কাঁকর বিছানো রাস্তা পার হয়ে লিমোজিন থেমে দাঁড়াল প্রাসাদের সামনে। বাটলার অপেক্ষা করছিল দোরগোড়ায়; বুহেরকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে গেল।
বুহের সোজা ঢুকল ড্রইংরুমে, একটা গ্লাসে মদ ঢেলে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল।
ঘরটা অত্যন্ত দামী আসবাবে সাজানো। ওক কাঠের প্যানেলে হাত বোলাল বুহের, মখমলের ভারী পর্দা টেনেটুনে দেখল, তারপর তাকাল পোর্ট্রেটগুলোর দিকে। রবার্ট থর্ন; তার ভাই, রিচার্ড; এবং ছেলে ডেমিয়েনের ছবি। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল বুহের। এগোল ফায়ার প্লেসের দিকে। বেশ গরম পড়েছে আজ, তবু ফায়ার প্লেসে কাঠ দাউ দাউ জ্বলছে। ওদিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুহের। অপেক্ষা করছে।
খানিক পরে আবার এল বাটলার। ‘বিশ মিনিটের মধ্যে ডিনার রেডি হয়ে যাবে, স্যার।’
মাথা ঝাঁকাল বুহের। ‘কেমন আছে সে?’
‘ভাল আছেন, স্যার।’
‘ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে?’
‘চেষ্টা করে দেখতে পারেন, স্যার।’
বুহের আবার মাথা ঝাঁকাল, মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হলঘর পার হয়ে, পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এল, তারপর একটা গ্যালারি ধরে ঢুকল অন্ধকার এক করিডরে। এটা বাড়ির পশ্চিম উইং-এ গিয়ে মিশেছে। বুহেরের বুকে ধুকধুকানি শুরু হয়ে গেছে, পেটটা আবার মোচড় দিয়ে উঠল। ছেলেটার বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় মৃদু টোকা দিল বুহের, কান পাতল। ভেতরে কোন সাড়া নেই। আবার নক্ করল সে, তারপর দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
ঘরে সরু একটা বিছানা ছাড়া কিছু নেই, দেয়াল আর ছাদের রঙ গাঢ় তামাটে। সুইচ টিপে বাতি জ্বালানোর জন্যে হাত বাড়াল বুহের। অবাক হয়ে দেখল ঘরে কোন বাল্ব নেই। বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কোলাজ করা কতগুলো নিউজপেপার ফটোগ্রাফের দিকে। পাশে দুটো বড়, বাঁধানো ছবিও আছে। একটা ডেমিয়েন থর্নের পোর্ট্রেট, তার মাথা আর কাঁধ দেখা যাচ্ছে শুধু। অন্যটা সমাধি স্তম্ভের ছবি। ঝোপঝাড়ে কবরের মাথায় লাগানো পাথরের টুকরোটা প্রায় ঢেকে গেছে। তবু কষ্ট করে পড়া যায়:
ক্যাথেলিন রেনল্ডস
প্রিয়তম কন্যা
১৯৪৯-১৯৮২
সশব্দে দম ফেলল পল বুহের, হাঁটু ভাঁজ করে বসল বিছানার পাশে, কোলাজটা দেখছে। ওয়ারশ ইহুদিদের দেখা যাচ্ছে ছবিতে, বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে, অসউইজ ক্যাম্পে পাঠানো হবে হতভাগ্য লোকগুলোকে। হিটলার, ইদি আমিন, মুসোলিনি, জোসেফ স্ট্যালিনের ছবিও আছে। হ্যারী ট্রুম্যান হাসছেন, হিরোশিমা ধ্বংস হয়েছে, ধোঁয়ার মধ্যে তাঁর মুখ। কোলাজে সিগার মুখে চার্চিল আছেন। আছেন হেনরী কিসিঞ্জার, এমনকি পলপটও। পলপট অসংখ্য খুলি আর হাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।
কোলাজের ওপর লাল কালিতে, বড় বড় অক্ষরে লেখা:
পুনরাবৃত্তি চাই
হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল বুহেরের, দ্রুত এক ঢোক ব্রান্ডি গিলে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। বাইরে এসে স্বস্তি অনুভব করল।
প্রাসাদের পশ্চিমাংশের আরও ভেতরে ঢুকে গেল বুহের দ্বিতীয় করিডর দিয়ে। ঠিক তখন বোটকা গন্ধটা ঝাপটা মারল নাকে। এক সেকেন্ড পরে ওটাকে দেখতে পেল সে। করিডরের শেষ মাথায় বসে আছে বিশাল আকারের জানোয়ারটা। ওটার হলুদ চোখ যেন আগুনের গোলা, জ্বলছে ধকধক করে। প্রকাণ্ড মাথাটা তুলল সে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, নিঃশব্দে এগিয়ে এল বুহেরের দিকে, প্রকাণ্ড দেহী, বিরাট চোয়াল, ঘাড় আর কাঁধের পেশীতে যেন জমাট বেঁধে আছে সমস্ত শক্তি। ওটার নিশ্বাসে বিকট গন্ধ। থেমে দাঁড়াল প্রাণীটা, তাকাল বুহেরের দিকে, মাথাটা বুহেরের পেটের সমান উচ্চতায় পৌঁছেছে। এক মুহূর্ত মানুষ এবং কুকুর পরস্পরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, নাক উঁচু করে টেনে নিল বাতাস, মাথা দোলাল, যেন গন্ধ চেনার চেষ্টা করছে, তারপর গলা দিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এল ওটার, সরে দাঁড়াল একপাশে, প্রহরী যাবার অনুমতি দিচ্ছে।
করিডরের শেষে, কালো একটা দরজার দিকে নিঃশব্দে পা বাড়াল বুহের, নক করার জন্যে হাত তুলল, তারপর কি ভেবে আস্তে ধাক্কা মেরে খুলে ফেলল দরজা।
ঘরটা গোল, কালো রঙ করা, ছয়টা স্তম্ভের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ। ঘরে কোন জানালা নেই, একটা বেদীর ওপর রাখা একটি কালো মোমবাতি কোনমতে দূর করেছে আঁধার।
মোমবাতির কাঁপা আলো গিয়ে পড়ছে কাঠের তৈরি যীশুর লাইফ-সাইজ প্রতিমূর্তির ওপর। একটা ক্রুশের গায়ে দাঁড় করানো যীশুর সারা গায়ে পেরেক বসানো, নগ্ন। শিরদাঁড়ায় আমূল ঢুকে আছে একটা ড্যাগার। ড্যাগারের বাঁটে যীশুর ছবি খোদাই করা।
ক্রুশ থেকে ছয় ফুট দূরে একটা মমি করা লাশ। এই লাশের গায়েও কাপড়- চোপড়ের বালাই নেই, শুধু একটা ইস্পাতের ফ্রেমের অবলম্বন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার হাত দুটো সামনের দিকে বাড়ানো, তালু ছড়ানো। মোমের আলো নাচছে তার খোলা চোখে, মনে হচ্ছে জ্যান্ত। মুখে ভয়ঙ্কর, বিকৃত এক টুকরো হাসি ফুটে আছে তার, যেন ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণাকাতর চেহারা দেখে মজা পাচ্ছে।
লাশের পায়ের কাছে বসা কালো আলখেল্লা পরা এক তরুণ, লাশের হাত চেপে ধরে আছে এত জোরে যে তার আঙুলের গাঁটগুলো সাদা হয়ে গেছে।
মৃদু, নিচু গলায় সে প্রার্থনা করে চলেছে। বুহের শুনতে পেল তার আর্তি