অনেক কষ্টে হাঁটু মুড়ে বসল আর্থার। ডান হাতটা অকেজো, অসাড় ভঙ্গিতে ঝুলছে শরীরের পাশে। আঙুল নাড়াতে চেষ্টা করল, সাড়া পেল না কোন। ঘাড় বেয়ে পিঠে নামছে রক্ত স্রোত, হঠাৎ খুব ঘুম পেল আর্থারের। ইচ্ছে করল চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে, ভুলে যায় সব কিছু।
ছেলেটা ঝুঁকে দেখল আর্থারকে, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। করিডরে কেউ এসেছে। আর্থার দেখল শীলা এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়। আধো আলো, আধো ছায়ায় মনে হলো ও নগ্ন।
শীলা এগোল আর্থারের দিকে। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠল আর্থার। অক্ষত হাতটা বাড়িয়ে দিল যাতে শীলা ওকে টেনে তুলতে পারে। কিন্তু আর্থারকে অগ্রাহ্য করে ছেলেটার দিকে ঘুরল শীলা। চোখ পিটপিট করল আর্থার, মাথা ঝাঁকাল। আবার সে হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছে। ডি কার্লোর কথা মনে পড়ে গেল: ‘কল্পনা শক্তির ওপরেও রয়েছে তার ক্ষমতা…’
ও নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন দেখছে, যেমন ক্রুশের ওপর শিশুকে দেখেছে, সেরকম। ওর স্ত্রী ওই জঘন্য প্রাণীটাকে কিছুতেই আদর করতে পারে না। সবই আসলে দৃষ্টিবিভ্রম।
চোখ বুজল আর্থার, গলার কাছে জমাট বাঁধল চিৎকার। চোখ মেলল ও, বিশ্বাস হলো না দেখে শীলা আস্তে আস্তে কুকুরটার কাঁধ থেকে ছুরিটা বের করে নিচ্ছে, বিশ্বাস করতে মন চাইল না দু’হাতে ছুরি ধরে তাকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, অবিশ্বাস্য লাগল তারপরও শীলা হাসিমুখে ছুরিটা ওর বুকেই বসাতে যাচ্ছে দেখে।
এটা হ্যালুসিনেশন ভেবে মাথা ঝাঁকাল আর্থার, সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে শেষ সময় হাতটা উঠে গেল শীলাকে বাধা দেয়ার জন্যে। তীব্র ব্যথার ঢেউটা যখন ওকে আঘাত করল তখনও ব্যাপারটা অস্বীকার করতে চাইল মন। চিৎ হয়ে পড়ে গেল আর্থার, হাঁ হয়ে গেল মুখ, গলার কাছে জমাট বাঁধা চিৎকারটা বেরিয়ে এল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ঘাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া ড্যাগারের বাঁটের দিকে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও বিশ্বাস হতে চাইল না জুগুলার ভেইন থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা লাল স্রোতটা ওরই শরীরের রক্ত। পৃথিবী আঁধার হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আর্থার দেখল ড্যাগারের বাঁটে, যীশুর মুখটা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেন ওরই যন্ত্রণা ধারণ করে।
.
খিঁচুনি খেতে থাকা শরীরটার পাশ থেকে সরে গেল শীলা, তাকাল নিজের রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া পোশাকের দিকে। মরে গেছে আর্থার, তারপরও ধমনী দিয়ে গল গল ধারায় রক্ত পড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে চ্যাপেলে, রক্ত রঞ্জিত করে তুলছে ভাঙা যীশু মূর্তিকে।
হাত বাড়িয়ে শীলাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ছেলেটা, তারপর মমি করা লাশের সামনে নিয়ে গেল।
‘হাঁটু গেড়ে বসো, নির্দেশ দিল সে। আদেশ পালন করল শীলা। মুখ তুলে দেখল লাশের চোখে মোমের আলো পড়েছে, যেন হাসছে ডেমিয়েন ওর দিকে তাকিয়ে। যেন জ্যান্ত সে, আশীর্বাদ করছে শীলাকে তার কাজে খুশি হয়ে।
‘তার শক্তি আমার ভেতর,’ শীলার মনের কথা যেন পড়ে ফেলল ছেলেটা। ‘এবার সময় এসেছে ধ্বংসের।’
‘আমেন,’ ফিসফিস করল শীলা 1
ঘুরল ও, কুকুরটা অনেক কষ্টে উঠে বসেছে, জিভ দিয়ে চাটছে আহত কাঁধ। টেনে টেনে এগোল জানোয়ারটা শীলার কাছে। ডানে আর বামে একবার চোখ বুলাল, তারপর লাশের হাত চেটে দিল। রক্ত লেগে গেল আঙুলে।
ছেলেটা শীলাকে টেনে তুলল। তার শক্তি অনুভব করো,’ বলল সে।
লাশটাকে জড়িয়ে ধরল শীলা। হঠাৎ একটা শব্দ হতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ছেলেটা ভাঙা ক্রুশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যীশুর দিকে।
‘তারপর নাজারিন,’ মুখ বাঁকাল ছেলেটা, ‘তোমার শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটল। তুমি, যে মানবতার কথা বলতে, সেই তুমি এখন কোথায়?’
শীলার দিকে আঙুল তুলল সে।
‘দেখো,’ বলল ছেলেটা। ‘একে দেখো। স্বামীর রক্তে রঞ্জিত সে, আমার বাবার প্রতি কামার্ত সে। তার স্বামী আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই নারী তার স্বামীকে ধ্বংস করেছে। তোমার এই পরাজয়ের লজ্জা কোথায় রাখবে, নাজারিন?’
যীশুর মাথার মুকুটের কাঁটাগুলো খামচে ধরল সে দু’হাতে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখের দিকে।
‘পৃথিবী এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় অস্থির। ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও ফলে যাবার পথে। সবকিছুর অবসান ঘটবে শীঘ্রি।’
সিধে হলো ছেলেটা, হাসল। চ্যাপেলে শুধু শোনা গেল শীলার মৃদু বিড়বিড়ানি আর কুকুরটার গোঙানি। এছাড়া গোটা চ্যাপেল নীরব, নিস্তব্ধ।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৯
উনিশ
পল বুহের গ্লাসটা শেষ করে আকাশের দিকে তাকাল। কল্পনায় দেখল পুবাকাশে লাল একটা আলো ফুটে উঠেছে। অবশ্য ওকে আর কল্পনা করতে হবে না। দৃশ্যপট লেখা হয়ে রয়েছে অনেক আগে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক দৃশ্যে সঠিক অভিনেতার অভিনয়। মানব সভ্যতা বেছে নিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ।
ড্রইংরুমে ঢুকল বুহের। আগুন নিভে গেছে। রেডিওর সুইচ অন করে আরেকটা ড্রিঙ্ক ঢালল সে।
…সমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে যে, জেরুজালেম, তেল আবিব এবং বৈরুতে পারমাণবিক হামলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আকাশ পথে শহর ত্যাগ করেছেন এ খবর ওয়াশিংটন থেকে হোয়াইট হাউজ এবং পেন্টাগন অস্বীকার করেছে। আমাদের মস্কো প্রতিনিধি কোন রিপোর্ট পাঠাতে পারছেন না, কার্যত ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রি একটি বিবৃতি দেবেন। জানা গেছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ন্যাটোভুক্ত সমস্ত দেশের রাষ্ট্রদূতগণ দশ নম্বর ডাইনিং স্ট্রীটে উপস্থিত হতে চলেছেন…