‘দিতেই পারেন,’ বলল ছেলেটা।
‘তীব্র এই যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না। আত্মহত্যা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখার বড় শখ ছিল আমার। দেখতে চেয়েছিলাম কাকে আমি পৃথিবীতে আনতে সাহায্য করেছি।’
ছেলেটা দু’হাত বাড়িয়ে দিল, উঁচু করল চিবুক।
‘আশা করি এখন খুশি হয়েছ।’ বলল সে।
‘আমাকে তোমার আশীর্বাদ দেবে না?’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, উঠে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে তাকাল অত্যন্ত রোগা শরীরটার দিকে। হাত বাড়িয়ে বুড়ির কপাল ছুঁলো সে, চোখ বুজল বুড়ি। হঠাৎ কেঁপে উঠে চোখ মেলে চাইল।
‘আমি সবসময় দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তোমার জন্মের সময় আমি হাজির ছিলাম আর তোমার বাবার জন্যে একটা শিশুকে হত্যা করেছি আমি।’
ছেলেটা চেপে ধরল বুড়ির মাথা, চেহারা কঠোর হয়ে উঠল, দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা। ‘ঈশ্বর পুত্রের পুনর্জন্মের দিন তোমার বাবা আমাদের বলেছিল ওই দিন যে সব শিশু জন্ম নেবে তাদের সবাইকে হত্যা করতে। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি এ আশায়-’
‘কি আশায়?’ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তরুণ বুড়ির দিকে।
‘আশা করেছিলাম যীশু-পুত্রকে ধ্বংস করতে পারব।’
‘কিন্তু পারোনি,’ গর্জে উঠল ছেলেটা, পিছিয়ে এল এক পা, হাত মুছল শার্টে যেন ময়লা লেগেছে।
‘তোমরা ওকে মারতে পারোনি। তোমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছ। ঈশ্বরের পুত্র বেঁচে আছে এখনও। তার উপস্থিতি প্রতিদিন টের পাই আমি। প্রতি ঘণ্টায় তার শক্তি বেড়ে চলেছে। সে আছে সর্বত্র, অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।’ আরেক পা পিছিয়ে গেল সে, কথা বলার সময় থুথু ছিটল, বুড়ির মুখে লাগল। ‘তোমরা আমার বাবাকে বাঁচাতে পারোনি, আমাকেও পারবে না।’
নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল মহিলা, গাল বেয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে মুখে। হাতের চেটো দিয়ে পানি মুছছে, ছেলেটা এগিয়ে এল সামনে, রাগে চোখে আগুন জ্বলছে।
‘তুমি ভেবেছ তোমাকে ঈশ্বর ব্যথা দিচ্ছেন,’ বলল সে, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। ‘ভুল। তিনি মানবতাকে শাস্তি দেন, যেটাকে তিনি পাপ বলে মনে করেন। আমার বাবা কাউকে শাস্তি দেন না। ব্যর্থতা ছাড়া কাউকে তিনি শাস্তি দেননি। ব্যর্থতা ক্ষমা করতে পারেন না তিনি।’
হাহাকার করে উঠল বৃদ্ধা। ‘কিন্তু আমাকে যা যা করতে বলা হয়েছিল সবই আমি করেছি। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমি আর কি…?’
ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটা। ‘চলে যাও তুমি। আর যেন কখনও না দেখি তোমাকে।’ পিছিয়ে গেল বুড়ি, বসে পড়ল হুইল চেয়ারে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দয়া করে ক্ষমা করো।’
কিন্তু ছেলেটা বুড়ির দিকে ফিরেও চাইল না। বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। নীরবতা নেমে এল ঘরে। বুহের ছেলেটার দিকে তাকাল।
‘তোমার কি মনে হয় না…?’
বুহেরকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল ছেলেটা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল, গনগনে মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেল ইনহন করে।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ৩
তিন
ট্যাক্সিটা গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল বুড়ির জন্যে। বুড়ি অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে, চেষ্টাকৃত হাসি দিল ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে। তারপর উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। বাড়ি যাবে। চলার পথে কোন কথা বলল না সে। বাড়ি পৌঁছে সোজা ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে, লিভিংরুম থেকে হুইল চেয়ার চালিয়ে বেডরুমে এল। এ ঘরে কারও প্রবেশাধিকার নেই।
পুরো ঘর কালো রঙ করা। দেয়ালে দুটো ছবি ঝুলছে। একটা ডেমিয়েন থর্নের, অন্যটা তরুণী এক মেয়ের। ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা খাট, লেখার টেবিল এবং চেয়ার। দুটো বুকশেলফও আছে, একটাতে বাইবেল সম্পর্কিত নানা বই, অন্যটাতে পর্নোগ্রাফি। শেলফের সামনে গিয়ে বইগুলো ছুঁয়ে দেখল বৃদ্ধা, তারপর টেবিল থেকে একটা পেপার ওয়েট তুলে ছুঁড়ে মারল ডেমিয়েনের ছবি লক্ষ্য করে। গায়ে শক্তি একেবারেই কম। দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছল না ওটা, পড়ে গেল মেঝেতে। সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপাতে লাগল বুড়ি। ধীরে ধীরে শরীরটাকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে, হাত বাড়িয়ে দেয়াল থেকে ছুটিয়ে আনল দ্বিতীয় ছবিটা, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিছানার কাছে গেল, রীতিমত কাঁপছে, ওটা রেখে দিল বিছানার ওপর। নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। ছবিটা তার বাবা তুলেছিল সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার মাস কয়েক আগে। ওই সময় সে ছিল সাংঘাতিক একা, ভীতু আর সরল।— তারপর একদিন বেলিয়াল নামে সেই পাগলা ছোঁড়ার সাথে পরিচয় হলো…তারপর কি হতে কি হয়ে গেল ঠাহর করতে পারেনি সে।
শুরুতে লোভ দমন করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু হেরে গেছে। নার্স ছিল বলে ওরা তাকে নিজেদের দলে টেনে নিতে কসুর করেনি। সবকিছু কেমন বিশৃঙ্খল মনে হত নিজের কাছে। রাত আর দিনের মাঝে যেন কোন ফারাক ছিল না। তাকে অত্যন্ত শক্তিশালী ড্রাগস খাওয়ানো হয়েছিল। একদিন সকালে তার ঘুম ভাঙে, মনে হয় এতদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু ওটাই ছিল চরম বাস্তবতা। একটা কুকুরের সাথে মিলিত হতে বাধ্য করেছিল ওরা, অবচেতন অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঘাড়ে শুকিয়ে থাকা লালা দেখতে পায় সে। শুকনো জিনিসটা ঘষে ওঠাতেই চোখে পড়ে একটা দাগ-লবঙ্গপাতার আকারে আঁকা তিনটে ছোট ছয়-আর তার বিছানার পাশের দেয়ালে লেখা ছিল বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি: