রায় তাকাচ্ছেই না, ভাবলেশহীন থাকার চেষ্টা করছে। পান করতে করতে পোর্ট হোলের দিকে তাকাচ্ছে, যেন এমন করেই সে অভ্যস্ত।

‘আপনি আকাশ ভ্রমণ পছন্দ করেন?’ জানতে চাইল স্টুয়ার্ডেস।

‘নাহ্,’ জবাব দিল ওয়াল্টার। ‘একটা ধাতব টুকরো কি করে আকাশে উড়ে বেড়ায় বুঝতে পারি না আমি।’

‘আমিও,’ খিলখিল হাসল ক্লেয়ার।

‘একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় ঢোকে না আমার,’ বলল ওয়াল্টার। ‘প্লেন চলার সময় চাকা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে কেন?’

‘নামিয়ে রাখলে প্লেন চালানো সম্ভব নয় বলে,’ জবাব দিল মেয়েটা।

‘কিন্তু আসল সময় যদি চাকা পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে না আসে তখন?’ ওয়াল্টারের প্রশ্ন শুনে হিহি করে হেসে উঠল ক্লেয়ার, ওর হাত ধরে এগোল গ্যালির মাঝ দিয়ে। তারপর উঠে পড়ল ছোট একটা লিফটে।

‘চাকা সবসময় নেমে আসে,’ বলল স্টুয়ার্ডেস। ‘চলুন, জিনিসটা দেখাই আপনাকে। আন্ডার ফ্লোর গ্যালিতে আছে ওটা…এই তো এসে পড়েছি।’ নেমে পড়ল ক্লেয়ার, তার পেছনে ওয়াল্টার। হাতে এখনও ড্রিঙ্কের গ্লাস।

ওভেন, বার বক্স আর ট্রলির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলল ক্লেয়ার, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ওয়াল্টারকে। ইশারা করল ওর পেছন পেছন আসতে। দুটো ট্রলির মাঝখানে আটকা পড়ে গেল ওয়াল্টার। হেসে ওকে উদ্ধার করল ক্লেয়ার, টুসকি মারল নাকে, তারপর নাচের ভঙ্গিতে সরে গেল। এগোল ভারী একটা দরজার দিকে।

ক্লেয়ারের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়েছে ওয়াল্টার। বেড়ে গেছে পালস রেট, পাঁজরে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত সে।

‘ওখানে চাকা রাখা হয়,’ বলল ক্লেয়ার। ‘সেন্টার হোল্ডে। লাল একটা বাতির দিকে ইঙ্গিত করল। ‘প্রেসারাইজেশন লেভেল নিচে নেমে গেলে আমরা সবুজ সংকেত পাই, মানে আলোটা সবুজ হয়ে ওঠে। তখন নামার জন্যে প্রস্তুত হই।’

‘সেটা কখন ঘটবে?’ জিজ্ঞেস করল ওয়াল্টার।

প্রার্থনা করল যেন ঘটনাটা অনেক পরে ঘটে।

‘সময় হয়ে এল বলে,’ জবাব দিল ক্লেয়ার। ধাক্কা মেরে দরজা খুলল, তার পিছু পিছু সেন্টার হোল্ডে ঢুকল ওয়াল্টার। ভেতরে ভীষণ ঠাণ্ডা। শিরশির করে উঠল গা। মদের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ওয়াল্টার, ক্লেয়ারের সাথে চলে এল ইস্পাতের প্রকাণ্ড একটা কন্টেইনারের সামনে। হোল্ডের পুরো জায়গা দখল করে আছে এটা।

‘আসুন,’ কন্টেইনারের গায়ে লাগানো সিঁড়ি বাইতে শুরু করল ক্লেয়ার। পেছন পেছন যথারীতি ওয়াল্টার। ওপরে উঠে এল ওরা।

‘এটাকে বলে হুইল ওয়েল বে,’ একটা হ্যাচ টেনে খুলল ক্লেয়ার।

‘দেখুন।’

উঁকি দিল ওয়াল্টার হ্যাচের মুখে। ওর নাকের কয়েক ইঞ্চি নিচে শুয়ে আছে দানব চাকাগুলো।

‘মোট ষোলোটা,’ জানাল ক্লেয়ার। ‘প্রতি চারটে চাকার জন্যে একটা বগি। প্রতিটি চাকা পাঁচ ফুট উঁচু।’

চেষ্টাকৃত হাসি দিল ওয়াল্টার, ভোঁতা চোখে তাকিয়ে আছে চাকাগুলোর দিকে। ক্লেয়ার বলে চলেছে কিভাবে হাইড্রলিক কাজ করে। যদি কাজ না করে, যদিও তা কখনোই ঘটেনি, তবু অমন ঘটলে নিচের হুইল ওয়েল ডোর হাত দিয়ে টানলেই খুলে যাবে, চাকাগুলো নিজে থেকে নেমে যাবে ঝপ করে।

‘মাধ্যাকর্ষণের কারণে, না?’

‘ঠিক ধরেছেন,’ নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে ওয়াল্টারের। মেয়েটা যখন চাকা দেখাতে চাইল সে বুঝতে পারেনি সত্যি স্টুয়ার্ডেসটা তাকে এসব বিশ্রী জিনিস দেখাতে নিয়ে আসবে।

‘ঘটনাটা এখুনি ঘটবে,’ বলল মেয়েটা ওয়াল্টারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। এয়ারক্রাফটের পেটের ভেতরের দরজা খুলে গেল, হিসিয়ে উঠল হাইড্রলিক। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় ওয়াল্টারের শার্ট পতপত করে উড়তে লাগল, বাতাসের চাপে বন্ধ হয়ে আসতে চাইল নিশ্বাস।

‘দেখছেন, চাকাগুলো নড়তে শুরু করেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই।’

ইঞ্জিনের কান ফাটানো শব্দে আর বাতাসের গর্জনে মেয়েটার গলা প্রায় শুনতেই পেল না ওয়াল্টার। নিচে তাকাল ও। চাকার ফাঁক দিয়ে নিউ ইয়র্কের শহরতলি, বাড়ি-ঘর দেখা গেল।

আবার শিউরে উঠল ওয়াল্টার, ধরে ফেলল হ্যাচের কিনারা। পিছিয়ে আসতে শুরু করেছে, মেয়েটার হাতের স্পর্শ পেল কাঁধে। মনে মনে হাসল ওয়াল্টার। অদ্ভুত একটা সময় নির্বাচন করেছে মেয়েটা…পরক্ষণে ধাক্কা খেল সে, ছিটকে গেল সামনে। গলায় চাবুক কষাল বাতাস, হাত জোড়া বাড়ি খেল চাকায়, খামচে ধরল খাঁজ, মুখটা খুব জোরে ঘষা লাগল রাবার টায়ারের সাথে, ব্যথায় ককিয়ে উঠল ওয়ালটার, একটা পা হ্যাচের সাথে আটকে গেছে। টায়ার ধরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে ক্লেয়ার, হাসছে। হাসতে হাসতে বন্ধ করে দিল হ্যাচ।

হামাগুড়ি দিয়ে সামনে বাড়ল ওয়াল্টার, খামচে ধরে আছে রাবার। আর এগোতে পারল না। নাকটা ঠেকে আছে টায়ারের গভীর খাঁজে, গোবরের গন্ধ আসছে।

টেকঅফের সময় নিশ্চয়ই চাকায় গোবর লেগেছিল। গুলিয়ে উঠল গা।

সামনে-পেছনে কোথাও যেতে পারছে না ওয়াল্টার। ভয়ানক আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বাতাসের ধাক্কায় একটা চোখ বুজে গেছে, আরেকটা চোখ দিয়ে দরদর ধারায় পানি পড়ছে। নিচে তাকাতে কেনেডি এয়ারপোর্ট এক ঝলক দেখতে পেল ওয়াল্টার। ওর স্ত্রী বলেছে এয়ারপোর্টে থাকবে সে। ওয়াল্টারকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। এ মুহূর্তে হয়তো সে অবজার্ভেশন এলাকায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, খুঁজছে স্বামীর প্লেন।

টায়ারের সাথে মুখ ঘষল ওয়াল্টার। মনে পড়ে গেল ক্লেয়ার বলেছিল কখনও কখনও এত বেগে ল্যান্ড করে প্লেন যে টায়ারের এক ইঞ্চির মত রাবার পুড়ে যায়।

ওয়াল্টারের দৃষ্টি হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে এল। রানওয়ে দেখতে পাচ্ছে। নামতে যাচ্ছে প্লেন। আস্তে আস্তে, তীব্র যন্ত্রণা সয়ে মাথা তুলল সে। তারপর চিৎকার দিল।

.

ডানার ওপর, জানালার ধারে ছোট্ট রকিব তার মা’র সাথে বসেছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। এক স্টুয়ার্ডেস এগিয়ে এল ওদের দিকে। হেসে জানতে চাইল কি হয়েছে।

‘জীবনে এই প্রথম প্লেনে উঠেছে ও,’ বললেন রকিবের মা।

‘আবার,’ শিউরে উঠল রকিব।

‘আমার বাচ্চাটা বলছে ও শুনেছে কে নাকি চিৎকার করছে,’ ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন মিসেস হাসান। ‘ওকে বলেছি ওটা বাতাসের শব্দ।’

‘মা ঠিকই বলেছেন,’ রকিবের থুতনি নেড়ে দিল স্টুয়ার্ডেস আদর করে। ‘আমরা ঘণ্টায় দুশো মাইল বেগে উড়ে চলেছি। আর প্লেন নামার সময় বাতাসে অনেক অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়।’

রকিব কিছু বলল না, জানালায় খাড়া করে রাখল কান। প্লেন রানওয়েতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে, চোখ বুজে কানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখল ও। ভয়ঙ্কর চিৎকারটা আর শুনতে চায় না। দুম করে শব্দ হলো, কংক্রিটের সাথে ঘষা খেয়েছে রাবার। একটু পর কমে এল এঞ্জিনের শব্দ, তারপর শুধু মৃদু গুঞ্জন তুলল টার্মিনাল গেটের দিকে এগোবার সময়।

প্লেন না থামা পর্যন্ত চোখ খুলল না রকিব। চোখ মেলে দেখল এক মেকানিক চাকার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তীব্র আতঙ্কে মুখের সমস্ত রক্ত সরে গেছে তার, চাকার সাথে দলা-পাকানো মাংসের টুকরোগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই কিছুক্ষণ আগেও ওটা ছিল নিকোলাস ওয়াল্টার। ‘চিৎকারটা এখন থেমে গেছে,’ মা’র দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল রকিব।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১০

দশ

লিফটে ফ্রেডরিক আর্থারের সাথে দুই তরুণ উঠল। তাদেরকে মৃদু গলায় ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলল রাষ্ট্রদূত। নিজের চিন্তায় বুঁদ হয়ে ছিল বলে শুরুতে ওদের কথা শুনতে পায়নি আর্থার। সচেতন হয়ে উঠল ‘শিকাগো’ শব্দটা শুনে। দুই তরুণ শিকাগোর এক প্লেন যাত্রীর করুণ মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করছে। প্লেনের চাকার নিচে পড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেছে বেচারা, বলছিল একজন তার সঙ্গীকে। ‘চিন্তা করতে পারো কেনেডি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার সময় প্লেন টানা দু’মাইল দৌড়েছে। আর বেচারা যাত্রী চাকার সাথে পিষতে পিষতে ভর্তা হয়ে গেছে,’ শিউরে উঠল এক তরুণ।

‘লোকটা কি করত?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।

‘শুনেছি অ্যান্টিক ডিলার ছিল,’ জবাব দিল তরুণ। ‘পেপারে বেরিয়েছে খবরটা। নিউজেও দেখিয়েছে।

‘তার নাম কি ওয়াল্টার?’

‘জ্বী। জ্বী,’ তরুণ বিস্মিত চোখে তাকাল আর্থারের দিকে। ‘আপনি তাকে চিনতেন নাকি, স্যার?’

খুলে গেল লিফটের দরজা, ডানে-বামে মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল আর্থার।

.

সে সন্ধ্যায় ফ্রেডরিক আর্থারের মন জুড়ে আচ্ছন্ন হয়ে রইল নিকোলাস ওয়াল্টার। চেষ্টা করল ভুলে থাকতে। কিন্তু চেহারাটা যেন মগজে ছাপ মেরে আছে, সরু গলাটা বারবার বাজছে কানে। ডিনারে কিছুই খেতে পারল না আর্থার। শীলার প্রশ্নের হুঁ হাঁ জবাব দিয়ে গেল। টিভিতে ওয়াল্টারের খবর দেখাল সবশেষে। সংবাদ পাঠক বললেন দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটল প্যান অ্যাম তা তদন্ত করে দেখছে।

‘বেচারা!’ বলল আর্থার।

‘সম্ভবত মাতাল ছিল। নইলে প্লেন থেকে পড়ে যায় কেউ?’ মন্তব্য করল শীলা।

আর্থার কিছু না বলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ঢুকল স্টাডিরুমে।

নিকোলাস ওয়াল্টারের প্যাকেজটা কতগুলো পত্রিকার ওপর রাখা। খোলা হয়নি এখনও। খুলল আর্থার। দুটো খাম, এক তাড়া নোট আর একটা পত্রিকার কাটিং বের হলো। নোটের প্রথম পৃষ্ঠায় আলাদা এক টুকরো কাগজ স্ট্যা করা। কাগজের মাথায় লন্ডনের এক হোটেলের ঠিকানা।

‘ডিয়ার মি. অ্যামব্যাসাডর,’ পড়ল আর্থার। ‘কৌতূহল প্রকাশের জন্যে ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে নোট আর চিঠি দুটি পড়বেন। অনুরোধ রইল পুরোটা পড়ার জন্যে। আমি শীঘ্রি কিছু নিখাদ প্রমাণ নিয়ে আপনার সামনে হাজির হব।

নিচে নিকোলাস ওয়াল্টারের স্পষ্ট হস্তাক্ষরের দস্তখত।

ব্রান্ডির বোতলের দিকে হাত বাড়াল আর্থার, ঢালল গ্লাসে। একটু আগে শীলা অনুযোগ করেছে সে আজ বেশি মদ খাচ্ছে। গ্রাহ্য করেনি আর্থার।

ওয়াল্টারের লিখিত নির্দেশ মত প্রথম চিঠিটা খুলল সে।

‘আগামী হপ্তা, ফাদার, আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে…’ ব্রান্ডির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চিঠির ওপর ঝুঁকল আর্থার, ডেস্ক ল্যাম্পটা একটু ডানে সরাতে আলোটা সরাসরি পড়ল কাগজে। প্রথমটা পড়া শেষ করে দ্বিতীয়টা খুলল আর্থার। ‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’

আবার সেই চিঠি! গুঙিয়ে উঠল আর্থার। সিনথিয়া অ্যাবটের চিঠি দলা পাকাল মুঠোর ভেতর। ইচ্ছে করছে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের জয় হলো। আবার পড়তে শুরু করল। পড়া শেষে খামের ভেতর ঢোকাল চিঠি। এবার নোটগুলোর দিকে নজর দিল। প্রথম পৃষ্ঠায় টাইপ করা ‘মনাস্টেরি অভ সান বেনেডেটো।’

ফাদার ডি কার্লো সহজ ভাষায় লিখেছেন। বলেছেন আঠারো বছর আগে ক্যাসিওপিয়ায় কিভাবে কতগুলো তারা একত্র হয়ে পড়েছিল, কিভাবে তিনি এবং তাঁর ছয় সন্ন্যাসী ইংল্যান্ড এসেছিলেন অ্যান্টিক্রাইস্টকে ধ্বংস করতে, কিভাবে তাঁরা অন্ধকারের শক্তির সাথে লড়াই করেছেন এবং কিভাবে ছয় সন্ন্যাসীকে জীবন দিতে হয়েছে।

এসব ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেননি ডি কার্লো, সংক্ষেপে লিখেছেন। শেষ প্যারাটা কর্কশ গলায়, ফিসফিসিয়ে পড়ে গেল আর্থার। ‘তিন তারকার মিলন হলো, সঙ্কেত পেলাম যীশুর দ্বিতীয়বার আগমনের। ভেবেছিলাম অ্যান্টিক্রাইস্টকে অবশেষে ধ্বংস করতে পেরেছি। ভেবেছিলাম ওটাই আমাদের শেষ লড়াই। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। অ্যান্টিক্রাইস্টের শক্তি ধ্বংস হয়নি। তবে ঈশ্বর পুত্র আবার এসেছেন পৃথিবীর বুকে। অশুভ শক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হবে রোজ-কেয়ামতের দিনে।’

শেষ চিঠিটি লিখেছে নিকোলাস ওয়াল্টার।

‘ব্যাপারটা বুঝতে হলে,’ লিখেছে ওয়াল্টার, ‘আপনাকে বাইবেল নিয়ে বসতে হবে…’

উঠে দাঁড়াল আর্থার, টলমল পায়ে এগোল শেলফের দিকে। বাইবেলের ওপর ধুলো জমে গেছে। ফুঁ দিল আর্থার। কেশে উঠল খক খক করে। নাকে-মুখে ঢুকে গেছে ধুলো। শেষ কবে বাইবেল খুলেছে মনে করতে পারল না।

ওয়াল্টার তার নোট বইতে বাইবেল থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছে। সেই সাথে উদ্ধৃতিগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও করেছে। আর্থার বাইবেলের সাথে ওয়াল্টারের নোটের উদ্ধৃতি মিলিয়ে দেখল। তারপর থম্ মেরে বসে রইল।

বাইবেলে এক জায়গায় আছে ‘জাতি শত্রু হইয়া উঠিবে জাতির…’ এ উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা করেছে ওয়াল্টার এভাবে-’অনেকের বিশ্বাস বাইবেলের এ উদ্ধৃতির সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা মিলে যায়।’

‘দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং ভূমিকম্প; ম্যাথিউ ২৪। ওয়াল্টার লিখেছে, ‘এবং তাই ঘটেছে ইতালি, চীন এবং জাপানে।

‘ম্যাথিউ যাকে কেয়ামতের দিন বলেছে তার লক্ষণ সবে শুরু, লিখেছে ওয়াল্টার। ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ, ইসরায়েলে জুবিলী হামলা; ওই মহাযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে সেরকম মানুষ এখন খুব কমই বেঁচে আছে। কেয়ামতের দিন সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা সত্যি আসছে। শুধু বাইবেলেই নয়, জাসটিন, টারটুলিয়ানের মত পণ্ডিত ব্যক্তিরাও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন।’

 

 

জুবিলী অর্থাৎ প্রতি পঞ্চাশ বছর অন্তর ইহুদিরা যে ধর্মোৎসব করে, সেই সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর আবার আসছে ২০০০ সালে। ওয়াল্টার বলছে, এই সুবর্ণ-জয়ন্তীর বছরই কেয়ামতের বছর। নতুন শতকের এই বছরে আবার সংঘাত হবে শুভ এবং অশুভের মাঝে। যদি অশুভকে ধ্বংস না করা যায়, পৃথিবী পরিণত হবে অরাজক এক গ্রহে। তবে আশার কথা, যীশু আবার জেগেছেন। তাঁর সাহায্য নিয়ে ধ্বংস করতে হবে অ্যান্টিক্রাইস্টকে।

শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের লেখাটার দিকে তাকাল আর্থার, পড়তে ইচ্ছে করছে না। ইতিমধ্যে ব্রান্ডির বোতল প্রায় শেষ করে ফেলেছে সে। মাথা টলছে। এতক্ষণ যা পড়েছে, পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য আর পাগলামি মনে হচ্ছে। সিধে হলো ও, বাতি নিভিয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে, সামান্য টলছে। শীলা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের পর এই প্রথম স্ত্রীর কণ্ঠ শুনতে মন চাইল না আর্থারের। ওকে এখন কেউ বিরক্ত করুক মোটেই চাইছে না।

চুপচাপ বিছানায়, শীলার পাশে শুয়ে পড়ল আর্থার। গভীর শ্বাস নিচ্ছে শীলা, ঘুমে অচেতন। জানালা দিয়ে রাতের আকাশে তাকাল আর্থার, অলস মস্তিষ্কে বৃথাই তারাগুলোর নাম দেয়ার চেষ্টা করল, হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল, প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে আগে ভাগে অফিসে গেল ফ্রেডরিক আর্থার। তবে কাজে তেমন মন দিতে পারল না। আগের রাতে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ওটা তার মগজ যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

সারাটা সকাল তার গেল কাজের ভান করে, কয়েকটা ফোন করে আর কারণে- অকারণে সেক্রেটারিকে ধমকে। দুপুরে লাঞ্চ করল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ এক ডিপ্লোম্যাটের সাথে। আসন্ন মীটিং নিয়ে কথা বলল দু’জনে। আসলে কথা বলল তরুণ, আর্থার শুধু হুঁ হাঁ করে গেল।

ডেস্কে ফিরে প্যাকেজটার কথা আবার মনে পড় গেল আর্থারের। স্টাডিরুমে তালা মেরে রেখেছে ওটা। হঠাৎ একটা নাম ঝিলিক দিল মনে। ইন্টারকমের সুইচ টিপল আর্থার।

‘মার্টিন কেইডিনকে দাও।’

এক মুহূর্ত পর চীফ প্রেস অ্যাটাচের কণ্ঠ ভেসে এল।

‘মার্টিন, শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড নামে একটা মেয়ে কিছুদিন আগে আমার ইন্টারভ্যু নিতে চেয়েছিল না?’

‘এক মিনিট স্যার,’ চীফ প্রেস অ্যাটাচে দ্রুত তার ফাইল দেখল। তারপর বলল, ‘জ্বী, স্যার। মেয়েটা ড্যাগার, ছোরা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল।’

‘ওকে জানাও আমি ইন্টারভ্যু দেব।’

‘কিন্তু, স্যার। মেয়েটা এমন বিশেষ কেউ নয় যে-’

‘ওর সাথে যোগাযোগ করো।’

‘আপনি যা বলবেন, স্যার।’

চেয়ারে গা এলিয়ে দিল আর্থার। কিছুক্ষণ পর বেজে উঠল ইন্টারকম।

‘কেইডিন বলছি, স্যার। আপনার রিপোর্টারের কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আপনার সাথে যেদিন দেখা করতে চেয়েছিল সেদিন থেকে সে নিখোঁজ।’

‘ওহ্, ক্রাইস্ট,’ বলে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল আর্থার।

‘এনিথিং রং, স্যার।

‘না, ঠিক আছে।’

‘আমি কি ইন্টারভ্যুর বিষয়টা ফাইলে তুলে রাখব? আবার যদি মেয়েটা আসে…’

‘রাখো। তবে আমার মনে হয় না…’ ম্লান, অস্পষ্ট শোনাল আর্থারের কণ্ঠ।

‘স্যার?’

‘হ্যাঁ, ফাইল করো।’

আরও একজন, ভাবল আর্থার। কড় গুনতে লাগল:

রেনল্ডস, সিনথিয়া, ডি কার্লো, ওয়াল্টার, ডুলান আর এখন শ্যারন, এরা প্রায় সবাই মারা গেছে, দু’একজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নিখোঁজ মেয়েটাও মরে গেছে।

বেঁচে আছেন শুধু ডি কার্লো। আর্থারের ধারণা উনি একটা পাগল। সত্যি কি তাই?

আবার ইন্টারকম বেজে উঠল। সেক্রেটারি জানাল স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন এসেছে। ফোন করেছে বিল ওয়ালেস, আর্থারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্টেট ডিপার্টমেন্ট মূলত সে-ই চালায়। পররাষ্ট্র সচিবের মীটিং নিয়ে কথা বলল বিল।

‘চোখ-কান খোলা রাখতে হবে তোমাকে,’ বলল বিল।

‘ওই কাজের জন্যেই আমাকে বেতন দেয়া হয়।’

‘ভাল কথা, আর্থার। দেখলাম আগামী মাসে তুমি ছুটি চেয়েছ। আমি দুঃখিত, ভাই। তবে মনে হয় ছুটিটা তোমার ক্যান্সেল করতে হবে। জানোই তো, সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।’

‘ঠিক আছে। অসুবিধে নেই।’

‘পরের ফল-এ ছুটি নিয়ো।’

‘বললাম তো অসুবিধে নেই।’ ফোন রাখতে যাচ্ছিল আর্থার, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। বিল লোক ভাল। ওকে এরকম অনুরোধ করা যায়।

‘বিল, সরকারী এক কর্মকর্তার নতুন করে কবর খোঁড়া যাবে?’

‘নির্ভর করছে লোকটা কে তার ওপর।’

‘ডেমিয়েন থর্ন।’

‘কি! তোমার হলোটা কি, আর্থার?’

‘থর্নের লাশ কবরে আছে কিনা দেখার উপায় কি বলো?’

‘জেসাস, আর্থার।’

‘জানি পাগলের মত শোনাচ্ছে কথাগুলো। কিন্তু কাজটা করা সম্ভব?’

‘জানি না।’

‘তুমি পারবে কি না বলো।’

‘পারব হয়তো। কিন্তু কেন বলো তো?’

‘বলতে পারি যদি কথা দাও কথাটা গোপন রাখবে।’

কলেজ জীবনের মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল দুই বন্ধু। হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিল আর্থার। এখন ভাল লাগতে শুরু করেছে ওর। যেন কারও বোঝার খানিকটা ভার বইতে পেরে সন্তুষ্ট।

ওয়াশিংটনে, বিল ওয়ালেস তার সেক্রেটারিকে ডেকে বলল, ‘থর্ন কর্পোরেশনে ফোন লাগাও। জলদি।’

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১১

এগারো

মাঝরাতে পেরিফোর্ডে এসে পৌছল পল বুহের। লিমোজিনের দরজা খুলে নামল। দোরগোড়ায় বাটলার টম, আগের মত হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

‘কেমন আছ, টম?’ কোটটা তার হাতে তুলে দিল বুহের।

‘ভাল, স্যার।’ জবাব দিল টম। তবে চেহারা দেখে মনে হলো না ভাল আছে।

‘সত্যি ভাল আছ?’

‘অবশ্যই, স্যার।’ টমের চেহারা সামান্য লালচে হয়ে উঠল, বুহেরকে নিয়ে গেল ড্রইংরুমে। ‘উনি চলে আসবেন এখুনি।’

‘এখনও জেগে আছে?’

‘জ্বী। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’ চলে গেল টম।

সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে চোখ বুজল পল বুহের। উড়োজাহাজ ভ্রমণ ওকে বরাবরই ক্লান্ত করে দেয়। আর আটলান্টিক পার হতে সময়ও লাগে প্রচুর। তবু এতদূর ছুটে এসেছে ছেলেটাকে মীটিং-এর রিপোর্ট দিতে।

চোখ মেলল বুহের। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে পাশে, কৌতূহলী চোখে দেখছে তাকে।

‘আপনাকে বিধ্বস্ত লাগছে,’ বলল ছেলেটা।

‘বয়স, বন্ধু, সবাইকেই শেষ পর্যন্ত কাবু করে ফেলে।’

‘হুম,’ বুহেরের মন্তব্যকে সমর্থন করল কিনা বোঝা গেল না।

‘মীটিং নিয়ে কথা বলতে পারবেন নাকি…’

‘অবশ্যই পারব,’ উঠে বসল বুহের, ব্রীফকেস খুলে একতাড়া কাগজ ধরিয়ে দিল ছেলেটাকে। মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট পড়ল সে, তারপর তাকাল বুহেরের দিকে।

‘ইহুদ বারাক তাহলে সমঝোতায় আসতে চাইছে না?’

মাথা ঝাঁকাল বহের।

‘তার মানে মীটিং স্থগিত?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু এতে তো আমাদের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হবে না।’ স্পষ্ট বিরক্তি ছেলেটির কণ্ঠে।

‘মানে?’ বিস্মিত দেখাল বুহেরকে। ‘আমরা তো এটাই চাই। বরাবর এরকম কৌশলই আমরা অবলম্বন করে চলেছি। ডিভাইড অ্যান্ড রুল। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অচলাবস্থা তৈরি করো এবং আবার বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করো। এভাবে আমরা আমাদের অবস্থান-’

‘কিন্তু এটাকে অগ্রগতি বলে না,’ তীক্ষ্ণ শোনাল ছেলেটার কণ্ঠ।

‘কিসের অগ্রগতি?’ ক্রুদ্ধ গলায় বলল বুহের।

‘ধ্বংসের পথে, রুহেরের মুখের ওপর কাগজের তাড়াটা ছুঁড়ে মারল ছেলেটা, ঘুরে দাঁড়াল, বেরিয়ে গেল হনহন করে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুহের। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। ছেলেটার বাবা কখনও এমন হেঁয়ালি করে কথা বলত না। তার সাথে কাজ করে মজা ছিল।

.

রাতে ভাল ঘুম হয়নি। আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছে বুহের। বিছানা থেকে নেমে সোজা বাথরুমে ঢুকল। গোসল করল। চোখ এখনও ফুলে আছে। হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে।

ছেলেটার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় টোকা দিল দরজায়। কোন সাড়া নেই। এমনকি কুকুরটার নিশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। দরজা খুলল বুহের, উঁকি দিল। ছেলেটা রাতে ঘুমিয়েছে বিছানায় বোঝা গেল। বেডশীট কোঁচকানো, বালিশ মেঝের ওপর। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে, এমন সময় ছবিগুলো চোখে পড়ল বুহেরের। ভুরু কুঁচকে তাকাল ওদিকে। ছবিগুলো নতুন। অন্যরকম। ভেতরে ঢুকল সে। কেট রেনল্ডসের কবরের ছবির পাশে নতুন, রঙিন ছবিগুলো। প্রথমটাতে দেখা যাচ্ছে তরুণী এক মেয়ে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে চ্যাপেলে, বড় বড় বাদামী চোখে মৃত মানুষের শূন্য দৃষ্টি। পরের ছবিটা ভয়ঙ্কর। মেয়েটাকে টুকরো করে ফেলা হচ্ছে। তারপরেরগুলোতে মেয়েটার কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা গেল।

দেয়ালে হেলান দিল বুহের, কাঁপছে। হাত বাড়িয়ে, ছবিগুলো ছুটিয়ে আনল, ফেলে দিল মেঝেতে। তারপর টলতে টলতে বেরিয়ে এল, বমি ঠেকিয়ে রাখতে ঢোক গিলল।

দরজা বুজিয়ে দিল বুহের, করিডর ধরে এগোল। নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চ্যাপেলের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল কুকুরটা, ওকে দেখে মুখ তুলে চাইল। দরজায় টোকা দিল বুহের। সাড়া নেই। আস্তে দরজা খুলল সে, ভেতরে ঢুকল। ছেলেটা চেয়ে আছে তার দিকে রাগ নিয়ে। ঘাম গড়াচ্ছে মুখ বেয়ে।

ভয় পাচ্ছিল বুহের এ ঘরে ঢুকে ভয়ানক কিছু একটা দেখতে হবে ভেবে। কিন্তু অশ্লীল বা বীভৎস কোন দৃশ্য চোখে পড়ল না।

‘পল,’ কুকুরটার মত ঘেউ করে উঠল ছেলেটা।

প্রভুভক্ত ভৃত্যের মত পিছিয়ে যেতে শুরু করল বুহের।

‘চলে যান।’

তাই করল বুহের। বেরিয়ে এল সে। বন্ধ করে দিল দরজা।

ড্রইংরুমে এসে গ্লাসে মদ ঢালল পল বুহের। ঢকঢক করে গিলে ফেলল। তারপর বেল বাজাল। বুড়ো টম ঢুকল ঘরে, মাথাটা একদিকে হেলিয়ে আছে, স্প্যানিয়েলের মত।

‘এখানে কেউ এসেছিল, টম? কোন তরুণী মেয়ে?’

ইতস্তত করছে বুড়ো জবাব দিতে। তারপর বলল, ‘একটা গাড়ি, স্যার। ছোট সাহেব বললেন গাড়িটা কোথাও ফেলে দিয়ে আসতে। আমি তাই করেছি। তবে আমার মনে হয় গাড়িটা কোন মেয়ের হবে।’

‘আমাকে কথাটা বলোনি কেন? অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে আমাকে জানাবার কথা, না?’

‘ছোট সাহেব আমাকে নিষেধ করেছিলেন বলতে। বলেছিলেন তাঁর হুকুম মেনে চলেছি কিনা তিনি তা ঠিক জেনে যাবেন।’ বিরতি দিল বুড়ো। তারপর ‘কি আর করা ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আপনাকে যে কথাটা বলেছি উনি ঠিক জেনে যাবেন। কারণ ওনার কাছে কিছুই গোপন থাকে না।’

‘তবে,’ হাসল সে বুহেরের দিকে তাকিয়ে। ‘আমি বেশিদিন আর বাঁচব না। সব সময় বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে এসেছি। এটুকু আশা অন্তত করতে পারি এজন্যে কঠিন কোন শাস্তি তিনি আমাকে দেবেন না।

বুহেরও হাসল। ‘আমারও তাই ধারণা।’

অপেক্ষা করছে বুহের ছেলেটার জন্যে। তাকিয়ে আছে লন আর জঙ্গলের দিকে। জায়গাটা আশ্চর্য শান্ত। স্থির। কিছু নড়ছে না। এমনকি বাতাসও থম্ মেরে আছে। এখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না বুহেরের। চলে যেতে ইচ্ছে করছে।

নিজের ভাবনায় বুঁদ ছিল বলে টের পায়নি কখন ছেলেটা ঘরে ঢুকেছে। বুহেরের নাম ধরে ডাকল ছেলেটা। ঘুরল বুহের। ছেলেটার চোখ থেকে বুনো চাউনি অদৃশ্য তবে চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

‘তুমি অসুস্থ নাকি?’ জিজ্ঞেস করল বুহের।

মাথা নাড়ল ছেলেটা। ‘না। আমি তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি সবখানে। তার প্রভাব। তার শক্তি। চেয়ারে বসল সে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুহের ভাবল দু’একটা সান্ত্বনা বাক্য শোনাবে ছেলেটাকে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। বলল, ‘ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে।’

ছেলেটা তাকাল তার দিকে।

‘ফ্রেডরিক আর্থারের কথা বোধহয় তোমাকে বলেছি। মনে হচ্ছে সে-’

‘ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না,’ মৃদু গলায় বলল ছেলেটা। ‘সে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে।’

সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল বুহের। ব্যাপারটা আগেই বোঝা উচিত ছিল। যখনই বিপদে পড়েছে বুহের, ছেলেটা আগে ভাগে জেনে গেছে এবং বুহেরকে রক্ষা ‘ করেছে।

‘ভাল কথা,’ বলল বুহের। ‘মেয়েটা কে? তোমার ঘরের দেয়ালে যার ছবি দেখলাম?’

শ্রাগ করল ছেলেটা। ‘সে ওকে পাঠিয়েছিল। ছলনাময়ী।’

‘লাশটার কি করেছ? বাকি অংশ?’

‘কাটা ছেঁড়া করেছি,’ হাসছে ছেলেটা। ‘তারপর ফেলে দিয়েছি।’ বংশগত অভ্যাস।

রাগে তালু জ্বলে গেল পল বুহেরের। মুঠো পাকিয়ে উঠে দাঁড়াল, গনগনে চোখে তাকাল ছেলেটার দিকে।

‘অন্যায় করেছ,’ বলল সে। ‘এটা…এটা…’ শব্দ হাতড়ে বেড়াল বুহের। ….এতে তোমার বাবার প্রতি অসম্মান করা হয়েছে। তোমার বাবা এত নিচে নামতে পারতেন না, এভাবে নিজের হাত নোংরা করতেন না।’ লাল টকটকে হয়ে গেছে বুহেরের চেহারা। ‘তোমার বাবা-’

ঝট করে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। ‘খবরদার।’ ধাক্কা মারল সে বুহেরকে, পড়ে গেল বুহের সোফার ওপর। ‘আমার কাছে আমার বাবা সম্পর্কে কোন কথা বলতে আসবেন না।’

‘তিনি কক্ষনো এমন কাজ করতে পারতেন না,’ বুহেরের রাগ কমেনি। ‘যা কিছু তিনি করেছেন প্রতিটির পেছনে কারণ ছিল। ছিল শৃঙ্খলা। তুমি ধ্বংসের কথা বলো। তোমার বাবা বলতেন নিয়ন্ত্রণ করার কথা। তিনি চেয়েছিলেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এনে…’

 

 

‘যথেষ্ট হয়েছে,’ দাবড়ে উঠল ছেলেটা। ‘এখন চুপ করুন। আমি ধ্বংস চাই। আর ধ্বংসের মাঝে আছে প্রতিশোধ নেয়ার সুখ।’ হাসল সে। তারপর বেরিয়ে গেল গটগট করে।

ছেলেটার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল বুহের। তারপর হলঘরে ঢুকল, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দোতলায়। ছেলেটার ঘরের সামনে দিয়ে পা টিপে টিপে এগোল। ছেলেটা ঘরেই আছে, কুকুরটার গায়ের গন্ধও পেল বুহের করিডর পার হয়ে চ্যাপেলে ঢুকল সে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ, তারপর লাশটার দিকে পা বাড়াল।

হাঁটু গেড়ে বসল বুহের লাশের সামনে, হাত ধরল। মনে পড়ে গেল স্কুল জীবনের কথা। এক সাথে কত খেলা করেছে দু’জনে। ‘ডেমিয়েন,’ ফিসফিস করল সে। ‘তোমার দলে যোগ দিয়েছিলাম তোমার পিতার রাজ্যে প্রবেশ করার জন্যে। আমি এতদিন বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে এসেছি। তোমার শরীরী জীবন ধ্বংস হলেও তোমার আত্মার উদ্দেশে যতবার প্রার্থনা করেছি, ততবার তুমি সাড়া দিয়েছ। বলেছ হতাশ না হতে। কারণ, তোমার সময় এখনও আসেনি। আমার প্রার্থনার জবাব দিয়েছ তুমি। বলেছ তোমার পুনর্জন্মের ওপর বিশ্বাস রাখতে। আবার তোমার পাশে বসার সৌভাগ্য হবে আমার, বলেছ তুমি।

‘তুমি আবার বলো, আমরা যা করেছি সব নিয়ন্ত্রণের জন্যে, ধ্বংসের জন্যে নয়। বলো ডেমিয়েন?’

লাশটাকে কুর্নিশ করল বুহের, হাঁটু গেড়ে চুপচাপ বসে রইল, যেন নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ মুখ তুলে চাইল। একটা আলোক রেখা এসে পড়েছে ডেমিয়েনের মুখে, চোখ দুটো মনে হলো ফিরে পেয়েছে জীবন। চোখ পিটপিট করল বুহের। তারপর সচকিত হয়ে উঠল মৃদু গরগর শুনে। ঘুরল। আলোটা এসেছে খোলা দরজা দিয়ে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, সাথে তার কুকুর। কটমট করে তাকিয়ে রইল সে বুহেরের দিকে।

‘এখানে কি করছেন?’ কণ্ঠ শান্ত আর আবেগশূন্য শোনাল।

‘পথ নির্দেশ খুঁজছি।’

‘অন্য কোথাও খুঁজুন গিয়ে। আমার বাবাকে একা থাকতে দিন।’

উঠে দাঁড়াল বুহের, হাঁটু কাঁপছে। ছেলেটা একপাশে সরে দাঁড়াল ওকে যাবার রাস্তা করে দিয়ে। যে পথে এসেছে সে দিকে ধীরে ধীরে এগোল বুহের। নিজেকে হতবুদ্ধি, পরাজিত এবং অশীতিপর বৃদ্ধ মনে হলো তার।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১২

বারো

শত শত, হাজারে হাজারে দল বেঁধে ওরা এল র‍্যালিতে যোগ দিতে। লন্ডনের পুব থেকে পশ্চিমে স্লোন স্কোয়ার পর্যন্ত জ্যাম বেঁধে গেল। অক্সফোর্ড স্ট্রীটের দক্ষিণ থেকে এমব্যাঙ্কমেন্ট এবং সবগুলোর কেন্দ্র বিন্দু, ট্রাফালগার স্কোয়ারে সব যেন স্থির হয়ে রইল। জনসভায় যোগ দিতে কত লোক এসেছে প্রেস এবং মিডিয়া দু’পক্ষই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষের মাথা। স্কোয়ারের দিকে এগোচ্ছে সবাই, প্রতি মিনিটে বেড়ে চলেছে লোকসংখ্যা। ঘোড়ার পিঠে এবং রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পুলিশ নীরবে দেখছে তাদেরকে।

বক্তৃতা শুরু হবার কথা দুপুর তিনটায়। কিন্তু দেড়টার সময়ই পিমলিবোতে পল বুহেরের লিমোজিন জ্যামে আটকা পড়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পিঁপড়ের মত পিলপিল করে লোকজন তাদের গন্তব্যে চলেছে। বেশিরভাগের পরনে কঙ্কালের ছবি আঁকা আলখেল্লা, অনেকে কাফনও পরে আছে।

বুহের কনসোলের একটা বোতাম টিপল।

‘কি ব্যাপার?’

ভেসে এল ড্রাইভারের কণ্ঠ, ‘জ্যাম, স্যার। পুলিশ বলছে এখান থেকে আর গাড়ি যাবে না।’

‘ধ্যাত্তেরি, বেজায় বিরক্ত হলো বুহের। বেশি রাগ লাগছে ছেলেটার ওপর। ওর জন্যেই এই র‍্যালিতে আসা। মাঝে মাঝে কি যে বাই চাপে ছেলেটার মাথায়। অথচ ব্যাপারটা তাকে মানায় না। খুব কম ব্যাপারেই সে কৌতূহল প্রকাশ করে।

‘চলুন, নেমে পড়ি,’ বলল ছেলেটা।

 

 

‘কিন্তু অনেকটা পথ হাঁটতে হবে,’ আপত্তি জানাল বুহের।

ছেলেটা কিছু না বলে দরজা খুলে নেমে পড়ল। তার পিছু পিছু কুকুরটাও। অগত্যা বুহেরকেও উঠতে হলো। নামার আগে ড্রাইভারকে বলল কোথায় গাড়ি পার্ক করতে হবে। ওখানে থাকবে ওরা।

ভিড়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল ওরা। একটা জার্মান শেফার্ড ওদের আগে আগে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, ছেলেটা আর কুকুরটাকে দেখে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চাউনি, দ্রুত ফুটপাথে উঠে পড়ল সে, কান দুটো সেঁটে গেছে মাথার সাথে।

খুব গরম পড়েছে। ঘামছে জনতা। ঘামের গন্ধে নাক কোঁচকাল ছেলেটা কুকুরটার মাথায় আলতো হাত রাখল। বুহের ওদের ঠিক পেছনে। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। হোয়াইট হল-এ মীটিং শুরু হবার কথা এখন। তার কর্মচারীরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবে হেডকোয়ার্টারে। তার অফিসে থাকা দরকার ছিল। এ সব গোঁয়ার্তুমির কোন মানে হয় না। মুখ অন্ধকার করে সে ছেলেটার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। ভিক্টোরিয়া পার হয়ে, মল ধরে ট্রাফালগার স্কোয়ারের কাছাকাছি এসে পড়ল ওরা। লাউড স্পিকারের কর্কশ আওয়াজ আর জনতার চেঁচামেচি শোনা গেল পরিষ্কার। মাথার ওপর পুলিশের হেলিকপ্টার উড়ছে। রোটর ব্লেডের গর্জনে জনতার চিৎকার চাপা পড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

স্কোয়ারে পৌছে দেখল জনতা গাদাগাদি করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা তার কুকুর সঙ্গীকে নিয়ে ভিড় ঠেলে এগুতে লাগল। অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করল। তবে কুকুরটাকে দেখে কেউ কেউ আড়ষ্ট হয়ে গেল। এক লোক রাস্তা ছাড়ছিল না বলে কুকুরটা বিরাট মাথা দিয়ে তাকে ঢুস দিল। রেগেমেগে কিছু বলার জন্যে নিচে তাকিয়েছে লোকটা, তাকে লক্ষ্য করে দাঁত মুখ খিঁচাল কুকুর। সভয়ে একপাশে সরে গেল লোকটা। নেলসন্স কলামের নিচে এসে দাঁড়াল তিনজনের দলটা। পাথরের একটা সিংহাসনের পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিল। তাকাল দশ গজ দূরের প্ল্যাটফর্মের দিকে। মাটি থেকে অন্তত বিশ ফুট উঁচুতে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। প্ল্যাটফর্মের দু’পাশে, পনেরো ফুট উচ্চতায় দুটি ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন, ক্লোজ- আপে ধরে রেখেছে এক তরুণ, জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের মুখ। রাজনীতিবিদটি এ আন্দোলনের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠাতার দৌহিত্র। তার কণ্ঠ স্পিকারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা স্কোয়ারে।

‘বন, প্যারিস, হেগ, রোম, দিল্লী, ঢাকা সহ আরও অনেক শহরে এই আন্দোলন একই সাথে সূচিত হতে চলেছে।’

জনতা সায় দিল তার কথায় গর্জে উঠে

‘আর পাঁচ ঘণ্টা পর ওয়াশিংটনের উদ্দেশে একটি মার্চ শুরু হবে। কাল পালা দূর প্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার। মস্কো, প্রাগ, বুদাপেস্ট এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আমাদের অন্যান্য বন্ধুরা আমাদের প্রচেষ্টার কথা জানতে পারবে এবং উৎসাহিত হয়ে উঠবে তাদের সংগ্রামে শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে…

হাই তুলল বুহের।

‘এবার,’ বলল তরুণ রাজনীতিবিদ, ‘আসছেন জ্যাক বিকহ্যাম।’

জনতার উল্লসিত চিৎকারে কানে তালা লেগে গেল। কানে হাত চাপা দিল বুহের, তাকাল ছেলেটার দিকে। সে নেলসন্স কলামের সিঁড়ির ওপর উঠে বসেছে। চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে, কাউকে খুঁজছে বোধহয়। চঞ্চল দৃষ্টি স্থির হলো সাদা চুলো, লম্বা, রোগা এক লোকের ওপর। হেঁটে যাচ্ছেন প্ল্যাটফর্মে, তাঁকে নিয়ে আসছে সোনালি রঙের একটা ল্যাব্রাডর। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুকুরটা, যেন সুতোয় বেঁধে টেনে আনা হয়েছে তাকে। তারপর তাকাল বুড়ো লোকটির দিকে। নাক দিয়ে ধাক্কা মারল হাতে; বুড়োকে বুঝিয়ে দিল মাইকের অবস্থান। তিনি দু’হাত তুললেন জনতার উদ্দেশে, তাঁর বাম হাতে বাঁধা কুকুরটার বেল্ট।

ভিড়ের ওপর নজর বোলাল বুহের। হাততালি দিচ্ছে জনতা, চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ কেউ শিসও দিল। ডেমিয়েন থর্নের কথা মনে পড়ল বুহেরের। নিজের শিষ্যদের ওপর এরকম প্রভাব ছিল তার। তবে পার্থক্য একটাই- তার শিষ্যরা ছিল এদের চেয়ে সৎ। এই লোকগুলো জ্যাক বিকহ্যামের জন্যে জীবন দিতে পারবে? তারচে’ও বড় কথা তারা তাদের নেতার জন্যে মানুষ খুন করতে পারবে? বুহেরের সন্দেহ হলো পারবে না।

পর্দায় বুড়ো লোকটার চেহারা ফুটে উঠল। চোখে গাঢ় রঙের চশমা। মানুষটা অন্ধ। ল্যাব্রাডরটা তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জ্যাক বিকহ্যামকে বলা হয় বারট্রান্ড রাসেলের যোগ্য উত্তরসুরি। তিনি একজন দার্শনিক, একজন মানবতাবাদী, রাজনীতিবিদদের চেয়ে তাঁর জ্ঞান প্রখর, অসাধারণ বাগ্মীতার কারণে বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিক শ্রেণীকে একই ছাতের তলায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে।

আবার ছেলেটার দিকে ফিরল বুহের। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জ্যাক বিকহ্যামের দিকে। পাথুরে স্তম্ভের ওপর বসে কুকুরটাও সম্মোহিতের মত চেয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মের দিকে।

জ্যাক বিকহ্যাম হাত নামালেন। সাথে সাথে থেমে গেল জনতার চেঁচামেচি, যেন হঠাৎ সুইচ অফ করে দেয়া হয়েছে। গলা খাঁকারি দিলেন তিনি, বজ্রের মত শোনাল শব্দটা। ল্যাব্রাডর কান খাড়া করে তাকাল প্রভুর দিকে, যেন সব ঠিক আছে কি না দেখছে।

‘বন্ধুগণ,’ বৃদ্ধের কণ্ঠ গভীর এবং জোরাল। শুনেছি আজকের মত জন সমাবেশ এই শহরে আগে কোনদিন হয়নি।

জনতা আবার চিৎকার করে তাঁকে সায় দিতে যাচ্ছিল, এক হাত তুলে তাদেরকে থামালেন বিকহ্যাম।

‘এক, মহান ব্যক্তি, সাংবাদিক মেন্ডাল জনসন, যিনি আমাদের আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের মত একটি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলেছিলেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, অক্সফ্যাম বলে কোন কিছুর যেন অস্তিত্ব না থাকে।’ বিরতি দিলেন তিনি। তারপর শুরু করলেন, ‘আমিও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি তুলে বলতে চাই, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনের যেন আর প্রয়োজন না হয়, ঈশ্বর।’

সাগরের ঢেউ’র মত গর্জন উঠল এবার, থামতেই চায় না। বিকহ্যাম ডান থেকে বামে একবার মাথা ঘোরালেন, যেন জনতার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছেন।

আবার একটা হাত তুললেন তিনি। আবার নীরব হয়ে গেল জনতা।

‘আজ বিকেলে, অনুমান করি প্রায় এক মাইল লম্বা লাইন সৃষ্টি হয়েছে আপনাদের আগমনে। আপনারা এসেছেন এমন একটি সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যেটি গত পঞ্চাশ বছর ধরে গোটা বিশ্বে হুমকির সৃষ্টি করে চলেছে। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দিন কাগজে-কলমে শেষ হলেও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কিন্তু থেমে নেই। অর্ধেক পৃথিবী আজও যুদ্ধের উন্মাদনায় অস্থির। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা, আমাদের সামরিক শাসকরা তা দেখেও না দেখার ভান করছেন। আমরা রাজনীতির নামে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সন্ত্রাস এবং ভণ্ডামি চাই না। আমরা চাই সারল্য, জবাবদিহিতা। দলগত রাজনীতির এখন কোন প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন নিজেদেরকে, বিশ্ব মানবতাকে বাঁচানোর প্রশ্নে একত্র হওয়া। আমরা চাই অস্ত্র মুক্ত, হানাহানি মুক্ত একটি বিশ্ব।

পুরো এক মিনিট হাততালি চলল। বুহের তার বাম পাশে দাঁড়ানো পুলিশদের জনতার সাথে তাল মিলিয়ে হাততালি দিতে দেখে অবাক হলো।

‘একটা পতিত জমির জন্যে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের কি মানে আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন বিকহ্যাম।

‘কোন মানে নেই,’ গর্জে উঠল জনতা।

‘যে গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার জন্যে বিকল্প সমাজ ব্যবস্থার কথা বলার কতটুকু দরকার আছে?’

আবার গর্জে উঠল জনতা: কোন দরকার নেই।

বুড়ো মানুষটি দুই হাত ওপরে তুললেন, গলার বেল্টে টান পড়ায় উঠে দাঁড়াল কুকুরটা।

‘আপনারা অনেকেই জানেন,’ বললেন বিকহ্যাম, ‘আমি ধর্মভীরু নই। তবু টিমোথিকে বলা পলের দ্বিতীয় চিঠি থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃতি করে শোনাচ্ছি,’ আবার গলা খাঁকারি দিলেন তিনি। কুকুরটা তাকাল ভিড়ের দিকে, একটা থাবা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে আঁচড় কাটছে।

বুহের লক্ষ করল ছেলেটা এবার ল্যাব্রাডরটার দিকে নজর ফিরিয়েছে, চোখের পলক পড়ছে না।

‘কেয়ামতের দিন,’ শুরু করলেন বিকহ্যাম, ‘ভয়ঙ্কর এক সময় উপস্থিত হইবে। মানুষ হইয়া উঠিবে অহঙ্কারী, অর্থ লোলুপ, ঈশ্বর-নিন্দুক, অকৃতজ্ঞ, পিতা-মাতার অবাধ্য, অপবিত্র, আত্মসংযমহীন, অসচ্চরিত্র, দয়া-মায়াহীন, শাস্তি ভঙ্গকারী, ক্রোধোন্মত্ত, বিশ্বাসঘাতক, সমস্ত ভালর নিন্দাকারী।’

ল্যাব্রাডর এবার পেছনের পায়ে ভর করে দাঁড়াল, সামনের থাবা দুটো আড়াআড়ি রাখল মুখের ওপর, নাক উঁচু করে বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুঁকল। বুহেরের মনে হলো ওটা সরাসরি ছেলেটার দিকে তাকাল।

‘আমি আপনাদের আহ্বান করছি যাদের মনে বিশ্বাস আছে তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন,’ বললেন বিকহ্যাম। ‘আর যাদের বিশ্বাস নেই তারা নিজেদের বিবেক ও বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা রাখুন।’

পলকহীন চোখে ল্যাব্রাডরের দিকে চেয়ে আছে ছেলেটা। প্ল্যাটফর্মে আঁচড় কাটছে ওটা, মুখ বেয়ে লালা পড়ছে। পর্দায় দেখতে পাচ্ছে ওটাকে জনতা।

‘আমার থীম,’ বলে চললেন বৃদ্ধ, ‘নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে…’

লাফ দিল ল্যাব্রাডর, প্রভুর মুখে কামড় বসাল। হোঁচট খেয়ে পেছন দিকে হেলে গেলেন তিনি, মাইক্রোফোনের তার বেঁধে গেল পায়ে, তাঁর পতন-চিৎকার অ্যামপ্লিফায়ারে প্রতিধ্বনি তুলল স্কোয়ারে। কেউ এক চুল নড়ছে না। প্ল্যাটফর্মের পাশে দাঁড়ানো ভলান্টিয়াররা যে যার জায়গায় জমে গেল, নড়তে ভুলে গেছে।

পিছিয়ে এল কুকুরটা, বিকহ্যাম টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন, কুকুর-বাঁধা রশি বা বেল্টটা এখনও তাঁর কব্জিতে বাঁধা।

‘ওহ্, মাই গড,’ ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি, গোঙানির শব্দ ছড়িয়ে পড়ল জনারণ্যে। এক হাতে মুখ চাপা দিলেন বিকহ্যাম। কাছের লোকজন পরিষ্কার দেখতে পেল তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। টেলিভিশন পরিচালক চট করে ক্লোজ-আপে ধরল মুখটা, জনতা বিকহ্যামের রক্তাক্ত চেহারা পর্দায় দেখে শিউরে উঠল। চশমাটা ঝুলে আছে এক কানের ওপর, চোখের শূন্য কোটর রক্তাক্ত হাতে চেপে ধরে আছেন তিনি। ভলান্টিয়াররা এবার ছুটল তাঁর দিকে; কুকুরটা ঘুরে দেখল তাদেরকে, তারপর ফিরল ভিড়ের দিকে, এগোল প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায়, বুড়ো মানুষটাকে পেছনে টানতে টানতে।

কুকুরটার মতলব বুঝতে পেরে চিৎকার দিল এক মহিলা। ঠিক সেই সময় শূন্যে লাফ দিল ল্যাব্রাডর জ্যাক বিকহ্যামকে নিয়ে। বাতাস খামচালেন বৃদ্ধ বৃথা অবলম্বনের আশায়। ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন, ক্যামেরা অনুসরণ করল তাঁকে, মাইক্রোফোনে ধরা পড়ল তাঁর অন্তিম চিৎকার, সাউন্ড সিস্টেম নিখুঁতভাবে কাজ করল, বিশ ফুট নিচে কুকুরটা ছিটকে পড়ল; তার হাড় ভাঙার আওয়াজ সেই সাথে জ্যাক বিকহ্যামের খুলি ফেটে যাবার শব্দও স্পষ্ট শোনা গেল। তাঁর মরণ আর্তনাদ শুনে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল সবার।

ছুটে আসা ভলান্টিয়ারদের চিৎকারও শোনা গেল মাইক্রোফোনে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত জনতার বিড়বিড়ানিও পরিষ্কার তুলে ধরল মাইক্রোফোন। ওটার তার প্ল্যাটফর্মের মাথায় ঝুলে আছে।

সবার আগে প্রতিক্রিয়া ঘটল ছেলেটার মধ্যে। ঘুরল সে, তাকাল ত্রিশ গজ দূরে চেস্টনাট পুলিশ-ঘোড়ার দিকে। ওদিকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে মোট দশজন অশ্বারোহী পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল হোয়াইট হল-এ যাবার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে। মাথা ঘোরাল ঘোড়া, আরোহী তার আকস্মিক চাঞ্চল্যে অবাক হলো। বলগা ধরে টান দিল সে। কিন্তু ঘোড়াটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়েই থাকল ছেলেটার দিকে। ওটার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, ঠোঁট কাঁপছে, বেরিয়ে পড়ল দাঁত, মৃদু গোঙানি বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। শব্দ শুনে অন্য ঘোড়াগুলো ফিরল তার দিকে। তারপর দৃষ্টি অনুসরণ করে নেলসন’স কলামে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে তাকাল এক সাথে।

প্রকাণ্ড ঘোড়াটা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে, শুধু চোখ জোড়া বিস্ফোরিত হলো আতঙ্কে, তারপর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হলো, ঝাঁকি খেল মাথা, পরক্ষণে সবেগে সামনের দিকে ছুটল দলের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে। ঝাঁকির চোটে তিন পুলিশ পড়ে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে, অন্যরা কোনমতে ঝুলে রইল বলগা ধরে। বলগায় টান মেরেও ঘোড়াগুলোকে থামাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো তারা। ব্যানার হাতে এক তরুণ দম্পতি হঠাৎ খেপে ওঠা ঘোড়াদের শিকার হলো প্রথমে। বিশালদেহী চেস্টনাটের খুরের নিচে পড়ে নিমিষে রক্তাক্ত হয়ে গেল তারা। তাদের আর্তনাদ শোনা গেল অ্যামপ্লিফায়ারে।

আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো ভিড়ের মাঝে আরও সেঁধিয়ে গেল। বাকিগুলো ভয়ে এবং মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে আক্ষরিক অর্থেই উন্মাদ হয়ে উঠল। কলামের সাথে সেঁটে গেল বুহের একটা ঘোড়াকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে। ওটার পায়ের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে পুরুষ আর নারীরা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়াটা, ঘুরল, এক লাফে পার হলো একটা ব্যারিয়ার, ছুটল এক দল তরুণকে লক্ষ্য করে। চারটে খুরের আওয়াজ যেন বুলেটের শব্দ তুলল কংক্রিটের রাস্তায়।

ঘোড়াগুলোর হামলায় দিশেহারা লোকজন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। ধাক্কাধাক্কিতে অনেকেই ছিটকে পড়ছে রাস্তার ওপর, তাদেরকে পায়ে মাড়িয়ে অন্যরা ছুটছে। চিৎকার-চেঁচামেচি-কান্নায় নরক হয়ে উঠল জায়গাটা। বুহের দেখল একটা ঘোড়া তার আরোহীকে পিঠ ঝাঁকিয়ে দড়াম করে ফেলে দিল। কাঁধে কার যেন হাতের কঠিন চাপ অনুভব করে ঘুরল সে। ছেলেটা। তার কাঁধে হাত রেখে নারকীয় দৃশ্যটা দেখছে। জ্বলজ্বল করছে চোখ, জিভ বোলাচ্ছে ঠোঁটে।

ক্যামেরা আগের মতই কাজ করে চলেছে। বিশাল পর্দায় রাস্তার নারকীয় দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, দেখল বুহের। বাচ্চাটাকে দু’হাতে শূন্যে তুলে ধরল সে। ঠিক তখন একটা ঘোড়া ছুটে এসে বাচ্চা এবং তার মাকে শক্ত খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেল। বুহের শুনল ছেলেটা চাপা উল্লাসে বিড়বিড় করছে, বিশুদ্ধ নৈরাজ্য নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে।

শিউরে উঠল বুহের, পাথরের সিংহের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

লোকজনের চিৎকার আর আর্তনাদ ক্রমে চড়া হয়ে উঠল, তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল। যেন কেউ পর্দায় ফ্রিজ করে দিয়েছে দৃশ্যটা, নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। স্কোয়ারের দক্ষিণ-পুব কোণে, হোয়াইট হলের সেফটি ব্যারিয়ার ভেঙে সবাই ওদিকে সরে গেছে, পেছনে ফেলে রেখে গেছে আহতদের। স্কোয়ার প্রায় ফাঁকা। শুধু নিহতদের লাশ আর আহতরা পড়ে আছে রাস্তায়। তারা যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে, কাঁদছে।

কলাম বা খিলানের নিচ থেকে বেরিয়ে এল পল বুহের। তার সামনে, কয়েক গজ দূরে একটা ঘোড়া মরে পড়ে আছে, নিচে তার আরোহীর বিধ্বস্ত লাশ।

পাথরের সিংহগুলোর একটার বেদির নিচে স্তূপ হয়ে আছে আরও কতগুলো লাশ। ছুটন্ত মানুষের পায়ের নিচে পড়ে ভর্তা হয়ে গেছে তারা। ইতিমধ্যে এসে . পড়েছে অ্যাম্বুলেন্স। তারা লাশ সরাচ্ছে, গাড়িতে তুলছে আহতদের। সাংবাদিকরা ছবি তুলছেন।

কঙ্কালের জামা পরা এক তরুণকে দেখা গেল নিশ্চল পড়ে আছে। বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে গেছে তার। আরেকটা ঘোড়া একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল লাশের দঙ্গলের মাঝে। আহতরা ঘোড়াটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ভয়ের চোটে কান্না থেমে গেল অনেকের।

ছেলেটা খিলান থেকে লাফিয়ে নামল। বুহেরের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের গাড়ি কোথায় থাকবে?’

মাথা নাড়ল বুহের। মনে করতে পারছে না।

ছেলেটা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল একগাদা লাশের পাশে, কুকুরটা তার সাথেই আছে, নাক উঁচু করে বাতাস টানল, তারপর ঘুরে দেখল বুহেরকে।

‘বেচারা শান্তি রক্ষাকারীদের আত্মা শান্তি পাক,’ মুচকি হাসল ছেলেটা। তারপর বুহেরের হাত ধরে ভিড়ের মাঝ থেকে পথ করে হাঁটা শুরু করল।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৩

তেরো

জ্যাক বিকহ্যামের মৃত্যুর খবর শুনে মর্মাহত হলো ফ্রেডরিক আর্থার। বিকেলেই খবরটা পেয়েছে সে। আটত্রিশ জন মারা গেছে, শতাধিক আহত।

জ্যাক বিকহ্যামকে পছন্দ করত আর্থার। স্কুলে পড়ার সময় থেকে সে এ লোকটির ভক্ত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোকটির প্রতি শ্রদ্ধাও বেড়ে যাচ্ছিল আর্থারের। অনেকেই বিকহ্যামের সমালোচনা করত। দু’বার মানুষটার সাথে দেখা হয়েছে আর্থারের। তাঁর রসবোধ এবং বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান মুগ্ধ করেছে তাকে। অনেকে বিকহ্যামকে সোভিয়েত চর বলতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে এক চুল নড়াতে পারেনি। আর্থারের কাছে বিকহ্যাম ছিলেন সন্ন্যাসীর মত। সূক্ষ্ম রসবোধ সম্পন্ন মজার মানুষ।

রাতে স্টাডি রুমে বসে টেপ করা টিভি নিউজ দেখছিল আর্থার। সন্ধ্যার খবরে করুণ ঘটনাটা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। কুকুরটা বিকহ্যামের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, বুড়ো মানুষটা ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন প্ল্যাটফর্ম থেকে, এই দৃশ্যে চোখ বুজে ফেলল আর্থার।

ঘোড়াগুলো উন্মত্ত হয়ে ওঠার দৃশ্যে খবর-পাঠক বলল, মেট্রোপলিটান পুলিশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। ঘোড়াগুলোকে এমনভাবে ট্রেনিং দেয়া, কোন অবস্থাতেই তাদের উত্তেজিত হয়ে ওঠার কথা ছিল না। তদন্তের ব্যবস্থা করা হচ্ছে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল জানার জন্যে।

ভিডিও টেপটা মিনিট বিশেক দেখল আর্থার। শীলা সন্ধ্যার খবরটা তার অনুরোধে রেকর্ড করে রেখেছে। নতুন করে আবার প্রোগ্রামটা চালাল আর্থার। ভিড়টাকে কাভার করছে ক্যামেরা, একজনকে দেখে চোখ পিটপিট করল ও। নেলসন্স কলামের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পল বুহের। কিন্তু ও ওখানে কি করছে?

টেপটা আবার চালাল আর্থার। একটা ছেলে লাফিয়ে নামছে বেদি থেকে, বুহেরের হাতটা ধরল। ক্লোজ-আপে মুখটাকে পর্দায় নিয়ে এল ও। চেনা চেনা লাগছে মুখটা। কোথায় যেন দেখেছে? হঠাৎ মনে পড়ে গেল আর্থারের… ডেমিয়েন থর্নের মুখ ওটা। এমব্যাসীতে ডেমিয়েনের যে ছবি আছে সেটার বয়স পনেরো বছর কমিয়ে দিলে ঠিক অমনই লাগবে দেখতে।

‘ওহ, গড, বিড়বিড় করল আর্থার। তারপর কি ভেবে বুহেরের নাম্বারে ফোন করল। এটা-সেটা বলার পর আসল প্রসঙ্গে চলে এল আর্থার। জানতে চাইল র‍্যালিতে বুহেরের সাথে ছেলেটা কে ছিল। অস্বীকার করে বসল বুহের। র‍্যালিতে তার সাথে কোন ছেলে ছিল না। আর্থার মনে করিয়ে দিল, টিভিতে সে দেখেছে একটা ছেলে বুহেরের হাত ধরেছে। বুহের বলল, ধাক্কাধাক্কির সময় হয়তো অমন ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এ বিষয়টা নিয়ে আর্থারের মত মানুষের এত কৌতূহলের কারণ বুঝতে পারছে না সে।

 

 

‘এমনি,’ বলে এড়িয়ে গেল আর্থার। রেখে দিল ফোন। তারপর আবার চালু করল ভিডিও টেপ। ট্রাফালগার স্কোয়ারের করুণ ঘটনাটাকে রিউইন্ড এবং ফরোয়ার্ড করে বারবার দেখল। শেষে দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে: ওই ছেলেটা ডেমিয়েন থর্নের জ্যান্ত সত্তা আর বুহের মিথ্যা বলেছে তাকে। আসলে ছেলেটাকে সে চেনে। কিন্তু বুহের মিথ্যা কেন বলল ভেবে পেল না ফ্রেডরিক আর্থার। ব্রান্ডির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে মনে পড়ল একটা কথা বুহেরকে জিজ্ঞেস করতে সে ভুলে গেছে। ডেমিয়েন থর্নের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং দাফন সম্পর্কে একটা প্রশ্ন করবে ভেবেছিল ও।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৪

চোদ্দ

বিবিসি’র চীফ প্রেস অফিসার জিম থ্রপলটন আমেরিকান এমব্যাসী থেকে দাওয়াত পেয়ে আহ্লাদিত এবং কৌতূহলী হয়ে উঠল। এসভেনর স্কোয়ারে ট্যাক্সি চড়ে যাচ্ছে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ক্যাসেটটার স্পর্শ নিল। ফ্রেডরিক আর্থার এটার ব্যাপারে কেন আগ্রহ বোধ করেছেন ভেবে অবাক লাগছে তার। অ্যামব্যাসাডরের অফিসে ঢোকার সময় আর্থারের পূর্বসুরি এক রাষ্ট্রদূতের নির্মম মৃত্যুর কথা মনে পড়ে গেল। অ্যান্ড্রু ডয়েল। তিনি প্রেস কনফারেন্স ডাকার পর নিজের অফিসে বসে আত্মহত্যা করেন। জিমের তখন বয়স কম, রিপোর্টার হিসেবে অনেকের মত ডয়েলের আত্মহত্যার কারণ উদ্ঘাটন করতে চেয়েছিল সে-ও। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।

‘অ্যামব্যাসাডর এখুনি দেখা করবেন আপনার সাথে।’ জানাল সেক্রেটারি।

জবাবে হাসি মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে অফিসে ঢুকে পড়ল জিম। হাত বাড়িয়ে দিল আর্থার। হ্যান্ডশেক করার সময় ইউনাইটেড স্টেটস লেখা বড় সিলটার দিকে চোখ চলে গেল জিমের। ওখানে, বুলেটের আঘাতে ছিটকে পড়া ডয়েলের মগজ লেগে ছিল। ফটোগ্রাফ দেখেছে সে। ছবিটা এমন গা গোলানো যে কখনও ছাপা হয়নি পত্রিকায়।

‘এসেছেন বলে খুশি হয়েছি,’ বলল আর্থার।

‘আপনার সেবায় লাগতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।’

‘টেপটা এনেছেন?

পকেট থেকে টেপটা বের করল জিম, আর্থার ইঙ্গিত করল ওকে টিভির সামনে যেতে। জিম ক্যাসেট ঢোকাচ্ছে ভি.সি.আরে, আর্থার কফি ঢালল দু’জনের জন্যে।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রোগ্রামটা দেখল ওরা। পর্দায় ফুটে উঠেছে টাইটেল: ওয়ার্ল্ড ইন ফোকাস।

এক তরুণী হাসল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, তারপর ভূমিকা শুরু করে দিল। ‘কেট খুব সুন্দরী ছিল,’ নরম গলায় বলল জিম। ‘এবং প্রতিভাময়ী।’

‘চিনতেন ওকে?’

‘অল্প। খুব ট্রাজিক একটা ঘটনা। খুব কম বয়স ছিল মেয়েটার।’

‘শুনেছি মেয়েটা ক্যান্সারে মারা গেছে,’ পর্দায় চোখ রেখে বলল আর্থার।

‘হ্যাঁ।’

পর্দায় ডেমিয়েন থর্নকে দেখা গেল এবার। কেট রেনল্ডস সাক্ষাৎকার নিচ্ছে তার। কয়েক মিনিট কেটে গেল। ফিসফিস করে বলল জিম, ‘এবার।’

ডেমিয়েনের কথা বলার ভঙ্গিটা আন্তরিক, প্রাণবন্ত। ক্যামেরা ধরল কেটকে। মনোযোগের সাথে ডেমিয়েনের কথা শুনছে সে। কেট হঠাৎ ছাতের দিকে মুখ তুলে চাইল, চেহারায় ফুটে উঠল আতঙ্ক, দুড়ম করে কি একটা পড়ল টেবিলের ওপর। একটা লোক, ঝুলছে, মাথাটা দুলছে এদিক-ওদিক।

‘ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্য,’ চাপা গলায় বলল জিম। ‘চোখে দেখা যায় না।’ কিন্তু আর্থার অপলক তাকিয়ে রইল টিভি স্ক্রীনের দিকে। বিদ্যুতের একটা ঝাড়ের ওপর থেকে পড়ে যায় বেচারা, পা বেঁধে গিয়েছিল রশিতে, তারপর আটকে যায় পর্দার মধ্যে। ঝুলতে থাকে ওখানে। এমন সময় বিস্ফোরিত হয় বৈদ্যুতিক বাল্বগুলো, আগুন ধরে যায় লোকটার গায়ে।’ ধারা ভাষ্যকারের মত বলে চলল জিম।

পর্দা হঠাৎ কালো হয়ে গেল।

‘নাইলনের পর্দায় পেঁচিয়ে গিয়েছিল হতভাগা। পুড়ে রোস্ট হয়েছে।’

‘পর্দায় লোকটাকে প্রথম যখন দেখা গেল সে জায়গাটা আবার দেখান তো।’ জিম একটা বোতাম টিপল, ঝুলন্ত লোকটাকে দেখা গেল আবার।

‘ফ্রিজ করে রাখুন।’

পর্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আর্থার, ঝুঁকল।

 

 

‘আবার চালান।’

আর্থারের নির্দেশ পালন করল জিম।

‘থামুন।’

আবার পর্দার ওপর ঝুঁকে এল আর্থার। লোকটার চেহারা দেখল, দেখল বিকৃত মুখটা হাঁ হয়ে আছে চিৎকারের ভঙ্গিতে।

‘ওটা কি?’ পর্দার এক কোণে চকচকে এক টুকরো ধাতব খণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করল আর্থার।

কাঁধ ঝাঁকাল জিম। ‘বলতে পারব না। ঝাড় থেকে ছিটকে পড়া কোন বোল্ট হবে হয়তো।’

‘ছুরি-টুরি নয়তো?’-

‘ছুরি?’ হতভম্ব দেখাল জিমকে।

‘কোন ছুরি পাওয়া যায়নি?’

‘না।’

আর্থার রিমোটটা জিমের হাত থেকে নিয়ে নীরবে টেপটাকে রিউইন্ড আর ফরোয়ার্ড করল।

‘লোকটার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি,’ বলে চলল জিম। ‘গোটা ব্যাপারটা ছিল রহস্যময়। তবে আমার ধারণা এ ঘটনার মধ্যে ছুরি-টুরির কোন ভূমিকা ছিল না।’

মৃদু মাথা দোলাল আর্থার, টেপটা বের করে জিমের হাতে দিল।

‘থ্যাঙ্কিউ অ্যানিওয়ে। আসার জন্যে ধন্যবাদ।’ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জিমের সাথে হাত মেলাল সে। ‘ঘটনাটা কাউকে বলার দরকার নেই কেমন? স্রেফ অলস একটা কৌতূহল ছিল আমার।’

জিম ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে হাসল।

‘আপনার জন্যে যদি কিছু করার থাকে…’ বলল আর্থার।

‘আমরা একটা সিরিজ করার চিন্তাভাবনা করছি, স্যার। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সমাজ জীবন-’

‘ঠিক আছে,’ ওকে বাধা দিল আর্থার। ‘আমার সেক্রেটারির সাথে কথা বলুন। একটা সময় বের করা যাবে।’

জিম থ্রপলটন এমব্যাসী থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল। বাড়ি ফেরার পথে রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাপচারিতার বিষয়টা নিয়েই ভাবল। বিচ্ছিন্ন এবং অদ্ভুত মনে হয়েছে তার গোটা ব্যাপার। সন্দেহ হলো আর্থার গোপনে কিছু করছেন কি না।

.

বিকেল পর্যন্ত টানা কাজ করল ফ্রেডরিক আর্থার। সেক্রেটারি চলে যাবার পর ফোন করল বাড়িতে।

বাসায় নেই শীলা। খুশি হলো আর্থার। স্ত্রীকে মিথ্যা কথা বলতে হলো না। অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ রেখে গেল-ফিরতে দেরি হবে, সাড়ে ন’টা বেজে যেতে পারে। তারপর বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে।

শেষ বিকেলের জ্যামে আটকা পড়ে একটা ঘণ্টা নষ্ট হলো আর্থারের। আরও চল্লিশ মিনিট লাগল গলি-উপগলি ধরে বার্কশায়ারে পৌঁছুতে। রাস্তায় দু’বার থামল সে, ম্যাপ দেখল। ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মত দু’মুখো একটা রাস্তায় পৌছুল, তারপর মোড় নিল বামে। এটা একটা সরু, মেঠো রাস্তা। সারের গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে। রাস্তাটা জনশূন্য। একটা খামার বাড়িও চোখে পড়ল না। অডোমিটার চেক করল ও। ডি কার্লোর বর্ণনা অনুসারে আসল জায়গায় চলে আসার কথা ওর।

একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে একটা পাব দেখতে পেল আর্থার। আলো জ্বলছে। ছোট উঠনে গাড়ি থামাল সে। ওটা পার্কিং লট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গাড়ি থেকে নামল আর্থার। মুখ তুলে চাইল আকাশের দিকে। হালকা মেঘ জমেছে।

পাবে ঢুকল আর্থার। ছোট পাব। আর দশটা গ্রাম্য শুঁড়িখানার মতই, নিচু ছাত, মোটা, কালো খিলান। গরম পড়েছে। তবু কাঠের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে।

বার ম্যান ওরফে শুঁড়িখানার মালিক মোটাসোটা, ভালুকের মত পেট, ঠোঁটের ওপর মস্ত গোঁফ, লাল টকটকে গাল। আর্থারকে দেখে ঝলমলে চোখে তাকাল।

আর্থার ব্রান্ডির অর্ডার দিল।

‘আমেরিকান, স্যার?’

‘না, শুধু সোডা।’

হেসে ফেলল শুড়িখানার মালিক। ‘না, স্যার। জিজ্ঞেস করেছি আপনি আমেরিকান কিনা।’

‘ও, হ্যাঁ।’

চারপাশে চোখ বোলাল আর্থার। বার এবং আগুনের ধারে কয়েকজন গ্রামবাসী বসে আছে। একজন তার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল। প্রত্যুত্তরে হাসল আর্থার।

ঘরে তৈরি ব্রান্ডি এনে দিল মোটকু আর্থারকে। আর্থার ভেবেছিল খেজুরে আলাপ জুড়ে দেবে লোকটা। গ্রামের শুঁড়িখানায় এমনটাই হয়। আমেরিকান পেলে নানা গপপো শুরু করে দেয়। তবে এ লোকটা ওরকম নয়।

তৃতীয় গ্লাস ব্রান্ডি পান করার পর শুঁড়িখানার মালিককে প্রশ্নটা করল আর্থার। ‘ও, হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘এদিকে জিপসীদের আনাগোনা প্রচুর। সবগুলো শয়তানের হাড্ডি।

‘অদ্ভুত কোন জন্মের কথা শুনেছেন আপনি এখানে? বিশ বছর আগে?’

হাসল লোকটা। ‘জিপসীদের সবার জন্মই অদ্ভুত। কিন্তু আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারলাম না, স্যার।’

শ্রাগ করল আর্থার। জিপসীদের অনেক অদ্ভুত জন্মের কথা শুনেছি কিনা তাই আর কি।’

‘আপনি সাংবাদিক, স্যার?’

‘না। স্রেফ ট্যুরিস্ট।’

মাথা ঝাঁকিয়ে সরে গেল শুঁড়িখানার মালিক আরেক খদ্দেরের কাছে। ড্রিঙ্কটা শেষ করল আর্থার, উঠে পড়ল। নিজের ওপর রাগ লাগছে খুব। খামোকা সময় নষ্ট। এখানে কি পাবার আশায় এসেছে সে? আর্থার ঠিক করল জায়গাটা এক চক্কর দেখে বাড়ি ফিরে যাবে।

গ্রামবাসীদের শুভরাত্রি জানিয়ে পাব থেকে বেরিয়ে এল আর্থার। ওরা ওকে যেতে দেখল। শুঁড়িখানার মালিক বার ফ্ল্যাপ তুলে ধাক্কা মেরে হাফ-ডোরটা খুলল। তারপর সরে দাঁড়াল। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তার কুকুরটা। অনুসরণ করল আর্থারকে। মাথা তুলে বাতাসের গন্ধ শুঁকল, তাকাল মেঘের দিকে, তারপর নিঃশব্দে এগোল, মাটিতে তার পায়ের কোন ছাপ পড়ল না।

.

একটা জলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেডরিক আর্থার। জলায় থকথকে কাদা আর আগাছা ছাড়া কিছু নেই। স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ ঢুকে পড়ছে ফুসফুসে। শুধু শুধু সন্ধেটা নষ্ট করার জন্যে নিজেকে আবার গালি দিল আর্থার। তারপর ঘুরল।

পাবটাকে দেখা যাচ্ছে না। কপালে ভাঁজ পড়ল আর্থারের। খানিক এগোবার পর ছাতের কাঠামোটা নজরে এল। ওরা আলো নিভিয়ে দিয়েছে। ঘড়ি দেখল আর্থার। এত তাড়াতাড়ি? শ্রাগ করল সে। এ নিয়ে তার মাথা না ঘামালেও চলবে। সে পা বাড়াল গাড়ির দিকে। হঠাৎ হিম বাতাস বইতে শুরু করল। গায়ে কাঁটা দিল আর্থারের।

গাড়ির ভেতর ঢুকল আর্থার। সারের গন্ধটা পাচ্ছে আবার। এবার যেন ভেতর থেকে আসছে। ইঞ্জিন চালাল আর্থার, ফ্যানের সুইচ অন করল। ঘুরল না ফ্যান। লাল বাতিটা জানান দিল বৈদ্যুতিক সমস্যা হয়েছে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল আর্থার। ভাবল, ফ্যান নষ্ট হয়েছে হোক, এখন ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পারলেই বাঁচি।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে, টপাস করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল উইন্ডশিল্ডে। গ্লাসে, ওয়াইপারের গায়ে জমে আছে মরা পোকা। উইন্ডশিল্ড ওয়াশার চালু করতে গিয়ে দেখল ওটাও নষ্ট। এদিকে গন্ধটা বেড়েই চলেছে। জানালা খোলার জন্যে বোতাম টিপল আর্থার। খুলল না। মনে মনে গালি দিল ও। জুতোর ভেতর মুঠো করল পায়ের আঙুল, স্যাঁতসেঁতে ভাবটা যেন গোড়ালি বেয়ে উঠে আসছে।

‘শালার ড্যাম্প,’ বিড়বিড় করল আর্থার। গাড়ির গতি বাড়ছে, বাম দিকে তাকাতে এক ঝলক দেখতে পেল ও ওটাকে। মনে হলো একটা কুকুর তাকিয়ে আছে কটমট করে। রিয়ার ভিউ মিররে চাইল আর্থার। কেউ নেই।

মাথাটা ঘুরছে আর্থারের। অতখানি ব্রান্ডি খাওয়া উচিত হয়নি। মদের প্রভাব ওর অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করে দিচ্ছে, তালগোল পাকিয়ে যেতে চাইছে সবকিছু। কিন্তু তিনটে ব্রান্ডি এক সাথে এর আগেও অনেক পান করেছে আর্থার। কই, তখন তো কিছু হয়নি। এখন হচ্ছে কেন?

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। কাঁচ থেকে খসে পড়েছে পোকাগুলো। কিন্তু ওয়াইপারের অবস্থা আগের মতই। জানালা দিয়ে উঁকি দিল আর্থার। ওই তো দুমুখো রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। টি আকারের সাইন পোস্টটা নির্দেশ করছে বাম দিকে লন্ডন। রাস্তা খালি। হুইল ঘোরাল আর্থার, নিজের অজান্তে চোখ চলে গেল আয়নায়, দাঁড়িয়ে পড়ল ব্রেক কষে। সাইনপোস্টে কি যেন ঝুলছে, ছোট, গোলাপী রঙের। গেঁথে রয়েছে কাঠের সাথে। গাড়ি নিয়ে পিছিয়ে এল আর্থার। না, কিছু না। আলো পড়ে দূর থেকে অমন মনে হয়েছে। অ্যাকসিলেরাটরে চাপ দিল আর্থার, কিন্তু সাড়া দিল না গাড়ি

প্রথমে বামে তারপর ডানে তাকাল আর্থার। দু’পাশেই ঝোপঝাড়। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই কোথাও

ক্লাচ চেপে ধরল আর্থার, গিয়ার বদলাল, দু’পাশে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। ঝিম ধরা ভাবটা আবার ফিরে এসেছে। গন্ধটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। বমি আসছে ওর। খকখক কেশে উঠল আর্থার, আবার তাকাল আয়নার দিকে এবং আঁতকে উঠল। দুঃস্বপ্নে দেখা সেই ভয়ঙ্কর বাচ্চাটা খলখল করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।

চিৎকার দিল আর্থার, চোখে হাত চাপা দিল। ঠিক তখন চলতে শুরু করল গাড়ি। এগোচ্ছে, রাস্তার পাশে, জলভরা একটা ডোবার দিকে। প্রচণ্ড জোরে উইন্ডশিল্ডে যখন ঠুকে গেল মাথা, তখনও চিৎকার করে চলেছে আর্থার।

.

শীলা আর্থার ফাঁকা চোখে তাকিয়েছিল টিভি পর্দার দিকে, মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। হঠাৎ বেজে উঠল ফোন।

‘হাই,’ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল সে, তারপর কাঁধ ঝাঁকাল।

‘না, ফেরেনি এখনও ও। ফিরলে জানাব।’

ফোন রেখে আবার সোফায় বসল শীলা। চোখ চকচক করছে। আধঘণ্টা পর আবার ফোন বাজল। ঝট্ করে রিসিভার তুলল শীলা, ‘হ্যাঁ,’ শব্দটা উচ্চারণ করল পরপর তিনবার, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কোন্ হাসপাতাল?’ শেষে রিসিভার রেখে দৌড় দিল দরজার দিকে।

.

নরম, কোমল একটা হাত ওর কপালে বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। হাতটা ধরে ফেলল আর্থার, চোখ মেলার চেষ্টা করল। পারল না। শুনতে পেল একটা নারী কণ্ঠ তাকে বলছে সব ঠিক আছে। আঙুলগুলো শিশুর মত ধরে থাকল আর্থার। হঠাৎ টের পেল সুই ঢোকানো হচ্ছে তার শরীরে। আঁধার হয়ে এল আর্থারের দুনিয়া।

তালুতে দপদপে ব্যথা নিয়ে আবার জেগে উঠল আর্থার। ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নটা আবার দেখেছে। চোখ পিটপিট করল। কি হয়েছে মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়ছে না। মুখে হাত দিল ও। ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখে। মাথায়ও। ধীরে ধীরে উঠে বসল বিছানায়। মাথাটা ঘুরে উঠল খুব, আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে পা নামাল আর্থার, দরজার ধারে যাবে। কিন্তু শরীর টলছে। যেতে পারল না। বেডসাইড টেবিল থেকে একটা আয়না তুলে নিল। ভয়ে ভয়ে তাকাল ওদিকে। না, ভয়ের কিছু নেই। নিজের মুখটাকেই দেখতে পাচ্ছে সে। ব্যান্ডেজের নিচে ফোলা মুখ।

‘আর্থার!’

মুখ তুলে চাইল আর্থার। শীলা। দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। ওকে দেখে হাসল, কাছে এসে হালকা ভাবে ঠোঁট ছোঁয়াল মুখে। তারপর ওকে শুইয়ে দিল বিছানায়।

‘কি হয়েছিল আমার?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।

‘তুমি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে। রক্তাক্ত অবস্থায় ওরা তোমাকে উদ্ধার করে। তুমি-‘

‘ওরা বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে পেরেছে?’

‘তুমি হ্যালুসিনেশনে ভুগছ,’ শিশু ভোলানো মিষ্টি হাসল শীলা। ‘অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। মাথায় যা লেগেছে তোমার!’

কপালে হাত বুলিয়ে দিল শীলা, ওর হাতটা ধরে রইল আর্থার। টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে পড়তে গিয়েও পড়ছে না। ‘এখন ঘুমাও,’ বলল শীলা।

চোখ বুজল আর্থার। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ মেলে দেখল বেশ্যাদের মত নিতম্ব দুলিয়ে চলে যাচ্ছে শীলা। শীলা একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেমন আছে আর্থার। যেন তাতে তার কিছু আসে যায় না। আবার চোখ বুজল আর্থার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৫

পনেরো

জীবনে এই প্রথম অ্যামব্যাসাডরের সেক্রেটারির জবান বন্ধ হয়ে গেল। তার বসকে ব্যাগ গোছাতে দেখে হাঁ হয়ে গেছে মেয়েটা, মাথা চুলকাচ্ছে, অস্থির ভঙ্গিতে এক পায়ের ওপর শরীরের ভর চাপাচ্ছে, আবার জায়গা বদল করছে।

‘রোমে কেন?’ শেষে জিজ্ঞেস করল সে। ‘বিশেষ করে এ সময়ে?’

টুথপেস্ট, রেজর, ডেন্টাল ফ্লস,’ জবাবে বলল ফ্রেডরিক আর্থার। ‘আজ বিকেলে হোয়াইট হল-এ যাবার কথা আপনার। আপনি এভাবে-’

‘মার্টিনকে পাঠিয়ে দিয়ো,’ ফস করে ব্যাগের জিপার বন্ধ করল আর্থার। ‘এটা স্রেফ একটা অবজারভেশন জব। আমার অনুপস্থিতির যে কোন একটা কারণ দেখিও। তুমি তো এটা ভালই পারো। আমি কাল লাঞ্চের মধ্যে ফিরে আসব।’.

 

 

সেক্রেটারি রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কিন্তু কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন সেটা অন্তত বলে যান।’

‘যদি বলি এক পাগল সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, বিশ্বাস করবে?’ হাসল আর্থার। মেয়েটা শ্রাগ করে ঘুরে দাঁড়াল। আপনি যেমন আচরণ করছেন, বিশ্বাস না করে উপায় কি? ভাবল সে।

‘কাল দেখা হবে,’ বলল আর্থার। বেরিয়ে গেল কাঁধে ব্যাগটা ফেলে। তার মাথায় এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা, কালশিটে পড়া চোখ ঢেকে রেখেছে সানগ্লাসে।

.

ফ্রান্সের ওপর দিয়ে, দক্ষিণ-পুবে উড়ে চলেছে ছোট জেটটা, আর্থার আলতো আঙুল ছোঁয়াল ব্যান্ডেজে। ফুলে আছে সেলাই। হালকা একটা দাগ থাকবে, বলেছে ডাক্তার। তবে চিন্তার কিছু নেই। এতে ওর চেহারা বিকৃত দেখাবে না। বরং মনের দাগটা মুছে যাবার সম্ভাবনা কম।

পকেট থেকে টেলিগ্রামটা বের করল আর্থার, চোখ বুলাল আবার। আকুল আবেদন ফুটে উঠেছে লেখায়। মারা যাচ্ছেন প্রীস্ট, আর্থারের সাথে দেখা করতে চাইছেন। হাসপাতালের ঠিকানাটা দেখল আর্থার। খুঁজে পেতে আশা করি কষ্ট হবে না।

আউটার রানওয়েতে ল্যান্ড করল প্লেন। ফর্মালিটিজ সেরে দ্রুত বেরিয়ে এল আর্থার। ওর সেক্রেটারি রোম অফিসকে বলে আগেই ভাড়া করে রেখেছে গাড়ি। ওটাতে উঠে বসল সে।

ঘণ্টা দুই লাগল গ্রামটাতে পৌঁছুতে। হাসপাতালটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না, অনেক ভেতরে। সাইনবোর্ড দেখে অবাক হলো। মেন্টাল হসপিটাল! প্রবেশ পথে গাড়ি থামাল আর্থার। হেলান দিল সীটে। বৃথা সময় অপচয় করছে না তো? ভাবছে ও। কাজ ফেলে এসেছে একটা পাগলের প্রলাপ শুনতে? কিন্তু যখন চলেই এসেছে:: দীর্ঘশ্বাস ফেলে একতলা বিল্ডিংটাতে ঢুকে পড়ল আর্থার। হঠাৎ শিরশির করে উঠল গা। ওরা যদি ওকে পাগল সাজিয়ে আটকে রাখে? কেউ জানে না আর্থার এখানে আসবে। কেউ ওর খোঁজ পাবে না… দূর, কি আবোলতাবোল ভাবছি, নিজেকে চোখ রাঙাল আর্থার। হাসল রিসেপশনিস্টের দিকে তাকিয়ে। জানাল ফাদার ডি কার্লোর সাথে দেখা করতে এসেছে। রিসেপশনিস্ট অপেক্ষা করতে বলল ওকে। এক মিনিট পর, এক যুবককে দেখা গেল। এ সেই ব্রাদার ডেভিড। ওকে দেখে অনুতাপ জাগল আর্থারের মনে। লোকটার কথায় যদি ওই সময় কান দিত, হয়তো এতগুলো প্রাণকে অকালে ঝরে যেতে হত না…

‘আসার জন্যে ধন্যবাদ,’ হাত বাড়িয়ে দিল সন্ন্যাসী, তারপর আর্থারকে জড়িয়ে ধরল বুকে। আলিঙ্গন শেষে পিছিয়ে গেল আর্থার, লক্ষ করল লোকটার চোখে জল।

‘কেমন আছেন উনি?’

‘শীঘ্রি উনি শান্তির জগতে চলে যাবেন,’ বলল ডেভিড। আর্থারের হাত ধরে পা বাড়াল করিডরের উদ্দেশে।

‘কিন্তু উনি এখানে কেন? একটা পা–’ শব্দটা বেরুতে চাইল না মুখ থেকে।

‘পাগলাগারদে?’ বলল ডেভিড। ‘ওরা ওনাকে পাগল ঠাউরেছে। তিনি বারবার পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলতেন, ইংল্যান্ডে মেসেঞ্জার পাঠানোর জন্যে লোক খুঁজতেন। আমরা বলেছিলাম মঠেই ওনার দেখাশোনা করতে পারব। কিন্তু ওরা জোর করে…’

আর্থার জিজ্ঞেস করতে চাইছিল ‘ওরা’ কারা, কিন্তু কিছু বলল না। নীরবে অনুসরণ করল সন্ন্যাসীকে।

সিঁড়ি বেয়ে একটা বেযমেন্ট করিডরে নেমে এল দু’জনে। বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা, আর আলো খুব কম। যেন দর্শনার্থীরা পরিষ্কার ভাবে কিছু দেখতে না পারে তার জন্যে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।

করিডরের শেষ মাথায় একটা দরজায় টোকা দিল ডেভিড। সবুজ ইউনিফর্ম পরা পুরুষ নার্স উঁকি দিল, মাথা দুলিয়ে সরে দাঁড়াল এক পাশে। কার্বোলিক এসিডের গন্ধ ধাক্কা মারল আর্থারের নাকে।

সন্ন্যাসীর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল সে। ছোট একটা ঘর, সেল বললেই মানায়-একটা কট. একটা ওয়াশবেসিন আর একটা টয়লেট বোল। জানালার দিকে চোখ চলে গেল আর্থারের। গরাদ নেই। তবে এত সরু যে ফাঁক গলে ঢোকা বা বেরুনো মুশকিল।

কটে শোয়া শরীরটা নড়ে উঠল, একটা হাত তুলল।

‘মি. আর্থার?’ চিঁচিঁ গলায় জানতে চাইলেন মানুষটা।

ঝুঁকে হাড্ডিসার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল আর্থার। ডি কার্লোর মুখে মাংসের বালাই নেই, হাঁ টা কালো একটা গর্তের মত। ঠাণ্ডা চামড়ার স্পর্শে শিউরে উঠল আর্থার। এই মানুষটাই পৃথিবীকে রক্ষা করতে চেয়েছেন, এই হতভাগা পাগল মানুষটা। আর তার পুরস্কার কিনা জুটেছে পাগলাগারদে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গোণার মধ্যে।

‘বসুন, মি. আর্থার।

করিডর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এল সন্ন্যাসী।

‘আপনার অবস্থা দেখে সত্যি খুব খারাপ লাগছে,’ বিছানায় বসল আর্থার।

মাথা নাড়লেন ডি কার্লো। ‘আপনার সহানুভূতি তাদের জন্যে জমা রাখুন যাদের এটা সত্যি দরকার।’ এক মুহূর্ত দু’জনে তাকিয়ে রইলেন পরস্পরের দিকে।

‘আপনি তো ধার্মিক মানুষ নন, মি. আর্থার?’

মাথা নেড়ে সায় দিল আর্থার।

‘তাহলে এখানে এলেন কেন?’

শ্রাগ করল আর্থার। ‘আপনার নোট আর চিঠিগুলো পড়েছি। তবে কোন যুক্তি খুঁজে পাইনি—’

‘আমরা যুক্তি নিয়ে কথাও বলছি না।’

‘ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই।’

‘তাহলে, আবার প্রশ্নটা করি, কেন এলেন?’

‘হয়তো করুণা করে।

ডানে-বামে মাথা নাড়লেন ডি কার্লো।

‘তাহলে কৌতূহল।

হাসলেন ডি কার্লো। জবাবটা স্বার্থপরের মত হয়ে গেছে, ভাবল আর্থার। মুখ নিচু করে মেঝেতে তাকাল ও।

‘আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি,’ স্বীকারোক্তির মত শোনাল কথাটা। তবে কথাটা বলে স্বস্তি বোধ করছে সে।

‘আমার দিকে তাকান,’ বললেন ডি কার্লো।

আর্থার তাকাল ফাদারের দিকে। সে পাগল হয়ে যাবার ভয়ের কথা বলছে আরেক পাগল আখ্যা পাওয়া লোকের কাছে। কি অদ্ভুত!

‘পাগল হয়ে যাচ্ছেন এমনটি মনে হচ্ছে কেন আপনার?’

এবার দুঃস্বপ্নটার কথা ডি কার্লোকে খুলে বলল আর্থার। প্রথমে ঠাট্টাচ্ছলে শুরু করলেও, শেষের দিকে সিরিয়াস হয়ে উঠল, গরগর করে বলতে শুরু করল বাচ্চাটার কথা, যাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখে সে। বলল ক্রুশে বিদ্ধ শিশুর কথা। এই শিশুকেও স্বপ্নে দেখে আর্থার। সেদিন হাসপাতালে ঘোরের মধ্যে ক্রুশে বিদ্ধ শিশুর কথাই শীলাকে বলেছিল ও।

আর্থারের কথা শেষ হলে কনুইতে ভর করে অনেক কষ্টে উঠে বসলেন ডি কার্লো, একটা হাত রাখলেন ওর হাতে।

‘খারাপ স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠার ব্যাপারটাকে ইংরেজীতে কি যেন বলে?’

‘হ্যালুসিনেশন,’ জবাব দিল আর্থার।

মাথা ঝাঁকালেন ফাদার। শয়তানের শক্তি অসীম। তার জন্যে দূরত্ব কোন বাধা নয়। মানুষের কল্পনাশক্তিকেও সে প্রভাবিত, দূষিত করতে পারে। অ্যান্টিক্রাইস্টের শক্তি মানুষের মন ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এমনকি পশুদেরকেও সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’

‘শয়তানের শক্তি পাগল বানিয়ে দিতে পারে মানুষকে,’ বলে চললেন ডি কার্লো। ‘আপনার এক পূর্বসুরির কথা হয়তো মনে আছে-অ্যানড্রু ডয়েল?’

মাথা দুলিয়ে জানাল আর্থার। মনে আছে।

‘তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ডেমিয়েন থর্নের তাই সে তাকে পাগল বানিয়ে দেয়। লোকটা আত্মহত্যা করে। তবে কেউ জানতে পারেনি কেন।

‘দেবতারা যাদের ধ্বংস করতে চান, তাদের প্রথমে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটান,’ বিড়বিড় করল আর্থার।

এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন ডি কার্লো, ‘দেবতারা নন, মাই সন, দেবতারা নন।’

ডেভিড দাঁড়িয়ে ছিল দোরগোড়ায়, তার দিকে হাত তুলে ইশারা করলেন ডি কার্লো। আলখেল্লার পকেট থেকে একটা পাউচ বের করল সন্ন্যাসী। কার্লো বটুয়াটা খুলে একটা ড্যাগার বের করলেন। ‘ওরা এ জিনিস আমার কাছে রাখতে দেয় না,’ বললেন তিনি। ‘তাই ব্রাদার ডেভিডের কাছে এটা থাকে।’

ড্যাগারের বাঁটে, যীশুর মূর্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আর্থার।

‘এই ড্যাগার দিয়ে ডেমিয়েন থর্নকে হত্যা করা হয়েছিল,’ বললেন ডি কার্লো। ‘এটাকে আবার ব্যবহারের সময় এসেছে।’

আর্থারের হাতে ড্যাগারটা দিলেন তিনি। আর্থার ছুরিটার হাতল চেপে ধরল।

‘কি করতে হবে আপনার তা জানাই আছে,’ কাশতে কাশতে শুয়ে পড়লেন ডি কার্লো। ‘সময় কিন্তু খুব কম।’ চোখ বুজলেন তিনি। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘বুক অভ রেভেলেশন বলেছে: ‘পৃথিবী আর সাগরের বাসিন্দাদের ওপর নামিয়া আসিবে বিপর্যয়। কারণ শয়তান আসিতেছে প্রচণ্ড ক্রোধ লইয়া, আর সে জানে তাহার হাতে সময় খুব কম।’

চোখ মেললেন ফাদার, তাকালেন আর্থারের দিকে। ‘তার হাতে সময় কম, মি. আর্থার। ওকে ধ্বংস করুন। তাড়াতাড়ি। আর মনে রাখবেন আপনাকে দুঃস্বপ্ন ‘দেখাচ্ছে শয়তান। তবে ভয় পাবেন না। জাগ্রত যীশু আপনাকে সাহায্য করবেন। তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখুন।

মাথা ঝাঁকাল আর্থার সায় দেয়ার ভঙ্গিতে, সন্ন্যাসী বেরিয়ে গেল তাকে নিয়ে। নার্স বন্ধ করে দিল দরজা। করিডর ধরে হাঁটছে আর্থার, কানে ভেসে এল ডি কার্লোর কাশির শব্দ। গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৬

ষোলো

বিবিসি প্রেস অফিসারের মত মেট্রোপলিটান পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার টেড উইলিসও আমেরিকান এমব্যাসী থেকে ফ্রেডরিক আর্থারের দাওয়াত পেয়ে অবাক হয়ে গেল। আরও বেশি অবাক লাগল যখন রাষ্ট্রদূত নানা রাজনৈতিক সমস্যা, ট্রাফালগার স্কোয়ার বিপর্যয় এবং শেষে উইলিসের প্রিয় বিষয় সকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। এসব ফালতু জিনিস নিয়ে কথা বলার জন্যে অ্যামব্যাসাডর নিশ্চয়ই ওকে ডাকেননি, সন্দেহ হলো উইলিসের। ওর ধারণা সত্যি। একথা সেকথার পর ড্যাগার প্রসঙ্গ উত্থাপন করল আর্থার।

ভুরু কুঁচকে গেল টেড উইলিসের। ‘পাঁচটা ড্যাগার?’

‘হ্যাঁ। আপনাদের ব্ল্যাক মিউজিয়ামে আছে। শিকাগোতে কয়েক বছর আগে ওগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের মিউজিয়ামের ড্যাগারগুলো দরকার স্বল্প সময়ের একটা শো-র জন্যে। তারপর আবার ওগুলো ফেরত পাবেন।’

তাহলে এই ব্যাপার? পেশিতে ঢিল পড়ল উইলিসের। ‘ড্যাগারগুলো দেয়া যাবে। কোন অসুবিধে নেই। তবে যত্নে এবং সাবধানে রাখতে হবে।’

‘সে ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা আপনাকে দিচ্ছি।’

‘বেশ। তাহলে আমাদেরও দিতে কোন অসুবিধে নেই।

 

 

‘ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। আমাদের মিউজিয়াম খুব খুশি হবে ওগুলো পেলে।’

এরপর আবার সকারের গল্পে ফিরে গেল ওরা। মিনিট বিশেক পর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে বিদায় দিল আর্থার। বাড়ি ফেরার পথে মনটা খচখচ করতে লাগল টেড উইলিসের।

রাষ্ট্রদূতের ব্যাখ্যা মনঃপূত হয়নি তার। বলেছে মিউজিয়ামের জন্যে ড্যাগারগুলো চাই। আসলেও কি তাই? তবে কথা যখন দিয়ে ফেলেছে ড্যাগার দিতেই হবে। অবশ্য যথাসময়ে ওগুলো ফেরত পাবে বলে আর্থারের ওপর আস্থা আছে তার। কারণ ফ্রেডরিক আর্থারকে সে পছন্দ করে, বিশ্বাসও করে।

.

‘শীলা!’ গলা চড়িয়ে ডাকল আর্থার। আজ অবশ্য শীলার বাড়ি থাকার কথা নয়। শপিং-এ যাবে শুনেছে আর্থার। সাড়া না পেয়ে বুঝল শপিংয়েই গেছে শীলা। খুশি হলো ও। শীলা বাড়িতে না থেকে ভাল হয়েছে। বাড়ি থাকলে ড্যাগার নিয়ে নানা প্রশ্ন করত এবং আর্থারের জবাবে হয়তো তাকে সন্তুষ্ট করতে পারত না।

গ্লাস ভরে ব্রান্ডি নিল আর্থার, হলঘরে পায়চারি করছে। বেশি পান করে ফেলছে, বুঝতে পারছে। তাতে কি যায় আসে? ‘চলে এসো, চলে এসো,’ বিড়বিড় করছে আর্থার। উইলিস বলেছে ছ’টার মধ্যে প্যাকেজটা পাঠিয়ে দেবে।

বেজে উঠল ডোরবেল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল আর্থার। এক পুলিশ একটা প্যাকেজ দিল ওকে, দস্তখত করতে বলল। তারপর স্যালুট মেরে চলে গেল। আর্থার দরজা বন্ধ করে চলে এল স্টাডিতে। র‍্যাপিং পেপারটা শক্ত করে আটকানো। খুলতে কষ্ট হচ্ছে আর্থারের। ছুরি দিয়ে কাটতে শুরু করল পেপার। তারপর দু’হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল কাগজ। উহ করে উঠল। ছুরির খোঁচা খেয়েছে তালুতে। ফেলে দিল প্যাকেট, সরু ধারায় বেরিয়ে আসছে রক্ত, চুষতে লাগল আর্থার।

মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে লেবেল লাগানো ড্যাগারগুলো। একটা খাড়া ভাবে বিঁধে গেছে মেঝেতে, বাঁটটা মৃদু দুলছে, লেবেলটাকে পতাকার মত লাগল।

হাত বাড়াল আর্থার ড্যাগারটাকে তুলে নেয়ার জন্যে, আঙুলের ফাঁক বেয়ে বাঁটে, রক্তের ফোঁটা পড়ল। বাথরুমে ছুটল ও, দ্রুত ব্যান্ডেজের বাক্স টেনে নিল। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধছে, লক্ষ করল তালুর ভাঁজের রেখাটা কেটে গেছে ড্যাগারের খোঁচায়। জ্যোতিষীরা ওই রেখাটাকে বলে লাইফ লাইন। রেখাটা ওর মাঝবয়সটাকে যেখানে ইঙ্গিত করছে ঠিক সেই জায়গাটায় কেটে গেছে।

ব্যান্ডেজ বেঁধে স্টাডিতে ফিরে এল আর্থার। ড্যাগারটা এখনও দুলছে, বাঁটে রক্ত। ছুরিটা টেনে ওঠাল ও, টিস্যু দিয়ে রক্ত মুছল। যীশুর সারা শরীরে লেগে গেছে রক্ত। বাথরুমে গিয়ে ড্যাগারটা ভাল করে ধুলো আর্থার, তোয়ালে দিয়ে মুছে আবার চলে এল পড়ার ঘরে। ডেস্কের ড্রয়ার খুলে বের করল ডি কার্লোর দেয়া ড্যাগারটা, তারপর অন্যগুলোর সাথে ওটাকে সহ একটা ক্রুশের আকার দিল।

যীশুর ছয়টি যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ চেয়ে আছে আর্থারের দিকে। ফাঁকা চোখে ওদিকে তাকিয়ে রইল সে, দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না। যেন সম্মোহন করা হয়েছে ওকে।

কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিল বলতে পারবে না আর্থার, সংবিৎ ফিরে পেল সদর দরজা খোলার শব্দে। দ্রুত ড্যাগারগুলো ঢুকিয়ে ফেলল দেরাজে। শীলা এসে পড়েছে।

.

ভীষণ গরম পড়েছে। রেডিওতে ঘোষণা করা হয়েছে স্মরণকালের উষ্ণতম দিন আজ। বুহের আর ছেলেটা পেরিফোর্ডের বাগানে হাঁটছে, তাদের সাথে ছায়ার মত লেগে আছে কুকুরটা।

‘মীটিং-এ আর কিছু করার আছে?’ ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল বুহেরকে।

‘না,’ জবাব দিল বুহের। ‘সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন।’

‘বেশ। এবার সময় এসেছে কিছু ঘটার।’

বুহের জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কি ঘটবে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা, যেন ধাক্কা খেয়েছে। ঘুরে দাঁড়াল সে, তাকাল গাছের সারির দিকে। বুহের অনুসরণ করল তার দৃষ্টি। আধা মাইল দূরে, জঙ্গলের মধ্যে ঝিক্ করে উঠল সূর্য রশ্মি।

মৃদু গলায় গরগর শব্দ করল কুকুরটা।

সে তার লোক পাঠিয়েছে আমার জন্যে,’ বলল ছেলেটা। ‘ঈশ্বরের পুত্রের এজেন্ট এসেছে আমাকে ধ্বংস করতে।’

নড়ে উঠল কুকুরটা, পা বাড়াল জঙ্গলের দিকে। ছেলেটা দেখল ওকে।

‘আমি তার উপস্থিতি টের পাই সবখানে,’ ফিসফিস করল সে।

‘সে আমার আত্মা ছিদ্র করে ঢুকে পড়ছে। তার ধর্মানুরাগ চুইয়ে চুইয়ে ঢুকছে আমার হাড়ের মজ্জায়।’

শিউরে উঠল বুহের। ছেলেটার মনের অবস্থা সে বুঝতে পারছে। কারণ ঈশ্বর পুত্রের শক্তি সে-ও টের পায়। প্রতি রাতে তার কণ্ঠ শোনে সে, সকালে অদৃশ্য হয়ে যায় কণ্ঠটা স্বপ্নের মত।

ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে কুকুর, ছেলেটা ফিরল বাড়ির দিকে। ‘আমার জন্যে প্রার্থনা করুন, পল। শিষ্যদের বলুন প্রার্থনা করতে। সবার সম্মিলিত শক্তি আমার প্রয়োজন।’

ছেলেটা চলে যাচ্ছে, দেখছে ওকে বুহের। বুড়ো মানুষের মত ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা ফেলছে। তারপর চোখ ফেরাল পাহাড়ের দিকে। গাছের সারির আড়াল থেকে এখনও ঝিলিক দিচ্ছে সূর্য। এক মুহূর্ত ওদিকে তাকিয়ে রইল বুহের, তারপর ঘুরে অনুসরণ করল ছেলেটাকে। এত গরমের মধ্যেও হঠাৎ শীত লাগছে ওর।

.

বিনকিউলার নামিয়ে রাখল আর্থার, গভীর শ্বাস নিল। স্যাঁতসেঁতে বাতাস ঢুকে গেল ফুসফুসে। শরীর কাঁপছে ওর। অমন চোখ জীবনে দেখেনি সে। মরা মানুষের চোখ, অভিব্যক্তিশূন্য। দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ও। ঘাড় ঘুরিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকাল। ওখানে একটা হ্যাভারস্যাকে পাঁচটা ড্যাগার রেখে এসেছে। ছয় নম্বরটা ওর হাতে। বুঝতে পারছে প্রীস্ট ওকে যা বলেছে সে কাজ জীবনেও করতে পারবে না ও। এ অসম্ভব। ওরকম কথা ভাবাই তো পাগলামি।

দেয়ালের ওপর থেকে লাফ দিতে যাচ্ছে আর্থার, এমন সময় ঝোপের আড়াল থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে এল কুকুরটা। এমন বিশাল জানোয়ার কোনদিন দেখেনি ও। শক্তি যেন ফুঁড়ে বেরুচ্ছে গা থেকে। চট করে পা-টা টেনে নিল আর্থার দেয়ালের ওপর, উবু হয়ে বসল। লাফিয়ে লাফিয়ে আসছিল কুকুরটা, চলার ছন্দে বিরতি না দিয়ে শূন্যে গা ভাসিয়ে দিল ওটা। প্রকাণ্ড লাফে আর্থারের কাছে এসে পড়ল, সামনের থাবা জোড়া বাড়ি খেল দেয়ালে, তিন ফুট দূরে সশব্দে বন্ধ হলো প্রকাণ্ড চোয়াল।

আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল আর্থারের চোখ, চোয়াল আর হলুদ চোখ জোড়া দেখছে। লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে ছিটকে পড়ল কুকুরটা, আবার লাফ দিল। কোন শব্দ করছে না, শুধু দাঁতে দাঁত ঘষা খাওয়ার শব্দ হচ্ছে।

দুলে উঠল আর্থার দেয়ালের ওপর, অদম্য ইচ্ছে হলো লাফিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে সমুদ্র ভ্রমণে, জাহাজের ডেকে দাঁড়ালে যেমন পানিতে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনি। চোখ বুজে ফেলল ও। ক্রুশের ওপর সেই শিশুর ছবিটা ভেসে উঠল সামনে।

মাথা ঝাঁকাল আর্থার, ছবিটাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে, নাক কুঁচকে উঠল

বোটকা একটা গন্ধে। কুকুরটার গা থেকে আসছে। ড্যাগারের বাঁট চেপে ধরল ও, ধরেই থাকল। যীশুর মুকুটের কাঁটাগুলো ফুটে গেল হাতের তালুতে। ব্যথাটা আবার সচেতন করে তুলল ওকে। চাইল চোখ মেলে। সাথে সাথে হ্যালুসিনেশন থেকে মুক্ত হলো আর্থার।

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ও, তাকাল কুকুরটার দিকে। নড়ছে না ওটা, কটমট করে তাকিয়ে আছে আর্থারের দিকে। আর্থার দ্বিতীয়বার আর তাকাল না ওটার দিকে। দ্রুত এগোল দেয়ালের দূর প্রান্তে, নেমে পড়ল। হ্যাভারস্যাকটা কাঁধে ঝোলাচ্ছে, শুনতে পেল প্রলম্বিত একটা চিৎকার। ব্যর্থ আক্রোশে করুণ সুরে ডাকছে কুকুরটা।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৭

সতেরো

রবার্ট স্টিভেনসন জানালা দিয়ে তাকাতে লিমোজিনের প্রথম বহরটাকে দেখতে পেলেন। গাড়ি থেকে নামতেই প্রেস ফটোগ্রাফার আর টেলিভিশন ক্রুরা তাদেরকে মৌমাছির মত ছেঁকে ধরল। তৃপ্তির হাসি হাসলেন স্টিভেনসন। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছে। এরপর থেকে যা-ই ঘটুক না কেন, ইতিহাসে তার নাম যে স্থান পেতে চলেছে তা ধ্রুব সত্য। তিনি প্রায় একাই এই মীটিং-এর ব্যবস্থা করেছেন। ইসরায়েলিরা সিরিয়ান আর লেবানিজদের সাথে হাত মেলাতে যাচ্ছে। বিশেষ করে এমন এক লেবানিজের সাথে তারা হাত মেলাবে যার কিনা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-র সাথে সম্পর্ক রয়েছে। সকল পক্ষই কিছুটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছে, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দিতে চলেছেন ফরেন সেক্রেটারি।

এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক মত চলছে দেখে তিনি কল্পনার ফানুস ওড়ালেন; সাদাতের পর এই প্রথম ইসরায়েলি আর লেবানিজদের মাঝে সত্যিকার শান্তির সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। তবে যদি উল্টোটা ঘটে? ভাবতে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামতে লাগল। এদের প্রত্যেকের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে: লেবানিজ, সিরিয়ান, লিবিয়ান। যদিও কেউই স্বীকার করেনি ব্যাপারটা। কেউ বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করলে কেয়ামত শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, নিজেকে প্রশ্ন করলেন স্টিভেনসন, সমস্যা হবে এমনটি ভাবছেন কেন তিনি? চুক্তি তো তৈরি হয়েই গেছে, শুধু আকর্ষণীয়ভাবে ঘোষণার অপেক্ষা

কিংস চার্লস স্ট্রীট থেকে হোয়াইট হলের দিকে দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল স্টিভেনসনের। ইসরায়েলিরা আসছে। আবার চঞ্চল হয়ে উঠল সাংবাদিকরা। রাস্তার দু’পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। তবে কারও হাতে কোন ব্যানার নেই। মুচকি হাসলেন রবার্ট। লোকজন তাদের সন্তানদের বলতে পারবে ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদদের তারা এক দরজা দিয়ে ঢুকতে এবং বেরুতে দেখেছে। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে আন্দোলনেরও কোন ব্যানার চোখে পড়ল না। ট্রাফালগার স্কোয়ার ট্রাজেডি তাদেরকে নেতাশূন্য করে দিয়েছে। তারা এখনও শোক সামলে উঠতে পারেনি।

গভীর করে শ্বাস নিলেন রবার্ট স্টিভেনসন, আয়নায় নিজেকে দেখলেন একবার। তারপর পা বাড়ালেন সিঁড়ির দিকে। আর ষাট মিনিটের মধ্যে তিনি ভূষিত হতে চলেছেন বিশ্বের অন্যতম শান্তিরক্ষক হিসেবে…

.

কনফারেন্স রুমে, সেক্রেটারি অভ স্টেটের পেছনে গিয়ে বসল ফ্রেডরিক আর্থার।

প্রকাণ্ডদেহী লোকটা ঘুরে নড় করল ওকে। আর্থার মনে মনে প্রার্থনা করল সেক্রেটারি যেন তাকে জিজ্ঞেস না করে বসে সেদিন মীটিং-এ সে অনুপস্থিত ছিল কেন? রোম যাত্রার ব্যাখ্যা কি দেবে আর্থার?

শুরু হয়ে গেল মীটিং। সিরিয়ান এবং লেবানিজরা পাশাপাশি বসেছে, রাশানরা তাদের পেছনে। ওপেক-এর সদস্যরা এক সাথে বসেছে। ইসরায়েলিরা আসন নিয়েছে আমেরিকানদের ডান পাশে।

কয়েকজনের বক্তৃতা শেষ হবার পর রবার্ট স্টিভেনসন ঘোষণা করলেন, ‘এবার পূর্ব জেরুজালেমের বিতর্কিত এলাকা নিয়ে কথা বলতে আসছেন সিরিয়ান ডেলিগেট।’

একটা টেলিভিশন ক্যামেরা চট করে ঘুরে গেল দীর্ঘদেহী এক সিরিয়ানের দিকে। সে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল নোটের ওপর চোখ রেখে। মাতৃ ভাষায় বলতে শুরু করল সিরিয়ান। আর্থার হেডফোন লাগাল মাথায় অনুবাদ শোনার জন্যে। সিরিয়ানের বক্তৃতা শুনছে সবাই চুপচাপ। এক পর্যায়ে আরাফাতের প্রসঙ্গ তুলল সে। বলল, বুড়ো মানুষটাকে এ পর্যন্ত কতবার গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবু তিনি এখন পর্যন্ত সাহসের সাথে শক্তির বলগা ধরে আছেন।

কিংবদন্তীর পিএলও’র নেতার নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হিব্রু ভাষায় চিৎকার করে কি যেন বলল সে। আর্থার সহ সবাই তাকাল তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে।

দাঁড়িয়ে পড়লেন রবার্ট স্টিভেনসন, বক্সিং রেফারির মত হাত উঠে গেছে শূন্যে, মুখ থেকে সরে গেছে রক্ত।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাফ দিয়ে পড়ল নিজের টেবিলের ওপর দিয়ে, ছুটল সিরিয়ানকে লক্ষ্য করে। একজন তার পথ আটকে দাঁড়াতে চেয়েছিল, তবে দেরি হয়ে গেছে অনেক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি একটা ছুঁড়ে মেরেছে, আলো প্রতিফলিত হলো ওটার ওপর। ভারী একটা অ্যাশট্রে, ধাঁই করে লাগল সিরিয়ান ডেলিগেটের মুখে। আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা, দাঁত ভেঙে গেছে, রক্তে ভেসে গেল টেবিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাফিয়ে পড়ল তার ওপর, গালাগাল দিচ্ছে, তাকে সরিয়ে নেয়ার আগেই আবার আঘাত করে বসল সে।

কয়েকটা সেকেন্ড নিশ্চুপ হয়ে গেল চারপাশ, সবাই হাঁ করে দেখছে মারামারি। তারপর যা শুরু হলো তা কহতব্য নয়। স্রেফ নরক ভেঙে পড়ল কনফারেন্স রুমে। সিরিয়ান আর লেবানিজদের সাথে ইসরায়েলিদের ভয়ানক হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। অন্যান্য ডেলিগেটরাও দাঁড়িয়ে যা ইচ্ছে তাই গালাগালি শুরু করে দিল। সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে, স্টিভেনসন ছাড়া। বসে বসে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছেন তিনি হতাশ ভঙ্গিতে।

রাশানরা তাড়াতাড়ি কাগজপত্র নিয়ে কেটে পড়ল, তাদের পিছু পিছু গেল ইউ.এস সেক্রেটারি অভ স্টেট এবং ফ্রেডরিক আর্থার। বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে শুনল কে একজন ইংরেজীতে ওদের থামতে বলছে। কিন্তু কেউ থামল না।

 

 

.

আর্থার গাড়িতে উঠছে, শুনল রেডিওতে ইসরায়েলি-সিরিয়ানদের মারামারির খবর প্রচার শুরু হয়েছে। অফিসে পৌছার পর অসংখ্য ডিপ্লোম্যাটিক টেলেক্স আর ফোন পেল সে। তিন ঘণ্টা পর ডেস্ক ছেড়ে ওঠার ফুরসত মিলল। ততক্ষণে হাত ব্যথা হয়ে গেছে তার ফোন ধরে।

সেক্রেটারি বলল, ‘আপনার স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন মি. বুহেরের ডিনারে যাবেন কিনা।’

চোখ পিটপিট করল আর্থার। বুহেরের কোন দাওয়াতের খবর সে জানে না।

‘ডিনার, স্যার,’ ব্যাখ্যা করল মেয়েটা। ‘পেরিফোর্ডে। সাড়ে আটটার সময়। উনি বললেন আপনি ভুলে যেতে পারেন।’

আর্থার ধন্যবাদ দিল সেক্রেটারিকে।

‘উনি বলেছেন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে নাকি মি. বুহের এটাকে লাস্ট সাপার বলে অভিহিত করেছেন।’

‘রসিক জন,’ মন্তব্য করল আর্থার, তারপর হেসে উঠল দু’জনে একসাথে।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৮

আঠারো

অপরূপ সেজেছে শীলা। চোখ ফেরাতে পারছে না আর্থার। বিয়ের পর ছ’বছর হয়ে গেল, এখনও শীলাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে দেখলে অদ্ভুত কামনা অনুভব করে সে। এ মুহূর্তে, বিভিন্ন জায়গা থেকে টেলেক্স আসছে, টিভিতে খবর হচ্ছে, সব ভুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে আর্থার। শীলা একটা টুলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।

অনেক কষ্টে ওর ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে টিভির প্রতি নজর দিল আর্থার। সংবাদ পাঠক আসন্ন এক ঝড়ের কথা বলছে। ঝড় শুরু হতে যাচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। সিরিয়ানরা নেসেটের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে, রাশান অ্যামবাসাডরকে তুলে নেয়া হচ্ছে তেল আবিব থেকে। ডিপ্লোম্যাটিক টেলেক্সগুলোয় চোখ বুলাল আর্থার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।

‘কি ঘটবে বলে তোমার ধারণা?’ উঠে দাঁড়াল শীলা, শরীরে ঢেউ তুলে ঘুরল, বড় বড় চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।

ঢোক গিলল আর্থার। শীলাকে এত আকর্ষণীয় এর আগে আর কখনও মনে হয়নি তার। ওর সাথে এক্ষুণি, এখানে প্রেম করার অদম্য বাসনা জাগল মনে।

‘অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না,’ শীলার দিকে এগিয়ে গেল আর্থার। কি ঘটবে ভালই জানা আছে তার। কিন্তু আসল কথা বলে ওকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না। স্ত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড়াল আর্থার। কিন্তু শীলার তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষতে শুরু করল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর্থার। ‘আবার বলো তো পল কবে আমাদের দাওয়াত দিয়েছে।’

‘গত হপ্তায়। বললামই তো। একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তোমাকে বলেওছিলাম। তুমি শুধু মুচকি হেসেছ।’

শ্রাগ করল আর্থার। ব্যাপারটা মনে পড়ছে না। তবে শীলা যখন বলছে তখন তা সত্যি হবারই কথা।

‘তুমি রেডি?’ বলল আর্থার। ‘আমি গাড়িতে গেলাম।’

জবাবে মাথা ঝাঁকাল শীলা।

ওর ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়ল আর্থার। ঘর থেকে বেরিয়েই ছুটল সিঁড়ির দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখল শীলা ওকে অনুসরণ করছে কিনা। স্টাডিতে ঢুকল আর্থার। ড্রয়ার খুলে হ্যাভারস্যাকটা বের করল। উল বোনার কাঁটার মত ড্যাগারের ডগা ফুটে আছে কাপড়ে। সদর দরজা খোলার আগে আবার তাকাল সিঁড়ির দিকে। স্যাঁতসেঁতে বাতাস ধাক্কা মারল নাকে। খুক খুক কাশল আর্থার। পুবাকাশ থেকে ভারী মেঘ ছুটে আসছে, কুকুরের মত বাতাসের গন্ধ শুঁকল ও। মনে পড়ে গেল বাবার কথা। বাবা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন বৃষ্টি হবে কিনা। বলতেন বজ্রপাতের শব্দটা আসলে কিছু না-ঈশ্বর তাঁর আসবাবপত্র সরানোর সময় অমন আওয়াজ হয়। আজ রাতে ঈশ্বর অনেক আসবাব সরাবেন, গম্ভীর হয়ে ভাবল আর্থার।

কাঁকর বিছানো রাস্তা ধরে এক ছুটে গ্যারেজে পৌঁছে গেল ও, দেখল না শীলা জানালার ফাঁক দিয়ে লক্ষ করছে ওকে।

গাড়ি স্টার্ট দিল আর্থার, হ্যাভারস্যাকটা চালান করল ড্রাইভিং সীটের নিচে 1 পোশাকের কোনা উঁচু করে ধরে ছুটতে ছুটতে এল শীলা। গাড়িতে ঢোকার আগ মুহূর্তে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল গায়ে।

নুয়ে দরজা খুলে দিল আর্থার, খেয়াল করল হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপ পেঁচিয়ে গেছে গিয়ার স্টিকের সাথে। দ্রুত প্যাঁচ খুলে ওটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল শীলা দেখে ফেলার আগে। ‘কি খুঁজছ?’ সীটে বসে জানতে চাইল শীলা।

‘কিছু না,’ আর্থার চুমু খেল ওর গালে। ‘তোমাকে দারুণ লাগছে।’

‘ধন্যবাদ,’ বলে আয়না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শীলা। বৃষ্টিতে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেল কিনা দেখার জন্যে।

নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল গাড়ি, ক্যাসেট প্লেয়ারে রিকি মার্টিনের গান বাজছে। রিকি শীলার প্রিয় গায়ক। ‘মারিয়া’ গানটার সুরে তাল মেলাতে লাগল সে। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল আর্থার। একটুও বাড়িয়ে বলেনি ও। সত্যি দারুণ লাগছে শীলাকে। ইচ্ছে করল ওকে জড়িয়ে ধরে রাখে শক্ত করে, কেউ যেন ওর ক্ষতি করতে না পারে।

গান শেষ হয়ে গেল। আর্থার সুযোগ বুঝে প্রশ্নটা করল, ‘আমি যদি আজ রাতে কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়ে যাই, পলকে ব্যস্ত রাখতে পারবে তুমি?’

হাসল শীলা। ‘মানে? আমাকে বেশ্যা সাজতে বলছ তুমি? একটা ভুরু কপালে উঠে গেল কৌতুকের ভঙ্গিতে।

‘আমি কি অমন কথা বলতে পারি?’

সীটে গা এলিয়ে দিল শীলা। ‘আচ্ছা, বলো তো সত্তর বছরের বুড়োর জিনিসের সাইজটা কেমন হবে?’

‘চিনেবাদামের মত,’ বলল আর্থার। ‘বড় জোর আখরোটের সমান।’ ভাবল, ইদানীং কত স্বচ্ছন্দে এসব শব্দ উচ্চারণ করছে শীলা। অথচ বিয়ের পর ও গুষ্টি মারি’ বললেও লজ্জায় লাল হয়ে যেত মেয়েটা।

খিক খিক হাসল শীলা, হাত বাড়িয়ে চালু করে দিল ক্যাসেটের উল্টোপিঠ। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আর্থার। ভাগ্যিস শীলা জানতে চায়নি কেন সে বাড়িটাতে চক্কর দিতে চায়। জানতে চাইলে মুশকিল হত আর্থারের। বানিয়ে কি বলত সে?

মোটরওয়ে এক্সিট সাইনটা দেখা গেল, মোড় ঘুরল আর্থার। ঘড়ির দিকে চাইল, তারপর টেপ বন্ধ করে খবর শুনল।

…মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে জানার পর তেল আবিবে রাশান ডেলিগেশনরা তাদের এমব্যাসী ত্যাগ করেছেন। আমাদের পলিটিকাল এডিটর ক্লেয়ার ম্যাকডালি বলেছেন…

খবর শুনতে শুনতে আর্থারের মনে পড়ে গেল ছেলেটার কথা। কল্পনায় ভেসে উঠল মরা চোখ দুটো। জানে না ছেলেটার মুখোমুখি হবার সুযোগ তার হবে কিনা। তবে চেষ্টার ত্রুটি করবে না আর্থার। শুধু মুখোমুখি হয়েই তার দায়িত্ব শেষ। এরপরের কাজ ডি কার্লোর ঈশ্বর যা করার করবেন।

‘এদিকে আগে এসেছ কখনও?’ শীলার গলা শুনে বাস্তবে ফিরে এল আর্থার।

মাথা নাড়ল। ‘কেন?’

‘যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছ মনে হচ্ছে এদিকের পথঘাট সব তোমার চেনা।’

‘আসার আগে ম্যাপে চোখ বুলিয়ে নিয়েছি।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকাল শীলা। খানিক পর পেরিফোর্ডের অট্টালিকার প্রকাণ্ড গেটের সামনে হাজির হয়ে গেল ওরা। জানালা নামিয়ে হাত বাড়াল আর্থার, টিপে দিল গেট পোস্টের বোতাম। বলল নিজের নাম। খুলে গেল গেট। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা।

দরজায় ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল পল বুহের। তাকে দেখে খিলখিল হাসল শীলা। বলল, ‘চিনেবাদাম।’

গাড়ি থামাল আর্থার, নামার সময় জুতোর ডগায় টান লাগল হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপ, ঠুন শব্দ হলো। তবে শীলা লক্ষ করল না ব্যাপারটা। বুহের হেঁটে এল ওদের কাছে, শীলার দিকের দরজা খুলে ধরল। শীলা নামতে চুমু খেল ওকে, তারপর ঘুরল আর্থারের দিকে।

‘তুমি এসেছ খুব খুশি হয়েছি,’ হাত মেলাতে মেলাতে বলল বুহের। ভাবিনি এমন পরিস্থিতিতে আসতে পারবে।’

মোবাইলে টোকা দিল আর্থার। ‘আশা করি ডিনারের মজা এ জিনিসটা নষ্ট করবে না।’

শীলার হাত ধরে নিয়ে চলল বুহের, ওদের পিছু পিছু এগোল আর্থার।

ওরা হলঘরে ঢুকল। বাটলারের সালামের জবাবে মাথা ঝাঁকাল আর্থার। তাকাল গ্যালারির দিকে। সিঁড়ি এঁকেবেঁকে উঠে গেছে দোতলায়। করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে চাইছে ও, বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছে ছেলেটা কোথায় থাকতে পারে। শ্বাস টানল ও, লিভিংরুমে ফায়ারপ্লেসের ধোঁয়ার গন্ধ পেল শুধু।

ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর সামনে ওদের নিয়ে গেল বুহের। এখান থেকে বাগানটা পরিষ্কার দেখা যায়। ফ্লাডলাইটের আলোতে ঝলমল করছে লন আর বাগান।

‘পরে তোমাদের বাগানে নিয়ে যাব,’ বলল বুহের।

শীলাকে খুঁজল আর্থার। দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংগুলো দেখছে সে ঘুরে ঘুরে। হাত তুলে ডাকল স্বামীকে। দাঁড়িয়ে পড়েছে একটা পোর্ট্রেটের নিচে। ওদিকে পা বাড়াল আর্থার। ডেমিয়েন থর্নের ছবি। নিচে লেখা ইউ.এস অ্যামব্যাসাডর।

‘তোমাকে বলেছিলাম না ও খুব সুন্দর দেখতে,’ ফিসফিস করে বলল শীলা, চোখ টিপল।

বুহের যোগ দিল ওদের সাথে, হাসল শীলার কথা শুনে। ‘মেয়েদের সহজেই আকর্ষণ করতে পারত ডেমিয়েন,’ বলল সে।

‘কিন্তু ওর বাচ্চাকাচ্চা হয়নি?’ প্রশ্ন করল আর্থার।

অবাক চোখে স্বামীকে দেখল শীলা। ‘ও কথা বললে কেন তুমি? কিসের মধ্যে কি!

আর্থার শ্রাগ করে ফিরল বুহেরের দিকে। ‘ভদ্রলোক বংশ রক্ষার ব্যবস্থা করে যাননি জেনে অবাক লাগছে।’

‘মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মারা যায় সে,’ বলল বুহের।

‘শুনেছি। ওঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখেছি।’

হঠাৎ নীরবতা নেমে এল ঘরে। কেউ কিছু বলছে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল দরজা খোলার শব্দে। বাটলার জানাল ডিনার রেডি।

আবার শীলার হাত ধরল বুহের, বো করল। ‘তোমাদের বোধহয় খিদে পেয়েছে।’ বলে দু’জনকে নিয়ে বেরিয়ে এল সে ঘর থেকে।

হল পার হয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকল ওরা। বাটলার যার যার চেয়ার দেখিয়ে দিল। টেবিলের মাঝখানে, সুদৃশ্য মোমদানিতে ছ’টা কালো মোম জ্বলছে। লনের দিকে মুখ ফেরানো ফ্রেঞ্চ উইন্ডোগুলো খোলা। তারাজ্বলা আকাশ দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁকে।

বসার সময় আর্থারের ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে আর কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে কিনা। ডিনার পার্টিতে নারী সঙ্গ ছাড়া বুহেরের জমে না। তবে আজ বোধহয় আর কাউকে দাওয়াত দেয়নি সে। তিনটে প্লেট দেখা যাচ্ছে শুধু।

শীলার দিকে ফিরল আর্থার। আবার অনুভব করল ওকে ছাড়া তার চলবে না। এত অপরূপ লাগেনি কখনও শীলাকে। কালো, গা খোলা পোশাকটা ফর্সা শরীরে মানিয়ে গেছে দারুণ। শুধু আকর্ষণীয় বা অপরূপ বললে কম বলা হবে। বলা উচিত আগুনের মত জ্বলছে শীলা। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসল আর্থার। জবাবে শীলাও মিষ্টি হাসল। বুহেরকে ছোট বেলার গল্প বলছে সে। হাসছে বুহের।

পাঁচ ‘কোর্সের ডিনার। গল্প-গুজবে জমে উঠল বেশ। গল্প আসলে বলছে শীলা, ওরা শ্রোতা মাত্র। আকাশে মেঘ জমেছে, ঘরে আঁধার যেন ঘনিয়ে এসেছে আরও। মোমবাতির আলোয় সত্যি জ্বলছে শীলা। ও খানিকটা প্রগলভ হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মদ পানের ফল।

পাঁচ নম্বর কোর্স পরিবেশন করা হলো ভিলের সাথে। খিদে নেই তবু জোর করে গিলছে আর্থার। ওদের গল্পে মন দিতে পারছে না। কেটে পড়ার কথা ভাবছে। বাড়িটা ঘুরে দেখা দরকার। ছেলেটার খোঁজ পাওয়া দরকার। টেবিল ছাড়ার মওকা করে দিল মোবাইল ফোন। বেজে উঠল হঠাৎ।

‘এক্সকিউজ মি,’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আর্থার।

‘ড্রইংরুমে বসে কথা বলতে পারো,’ বলল বুহের।

ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল আর্থার, দরজা বন্ধ করার সময় চাইল একবার পেছন ফিরে। বুহের এবং শীলার গল্প থেমে গেছে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে নীরবে।

এ ফোনটার অপেক্ষায় ছিল আর্থার। বার দুই হুঁ হাঁ করল ও, তারপর অফ করে দিল মোবাইল। তাকাল আয়নার দিকে। ভালই লাগছে দেখতে। বিষণ্ণ লাগছে না। বুকও ধড়ফড় করছে না। পালস স্বাভাবিক। জানালা দিয়ে আকাশ দেখল। তারপর দৃঢ় পায়ে ফিরে এল ডাইনিং রুমে।

বুহের এবং শীলা আগের মতই চুপচাপ বসে আছে। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল আর্থার, হাত রাখল স্ত্রীর কাঁধে

‘ঘটনা শুরু হয়ে গেছে,’ বলল সে। ‘তেল আবিব এবং জেরুজালেমে বোমা পড়েছে।’

মুখ তুলে চাইল ওরা, কিছু বলল না।

‘স্যাটেলাইটে দৃশ্যটা ধরা পড়েছে,’ বলল আর্থার। ‘নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। বৈরুত থেকে কোন প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যাবে। ইসরায়েলে হামলা হবার মানে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ শুরু।’

‘চোখের বদলে চোখ,’ বলল শীলা। তার দিকে তাকাল আর্থার। এক কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপ খসে পড়েছে, বুক প্রায় উন্মুক্ত। তবে সেদিকে খেয়াল নেই শীলার। মোমের আলোয় চকচক করছে চোখ। মাতাল হয়ে গেল নাকি, ভাবল আর্থার।

অন্যদিকে মনোনিবেশের চেষ্টা করল আর্থার। মধ্যপ্রাচ্য এখন উত্তপ্ত তাওয়া, মিসাইল হামলা হয়তো শুরু হয়ে যাবে শীঘ্রি। কি ঘটবে বুঝতে পারছে আর্থার। এর জন্যে প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি শুরু হয়ে যাবার পর মনে হচ্ছে এত চাপ সে সহ্য করতে পারবে না।

উঠে দাঁড়াল বুহের, ধাক্কা লেগে একটা মদের গ্লাস পড়ে গেল মেঝেতে। রক্তের মত ছড়িয়ে পড়ছে তরল পদার্থটা, ওদিকে ফিরেও চাইল না সে।

‘যারা জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে,’ একঘেয়ে সুরে বলল সে। ‘তাদের মাংস পচে গলে খসে পড়বে।’

চেয়ার সরিয়ে সিধে হলো শীলাও, দাঁড়াল বুহেরের পাশে। তার দিকে স্থির তাকিয়ে বলল, ‘তাদের চক্ষু পচে যাবে কোটরের মধ্যে। তাদের জিভ পচবে মুখের ভেতর।’

আর্থার নাম ধরে ডাকল শীলার, হাত বাড়াল। ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল শীলা।

‘ইসরায়েল প্রচণ্ড নাড়া খাবে,’ বলল বুহের। ‘একই ঘটনা ঘটবে সমুদ্রের মাছ, স্বর্গের পাখি, মাঠের পশু এবং পৃথিবীর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে চলা সমস্ত প্রাণীর ‘ভাগ্যে…’ বলে চলল শীলা

‘… এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষ,’ আগের গলায় বলল বুহের। ‘আমার উপস্থিতিতে ধাক্কা খাবে, ভেঙে পড়বে পাহাড়, এবং সমস্ত দেয়াল।’

 

 

‘শীলা!’ চেঁচিয়ে উঠল আর্থার। ওকে ধরতে গিয়ে প্রচণ্ড ছ্যাঁকা খেল হাতে। প্রচণ্ড গরম শীলার শরীর, যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আর্থার বুঝতে পারছে ওরা বাইবেল থেকে ‘কোট’ করছে। ওরা বলে চলল:-

‘প্রতিটি মানুষের তরবারি ঝলসে উঠবে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে,’ একযোগে চেঁচাল দু’জনে। ‘আমি মহামারী এবং রক্ত ছড়িয়ে দেব তার বিরুদ্ধে, আমি তার ওপর বর্ষণ করব বৃষ্টি, তার শিষ্য এবং লোকদের ওপর প্রবল বৃষ্টি ঝরাব এবং ছুঁড়ে মারব শিলাখণ্ড, আগুন ও গন্ধক।’

তীক্ষ্ণ গলায় হেসে উঠল শীলা, ওর কাছ থেকে সরে গেল আর্থার। দরজার দিকে পা বাড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতে দেখল ওরা পরস্পরের হাত ধরে আছে, শীলার কথাটা মনে পড়ে গেল আর্থারের: ‘তুমি আমাকে বেশ্যা সাজতে বলছ?’

‘এবং যখন দেখবে জেরুজালেম ভরে গেছে সৈন্যতে, জানবে ধ্বংস সমাগত,’ বলল বুহের।

তরুণ সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে গেল আর্থারের। মনে হলো অনেক আগের ঘটনা ওটা, অন্য সময়ের, যখন সামান্য আশা তখনও প্রজ্জ্বলিত ছিল।

‘এ হবে প্রতিশোধের দিন,’ বলল শীলা, ‘যে সব ঘটনার কথা লেখা আছে তা সব ঘটবে।’

হলওয়ের দিকে যাচ্ছে আর্থার, ওদের গলা পরিষ্কার শুনতে পেল।

‘অ-ইহুদিদের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে জেরুজালেম, যত দিন না পর্যন্ত অ- ইহুদিদের শাসনকাল পূর্ণ হয়…’

দরজায় হোঁচট খেল আর্থার, কি করছে বুঝতে পারছে না। শুধু জানে এখান থেকে চলে যাবার আগে ড্যাগারসহ ছেলেটাকে খুঁজে পেতে হবে।

গাড়ির দরজা খুলল ও, হ্যাভারস্যাকটা বের করে কাঁধে ঝোলাল। পিঠে ড্যাগারের ছুঁচাল ডগার খোঁচা খেয়ে ‘আউ!’ করে উঠল।

বুড়ো সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে গেল আর্থারের: ‘জাগ্রত যীশু আপনাকে সাহায্য করবেন।’ কথাগুলো মনে মনে আওড়াল ও। ব্যাপারটা এখন তাঁর ওপর নির্ভর করছে। এটা তাঁর কর্তব্য। আর্থারের দায়িত্ব ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া। তারপর ডি কার্লোর ঈশ্বরের হাতে সব ছেড়ে দেবে সে। তিনি যা করার করবেন।

সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, মুখ তুলে চাইতে কুকুরটাকে দেখতে পেল আর্থার। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঘুরে দাঁড়াল ওটা, করিডর ধরে নিঃশব্দে হাঁটা দিল, যেন পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে আর্থারকে। দ্রুত ওপরে উঠে এল আর্থার, অনুসরণ করল জানোয়ারটাকে। ওর মন জুড়ে এখন ছেলেটার ভাবনা। তাকে যেমন করে হোক খুঁজে পেতে হবে।

করিডর অন্ধকার। শেষ মাথায় কালো একটা দরজা, ভেজানো। দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল কুকুরটা, আর্থারকে যাবার পথ করে দিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা, সামনের দৃশ্যটা দেখেই বুঝতে পারল তাকে এতদিন যা বলা হয়েছে তার মধ্যে অতিরঞ্জন নেই একরত্তি, সব সত্যি।

কালো একটা আলখেল্লা পরনে ছেলেটার, ঝুঁকে আছে লাশের পাশে, নিঃশব্দে ঠোঁট নড়ছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। দু’কদম বাড়ল আর্থার, ঠং শব্দ তুলল হ্যাভারস্যাকের ড্যাগার। তবে শব্দ শুনেও ঘুরল না ছেলেটা। যেন তাকে সম্মোহন করা হয়েছে।

যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে নিঃশব্দে এগোল আর্থার, শিরদাঁড়ায় বেঁধা ড্যাগারটা দেখল। সব খাপে খাপ মিলে গেছে। খামোকাই ফাদারকে এতদিন সন্দেহ করেছে সে। যীশুর চোখের দিকে চাইল সে, তারপর নজর ফেরাল লাশটার দিকে। ওর মেরুদণ্ডে শীতল একটা স্রোত নেমে এল।

চোখ বুজে প্রার্থনা করল আর্থার। যীশুর সাহায্য চাইছে। চোখ খুলল। এখন ও জানে ওকে কি করতে হবে। তবে সেই শক্তি ওর মাঝে আছে কিনা ভেবে সন্দেহ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে কেটে পড়ে, শীলার হাত ধরে, গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু যীশুর যন্ত্রণাকাতর চেহারার দিকে চোখ যেতে সে ইচ্ছেটা মরে গেল। কি জীবন্ত একটা মুখ!

যীশুর মূর্তির পেছনে চলে এল আর্থার, পিঠ থেকে টান মেরে ছুরি খুলল। মোমবাতির আলোয় ঝিলিক দিল ধারাল ফলা। যীশুর মুখ, মাথার কাঁটার মুকুট ইত্যাদি ছুঁলো ও। তারপর হ্যাভারস্যাকটা মেঝেতে নামিয়ে ছ’টা ড্যাগার বের করল।

ছেলেটা লাশের পায়ের কাছে এখনও হাঁটু গেড়ে বসে আছে, ক্রুশ থেকে ছুটিয়ে আনা ড্যাগারের বাঁটটা চেপে ধরল আর্থার দুই হাতে। তাকাল ছেলেটার দিকে। সুঠামদেহী ছেলেটার পাতলা আলখেল্লা ফুটে বেরিয়ে আছে পিঠের হাড়। পিঠে ছুরি বসিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু এভাবে চোরের মত পিঠে ছুরি বসানো আর্থারের পক্ষে সম্ভব নয়।

‘ক্ষমা করো, বিড়বিড় করল সে, হাত বাড়িয়ে ছেলেটার কাঁধ ধরে চাপ দিল যাতে সে আর্থারের দিকে ঘুরে বসে।

ঘুরল ছেলেটা, আর্থারের দিকে চাইল মুখ তুলে। মুখটা সাদা, চোখ দুটো হলুদ। জ্বলজ্বল করছে। হাসল সে।

আবার ড্যাগার তুলে নিল আর্থার, জোর করে তাকিয়ে রইল হলুদ চোখ জোড়ার দিকে, গভীর দম নিল। এবার…

খুলে গেল দরজা। আলোর একটা ঝলক ঢুকল ঘরে। সাথে সাথে আক্রান্ত হলো আর্থার। বোটকা একটা গন্ধ নাকে বাড়ি মারল, সেই সাথে প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মেঝেতে, হাত থেকে ছুটে গেল ড্যাগার। দেখল ওর টুটি কামড়ে ধরতে যাচ্ছে কুকুরটা।

প্রকাণ্ড মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরল আর্থার, বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে দিল চোখে, কনুই দিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে, তারপর কাত হয়ে জানোয়ারটার নিচের চোয়াল ধরে ফেলল এক হাতে।

মাথা ঝাঁকাল কুকুরটা, কামড় বসাল আর্থারের হাতে। আর্তনাদ করে উঠল আর্থার যন্ত্রণায়, পশুটা ওকে যেন মেঝের সাথে গেঁথে ফেলেছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে কুকুরটা, লালা পড়ছে মুখ বেয়ে, আর্থারের হাঁ করা মুখে ঢুকে গেল। শ্বাস বন্ধ হয়ে এল আর্থারের, থুথু ছিটাল হলুদ চোখে। এক মুহূর্তের জন্যে ওটার শক্ত আলিঙ্গন শিথিল হলো। ওই এক সেকেন্ডেই গড়ান মেরে খালি হাতটা দিয়ে ড্যাগারটা মুঠো করে ধরে ফেলল আর্থার। এদিকে কুকুরটা আবার ওর হাত কামড়ে ধরেছে, মেঝের সাথে ঠেসে ধরছে। হঠাৎ ওটা হাত ছেড়ে কামড়ে ধরল কাঁধ, ডানে-বামে ঝাঁকি খেল মাথা, খরগোশের মত আর্থারের ঘাড় মটকে দিতে চাইছে। ব্যথায় আবার চিৎকার দিল আর্থার, টের পেল কাঁধের কাছটায় ছিঁড়ে গেছে মাংস, হাতটা অবশ হয়ে পড়েছে। মোচড় খেল আর্থার, ছুরি ধরা হাতটা দিয়ে কোপ মারল। গায়ে লাগল না কুকুরটার, বাতাস কাটল শুধু।

আবার ড্যাগার চালাল আর্থার, এবার কুকুরটার গায়ে কোথাও লাগল ওটা, পশম ভেদ করে ফলা ঢুকে গেল মাংসে। ‘ঘাউ!’ করে উঠে ছেড়ে দিল আর্থারকে। হাঁটু ভাঁজ করে চিবুকের কাছে এনে গড়ান দিল ও, ক্রুশের পায়ের কাছে ধাক্কা খেল। জানোয়ারটার চাপ থেকে মুক্ত হয়ে মাত্র ও মুখ তুলেছে, দেখল ওটা লাফিয়ে পড়ছে ওর গলা লক্ষ্য করে। এবার রক্ত মাখা লালা পড়ল আর্থারের মুখে।

এক মুহূর্তের জন্যে আহত প্রাণীটার জন্যে মায়া লাগল আর্থারের, ইচ্ছে করল আদর করে। তা না করে গলায় বসিয়ে দিল ছুরি। এত জোরে ছুরি বসিয়েছে, মুঠো থেকে ছুটে গেল ওটা। পর মুহূর্তে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল আলো কুকুরটা ওর গায়ে এলিয়ে পড়তে। দড়াম করে শব্দ হলো পেছনে, পড়ে গেছে ক্রুশ। গোঙাচ্ছে কুকুরটা, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে আর্থারের মুখ।

লাথি মেরে জানোয়ারটাকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিল আর্থার, গড়ান দিয়ে সরে গেল একপাশে। যীশু পড়ে আছেন মেঝেতে, স্থির চেয়ে আছেন আর্থারের দিকে। পতনের কারণে শিরদাড়ায় চিড় ধরেছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে আর্থার, ছেলেটা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। হাসছে। কুকুরটাকে আবার আসতে দেখে লাথি মারল আর্থার। মুখে ড্যাগার বেঁধাতে পারেনি ও। কাঁধে বিধে আছে দেখে আফসোস হলো আর্থারের। ধীরে ধীরে শরীরটাকে টেনে তুলল আর্থার, ক্রুশের গায়ে হেলান দিল। তাকাল ছেলেটার দিকে। ছেলেটাকে হাসতে দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে ও। ওকে এখানে কেন আনা হয়েছে, কেন বুহের দাওয়াত দিয়েছে সব এখন পরিষ্কার আর্থারের কাছে। ওকে ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছে। শেষ বোঝাপড়া করতে চেয়েছে ওরা। ড্যাগারগুলো চেয়েছে ওরা যাতে শয়তান-পুত্র চিরতরে বিপদ মুক্ত হতে পারে।

অনেক কষ্টে হাঁটু মুড়ে বসল আর্থার। ডান হাতটা অকেজো, অসাড় ভঙ্গিতে ঝুলছে শরীরের পাশে। আঙুল নাড়াতে চেষ্টা করল, সাড়া পেল না কোন। ঘাড় বেয়ে পিঠে নামছে রক্ত স্রোত, হঠাৎ খুব ঘুম পেল আর্থারের। ইচ্ছে করল চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে, ভুলে যায় সব কিছু।

ছেলেটা ঝুঁকে দেখল আর্থারকে, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। করিডরে কেউ এসেছে। আর্থার দেখল শীলা এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়। আধো আলো, আধো ছায়ায় মনে হলো ও নগ্ন।

শীলা এগোল আর্থারের দিকে। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠল আর্থার। অক্ষত হাতটা বাড়িয়ে দিল যাতে শীলা ওকে টেনে তুলতে পারে। কিন্তু আর্থারকে অগ্রাহ্য করে ছেলেটার দিকে ঘুরল শীলা। চোখ পিটপিট করল আর্থার, মাথা ঝাঁকাল। আবার সে হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছে। ডি কার্লোর কথা মনে পড়ে গেল: ‘কল্পনা শক্তির ওপরেও রয়েছে তার ক্ষমতা…’

ও নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন দেখছে, যেমন ক্রুশের ওপর শিশুকে দেখেছে, সেরকম। ওর স্ত্রী ওই জঘন্য প্রাণীটাকে কিছুতেই আদর করতে পারে না। সবই আসলে দৃষ্টিবিভ্রম।

চোখ বুজল আর্থার, গলার কাছে জমাট বাঁধল চিৎকার। চোখ মেলল ও, বিশ্বাস হলো না দেখে শীলা আস্তে আস্তে কুকুরটার কাঁধ থেকে ছুরিটা বের করে নিচ্ছে, বিশ্বাস করতে মন চাইল না দু’হাতে ছুরি ধরে তাকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, অবিশ্বাস্য লাগল তারপরও শীলা হাসিমুখে ছুরিটা ওর বুকেই বসাতে যাচ্ছে দেখে।

এটা হ্যালুসিনেশন ভেবে মাথা ঝাঁকাল আর্থার, সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে শেষ সময় হাতটা উঠে গেল শীলাকে বাধা দেয়ার জন্যে। তীব্র ব্যথার ঢেউটা যখন ওকে আঘাত করল তখনও ব্যাপারটা অস্বীকার করতে চাইল মন। চিৎ হয়ে পড়ে গেল আর্থার, হাঁ হয়ে গেল মুখ, গলার কাছে জমাট বাঁধা চিৎকারটা বেরিয়ে এল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ঘাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া ড্যাগারের বাঁটের দিকে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও বিশ্বাস হতে চাইল না জুগুলার ভেইন থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা লাল স্রোতটা ওরই শরীরের রক্ত। পৃথিবী আঁধার হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আর্থার দেখল ড্যাগারের বাঁটে, যীশুর মুখটা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেন ওরই যন্ত্রণা ধারণ করে।

.

খিঁচুনি খেতে থাকা শরীরটার পাশ থেকে সরে গেল শীলা, তাকাল নিজের রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া পোশাকের দিকে। মরে গেছে আর্থার, তারপরও ধমনী দিয়ে গল গল ধারায় রক্ত পড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে চ্যাপেলে, রক্ত রঞ্জিত করে তুলছে ভাঙা যীশু মূর্তিকে।

হাত বাড়িয়ে শীলাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ছেলেটা, তারপর মমি করা লাশের সামনে নিয়ে গেল।

‘হাঁটু গেড়ে বসো, নির্দেশ দিল সে। আদেশ পালন করল শীলা। মুখ তুলে দেখল লাশের চোখে মোমের আলো পড়েছে, যেন হাসছে ডেমিয়েন ওর দিকে তাকিয়ে। যেন জ্যান্ত সে, আশীর্বাদ করছে শীলাকে তার কাজে খুশি হয়ে।

‘তার শক্তি আমার ভেতর,’ শীলার মনের কথা যেন পড়ে ফেলল ছেলেটা। ‘এবার সময় এসেছে ধ্বংসের।’

‘আমেন,’ ফিসফিস করল শীলা 1

ঘুরল ও, কুকুরটা অনেক কষ্টে উঠে বসেছে, জিভ দিয়ে চাটছে আহত কাঁধ। টেনে টেনে এগোল জানোয়ারটা শীলার কাছে। ডানে আর বামে একবার চোখ বুলাল, তারপর লাশের হাত চেটে দিল। রক্ত লেগে গেল আঙুলে।

ছেলেটা শীলাকে টেনে তুলল। তার শক্তি অনুভব করো,’ বলল সে।

লাশটাকে জড়িয়ে ধরল শীলা। হঠাৎ একটা শব্দ হতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ছেলেটা ভাঙা ক্রুশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যীশুর দিকে।

‘তারপর নাজারিন,’ মুখ বাঁকাল ছেলেটা, ‘তোমার শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটল। তুমি, যে মানবতার কথা বলতে, সেই তুমি এখন কোথায়?’

শীলার দিকে আঙুল তুলল সে।

‘দেখো,’ বলল ছেলেটা। ‘একে দেখো। স্বামীর রক্তে রঞ্জিত সে, আমার বাবার প্রতি কামার্ত সে। তার স্বামী আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই নারী তার স্বামীকে ধ্বংস করেছে। তোমার এই পরাজয়ের লজ্জা কোথায় রাখবে, নাজারিন?’

যীশুর মাথার মুকুটের কাঁটাগুলো খামচে ধরল সে দু’হাতে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখের দিকে।

‘পৃথিবী এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় অস্থির। ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও ফলে যাবার পথে। সবকিছুর অবসান ঘটবে শীঘ্রি।’

সিধে হলো ছেলেটা, হাসল। চ্যাপেলে শুধু শোনা গেল শীলার মৃদু বিড়বিড়ানি আর কুকুরটার গোঙানি। এছাড়া গোটা চ্যাপেল নীরব, নিস্তব্ধ।

 

আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৯

উনিশ

পল বুহের গ্লাসটা শেষ করে আকাশের দিকে তাকাল। কল্পনায় দেখল পুবাকাশে লাল একটা আলো ফুটে উঠেছে। অবশ্য ওকে আর কল্পনা করতে হবে না। দৃশ্যপট লেখা হয়ে রয়েছে অনেক আগে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক দৃশ্যে সঠিক অভিনেতার অভিনয়। মানব সভ্যতা বেছে নিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ।

ড্রইংরুমে ঢুকল বুহের। আগুন নিভে গেছে। রেডিওর সুইচ অন করে আরেকটা ড্রিঙ্ক ঢালল সে।

…সমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে যে, জেরুজালেম, তেল আবিব এবং বৈরুতে পারমাণবিক হামলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আকাশ পথে শহর ত্যাগ করেছেন এ খবর ওয়াশিংটন থেকে হোয়াইট হাউজ এবং পেন্টাগন অস্বীকার করেছে। আমাদের মস্কো প্রতিনিধি কোন রিপোর্ট পাঠাতে পারছেন না, কার্যত ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রি একটি বিবৃতি দেবেন। জানা গেছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ন্যাটোভুক্ত সমস্ত দেশের রাষ্ট্রদূতগণ দশ নম্বর ডাইনিং স্ট্রীটে উপস্থিত হতে চলেছেন…

থাবড়া মেরে রেডিওর সুইচ অফ করে দিল বুহের, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ নিজের বয়সের কথা মনে পড়ল। সত্তর চলছে। এবার মরার সময় হয়েছে।

‘তিন কুড়ি দশ’ বিড়বিড় করল বুহের, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হলঘরে দাঁড়ানো বাটলারের সাথে চোখাচোখি হলো তার। শ্রাগের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল দু’জনেই, যেন আর কারও কিছু বলার নেই। সিঁড়ির হাতল ধরে ওপরে উঠতে শুরু করল বুহের। চলে এল করিডরে, পা বাড়াল চ্যাপেলে। শীলার কথা ভাবছে। গেল কোথায় মহিলা?

দরজার কাছে পৌঁছার আগেই কুকুরটার গোঙানি শুনতে পেল বুহের। দরজা খোলা। তবে আলোটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে বলে ঘরের ভেতরটা ঠাহর করে নিতে সময় লাগল। দীর্ঘক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকল বুহের, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর যা দেখল, বিশ্বাস হতে চাইল না। চ্যাপেলের মেঝে মাখামাখি হয়ে গেছে ফ্রেডরিক আর্থারের রক্তে। ছেলেটা আর মহিলা থর্নের লাশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসা, বিড়বিড় করে কি সব বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।

ধীর ভঙ্গিতে আগ বাড়ল বুহের, বিস্ফারিত দৃষ্টি আর্থারের দিকে, অবিশ্বাস ফুটে আছে চোখে। ড্যাগারের বাঁট স্পর্শ করল সে, রক্ত লেগে গেল হাতে। হাতটা প্যান্টে মুছে আবার বাঁটটা ধরল। ড্যাগারটাকে টেনে বের করতে চাইছে বুহের, কিন্তু শক্তিতে কুলোচ্ছে না। শেষে আর্থারের বুকে পা রেখে হ্যাঁচকা টানে ছোরাটা বের করতে হলো।

এরপর অন্য ড্যাগারগুলো একত্র করে ছেলেটার দিকে তাকাল বুহের।

‘ও আমাকে হত্যা করতে এসেছিল, পল। কিন্তু নিজেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’

মাথা ঝাঁকাল বুহের, ড্যাগার বোঝাই হ্যাভারস্যাকটা কাঁধে ফেলল। ‘চিরদিনের জন্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি।’

কিন্তু ছেলেটা বুহেরের কথা শুনেছে বলে মনে হলো না।

আর্থারের দিকে তাকাল বুহের। কি নিষ্পাপ একটা মুখ, তবে সাহসী। ওরা ওকে পাগল বানানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তারপর ফাঁদ পেতেছে।

ড্যাগারগুলোয় একবার হাত বোলাল বুহের তারপর শীলার দিকে ফিরল। ওর কাঁধে টোকা দিল। ঘুরল শীলা। ওর ঠোঁট ভেজা ভেজা, ছায়াময় চোখ। বুহেরের মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা যখন টাকা দিয়ে বেশ্যা কিনতে হত তাকে। এভাবে মেয়েরা তাকাত তার দিকে। শীলার সারা শরীরে রক্ত। হাত বাড়িয়ে পোশাকটা তুলে নিল বুহের, শীলার বুক ঢাকল। শীলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, ফেলে দিল আচ্ছাদন। অভিমানে ঠোঁট ফোলানোর ভঙ্গি করল, তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল, চোখ টিপল। শীলার নগ্ন শরীর বুহেরকে মনে করিয়ে দিল সেই রাতের কথা যে রাতে মেয়েটা তার হাত চেপে ধরেছিল, পশুর চিহ্নের ছাপ পড়েছিল তার আঙুলে।

মনে পড়ে গেল দু’বছর আগের কথা। দু’বছর আগে শীলাকে দলে টানা হয়, অন্য অনেক মেয়ের মত, সেক্সের মাধ্যমে। আর্থার সেবার কি কাজে দেশের বাইরে, শীলাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল পেরিফোর্ডে। প্রথমে শীলা অনেক ওজর আপত্তি তুলেছে, প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু শেষতক প্রলোভনের কাছে হার মেনে যায় সে। বুহেরের শিষ্যরা তাকে বলেছে, গোপন কথাটা জানার পর শীলা সাংঘাতিক উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং পৈশাচিক ধর্মান্তকরণের সময়, রিপোর্ট এসেছিল, শীলার সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণে ওটা হয়ে ওঠে সবচে’ সফল একটা কাজ। শীলার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল বুহের। মানুষ আসলে খুব প্রেডিক্টা, সহজে যে কোন অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।

বুহেরকে আলিঙ্গনের চেষ্টা করল শীলা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল ওকে। অশ্লীল কথা বলছে শীলা, কানে তুলল না বুহের।

শীলাকে অগ্রাহ্য করে কুকুরটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। শুয়ে আছে জানোয়ারটা, হাঁপাচ্ছে, বুজে আসছে চোখ। মৃত্যুর ছায়া চোখে।

মমি করা লাশটার পেছনে চলে এল বুহের। ইস্পাতের একটা ফ্রেমের গায়ে ঠেস দেয়া ওটা। ফ্রেমটার নাট-বল্টু খুলতে শুরু করল বুহের। ফ্রেমটা লাশটাকে নিতম্বের কাছে সাঁড়াশির মত ধরে আছে, ফলে সিধে হয়ে থাকতে পারছে ওটা।

‘পল?’ তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটা।

‘তার শেষ অনুরোধ,’ বলল বুহের। ‘আরমাগেড্ডনের সময়। শেষ উপহাস।’

কপালে ভাঁজ পড়ল ছেলেটার। ‘আমি জানতাম না তো…’

চূড়ান্ত মুহূর্তে সে তার শত্রুর জমিনে দাঁড়াতে চেয়েছিল তাকে (যীশু) বর্জন করতে।

ছেলেটা এখনও সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে বুহেরের দিকে।

ক্রুশটা নিয়ে আমার পিছু পিছু এসো।’ আদেশ করল বুহের। জবাবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল ছেলেটা।

শেষ বল্টুটা খুলে ফেলল বুহের, লাশটা পড়ে গেল। দ্রুত ওটাকে ধরে ফেলল বুহের। খুব ভারী নয় শরীর, কিন্তু বুহের তেমন শক্তি পাচ্ছে না ওটাকে টেনে নিয়ে যাবার জন্যে। দেয়ালে হোঁচট খেল। দৌড়ে এল শীলা, দু’জনে মিলে লাশটাকে টেনে নিয়ে চলল।

দোরগোড়ায় থেমে দাঁড়াল ওরা, বুহের পেছন ফিরে চাইল। ছেলেটা ক্রুশটাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে, ওজনের চাপে বাঁকা হয়ে গেছে। কুকুরটা বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল, অনুসরণ করল ওদের। খোঁড়াচ্ছে ওটা, ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে।

ধীর গতিতে করিডর ধরে এগোল দলটা, নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে, লাশের পা বাড়ি খেল সিঁড়িতে, ঝরে পড়ল পাউডারের মত মিহি চামড়া। বুহেরদের পেছনে, ক্রুশ কাঁধে সিঁড়ির হাতল ধরে নামছিল ছেলেটা, হঠাৎ পিছলে গেল ওটা। গুঙিয়ে উঠল সে যীশুর মুকুটের কাঁটা তার ঘাড় আর কাঁধে বিধে যেতে। গালি দিল সে যীশুকে, ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রুশটাকে দেখল, তারপর আবার নামতে লাগল। কাঁটার আঘাতে রক্ত বেরুচ্ছে তার ঘাড় আর কাঁধ থেকে, ক্ষীণ একটা ধারা ঢুকে গেল পিঠে, ভিজিয়ে দিল আলখেল্লা।

আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে, ড্রাইভওয়েতে মাত্র এসেছে ওরা, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ল গায়ে। পশ্চিম উইং থেকে দুশো গজ দূরে, ঝোপের আড়ালে, একটা টিলার ওপর ছোট, ধ্বংসপ্রাপ্ত চার্চটা। এটা তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সাথে। বুহের শুনেছে, ছেলেবেলায় ডেমিয়েন চার্চটাকে ভেঙে ফেলতে বলেছিল। তবে তাকে বোঝানো হয়, খ্রীষ্ট ধর্মের উজ্জ্বলতা যে ক্রমে কমে আসছে, ধ্বংসের পথে যাচ্ছে যীশু,তার চিহ্ন হিসেবে চার্চটা থাকুক। পরে, বড় হয়ে জোর করে চার্চে একবার ঢুকেছিল ডেমিয়েন নিজের ভয় দূর করার জন্যে।

কিন্তু ছেলেটা কোন দিন চার্চে ঢোকেনি। বাবার মত সাহসই তার নেই। চার্চের পঞ্চাশ হাতের মধ্যে যেতেও সে ভয় পায়।

 

 

টিলায় উঠে এল ওরা। চারদিক আশ্চর্য নিস্তব্ধ। কোন কিছু নড়ছে না, পাখির ডাক বা পোকার আওয়াজ কিছু শোনা যাচ্ছে না। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝোপ ঝাড়, যেন দেখছে ওদের, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে।

চার্চের কাছে চলে এসেছে ওরা, চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। থামতে বলছে। কিন্তু থামল না বুহের। এগিয়েই চলল। হাঁপাচ্ছে শীলা, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গা বেয়ে, মিশে যাচ্ছে রক্তের সাথে। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে ও, উল্টোপাল্টা বকছে আপন মনে আর কামুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বুহেরের দিকে। বুহের পাত্তা দিচ্ছে না ওকে, টিলার ওপর টেনে নিয়ে চলল লাশটাকে। পাঁজরের গায়ে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, গলায় আটকে আসতে চাইছে দম।

‘পল!’ গর্জে উঠল ছেলেটা। চার্চের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল বুহের, লাশটাকে হেলান দিয়ে রাখল গেটপোস্টে।

ক্রুশটাকে টেনে আনতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ‘ওখানে রাখো,’ দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করল বুহের। ‘তাহলে একত্র হতে পারবে ওরা, বিজয়ী এবং বিজিত।’

বুহেরের নির্দেশ পালন করল ছেলেটা, তারপর পিছিয়ে গেল, পেরেকের আঘাতে ছড়ে যাওয়া ক্ষতে আঙুল বোলাল, চার্চের দিকে তাকাতে ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ।

‘এটাই তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল,’ আবার কথাটা বলল বুহের। পুব দিকে তাকাল সে। পাহাড়ের ঢেউ খেলানো চুড়ো, সোডিয়াম বাতিতে ভিজতে থাকা মেইন রোড আর গ্রামটাকে চোখে পড়ল তার।

‘সময় হয়েছে,’ বলল বুহের, দেখল চার্চের কাছ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

‘ওর কাছে যাও,’ শীলাকে ফিসফিস করে বলল বুহের। ‘তোমার শক্তি ওকে দাও। ওর জন্যে প্রার্থনা করো।’

চার্চ থেকে বিশ গজ দূরে দু’জনে বসল হাঁটু গেড়ে, দৃষ্টি মাটির দিকে। কুকুরটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেল ওদের পাশে, শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। বুহের এক পলক দেখল তিনজনকে, তারপর গভীর দম নিয়ে আঁকড়ে ধরল লাশটাকে, টানতে টানতে নিয়ে চলল গেটের ভেতরে। লাশের পা বাড়ি খাচ্ছে নুড়িতে। কাঠের পুরানো একটা সাইনবোর্ড পাশ কাটাল বুহের। ওতে লেখা :

দ্য প্যারিশ চার্চ অভ সেন্ট জন

হঠাৎ হোঁচট খেল বুহের, লাশটা ছুটে গেল হাত থেকে। ওটাকে আবার তুলছে, পেছন থেকে ভেসে এল ছেলেটার চিৎকার। বুহেরের নাম ধরে ডাকছে, দৌড়ে আসছে গেটের দিকে।

বেদম হাঁপাতে হাঁপাতে বুহের চার্চের দরজার সামনে চলে এল ভারী বোঝাটা নিয়ে, প্রার্থনা করল যেন ওটা খোলা থাকে। দেয়ালের গায়ে লাশটাকে দাঁড় করিয়ে দরজায় ঠেলা দিল বুহের। ক্যাচম্যাচ করে উঠল কবজা। পেছন ফিরল সে, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে গেটে, স্থির, আবার ভয় গ্রাস করেছে ওকে।

টানতে টানতে লাশটাকে ভেতরে নিয়ে গেল বুহের, দরজার কবাট বন্ধ করল। অন্ধকারে ছিটকিনি খুঁজল মরিয়া হয়ে। পেয়েও গেল। কিন্তু জং ধরে গেছে বোল্ট, নড়াতে পারছে না।

‘প্লীজ, গড,’ মিনতি করল বুহের, বোল্ট ধরে টানাটানি করছে। হাতের চামড়া ছড়ে গেল। অবশেষে বোল্টটা লেগে গেল জায়গা মত। বুহের ছেলেটার পায়ের শব্দ শুনতে পেল, দৌড়ে আসছে। হিংস্র পশুর মত গর্জন করছে। গায়ের শক্তি দিয়ে দরজার ওপর আছড়ে পড়ল ছেলেটা, ধাক্কার চোটে লাশটা পড়ে গেল মাটিতে।

বুহের ওটার পা ধরে টানতে টানতে গির্জার মূল অংশ বা বেদির কাছে নিয়ে এল। গির্জার একটা বেঞ্চিও আস্ত নেই, শুধু পাথরের বেদি আর পাথরের মঞ্চটা অক্ষত আছে।

‘বুহের!’ ছেলেটার চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল দালানে। পায়ের শব্দ শুনে বুহের বুঝতে পারল পাগলের মত দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে সে। দেয়াল খামচাচ্ছে ইঁদুরের মত। বেদির কাছে এসে লাশটাকে বুকের কাছে ধরে খাড়া করল বুহের, তারপর ছেড়ে দিল। পাথরের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল খুলি।

লাশটাকে চিৎ করে শোয়াল বুহের। মুখটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে, চেনা যাচ্ছে না। বেদির ওপর টেনে আনল সে ওটাকে, কাঁধ থেকে নামাল হ্যাভারস্যাক ড্যাগারগুলো বের করে মাটিতে রাখল।

‘বুহের,’ ছেলেটার কণ্ঠে এবার অনুনয়। বুহের মুখ তুলে চাইল। দেয়ালের ওপর ছেলেটার নখের ডগা দেখা যাচ্ছে। দেয়াল বেয়ে উঠতে চাইছে সে। হাত বাড়িয়ে একটা ড্যাগার তুলে নিল বুহের, তাকাল বেদিতে শোয়ানো লাশের দিকে।

‘তুমি নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, ডেমিয়েন। কিন্তু ছড়িয়ে দিয়েছ ধ্বংস। তুমি একটা ভুয়া প্রফেট।’

দু’হাতে ড্যাগার ধরে মাথার ওপর তুলল বুহের, তারপর চোখ বুজে সজোরে নামিয়ে আনল। পিস্তলের গুলির মত শব্দ করে ফেটে গেল চামড়া, দেয়ালের ওপাশ থেকে চিৎকার দিল ছেলেটা। পিছিয়ে গেল বুহের, বিশ্রী গ্যাস বেরুচ্ছে লাশের শরীর থেকে। দ্বিতীয় ড্যাগারটা মুঠো করে ধরল বুহের, জোর করে চোখ ফেরাল লাশটার দিকে। ক্ষত দিয়ে হিসহিস শব্দে বিকট গন্ধ নিয়ে গ্যাস বেরুচ্ছে। ড্যাগারের বাঁটে আটকানো লেবেলটা নড়ছে বাতাসে।

এবার জোর করে চোখ খুলে রাখল বুহের, দ্বিতীয় ড্যাগারটা ঢুকিয়ে দিল লাশের গায়ে। তারপর তৃতীয়টা, এবং চার নম্বরটা…প্রতিটি ফলা ঢুকে যাচ্ছে ডেমিয়েনের শরীরে আর আর্তনাদ করে উঠছে ছেলেটা। এখন আর মানুষের মত শোনাচ্ছে না তার গলা, যেন একটা শেয়াল মরণ আর্তনাদ করে চলেছে।

শেষে একটা ড্যাগার রয়ে গেল। বুহের বাঁটে, যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে তাকিয়ে বুকে ক্রুশ আঁকল। মনে পড়ে গেল ওর ধর্মান্তকরণের কথা, এক তরুণ, নামটা মনে নেই, বলেছিল তিন কুড়ি দশের কথা, বুড়ি নার্সের জন্যে হঠাৎ মায়া লাগল তার, আতঙ্ক জাগল মরা মেয়েটার সেই ছবিটার কথা মনে করে, উপলব্ধি করল আসলে সারাটা জীবন সে কাটিয়েছে প্রতারণার শিকার হয়ে।

ড্যাগারটা সর্বশক্তি দিয়ে লাশের পেটে ঢুকিয়ে দিল বুহের। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডেমিয়েন থর্ন, খোলা মুখ দিয়ে শেষবারের মত হিস্ করে বেরিয়ে এল গ্যাস। বুহের স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লাশের দিকে। দুই সারিতে বেঁধা ড্যাগারগুলো ক্রুশের আকার পেয়েছে। চোখ বুজল সে, হতাশার দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শুনল, চোখ মেলে দেখল লাশটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, হাড়গোড়ের মধ্যে পড়ে আছে ড্যাগারগুলো। সিধে হলো বুহের, শেয়ালের খুলি আর চোয়ালের দিকে তাকিয়ে আবার ক্রুশ আঁকল।

ঘুরল বুহের, ধীর পায়ে এগোল দরজার দিকে, বোল্ট খুলল, বেরিয়ে এল। ছেলেটা হাঁটু মুড়ে বসে আছে। জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকাল বুহের। ছেলেটাকে দেখলে মায়া লাগে। তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। মরা মানুষের দৃষ্টিতে বুহেরের দিকে তাকাল সে, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল। ছেলেটার পাশে পড়ে আছে কুকুরটা। মৃত।

শীলা গেটের সামনে দাঁড়ানো, রক্তাক্ত হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে আতঙ্ক নিয়ে, বারবার রক্ত মোছার চেষ্টা করছে, যেন এইমাত্র দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে।

রুহের শীলার কাছে গেল। নরম গলায় বলল, ‘কাপড় পরো।’

শীলা বুহেরের দিকে তাকাল, যেন চিনতে পারছে না। তারপর জামা দিয়ে বুক ঢাকল।

‘কাজ শেষ,’ বলল বুহের।

এক সাথে দু’জনে পা বাড়াল বাড়ির উদ্দেশে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, ঝিলমিল করছে তারার আলোয়। কেয়ামতের দিন শেষ, রক্ষা পেয়েছে পৃথিবী।

***

Exit mobile version