যাহার বোঝার ক্ষমতা আছে
সে পশুর সংখ্যা দেখিলেই চিনিতে পারিবে:
ইহা একটি মানুষের সংখ্যা
সংখ্যাটি হইল ছয়শো ছেষট্টি।
ওই ঘটনা তাকে ভীষণ আতঙ্কিত করে তোলে, সে ছুটে যায় বাবা-মা’র কাছে, হাতজোড় করে ক্ষমা চায়। যদিও নিজের জীবনের অনেক ঘটনাই সে গোপন করেছিল তাদের কাছে। কিন্তু নীতিবান বাবা-মা ঘর পালানো মেয়ের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন। মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাননি তাঁরা। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। তবে যাবার আগে পুরো গল্প বলে যায় সে। রেলিয়াল এবং তার দলের কাছে ফিরে গিয়েছিল সে। ওরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে, সেই সাথে বলেছে সে এখন তাদেরই লোক।
চোখ বুজল বৃদ্ধা, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে পড়ছে ডেমিয়েন থর্নের নির্দেশের কথা, কিভাবে নবজাতক শিশুকে ইনকিউবেটরের মধ্যে হত্যা করেছিল তার কথা। কাজটা করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি তাকে। অল্প সময়ের জন্যে অক্সিজেনের লাইনটা খুলে রেখেছে। বাচ্চাটার নামও মনে আছে তার: মাইকেল থমাস, খুদে একটা শিশু।
আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে…
চোখের সামনে ভেসে উঠল নানা দৃশ্য…
বেঁটে একটা লোক, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ। তাকে ভীষণ বিশ্বাস করত সে। তার কাছেই প্রথম সতীত্ব খুইয়েছিল সে। লোকটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে ঠেসে ধরেছিল তার হাতে, যন্ত্রণায় সে চিৎকার করছে, ওদিকে লোকটা তার কানে কানে বলছিল: ‘পাপ ক’রলে কি হবে তার একটু স্বাদ নাও…’
প্রীস্টকে দেখতে পেল সে এবার। কামাতুর একটা মুখ। তার গালে ঠোঁট ঘষছে, একটা হাত পিষছে বুক। ‘যন্ত্রণা অবিনশ্বর। যে ত্বক জ্বলে কিন্তু শেষ হয়ে যায় না…’
টের পাচ্ছে কর্কশ একজোড়া হাত তাকে নির্মমভাবে নিষ্পেষণ করে চলেছে। চিৎকার করে উঠল সে। চোখ মেলে চাইল। দেখল এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, সুদর্শন ছেলেটির নাম মাইকেল থমাস। হাসছে সে, তার হাসিতে করুণা আর দয়া যেন ঝরে পড়ছে। তার পাশে একটা মুখ দেখা গেল, অস্পষ্ট, চেহারা চেনা যাচ্ছে না, এগিয়ে এল সে তার দিকে, অগ্নিদগ্ধ হাতটা ধরল পরম মমতায়, কথা বলল সে। তাকে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলছে, বলছে পিতার রাজ্যে তার জন্যে এখনও খালি আছে জায়গা…
ঘুম থেকে জেগে উঠল সে, ঘৃণার দৃষ্টিতে চাইল ডেমিয়েন থর্নের ছবির দিকে। কিন্তু ওখানে থর্নের বদলে সেই অস্পষ্ট মুখটিকে দেখা যাচ্ছে, মনে হলো এখনও স্বপ্ন দেখছে সে আর যেন ঘুমের মধ্যে থেকে তার কণ্ঠ ভেসে আসছে: ‘অনুতাপ করো। অনুতাপের দ্বার সবসময়ই খোলা।’
বিছানায় উঠে বসল বৃদ্ধা, খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোল টেবিলের দিকে। কলম আর কাগজ টেনে নিল। তারপর লেখা শুরু করল। ধীরে ধীরে লিখল সে, কলমটা ধরে আছে শক্ত হাতে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠল মুখ।
‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’
কোন বিরতি ছাড়াই টানা দু’ঘণ্টা লিখে গেল সে, কাগজের ওপর ধীর গতিতে অক্ষর সৃষ্টি করে চলল কলম, যেন ওটা জীবন ফিরে পেয়েছে। লেখা শেষ করে কাগজের তাড়াটা ভাঁজ করে একটা খামে ঢোকাল সে, তারপর ঠিকানা লিখল:
‘ফাদার ডি কার্লো, মনাস্টেরি অভ সান বেনেদেতো, সুবিয়াকো, ইটালি।’
ফাদার ডি কার্লো ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করে না সিনথিয়া। আর কারও কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ার কথা ভাবতেও পারেনি সে। ফাদারই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন, ওকে বুঝতে পারবেন। বাইরে তাকাল বৃদ্ধা। ভোর হয়ে গেছে। ফোন টেনে নিল সে, ট্যাক্সি ডাকবে।
পুব দিকে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি, ভেতরে বসে বৃদ্ধা ভাবছে ফাদার ডি কার্লো সত্যি তাকে ক্ষমা করবেন কিনা। এমনও হতে পারে তিনি তার অনুতাপের বিষয়টিকে শেষ মুহূর্তের হতাশা ভেবে পাত্তা দেবেন না। শালের নিচে চিঠিটি খামচে ধরল সে জোরে, আবার চোখ বেয়ে গড়াতে শুরু করেছে পানি। এবার নিজের কথা ভেবে কাঁদছে সিনথিয়া, কাঁদছে নষ্ট, অন্ধকার জীবনটার কথা ভেবে, যে বাচ্চাটাকে সে নিজের হাতে হত্যা করেছে তার কথা ভেবে।
‘এসে পড়েছি,’ ড্রাইভারের উঁচু গলা শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছল বুড়ি। দেখল যেখানে কনভেন্টটা ছিল সেখানে এখন অফিস উঠেছে। বুক কাঁপিয়ে নিশ্বাস ফেলল সে। যাক, এখানে অন্তত একটা মেইল বক্স আছে।
‘বুড়ি মা, চিঠিটা দিন। আমি ডাকে ফেলে আসি,’ বলল ড্রাইভার। কিন্তু বুড়ি রীতিমত সংগ্রাম করে ক্রাচে ভর দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। কাউকে দিয়ে চিঠি পোস্ট করতে দিতে রাজি নয় সে। নিজেই ডাকে ফেলে এল চিঠি।
‘কাজ শেষ,’ বলল বৃদ্ধা। ‘এবার একটু বায়ে ঘোরাও, বাবা।’
চার্চটা আছে। তবে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ওটা। ছাদ-টাদহীন স্রেফ একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, ভাঙাচোরা সাইন বোর্ড পড়ে বোঝা যায় এটা সেন্ট লিউকাস চার্চ। এখানে তাকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেয়া হয়েছিল, তার বাবা এবং দাদুকেও।
আবার ক্যাব থেকে শরীরটাকে টেনে নামাল বৃদ্ধা, দাঁড়াল পেভমেন্টে। ফুটপাথ কাঁপছে হাতুড়ির বাড়িতে। চার্চ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কাছের একটা সাইন বোর্ডে তা. লেখাও আছে।
চার্চের দরজার দিকে পা বাড়াল বুড়ি। রশিতে পা বেধে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল। শরীরের হাড়গুলো ফুটল মটমট করে। পেছন ফিরে তাকাল বৃদ্ধা। ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজের সীটে বসে ঝিমুচ্ছে।