পাঁচ ‘কোর্সের ডিনার। গল্প-গুজবে জমে উঠল বেশ। গল্প আসলে বলছে শীলা, ওরা শ্রোতা মাত্র। আকাশে মেঘ জমেছে, ঘরে আঁধার যেন ঘনিয়ে এসেছে আরও। মোমবাতির আলোয় সত্যি জ্বলছে শীলা। ও খানিকটা প্রগলভ হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মদ পানের ফল।
পাঁচ নম্বর কোর্স পরিবেশন করা হলো ভিলের সাথে। খিদে নেই তবু জোর করে গিলছে আর্থার। ওদের গল্পে মন দিতে পারছে না। কেটে পড়ার কথা ভাবছে। বাড়িটা ঘুরে দেখা দরকার। ছেলেটার খোঁজ পাওয়া দরকার। টেবিল ছাড়ার মওকা করে দিল মোবাইল ফোন। বেজে উঠল হঠাৎ।
‘এক্সকিউজ মি,’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আর্থার।
‘ড্রইংরুমে বসে কথা বলতে পারো,’ বলল বুহের।
ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল আর্থার, দরজা বন্ধ করার সময় চাইল একবার পেছন ফিরে। বুহের এবং শীলার গল্প থেমে গেছে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে নীরবে।
এ ফোনটার অপেক্ষায় ছিল আর্থার। বার দুই হুঁ হাঁ করল ও, তারপর অফ করে দিল মোবাইল। তাকাল আয়নার দিকে। ভালই লাগছে দেখতে। বিষণ্ণ লাগছে না। বুকও ধড়ফড় করছে না। পালস স্বাভাবিক। জানালা দিয়ে আকাশ দেখল। তারপর দৃঢ় পায়ে ফিরে এল ডাইনিং রুমে।
বুহের এবং শীলা আগের মতই চুপচাপ বসে আছে। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল আর্থার, হাত রাখল স্ত্রীর কাঁধে
‘ঘটনা শুরু হয়ে গেছে,’ বলল সে। ‘তেল আবিব এবং জেরুজালেমে বোমা পড়েছে।’
মুখ তুলে চাইল ওরা, কিছু বলল না।
‘স্যাটেলাইটে দৃশ্যটা ধরা পড়েছে,’ বলল আর্থার। ‘নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। বৈরুত থেকে কোন প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যাবে। ইসরায়েলে হামলা হবার মানে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ শুরু।’
‘চোখের বদলে চোখ,’ বলল শীলা। তার দিকে তাকাল আর্থার। এক কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপ খসে পড়েছে, বুক প্রায় উন্মুক্ত। তবে সেদিকে খেয়াল নেই শীলার। মোমের আলোয় চকচক করছে চোখ। মাতাল হয়ে গেল নাকি, ভাবল আর্থার।
অন্যদিকে মনোনিবেশের চেষ্টা করল আর্থার। মধ্যপ্রাচ্য এখন উত্তপ্ত তাওয়া, মিসাইল হামলা হয়তো শুরু হয়ে যাবে শীঘ্রি। কি ঘটবে বুঝতে পারছে আর্থার। এর জন্যে প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি শুরু হয়ে যাবার পর মনে হচ্ছে এত চাপ সে সহ্য করতে পারবে না।
উঠে দাঁড়াল বুহের, ধাক্কা লেগে একটা মদের গ্লাস পড়ে গেল মেঝেতে। রক্তের মত ছড়িয়ে পড়ছে তরল পদার্থটা, ওদিকে ফিরেও চাইল না সে।
‘যারা জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে,’ একঘেয়ে সুরে বলল সে। ‘তাদের মাংস পচে গলে খসে পড়বে।’
চেয়ার সরিয়ে সিধে হলো শীলাও, দাঁড়াল বুহেরের পাশে। তার দিকে স্থির তাকিয়ে বলল, ‘তাদের চক্ষু পচে যাবে কোটরের মধ্যে। তাদের জিভ পচবে মুখের ভেতর।’
আর্থার নাম ধরে ডাকল শীলার, হাত বাড়াল। ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল শীলা।
‘ইসরায়েল প্রচণ্ড নাড়া খাবে,’ বলল বুহের। ‘একই ঘটনা ঘটবে সমুদ্রের মাছ, স্বর্গের পাখি, মাঠের পশু এবং পৃথিবীর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে চলা সমস্ত প্রাণীর ‘ভাগ্যে…’ বলে চলল শীলা
‘… এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষ,’ আগের গলায় বলল বুহের। ‘আমার উপস্থিতিতে ধাক্কা খাবে, ভেঙে পড়বে পাহাড়, এবং সমস্ত দেয়াল।’
‘শীলা!’ চেঁচিয়ে উঠল আর্থার। ওকে ধরতে গিয়ে প্রচণ্ড ছ্যাঁকা খেল হাতে। প্রচণ্ড গরম শীলার শরীর, যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আর্থার বুঝতে পারছে ওরা বাইবেল থেকে ‘কোট’ করছে। ওরা বলে চলল:-
‘প্রতিটি মানুষের তরবারি ঝলসে উঠবে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে,’ একযোগে চেঁচাল দু’জনে। ‘আমি মহামারী এবং রক্ত ছড়িয়ে দেব তার বিরুদ্ধে, আমি তার ওপর বর্ষণ করব বৃষ্টি, তার শিষ্য এবং লোকদের ওপর প্রবল বৃষ্টি ঝরাব এবং ছুঁড়ে মারব শিলাখণ্ড, আগুন ও গন্ধক।’
তীক্ষ্ণ গলায় হেসে উঠল শীলা, ওর কাছ থেকে সরে গেল আর্থার। দরজার দিকে পা বাড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতে দেখল ওরা পরস্পরের হাত ধরে আছে, শীলার কথাটা মনে পড়ে গেল আর্থারের: ‘তুমি আমাকে বেশ্যা সাজতে বলছ?’
‘এবং যখন দেখবে জেরুজালেম ভরে গেছে সৈন্যতে, জানবে ধ্বংস সমাগত,’ বলল বুহের।
তরুণ সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে গেল আর্থারের। মনে হলো অনেক আগের ঘটনা ওটা, অন্য সময়ের, যখন সামান্য আশা তখনও প্রজ্জ্বলিত ছিল।
‘এ হবে প্রতিশোধের দিন,’ বলল শীলা, ‘যে সব ঘটনার কথা লেখা আছে তা সব ঘটবে।’
হলওয়ের দিকে যাচ্ছে আর্থার, ওদের গলা পরিষ্কার শুনতে পেল।
‘অ-ইহুদিদের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে জেরুজালেম, যত দিন না পর্যন্ত অ- ইহুদিদের শাসনকাল পূর্ণ হয়…’
দরজায় হোঁচট খেল আর্থার, কি করছে বুঝতে পারছে না। শুধু জানে এখান থেকে চলে যাবার আগে ড্যাগারসহ ছেলেটাকে খুঁজে পেতে হবে।
গাড়ির দরজা খুলল ও, হ্যাভারস্যাকটা বের করে কাঁধে ঝোলাল। পিঠে ড্যাগারের ছুঁচাল ডগার খোঁচা খেয়ে ‘আউ!’ করে উঠল।
বুড়ো সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে গেল আর্থারের: ‘জাগ্রত যীশু আপনাকে সাহায্য করবেন।’ কথাগুলো মনে মনে আওড়াল ও। ব্যাপারটা এখন তাঁর ওপর নির্ভর করছে। এটা তাঁর কর্তব্য। আর্থারের দায়িত্ব ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া। তারপর ডি কার্লোর ঈশ্বরের হাতে সব ছেড়ে দেবে সে। তিনি যা করার করবেন।