থাবড়া মেরে রেডিওর সুইচ অফ করে দিল বুহের, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ নিজের বয়সের কথা মনে পড়ল। সত্তর চলছে। এবার মরার সময় হয়েছে।
‘তিন কুড়ি দশ’ বিড়বিড় করল বুহের, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হলঘরে দাঁড়ানো বাটলারের সাথে চোখাচোখি হলো তার। শ্রাগের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল দু’জনেই, যেন আর কারও কিছু বলার নেই। সিঁড়ির হাতল ধরে ওপরে উঠতে শুরু করল বুহের। চলে এল করিডরে, পা বাড়াল চ্যাপেলে। শীলার কথা ভাবছে। গেল কোথায় মহিলা?
দরজার কাছে পৌঁছার আগেই কুকুরটার গোঙানি শুনতে পেল বুহের। দরজা খোলা। তবে আলোটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে বলে ঘরের ভেতরটা ঠাহর করে নিতে সময় লাগল। দীর্ঘক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকল বুহের, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর যা দেখল, বিশ্বাস হতে চাইল না। চ্যাপেলের মেঝে মাখামাখি হয়ে গেছে ফ্রেডরিক আর্থারের রক্তে। ছেলেটা আর মহিলা থর্নের লাশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসা, বিড়বিড় করে কি সব বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।
ধীর ভঙ্গিতে আগ বাড়ল বুহের, বিস্ফারিত দৃষ্টি আর্থারের দিকে, অবিশ্বাস ফুটে আছে চোখে। ড্যাগারের বাঁট স্পর্শ করল সে, রক্ত লেগে গেল হাতে। হাতটা প্যান্টে মুছে আবার বাঁটটা ধরল। ড্যাগারটাকে টেনে বের করতে চাইছে বুহের, কিন্তু শক্তিতে কুলোচ্ছে না। শেষে আর্থারের বুকে পা রেখে হ্যাঁচকা টানে ছোরাটা বের করতে হলো।
এরপর অন্য ড্যাগারগুলো একত্র করে ছেলেটার দিকে তাকাল বুহের।
‘ও আমাকে হত্যা করতে এসেছিল, পল। কিন্তু নিজেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’
মাথা ঝাঁকাল বুহের, ড্যাগার বোঝাই হ্যাভারস্যাকটা কাঁধে ফেলল। ‘চিরদিনের জন্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি।’
কিন্তু ছেলেটা বুহেরের কথা শুনেছে বলে মনে হলো না।
আর্থারের দিকে তাকাল বুহের। কি নিষ্পাপ একটা মুখ, তবে সাহসী। ওরা ওকে পাগল বানানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তারপর ফাঁদ পেতেছে।
ড্যাগারগুলোয় একবার হাত বোলাল বুহের তারপর শীলার দিকে ফিরল। ওর কাঁধে টোকা দিল। ঘুরল শীলা। ওর ঠোঁট ভেজা ভেজা, ছায়াময় চোখ। বুহেরের মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা যখন টাকা দিয়ে বেশ্যা কিনতে হত তাকে। এভাবে মেয়েরা তাকাত তার দিকে। শীলার সারা শরীরে রক্ত। হাত বাড়িয়ে পোশাকটা তুলে নিল বুহের, শীলার বুক ঢাকল। শীলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, ফেলে দিল আচ্ছাদন। অভিমানে ঠোঁট ফোলানোর ভঙ্গি করল, তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল, চোখ টিপল। শীলার নগ্ন শরীর বুহেরকে মনে করিয়ে দিল সেই রাতের কথা যে রাতে মেয়েটা তার হাত চেপে ধরেছিল, পশুর চিহ্নের ছাপ পড়েছিল তার আঙুলে।
মনে পড়ে গেল দু’বছর আগের কথা। দু’বছর আগে শীলাকে দলে টানা হয়, অন্য অনেক মেয়ের মত, সেক্সের মাধ্যমে। আর্থার সেবার কি কাজে দেশের বাইরে, শীলাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল পেরিফোর্ডে। প্রথমে শীলা অনেক ওজর আপত্তি তুলেছে, প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু শেষতক প্রলোভনের কাছে হার মেনে যায় সে। বুহেরের শিষ্যরা তাকে বলেছে, গোপন কথাটা জানার পর শীলা সাংঘাতিক উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং পৈশাচিক ধর্মান্তকরণের সময়, রিপোর্ট এসেছিল, শীলার সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণে ওটা হয়ে ওঠে সবচে’ সফল একটা কাজ। শীলার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল বুহের। মানুষ আসলে খুব প্রেডিক্টা, সহজে যে কোন অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
বুহেরকে আলিঙ্গনের চেষ্টা করল শীলা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল ওকে। অশ্লীল কথা বলছে শীলা, কানে তুলল না বুহের।
শীলাকে অগ্রাহ্য করে কুকুরটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। শুয়ে আছে জানোয়ারটা, হাঁপাচ্ছে, বুজে আসছে চোখ। মৃত্যুর ছায়া চোখে।
মমি করা লাশটার পেছনে চলে এল বুহের। ইস্পাতের একটা ফ্রেমের গায়ে ঠেস দেয়া ওটা। ফ্রেমটার নাট-বল্টু খুলতে শুরু করল বুহের। ফ্রেমটা লাশটাকে নিতম্বের কাছে সাঁড়াশির মত ধরে আছে, ফলে সিধে হয়ে থাকতে পারছে ওটা।
‘পল?’ তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটা।
‘তার শেষ অনুরোধ,’ বলল বুহের। ‘আরমাগেড্ডনের সময়। শেষ উপহাস।’
কপালে ভাঁজ পড়ল ছেলেটার। ‘আমি জানতাম না তো…’
চূড়ান্ত মুহূর্তে সে তার শত্রুর জমিনে দাঁড়াতে চেয়েছিল তাকে (যীশু) বর্জন করতে।
ছেলেটা এখনও সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে বুহেরের দিকে।
ক্রুশটা নিয়ে আমার পিছু পিছু এসো।’ আদেশ করল বুহের। জবাবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল ছেলেটা।
শেষ বল্টুটা খুলে ফেলল বুহের, লাশটা পড়ে গেল। দ্রুত ওটাকে ধরে ফেলল বুহের। খুব ভারী নয় শরীর, কিন্তু বুহের তেমন শক্তি পাচ্ছে না ওটাকে টেনে নিয়ে যাবার জন্যে। দেয়ালে হোঁচট খেল। দৌড়ে এল শীলা, দু’জনে মিলে লাশটাকে টেনে নিয়ে চলল।
দোরগোড়ায় থেমে দাঁড়াল ওরা, বুহের পেছন ফিরে চাইল। ছেলেটা ক্রুশটাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে, ওজনের চাপে বাঁকা হয়ে গেছে। কুকুরটা বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল, অনুসরণ করল ওদের। খোঁড়াচ্ছে ওটা, ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে।
ধীর গতিতে করিডর ধরে এগোল দলটা, নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে, লাশের পা বাড়ি খেল সিঁড়িতে, ঝরে পড়ল পাউডারের মত মিহি চামড়া। বুহেরদের পেছনে, ক্রুশ কাঁধে সিঁড়ির হাতল ধরে নামছিল ছেলেটা, হঠাৎ পিছলে গেল ওটা। গুঙিয়ে উঠল সে যীশুর মুকুটের কাঁটা তার ঘাড় আর কাঁধে বিধে যেতে। গালি দিল সে যীশুকে, ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রুশটাকে দেখল, তারপর আবার নামতে লাগল। কাঁটার আঘাতে রক্ত বেরুচ্ছে তার ঘাড় আর কাঁধ থেকে, ক্ষীণ একটা ধারা ঢুকে গেল পিঠে, ভিজিয়ে দিল আলখেল্লা।