সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, মুখ তুলে চাইতে কুকুরটাকে দেখতে পেল আর্থার। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঘুরে দাঁড়াল ওটা, করিডর ধরে নিঃশব্দে হাঁটা দিল, যেন পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে আর্থারকে। দ্রুত ওপরে উঠে এল আর্থার, অনুসরণ করল জানোয়ারটাকে। ওর মন জুড়ে এখন ছেলেটার ভাবনা। তাকে যেমন করে হোক খুঁজে পেতে হবে।
করিডর অন্ধকার। শেষ মাথায় কালো একটা দরজা, ভেজানো। দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল কুকুরটা, আর্থারকে যাবার পথ করে দিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা, সামনের দৃশ্যটা দেখেই বুঝতে পারল তাকে এতদিন যা বলা হয়েছে তার মধ্যে অতিরঞ্জন নেই একরত্তি, সব সত্যি।
কালো একটা আলখেল্লা পরনে ছেলেটার, ঝুঁকে আছে লাশের পাশে, নিঃশব্দে ঠোঁট নড়ছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। দু’কদম বাড়ল আর্থার, ঠং শব্দ তুলল হ্যাভারস্যাকের ড্যাগার। তবে শব্দ শুনেও ঘুরল না ছেলেটা। যেন তাকে সম্মোহন করা হয়েছে।
যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে নিঃশব্দে এগোল আর্থার, শিরদাঁড়ায় বেঁধা ড্যাগারটা দেখল। সব খাপে খাপ মিলে গেছে। খামোকাই ফাদারকে এতদিন সন্দেহ করেছে সে। যীশুর চোখের দিকে চাইল সে, তারপর নজর ফেরাল লাশটার দিকে। ওর মেরুদণ্ডে শীতল একটা স্রোত নেমে এল।
চোখ বুজে প্রার্থনা করল আর্থার। যীশুর সাহায্য চাইছে। চোখ খুলল। এখন ও জানে ওকে কি করতে হবে। তবে সেই শক্তি ওর মাঝে আছে কিনা ভেবে সন্দেহ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে কেটে পড়ে, শীলার হাত ধরে, গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু যীশুর যন্ত্রণাকাতর চেহারার দিকে চোখ যেতে সে ইচ্ছেটা মরে গেল। কি জীবন্ত একটা মুখ!
যীশুর মূর্তির পেছনে চলে এল আর্থার, পিঠ থেকে টান মেরে ছুরি খুলল। মোমবাতির আলোয় ঝিলিক দিল ধারাল ফলা। যীশুর মুখ, মাথার কাঁটার মুকুট ইত্যাদি ছুঁলো ও। তারপর হ্যাভারস্যাকটা মেঝেতে নামিয়ে ছ’টা ড্যাগার বের করল।
ছেলেটা লাশের পায়ের কাছে এখনও হাঁটু গেড়ে বসে আছে, ক্রুশ থেকে ছুটিয়ে আনা ড্যাগারের বাঁটটা চেপে ধরল আর্থার দুই হাতে। তাকাল ছেলেটার দিকে। সুঠামদেহী ছেলেটার পাতলা আলখেল্লা ফুটে বেরিয়ে আছে পিঠের হাড়। পিঠে ছুরি বসিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু এভাবে চোরের মত পিঠে ছুরি বসানো আর্থারের পক্ষে সম্ভব নয়।
‘ক্ষমা করো, বিড়বিড় করল সে, হাত বাড়িয়ে ছেলেটার কাঁধ ধরে চাপ দিল যাতে সে আর্থারের দিকে ঘুরে বসে।
ঘুরল ছেলেটা, আর্থারের দিকে চাইল মুখ তুলে। মুখটা সাদা, চোখ দুটো হলুদ। জ্বলজ্বল করছে। হাসল সে।
আবার ড্যাগার তুলে নিল আর্থার, জোর করে তাকিয়ে রইল হলুদ চোখ জোড়ার দিকে, গভীর দম নিল। এবার…
খুলে গেল দরজা। আলোর একটা ঝলক ঢুকল ঘরে। সাথে সাথে আক্রান্ত হলো আর্থার। বোটকা একটা গন্ধ নাকে বাড়ি মারল, সেই সাথে প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মেঝেতে, হাত থেকে ছুটে গেল ড্যাগার। দেখল ওর টুটি কামড়ে ধরতে যাচ্ছে কুকুরটা।
প্রকাণ্ড মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরল আর্থার, বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে দিল চোখে, কনুই দিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে, তারপর কাত হয়ে জানোয়ারটার নিচের চোয়াল ধরে ফেলল এক হাতে।
মাথা ঝাঁকাল কুকুরটা, কামড় বসাল আর্থারের হাতে। আর্তনাদ করে উঠল আর্থার যন্ত্রণায়, পশুটা ওকে যেন মেঝের সাথে গেঁথে ফেলেছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে কুকুরটা, লালা পড়ছে মুখ বেয়ে, আর্থারের হাঁ করা মুখে ঢুকে গেল। শ্বাস বন্ধ হয়ে এল আর্থারের, থুথু ছিটাল হলুদ চোখে। এক মুহূর্তের জন্যে ওটার শক্ত আলিঙ্গন শিথিল হলো। ওই এক সেকেন্ডেই গড়ান মেরে খালি হাতটা দিয়ে ড্যাগারটা মুঠো করে ধরে ফেলল আর্থার। এদিকে কুকুরটা আবার ওর হাত কামড়ে ধরেছে, মেঝের সাথে ঠেসে ধরছে। হঠাৎ ওটা হাত ছেড়ে কামড়ে ধরল কাঁধ, ডানে-বামে ঝাঁকি খেল মাথা, খরগোশের মত আর্থারের ঘাড় মটকে দিতে চাইছে। ব্যথায় আবার চিৎকার দিল আর্থার, টের পেল কাঁধের কাছটায় ছিঁড়ে গেছে মাংস, হাতটা অবশ হয়ে পড়েছে। মোচড় খেল আর্থার, ছুরি ধরা হাতটা দিয়ে কোপ মারল। গায়ে লাগল না কুকুরটার, বাতাস কাটল শুধু।
আবার ড্যাগার চালাল আর্থার, এবার কুকুরটার গায়ে কোথাও লাগল ওটা, পশম ভেদ করে ফলা ঢুকে গেল মাংসে। ‘ঘাউ!’ করে উঠে ছেড়ে দিল আর্থারকে। হাঁটু ভাঁজ করে চিবুকের কাছে এনে গড়ান দিল ও, ক্রুশের পায়ের কাছে ধাক্কা খেল। জানোয়ারটার চাপ থেকে মুক্ত হয়ে মাত্র ও মুখ তুলেছে, দেখল ওটা লাফিয়ে পড়ছে ওর গলা লক্ষ্য করে। এবার রক্ত মাখা লালা পড়ল আর্থারের মুখে।
এক মুহূর্তের জন্যে আহত প্রাণীটার জন্যে মায়া লাগল আর্থারের, ইচ্ছে করল আদর করে। তা না করে গলায় বসিয়ে দিল ছুরি। এত জোরে ছুরি বসিয়েছে, মুঠো থেকে ছুটে গেল ওটা। পর মুহূর্তে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল আলো কুকুরটা ওর গায়ে এলিয়ে পড়তে। দড়াম করে শব্দ হলো পেছনে, পড়ে গেছে ক্রুশ। গোঙাচ্ছে কুকুরটা, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে আর্থারের মুখ।
লাথি মেরে জানোয়ারটাকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিল আর্থার, গড়ান দিয়ে সরে গেল একপাশে। যীশু পড়ে আছেন মেঝেতে, স্থির চেয়ে আছেন আর্থারের দিকে। পতনের কারণে শিরদাড়ায় চিড় ধরেছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে আর্থার, ছেলেটা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। হাসছে। কুকুরটাকে আবার আসতে দেখে লাথি মারল আর্থার। মুখে ড্যাগার বেঁধাতে পারেনি ও। কাঁধে বিধে আছে দেখে আফসোস হলো আর্থারের। ধীরে ধীরে শরীরটাকে টেনে তুলল আর্থার, ক্রুশের গায়ে হেলান দিল। তাকাল ছেলেটার দিকে। ছেলেটাকে হাসতে দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে ও। ওকে এখানে কেন আনা হয়েছে, কেন বুহের দাওয়াত দিয়েছে সব এখন পরিষ্কার আর্থারের কাছে। ওকে ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছে। শেষ বোঝাপড়া করতে চেয়েছে ওরা। ড্যাগারগুলো চেয়েছে ওরা যাতে শয়তান-পুত্র চিরতরে বিপদ মুক্ত হতে পারে।