আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে, ড্রাইভওয়েতে মাত্র এসেছে ওরা, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ল গায়ে। পশ্চিম উইং থেকে দুশো গজ দূরে, ঝোপের আড়ালে, একটা টিলার ওপর ছোট, ধ্বংসপ্রাপ্ত চার্চটা। এটা তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সাথে। বুহের শুনেছে, ছেলেবেলায় ডেমিয়েন চার্চটাকে ভেঙে ফেলতে বলেছিল। তবে তাকে বোঝানো হয়, খ্রীষ্ট ধর্মের উজ্জ্বলতা যে ক্রমে কমে আসছে, ধ্বংসের পথে যাচ্ছে যীশু,তার চিহ্ন হিসেবে চার্চটা থাকুক। পরে, বড় হয়ে জোর করে চার্চে একবার ঢুকেছিল ডেমিয়েন নিজের ভয় দূর করার জন্যে।
কিন্তু ছেলেটা কোন দিন চার্চে ঢোকেনি। বাবার মত সাহসই তার নেই। চার্চের পঞ্চাশ হাতের মধ্যে যেতেও সে ভয় পায়।
টিলায় উঠে এল ওরা। চারদিক আশ্চর্য নিস্তব্ধ। কোন কিছু নড়ছে না, পাখির ডাক বা পোকার আওয়াজ কিছু শোনা যাচ্ছে না। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝোপ ঝাড়, যেন দেখছে ওদের, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে।
চার্চের কাছে চলে এসেছে ওরা, চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। থামতে বলছে। কিন্তু থামল না বুহের। এগিয়েই চলল। হাঁপাচ্ছে শীলা, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গা বেয়ে, মিশে যাচ্ছে রক্তের সাথে। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে ও, উল্টোপাল্টা বকছে আপন মনে আর কামুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বুহেরের দিকে। বুহের পাত্তা দিচ্ছে না ওকে, টিলার ওপর টেনে নিয়ে চলল লাশটাকে। পাঁজরের গায়ে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, গলায় আটকে আসতে চাইছে দম।
‘পল!’ গর্জে উঠল ছেলেটা। চার্চের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল বুহের, লাশটাকে হেলান দিয়ে রাখল গেটপোস্টে।
ক্রুশটাকে টেনে আনতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ‘ওখানে রাখো,’ দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করল বুহের। ‘তাহলে একত্র হতে পারবে ওরা, বিজয়ী এবং বিজিত।’
বুহেরের নির্দেশ পালন করল ছেলেটা, তারপর পিছিয়ে গেল, পেরেকের আঘাতে ছড়ে যাওয়া ক্ষতে আঙুল বোলাল, চার্চের দিকে তাকাতে ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ।
‘এটাই তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল,’ আবার কথাটা বলল বুহের। পুব দিকে তাকাল সে। পাহাড়ের ঢেউ খেলানো চুড়ো, সোডিয়াম বাতিতে ভিজতে থাকা মেইন রোড আর গ্রামটাকে চোখে পড়ল তার।
‘সময় হয়েছে,’ বলল বুহের, দেখল চার্চের কাছ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
‘ওর কাছে যাও,’ শীলাকে ফিসফিস করে বলল বুহের। ‘তোমার শক্তি ওকে দাও। ওর জন্যে প্রার্থনা করো।’
চার্চ থেকে বিশ গজ দূরে দু’জনে বসল হাঁটু গেড়ে, দৃষ্টি মাটির দিকে। কুকুরটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেল ওদের পাশে, শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। বুহের এক পলক দেখল তিনজনকে, তারপর গভীর দম নিয়ে আঁকড়ে ধরল লাশটাকে, টানতে টানতে নিয়ে চলল গেটের ভেতরে। লাশের পা বাড়ি খাচ্ছে নুড়িতে। কাঠের পুরানো একটা সাইনবোর্ড পাশ কাটাল বুহের। ওতে লেখা :
দ্য প্যারিশ চার্চ অভ সেন্ট জন
হঠাৎ হোঁচট খেল বুহের, লাশটা ছুটে গেল হাত থেকে। ওটাকে আবার তুলছে, পেছন থেকে ভেসে এল ছেলেটার চিৎকার। বুহেরের নাম ধরে ডাকছে, দৌড়ে আসছে গেটের দিকে।
বেদম হাঁপাতে হাঁপাতে বুহের চার্চের দরজার সামনে চলে এল ভারী বোঝাটা নিয়ে, প্রার্থনা করল যেন ওটা খোলা থাকে। দেয়ালের গায়ে লাশটাকে দাঁড় করিয়ে দরজায় ঠেলা দিল বুহের। ক্যাচম্যাচ করে উঠল কবজা। পেছন ফিরল সে, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে গেটে, স্থির, আবার ভয় গ্রাস করেছে ওকে।
টানতে টানতে লাশটাকে ভেতরে নিয়ে গেল বুহের, দরজার কবাট বন্ধ করল। অন্ধকারে ছিটকিনি খুঁজল মরিয়া হয়ে। পেয়েও গেল। কিন্তু জং ধরে গেছে বোল্ট, নড়াতে পারছে না।
‘প্লীজ, গড,’ মিনতি করল বুহের, বোল্ট ধরে টানাটানি করছে। হাতের চামড়া ছড়ে গেল। অবশেষে বোল্টটা লেগে গেল জায়গা মত। বুহের ছেলেটার পায়ের শব্দ শুনতে পেল, দৌড়ে আসছে। হিংস্র পশুর মত গর্জন করছে। গায়ের শক্তি দিয়ে দরজার ওপর আছড়ে পড়ল ছেলেটা, ধাক্কার চোটে লাশটা পড়ে গেল মাটিতে।
বুহের ওটার পা ধরে টানতে টানতে গির্জার মূল অংশ বা বেদির কাছে নিয়ে এল। গির্জার একটা বেঞ্চিও আস্ত নেই, শুধু পাথরের বেদি আর পাথরের মঞ্চটা অক্ষত আছে।
‘বুহের!’ ছেলেটার চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল দালানে। পায়ের শব্দ শুনে বুহের বুঝতে পারল পাগলের মত দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে সে। দেয়াল খামচাচ্ছে ইঁদুরের মত। বেদির কাছে এসে লাশটাকে বুকের কাছে ধরে খাড়া করল বুহের, তারপর ছেড়ে দিল। পাথরের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল খুলি।
লাশটাকে চিৎ করে শোয়াল বুহের। মুখটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে, চেনা যাচ্ছে না। বেদির ওপর টেনে আনল সে ওটাকে, কাঁধ থেকে নামাল হ্যাভারস্যাক ড্যাগারগুলো বের করে মাটিতে রাখল।
‘বুহের,’ ছেলেটার কণ্ঠে এবার অনুনয়। বুহের মুখ তুলে চাইল। দেয়ালের ওপর ছেলেটার নখের ডগা দেখা যাচ্ছে। দেয়াল বেয়ে উঠতে চাইছে সে। হাত বাড়িয়ে একটা ড্যাগার তুলে নিল বুহের, তাকাল বেদিতে শোয়ানো লাশের দিকে।
‘তুমি নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, ডেমিয়েন। কিন্তু ছড়িয়ে দিয়েছ ধ্বংস। তুমি একটা ভুয়া প্রফেট।’
দু’হাতে ড্যাগার ধরে মাথার ওপর তুলল বুহের, তারপর চোখ বুজে সজোরে নামিয়ে আনল। পিস্তলের গুলির মত শব্দ করে ফেটে গেল চামড়া, দেয়ালের ওপাশ থেকে চিৎকার দিল ছেলেটা। পিছিয়ে গেল বুহের, বিশ্রী গ্যাস বেরুচ্ছে লাশের শরীর থেকে। দ্বিতীয় ড্যাগারটা মুঠো করে ধরল বুহের, জোর করে চোখ ফেরাল লাশটার দিকে। ক্ষত দিয়ে হিসহিস শব্দে বিকট গন্ধ নিয়ে গ্যাস বেরুচ্ছে। ড্যাগারের বাঁটে আটকানো লেবেলটা নড়ছে বাতাসে।