সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল বৃদ্ধা। বিশাল ওক কাঠের দরজাটা ‘নেই’ হয়ে গেছে। ভেতরে পা রাখল সে, মুখ তুলে চাইল। ভাঙা ছাদ। ওপরে ভাঙচুর চলছে। হাতুড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোটা জায়গা কাঁপছে থরথর করে, জুতো ভেদ করে কাঁপুনিটা ঢুকে যাচ্ছে গায়ে। চার্চের ভেতরে একটাও বেঞ্চি নেই, শুধু বেদীটা আছে। বেদীর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল বুড়ি। ওপরে তাকাতেই ফুটো ছাদ থেকে ঝুরঝুর করে বালি পড়ল চোখে-মুখে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ হয়ে গেল সে। চোখ ডলে খানিক পরে ধাতস্থ হলো। তাকাল যীশুর মুখের দিকে। ছেলেবেলায় এখানে কত এসেছে সে। এখানে দাঁড়িয়ে যীশুর দিকে তাকিয়ে থাকত।
যীশুর দাড়িঅলা মুখখানা অদ্ভুত শান্ত, সোজা তাকিয়ে আছেন চার্চের বারান্দার দিকে। আজ ওখানে কোন দর্শক বা উপাসনাকারী নেই। যীশু প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। বুড়ি তাঁর সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসল, শুরু করল প্রার্থনা। প্রার্থনা সঙ্গীত সম্পূর্ণ মনে আসছে না, কিন্তু সে নীরবে প্রার্থনা করে যেতে লাগল। হঠাৎ একটা প্রার্থনা সঙ্গীত মনে পড়ে গেল তার, মাথা তুলে গানটা গাইতে শুরু করল বৃদ্ধা।
হাতুড়িগুলোও যেন প্রার্থনা সঙ্গীতে যোগ দিল, একই ছন্দে বাড়ি পড়তে লাগল; নড়ে উঠল যীশুর মূর্তি, ধুলোর ঘন একটা মেঘ তার মুখটাকে ঢেকে দিল।
বুড়ি অনেক কসরত করে উঠে দাঁড়াল, হাত ছোঁয়াল ঘাড়ে। দাগটা নেই। ও জায়গার চামড়া আশ্চর্য মসৃণ। ফুঁপিয়ে উঠল সে, তবে এ তার আনন্দের কান্না।
‘আমি মুক্তি পেয়েছি, ফিসফিস করল সে।
ঠিক তখন হাতুড়ির আঘাতে তার পেছনের দেয়ালে চিড় ধরল, বেদীর ওপর দুলতে শুরু করল মূর্তি। প্রাণপণ চেষ্টায় সটান দাঁড়িয়ে গেল বৃদ্ধা, দু’হাত ছড়িয়ে দিল যীশুর দিকে।
‘এসো, প্রভু, তোমার রাজ্যে আমাকে ঠাঁই দাও।’
শেষ দৃশ্যটা সে দেখল যীশু তার ওপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছেন। ছুঁচাল দাড়ি তার খুলি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল, পাথরের আঙুলের চাপে হাড্ডিসার বুকের সবগুলো পাঁজর ভেঙে গেল মটমট করে। শেষ মুহূর্তে উল্লাসের চিৎকার দিল বৃদ্ধা।
তার লাশ আবিষ্কার করল এক রাজ মিস্ত্রী। সিনথিয়ার মরণ চিৎকার শুনতে পেয়েছিল সে। ব্যাপারটা কি জানার জন্যে ভাঙা দেয়াল টপকাল সে, দেখল যীশুর মূর্তির নিচে চাপা পড়ে আছে এক বুড়ি। মূর্তির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা একটা পা তখনও প্রবল আক্ষেপে মোচড় খাচ্ছে। বুড়ির মুখ রক্তে মাখামাখি, যীশুর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখে জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে রাজ মিস্ত্রীর মনে হলো বুড়ি যেন হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ৪
চার
রোমে, নিজের হোটেল রুমে, ঘুম ভেঙে গেল ফ্রেডরিক আর্থারের টেলিফোনের আওয়াজে। বুকের ওপর থেকে আস্তে ধাক্কা মেরে স্ত্রীকে সরিয়ে দিল সে, হাত বাড়াল রিসিভারের দিকে। ফ্রেডরিকের সেক্রেটারি। হাই তুলতে তুলতে জানতে চাইল রাষ্ট্রদূত তার আলোচ্য বিষয়সূচিতে হঠাৎ কোন পরিবর্তন ঘটেছে কিনা। ঘটেনি শুনে বলল, ‘তাহলে কফির সাথে কাগজপত্রগুলো পাঠিয়ে দাও। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।’
রিসিভার রেখে, গড়ান দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল ফ্রেডরিক আর্থার। শীলা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাতে বুনো হয়ে উঠেছিল মেয়েটা। ব্যাপারটা আর্থারের কাছে উপভোগ্য মনে হলেও মিলন পর্বটা আরও আনন্দদায়ক হয়ে উঠত যদি শীলার আবেগ প্রকাশের ভঙ্গীটা আরেকটু সংযত এবং অনুরাগপূর্ণ হত। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠল আর্থার। ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়ায় নয়, কাল রাতে ভালবাসাবাসির ফলে পিঠ আর বুকে জন্ম নেয়া আঁচড় আর কামড়গুলো সাবান লেগে জ্বালা করে ওঠার কারণে। রোম রোমান্টিক শহর, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রোমান্টিকতা শীলাকে যেন আরও যৌনবুভুক্ষু করে তুলেছে।
গোসল সেরে কাপড় পরল আর্থার। তারপর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখ বোলাতে লাগল তেল আবিব থেকে আসা লেটেস্ট ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে। পশ্চিম তীর আর গাজায় সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট সম্পর্কে সেই গৎ বাঁধা খবর যা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে আর্থার। ওদিকে পরিবর্তন খুব কমই হয়েছে। সেই একই বুলি বারবার, জায়গাটাও এক। এমনকি বোমা বর্ষণের ঘটনাতেও কোন বৈচিত্র নেই। সাম্প্রতিক পরিবর্তন বলতে হেবরনে হামলার ঘটনার পরে বিশ্ব-রাজনীতিতে টেনশনটা একটু বেড়েছে। আর লিবিয়ানদের হাতে বোমা আসার খবরে আশঙ্কা এবং ভয়টাও একটু বেশি কাজ করছে, এটুকুই যা।
ফ্রেডরিক আর্থার মনে মনে খুশি। কারণ এবারের রোম সফরে তাকে শুধু দর্শকের ভূমিকাই পালন করতে হবে। দুটো দিন শুধু দেখো, কথা শোনো এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলো-ব্যস, ফুরিয়ে গেল কাজ। প্রেস তাকে নিয়ে বেশি মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানার জন্যে মুখিয়ে আছে স্বাই। স্রেফ ‘নো কমেন্ট’ বলে তাদেরকে পাশ কাটিয়েছে আর্থার। তাকে নিয়ে কার কি পরিকল্পনা রয়েছে জানে না আর্থার, তবে নিজের জন্যে পরিকল্পনা করে রেখেছে সে আগেই।
কফি শেষ করে স্ত্রীকে চুমু খেল আর্থার, তারপর বেরিয়ে পড়ল। নিজেকে খুব তাজা লাগছে, নতুন একটি দিন শুরু করার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।