‘বাবা, আমাকে শক্তি দাও, তোমার সমস্ত বল আমার মধ্যে সঞ্চার করো। আমাকে শক্তি দাও হে মহান পিতা…’
একটানা, একভাবে প্রার্থনা করেই যেতে লাগল সে। সামান্য সময়ের জন্যেও বিরতি দিল না, দম যেন নিচ্ছেই না। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল বুহের, তারপর চাইল ডেমিয়েন থর্নের মরা মুখের দিকে। তারপর, যেন সহজাত প্রবৃত্তিতে ক্রুশের বিপরীত চিহ্ন আঁকল সে বুকে, পিছিয়ে এল, নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল দরজা।
কুকুরটা ঠাণ্ডা চোখে তাকে দেখল, কান পেতে শুনল বুহেরের ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসা পায়ের শব্দ, শেষে আবার গার্ড নিয়ে বসল সে, কান দুটো সেঁটে আছে মাথার পেছনে, গভীর মনোযোগে শুনতে লাগল ছেলেটার প্রার্থনার গুনগুন শব্দ।
.
ছেলেটির জন্যে ডাইনিংরুমে অপেক্ষা করছে বুহের। মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, শূন্য দৃষ্টি টেলিভিশন পর্দায়, দেখছে না কিছুই। হঠাৎ মুখ তুলে দেখল ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। পরনে শার্ট আর জিনস। শিষ্যরা ঠিকই বলেছে অনেক বড় হয়ে গেছে সে। এখনই লম্বায় তার মৃত বাবার মত, চেহারায় মিলও রয়েছে অনেক। ‘আপনাকে ক্লান্ত লাগছে,’ বলল ছেলেটা। গলার স্বর জোরাল, গভীর।
‘ও কিছু না,’ জবাব দিল বুহের। ‘বয়স হয়েছে না।’
‘নারী সঙ্গ বর্জন করা উচিত আপনার।’
হাসল বুহের। ‘আগে ব্যাপারটা উত্তেজিত করে তুলত আমাকে। এখন আর করে না।’
ছেলেটা বসল। প্রায় সাথে সাথে জর্জ হাজির হয়ে গেল ডিনার ট্রলি নিয়ে।
‘রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন?’ বাটলারের দিকে ফিরেও তাকাল না সে।
মাথা ঝাঁকাল বুহের, পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে ছেলেটার হাতে দিল। এক নিঃশ্বাসে রিপোর্টটা পড়ে ফেলল সে। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বুহেরের দিকে।
‘লিবিয়ানরা আশা করে ডি ফল্ট হবে না। হবে কি?’
মাথা নাড়ল বুহের। ‘ওদের সব কটার লেজ বেঁধে দিয়েছি এক সুতো দিয়ে। কোথাও আর যাবার জায়গা নেই।’ ছেলেটা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা দোলাল, কাগজের তাড়াটা ভাঁজ করে ফিরিয়ে দিল বুহেরকে।
‘বেশ। তাহলে সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে?’ প্রশ্ন করল সে।
‘ব্রিটিশরা জেরুজালেমে নিজেদের ক্যাম্প ডেভিডকে সুসংহত করতে চাইছে। কিন্তু কাজ হবে না।’
‘বেশ,’ কোলে ন্যাপকিন বিছাল ছেলেটা, তারপর খাওয়া শুরু করল।
খাওয়ার সময় তেমন কথা হলো না ওদের মধ্যে। ছেলেটা ক্ষুধার্তের মত খাচ্ছে, চুমুক দিয়ে সাবাড় করছে ওয়াইন, দ্রুত চোয়াল নড়ছে তার, মাঝেমধ্যে মুখে খাবার নিয়েই নানা প্রশ্ন করে গেল সে বুহেরকে।
‘শুনলাম ইহুদ বারাক নেসেট নিয়ে সমস্যায় পড়েছে…’
‘ব্রাডলি হোয়াইট হাউজ চালাচ্ছেন কেমন?’
‘জিম্বাবুয়েতে কবে ক্যু হবে?’
বুহের তার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেল ধৈর্যের সাথে। ছেলেটা হয়েছে তার বাপের মতই, তবে ডেমিয়েন থর্নের আকর্ষণ করার শক্তি নেই ওর মধ্যে। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই মোহিনী জাদুও এসে যাবে।
ডিনার শেষে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে দু’জনে, বাটলার এসে এক টুকরো কাগজ দিল বুহেরকে, ছেলেটার দিকে ফিরে বলল:
‘সেই বুড়ি আবার এসেছে, স্যার।’
হাই তুলল ছেলেটা, বুহের তাকাল চিরকুটের দিকে। ‘মহিলা বলছে সে নাকি তোমার দাইমা ছিল,’ বলল বুহের।
কাঁধ ঝাঁকাল বাটলার। ‘গত এক হপ্তা ধরে মহিলা এখানে ঘুর ঘুর করছে, স্যার।’
বুহের ছেলেটার দিকে চাইল। ‘তোমার কাছ থেকে শেষ আশীর্বাদটুকু পেতে চায় সে।’
আবার হাই তুলল ছেলেটা।
বুহের কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল ফায়ার প্লেসে। ‘ওকে আসতে বলো,’ বলল সে। ‘তবে নিশ্চিত হয়ে নিও এই মহিলা সে-ই মহিলাই কিনা।’
‘জ্বী, স্যার।’
‘ব্রাডলির ব্যাপারে আপনি শিওর তো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুহের। ছেলেটা বড্ড একগুঁয়ে আর ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। বাইরের কোন ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই। বিশেষ করে এ বয়সের ছেলেরা যেসব কাজ করে আনন্দ পায়। তবে এটাও অস্বীকার করার জো নেই সে অন্য দশটা ছেলের মত সাধারণ নয়।
দরজাটা আবার খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল লোলচর্ম এক বৃদ্ধা। হুইল চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসা, পা ঢাকা কম্বলে, কাঁধে শাল। হাত দুটো কোঁচকানো, আঙুলগুলো যেন আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পরস্পরের সাথে। বুড়ির ওজন টেনেটুনে আশি পাউন্ড হবে। চেয়ারের একটা বোতাম টিপল সে, হিসিয়ে উঠল মোটর, টায়ারের শব্দ তুলে হুইল চেয়ার এগিয়ে আসতে লাগল বুহেরদের দিকে। টেবিলের ধারে এসে থেমে গেল বৃদ্ধা, স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। হাত বাড়িয়ে ক্রাচ তুলে নিল সে, আস্তে আস্তে সিধে হলো। বুড়িকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে যাচ্ছিল বুহের, মানা করল সে।
‘পারব আমি,’ ভাঙা, ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল বৃদ্ধা। ওঠার সময় তার গায়ের হাড় ফুটল মটমট করে, সোজা হয়ে দাঁড়াবার পরে দেখা গেল প্রায় ছেলেটার মতই লম্বা সে।
‘আমার নাম সিনথিয়া অ্যাবট,’ বলল সে। ‘আমি একজন নার্স। তোমাকে জন্মাতে দেখেছি আমি।’
ছেলেটা চুপ করে রইল। ‘তোমার যেদিন জন্ম হলো, সেদিন সন্ধ্যায় বাত রোগে আক্রান্ত হলো আমার হাত। তারপর থেকে সারা শরীরে যন্ত্রণা আমার। প্রচুর ওষুধ খেয়েছি। কাজ হয়নি কোন। বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার ধারণা, ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।